নেইমার।
এই একটি নাম শুনলেই বার্সেলোনা সমর্থকেরা একই সঙ্গে হতাশা, আক্ষেপ আর ক্ষোভের যে বহিঃপ্রকাশ দেখান, তা অনন্য। যাকে ভাবা হচ্ছিলো লিওনেল মেসির যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে, সেই নেইমার যখন ২৫ বছর বয়সে, নিজের সেরা সময়ে ক্লাব ছেড়ে চলে যান, তখন আক্ষেপ আর হতাশা তো বটেই, তার প্রতি সমর্থকদের ক্ষোভের কারণটাও খুব অযৌক্তিক নয়।
শুরু
নেইমারের জন্ম ১৯৯২ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি, ব্রাজিলের সাও পাওলোতে। অধিকাংশ ব্রাজিলিয়ানের মতোই জন্ম থেকেই বলের সাথে তার সখ্যতা। পৃথিবীর অন্য সবকিছুর চেয়ে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু ওই গোলাকার চামড়ার বলটি। নেইমার যে এখন মাঠে প্রচুর স্কিল দেখান, তার কারণ তিনি খেলা শিখেছেন ব্রাজিলের রাস্তায়, ফুটসাল খেলে। কিছুদিন পর্তুগিজ সানতিস্তায় খেলার পর ২০০৩ সালে তিনি যোগ দেন সান্তোসে, যেখানে খেলে ইতিহাস রচনা করে গেছেন ব্রাজিলের ‘কালো মানিক’ পেলে।
সান্তোস যে হীরা চিনতে ভুল করেননি, সেই ব্যাপারটি নেইমার পরিষ্কার করতে থাকেন দিনের পর দিন দুর্দান্ত খেলে। আর এই দুর্দান্ত খেলার পুরস্কার হিসেবে মাত্র সতেরো বছর বয়সেই তার সাথে পেশাদার চুক্তি করে সান্তোস, নেইমার নিয়মিত খেলতে থাকেন সান্তোসের মূল দলে। দিনের পর দিন নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে থাকেন নেইমার।
তবে এত কিছুর পরও জায়গা পাননি ২০১০ সালের বিশ্বকাপ দলে। তুমুল সমালোচনার পরও নিজের সিদ্ধান্ত থেকে টলানো যায়নি তখনকার ব্রাজিল কোচ কার্লোস দুঙ্গাকে, তার মাশুল অবশ্য ব্রাজিলের কোচ দিয়েছিলেন বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়ার পর বরখাস্ত হয়ে। বিশ্বকাপের পরই যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সেলেকাওদের হয়ে অভিষেক হয় নেইমারের, ম্যাচটিতে ব্রাজিল জয় পায় ২-১ ব্যবধানে।
সান্তোস যখন শেষবার কোপা লিবার্তোদোরেস জেতে, নেইমারের তখন জন্ম হয়নি। পেলে তখন সান্তোসের জার্সি পরে মাঠ মাতাতেন, সালটা ছিল ১৯৬৩। এরপর প্রায় পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে, সান্তোসে আসেনি ল্যাতিন আমেরিকার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এই ট্রফি। নেইমার যেন ধনুর্ভাঙা পণ করলেন, ট্রফিটা এবার নিয়েই আসবেন। ২০১১ সালের ফাইনালে ওঠালেন, প্রতিপক্ষ উরুগুইয়ান ক্লাব পেনারল। পেনারলের মাঠে প্রথম লেগ গোলশুন্য ড্র হিসেবে শেষ হলো। সান্তোসের মাঠে আর নেইমার থেমে থাকলেন না, গোলের খাতা খুললেন নিজেই। শেষ পর্যন্ত ২-১ গোলে জয়ী সান্তোস, পেলের সান্তোসের পর পুরো লাতিন আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন এবার নেইমারের সান্তোস, মাঝখানে পার হয়ে গেছে ৪৮ বছর!
