আমরা সবাই