সেবছর অনুষ্ঠিত ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনালে সান্তোস মুখোমুখি হয় বার্সেলোনার, নেইমার মুখোমুখি হন লিওনেল মেসির। মেসির জোড়া গোলের সুবাদে ফাইনালে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত হয় নেইমারের সান্তোস, তবে নেইমার জেতেন টুর্নামেন্টের ব্রোঞ্জ বল। এবং সেই ফাইনালেই তিনি মেসিকে বলেন, তিনি বার্সেলোনায় খেলতে চান, তার সাথে খেলতে চান। এবং এরপরই শুরু হয় বিশ্ববিখ্যাত সেই ট্রান্সফার সাগা, যেখানে কালি লেগেছিলো বার্সেলোনার গায়ে।
বার্সেলোনায় আগমন
২০১১ সালেই শুরু হয় নেইমারকে নিয়ে বার্সেলোনা, চেলসি এবং রিয়াল মাদ্রিদের টানাহেঁচড়া। আব্রামোভিচ, পেরেজ কিংবা স্যান্দ্রো রোসেল, কেউই ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না। আর এজন্য স্যান্দ্রো রোসেল এতদূর পর্যন্ত গিয়েছিলেন, যেখানে বার্সেলোনা আগে কখনো যায়নি, ভবিষ্যতে যাওয়ার সম্ভাবনাও কম।
২০১১ সালে চেলসি ও রিয়াল মাদ্রিদ বারবার সান্তোসের সাথে যোগাযোগ করলেও তারা রাজি ছিল না তাদের সেরা খেলোয়াড়কে বিক্রি করতে, কারণ নেইমারের সাথে তাদের চুক্তি ছিলো ২০১৪ বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত। রিয়াল মাদ্রিদ এবং চেলসি নেইমারকে লোভনীয় প্রস্তাব দিলেও নেইমারের মন পড়ে ছিলো বার্সেলোনায়। রোসেল সেটারই সুযোগ নেন। তবে নেইমারের বাবা আগে থেকেই দাম ঠিক করে রেখেছিলেন, নেইমারকে দলে ভেড়াতে হলে নেইমারকে দিতে হবে ৪০ মিলিয়ন ইউরো; প্রাথমিকভাবে দশ মিলিয়ন এবং পরবর্তীতে বাকি ৩০ মিলিয়ন। বার্সেলোনা রাজি হয়, তারা সেই দশ মিলিয়ন দেয় নেইমারকে, এবং নেইমারের নাম উল্লেখ ছাড়াই সেটি তাদের ব্যবসায়িক খরচের হিসাবে নথিবদ্ধ করে। প্রাথমিকভাবে ২০১৪ বিশ্বকাপের পর নেইমারের বার্সেলোনায় যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের একগুঁয়েমিতে বেশ ভয় পেয়ে যায় বার্সেলোনা বোর্ড। সান্তোসের সাথে ১৭.১ মিলিয়নের চুক্তি করে ২০১৩ এর গ্রীষ্মেই তাকে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। তবে ঝামেলা বাধালেন জর্দি ক্যাসেস, বার্সেলোনার একজন সদস্য।
স্যান্দ্রো রোসেল মাত্রই কাতার এয়ারওয়েজের সাথে চুক্তি করেছেন, বার্সেলোনার জার্সির বুকে আর ‘ইউনিসেফ’ লেখা থাকবে না, থাকবে ‘কাতার এয়ারওয়েজ’। ক্যাসেসের সেটি পছন্দ হয়নি, তার মতে ক্লাবের ‘মোর দ্যান আ ক্লাব’ আদর্শের পরিপন্থী এই চুক্তি। ক্যাসেস এই চুক্তি বাতিলের জন্য যথেষ্ট ভোট যোগাড় করতে পারেননি বটে, কিন্তু ঠিক তখনই তার চোখে পড়ে সেই ৪০ মিলিয়ন চুক্তির ১০ মিলিয়ন ডাউন পেমেন্ট, যেখানে নেইমারের নাম ছিল না। ক্যাসেস বোর্ডের কাছে জানতে চাইলে তারা তাকে অবজ্ঞা করে। ক্যাসেস স্পেনের কোর্টে এই মর্মে অভিযোগ দায়ের করেন, স্যান্দ্রো রোসেল ক্লাবের অর্থ অসৎ উপায়ে ব্যয় করছিলেন। তিনি বলেন, তিনি প্রেসিডেন্টের বিপক্ষে দুর্নীতির অভিযোগ আনছেন না, তিনি শুধু জানতে চান বোর্ডের সদস্যদের পক্ষ থেকে ক্লাব কীভাবে টাকা খরচ করছে। রোসেল এই অভিযোগকে ‘উদ্ধত’ বলে আখ্যায়িত করেন, এবং তার সেক্রেটারি টনি ফ্রেইক্সা ক্যাসেসকে এক চিঠিতে জানান, নেইমারের চুক্তির কোনো বিষয় সাধারণের সামনে আসলে ক্যাসেসের অবর্ণনীয় ক্ষতি হবে। ক্যাসেস মাথা নত করেননি, এবং ডিসেম্বরে স্প্যানিশ কোর্ট তদন্ত করতে রাজি হয়। অপরাধ অস্বীকার করেও পদত্যাগ করেন রোসেল, বলেন ক্লাবকে বিপর্যয় থেকে বাঁচাতেই তার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত।
নেইমারের পরিবার থেকে অনুমতি পাওয়ার পর প্রেস কনফারেন্স ডাকেন অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট জোসেপ মারিয়া বার্তোমিউ, সেখানে তিনি নেইমারের দলবদলের পুরো হিসাব দেন, সান্তোসের ১৭.১ মিলিয়ন ও নেইমারের ৪০ মিলিয়ন ইউরো। নেইমারের ১০ মিলিয়ন ইউরোরও বেশি বেতনের পাশাপাশি তাকে বার্ষিক আধা মিলিয়ন ইউরো দেওয়া হবে বার্সেলোনার ব্রাজিল অ্যাম্বাসেডর হওয়ার জন্য, আর তার বাবা পাবেন ০.৪ মিলিয়ন ইউরো, তিনজন তরুণ সান্তোস খেলোয়াড়কে স্কাউট করার জন্য। স্প্যানিশ পাবলিক প্রসিকিউটর জোসে পেরালস অভি্যোগ করেন, এই চুক্তিতে কর ফাঁকি দিয়েছে বার্সেলোনা। এর মাশুল দিতে পাঁচ দিন পর বার্সেলোনাকে জরিমানা হিসেবে দিতে হয় ১৪ মিলিয়ন ইউরো।
তবে রোসেলের জন্য ঝামেলার শেষ এখানেই ছিলো না, তাকে স্প্যানিশ কোর্ট ‘সরকারি কোষাগারের বিপক্ষে অপরাধ’ এবং ‘অসাধু ম্যানেজমেন্ট’ এর জন্য বিচারে দাঁড় করায়। ক্যাসেস জল এতদূর গড়াবে কখনোই ভাবেননি, তিনি তার অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু ততক্ষণে রোসেলের যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গিয়েছে। বিচারে রোসেলকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যদিও পরে অন্য আরেকটি কোর্ট তার এই সাজা খারিজ করে দেয়।
এভাবেই নেইমার যোগ দেন বার্সেলোনায়, বার্সেলোনার ‘মোর দ্যান আ ক্লাব’ আদর্শবাণীর গায়ে কালি লাগিয়ে, এবং কালি লাগানো সেই রোসেলের কারাগারযাপনের মধ্য দিয়ে। ২০১৬ সালে অবশ্য বার্সেলোনা প্রেসিডেন্ট বার্তোমিউ জানান, নেইমারকে দলে ভেড়াতে খরচ হয়েছিলো ১০০ মিলিয়ন ইউরোরও উপরে।
সোনালী সময়
২০১৩ সালে যখন বার্সেলোনায় যোগ দেন নেইমার, মাত্রই ব্রাজিলকে জিতিয়ে এসেছেন কনফেডারেশনস কাপ, হয়েছেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়। বার্সেলোনায় শুরুটাও বেশ ভালোই ছিলো, নিজের প্রথম ক্লাসিকোতেই তুলে নেন গোল। তবে ২০১৩-১৪ মৌসুমটা জঘন্য যায় বার্সেলোনার, কোনো শিরোপাই ঘরে তুলতে পারেনি তারা। তবে বিশ্বকাপে গিয়ে ঘরের মাঠে ঠিকই আলো ছড়াচ্ছিলেন নেইমার, দলকে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত তোলার পথে করেছিলেন ৪ গোল। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়ার জুনিগার এক ভয়ংকর ফাউল; বিশ্বকাপ শেষ নেইমারের, ব্রাজিলেরও। পরের ম্যাচে জার্মানির বিপক্ষে ব্রাজিল ডুবলো ৭-১ গোলের লজ্জায়, সাইডলাইনে বসে থাকা ছাড়া কিছুই করার ছিল না ব্রাজিলের দশ নম্বরের।
বার্সেলোনায় ফিরলেন, নতুন কোচ লুইস এনরিকের অধীনে বছরটা ঠিক ‘দারুণ’ যাচ্ছিলো না। ২০১৫ এর শুরুতেই ম্যাচ হারলো বার্সেলোনা, যেখানে বেঞ্চে ছিলেন মেসি ও নেইমার দু’জনেই। মেসি আর এনরিকের কলহের গুঞ্জন পাওয়া যাচ্ছিলো, কিন্তু এরপর যা হলো, তা অবিশ্বাস্য। মেসি, সুয়ারেজ আর নেইমার মিলে গড়ে তুললেন ‘এমএসএন’, পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর আক্রমণত্রয়ী বলা হয় যাদের। সামনে যে প্রতিপক্ষ আসছিলো তাকেই গুড়িয়ে দিচ্ছিলো বার্সেলোনা, শেষ পর্যন্ত তারা জিতে নেয় ট্রেবল, সব মিলিয়ে মৌসুমে শিরোপা জেতে পাঁচটি।
২০১৫ কোপা আমেরিকায় বাদ পড়লেন কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই, চ্যাম্পিয়নস লিগেও তাই। তবে বার্সেলোনা জিতে নিলো লিগ ও কাপ, ঘরোয়া ডাবল জিতেই খুশি থাকতে হলো নেইমার ও কাতালান ক্লাবটিকে। ২০১৬ সালে একই সাথে ছিলো কোপা আমেরিকা ও অলিম্পিক, বার্সেলোনার শর্ত ছিলো যেকোন একটি খেলতে পারবেন নেইমার। কখনোই ফুটবলে অলিম্পিক স্বর্ণ না জেতা ব্রাজিলের জন্য বেছে নেওয়ার ব্যাপারটি মোটেও কঠিন ছিলো না, কোপা খেলছেন না নেইমার। নেইমারবিহীন ব্রাজিল কোপায় বাদ পড়লো গ্রুপ পর্ব থেকেই, অলিম্পিকেও নিজের জাত চেনাতে পারছিলেন না নেইমার। ঘরের মাঠ রিও অলিম্পিকে এরকম সাধারণ মানের পারফরম্যান্সে ক্ষেপে গেল ব্রাজিলের জনগণ, ব্রাজিলের দশ নম্বর জার্সিতে নেইমারের নাম কেটে লেখা হলো মার্তার নাম, নেইমার তখন সমালোচনায় বিদ্ধ এক দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া খেলোয়াড়।
তবে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই নায়কেরা ফিরে আসেন, নেইমারও আসলেন। কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রি-কিক থেকে করলেন টুর্নামেন্টে নিজের প্রথম গোল, হন্ডুরাসের সাথে সেমিফাইনালে ৬-০ গোলের জয়ে করলেন জোড়া গোল। জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালের প্রথম গোলটাও করলেন তিনি ফ্রি-কিক থেকে; তবে জার্মানি সমতায় ফিরলো, খেলা গড়ালো টাইব্রেকারে। ৪-৪ সমতায় থাকা অবস্থায় পেনাল্টি নিতে এলেন নেইমার, তার স্বভাবসুলভ ‘স্টপ অ্যান্ড স্টার্ট’ রানআপ নিলেন…
এবং গোল করলেন। গোল করে দু’কদম এগিয়েই কান্নায় ভেঙে পড়লেন, সাথে কান্নায় ভেঙে পড়লো গোটা ব্রাজিল। সোনার ছেলের হাত ধরে প্রথমবারের মতো ঘরে এসেছে ফুটবলের অলিম্পিক স্বর্ণ। সেই ছেলের হাত ধরে, ক’দিন আগে যার মুণ্ডুপাত করতে দু’বার ভাবছিলো না কেউ। সেই নেইমার, যার নাম কেটে জার্সিতে লেখা হচ্ছিলো মার্তার নাম। সেই নেইমার, যাকে দলে রাখার জন্য করা হচ্ছিলো সমালোচনা।
ক্লাবে ফিরলেন। জিদানের মাদ্রিদের সাথে লিগে কোনোভাবেই পেরে উঠছিলো না বার্সেলোনা। চ্যাম্পিয়নস লিগে অবশ্য সহজেই দ্বিতীয় পর্বে উঠে গেলো বার্সেলোনা। দ্বিতীয় পর্বে বার্সেলোনার খেলা ছিলো ফরাসি ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেইর সঙ্গে, ১৪ ফেব্রুয়ারি পার্ক দেস প্রিন্সেসে। প্রথম লেগে রীতিমতো বার্সেলোনাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেলো পিএসজি, উড়িয়ে দিলো ৪-০ গোলের ব্যবধানে। চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসে চার গোলের ব্যবধান পার করে এসে জেতেনি কোনো ক্লাব, বার্সেলোনার বিপক্ষে তাই ছিল ইতিহাস। এসময় নিজের ইন্সটাগ্রামে একটি ছবি দিলেন নেইমার, সেখানে শিরোনাম হিসেবে লিখলেন,
‘এক শতাংশ সুযোগ, ৯৯ শতাংশ বিশ্বাস।’
৩ সপ্তাহ পর ন্যু ক্যাম্পে যখন খেলতে নামছে বার্সেলোনা, লুইস এনরিকে তার সেরা খেলোয়াড় মেসিকে যেন বলে দিলেন, দুই সেন্টার ব্যাক আর তিন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের মাঝখানে পড়ে যাওয়া মেসির আসলে কিছু করার ছিলো না। এনরিকে বাজি ধরলেন মেসির ‘পার্টনার ইন ক্রাইম’ নেইমারের উপর, কারণ নেইমার মেসি না হতে পারেন, অন্তত নেইমার তো! ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিটেই সুয়ারেজের গোল, প্রথমার্ধের শেষ দিকে কুরজাওয়ার আত্মঘাতী গোলে পিএসজির লিড অর্ধেক করে ফেলে বার্সেলোনা। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই বক্সে নেইমারকে মুনিয়েরের ফাউল, পেনাল্টি! মেসি ভুল করলেন না, ৩-০! তবে সেই আনন্দ নষ্ট হয়ে গেলো ক্ষণিকেই, কুরজাওয়ার ক্রস থেকে দারুণ এক ভলিতে গোল করেন কাভানি, জিততে হলে বার্সেলোনাকে করতে হবে আরও ৩ গোল! সময় গড়িয়ে হয়ে পার হয়ে গেলো ৮৭ মিনিট, আছে মাত্র মিনিট তিনেক, এখনও গোল লাগবে তিনটি। পাড় বার্সেলোনা সমর্থকও আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু নেইমার ছাড়েননি। ৮৭ মিনিটে পাওয়া ফ্রি-কিক থেকে দারুণ এক গোল করলেন, ৯১ মিনিটে সুয়ারেজ এক বিতর্কিত পেনাল্টি এনে দিলেন, নেইমার সেটিতেও গোল করলেন। এগ্রেগেট স্কোর এখন ৫-৫, কিন্তু এওয়ে গোলের সুবাদে তখনও কোয়ার্টারে যাচ্ছে পিএসজি। ৯৫তম মিনিট, ফ্রি-কিক পেলো বার্সেলোনা। নেইমারের প্রথম ডেলিভারিটা ফিরে এলো, আবার বল পেয়ে নিজের দুর্বল বাম পায়ে নিলেন, সবাই অবাক হলো। সেই দুর্বল পায়েই ক্রস করলেন, সার্জি রবার্তো গোল করলেন, কোয়ার্টার ফাইনালে বার্সেলোনা! সবাই যখন ভেবেছিলো কোনো আশা নেই, তখনও একজন মানুষ বিশ্বাস করেছিলো। আর সেই বিশ্বাসে চড়েই বার্সেলোনা পৌছে যায় কোয়ার্টারে, তৈরি করে চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফিরে আসার গল্প।
যদিও সেই মৌসুমটা শেষ হয়েছিলো বাজেভাবে, লিগ আর চ্যাম্পিয়নস লিগ দু’টোই জিতে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনার ভাগ্যে জোটে স্রেফ কোপা দেল রে। মালাগার সাথে লিগে লাল কার্ড দেখে তালি দিয়ে ম্যাঠ ছেড়ে নিষিদ্ধ হন, মালাগার সাথে হেরে লিগের শিরোপা দৌড় থেকে ছিটকে পড়ে বার্সেলোনা, নেইমার মিস করেন ক্লাসিকোও। এবং এই মৌসুমশেষেই শুরু হয় গুঞ্জন, ক্লাব ছাড়ছেন নেইমার।
নতুন শুরু
বার্সেলোনায় থাকা অবস্থায় সবার সাথে নেইমারও বুঝতে পেরেছিলেন, যতদিন লিওনেল মেসি কাতালোনিয়ায় থাকবেন, ততদিন অন্য কারও পক্ষে এখানে রাজা হওয়া অসম্ভব। অথচ নেইমারের রাজা হওয়ার ইচ্ছাটা তীব্র, রাজ্যলাভের উপায় একটাই, রাজ্য বদলানো। কিন্তু রাজ্য বদলে ফেলাটাও মুখের কথা নয়, নতুন চুক্তি সাক্ষরের পর তার রিলিজ ক্লজ যে ২২২ মিলিয়ন, এত টাকা কে খরচ করবে?
একে তো গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে অপমান, তার উপরে এই গ্রীষ্মে মার্কো ভেরাত্তিকে পিএসজি ছেড়ে বার্সেলোনায় যোগ দেওয়ার প্ররোচনা, বার্সেলোনার উপর ক্ষিপ্ত হওয়ার কারণের অভাব ছিল না পিএসজি মালিক নাসের আল খেলাইফির। তাই যখন সে নেইমারকে পিএসজিতে নিয়ে আসার সুযোগ দেখলো, সেটি গ্রহণ করতে কার্পণ্য করলো না। সিদ্ধান্ত নিলো তার পুরো রিলিজ ক্লজ মিটিয়ে দেওয়ার।
ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রাক-মৌসুমে দুর্দান্ত খেলছিলেন নেইমার। লোকে বলছিলো, এরকম খেলোয়াড়কে ২২২ মিলিয়ন দিয়ে কেনা যেতেই পারে। বার্সেলোনা বোর্ড চেষ্টা করেছিলো, চেষ্টা করেছিলেন খেলোয়াড়েরাও, কিন্তু নেইমারকে মানানো গেলো না। তার মাথায় যে তখন রাজ্যজয়ের নেশা, তার মনে যে রাজা হওয়ার তীব্র বাসনা।
নেইমার চলে গেলেন প্যারিসে, শুরুটা করলেন দুর্দান্ত। এমবাপ্পে আর কাভানিকে নিয়ে ত্রাস ছড়ালেন, চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় পর্বে পিএসজির খেলা পড়লো রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে। প্রথম লেগে বার্নাব্যু থেকে ৩-১ গোলে হেরে আসলেও আশা ছিলো, প্যারিসে এই ফল উল্টে দেবেন নেইমার, বছরখানেক আগে যেভাবে বার্সেলোনায় দিয়েছিলেন!
কিন্তু বিধিবাম! নেইমার ইনজুরিতে পড়লেন, পিএসজির বিদায়ও দ্বিতীয় পর্ব থেকেই, বিশ্বকাপের আগে কোনোমতে ফিট হলেন নেইমার। কিন্তু পুরো বিশ্বকাপজুড়েই ছিলেন ছন্নছাড়া, বোঝাই যাচ্ছিলো, ইনজুরির ধকল এখনও পুরোপুরি সামলে ওঠেননি। এরপর বিশ্বকাপে হালকা আঘাতে বারবার পড়ে যাওয়ায় তাকে নিয়ে শুরু হয় ইন্টারনেটজুড়ে ট্রল, হাজারো মিম টেমপ্লেটে খুঁজে পাওয়া যায় এই ব্রাজিলীয় সেনসেশনকে। ছন্নছাড়া নেইমারকে নিয়ে ব্রাজিলও বেশিদূর এগুতে পারেনি, বাদ পড়ে যায় কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই।
এই মৌসুমের শুরু থেকেও দারুণ ছন্দে ছিলেন নেইমার, পিএসজিকে লিগের শীর্ষে তো রেখেছেনই, লিভারপুল আর নাপোলিকে নিয়ে গড়া গ্রুপ থেকে দলকে পরের পর্বে তুলেছেন গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন করেই। কিন্তু যেখানে কিছুদিন পর চ্যাম্পিয়নস লিগ মাতানোর কথা, সেখানে ঘরে বসে আবার সুস্থ হওয়ার লড়াইয়ে থাকবেন তিনি! আবারও ইনজুরিতে পড়েছেন নেইমার, গত মৌসুমের মতই পঞ্চম মেটাটার্সালে। ফিরে আসতে সময় লাগবে দশ সপ্তাহ, তবে এই মেটাটার্সালে সমস্যা পুরোপুরি দূর হতে সময় লাগতে পারে দুই বছর পর্যন্ত! এবারও মৌসুমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দলের সাথে থাকবেন না নেইমার, আক্ষেপে পুড়বে গোটা বিশ্বই। রাজ্য জয়ের দাম থাকে, নেইমারের কাছে থেকে ঈশ্বর হয়তো নিচ্ছেন সেটিই!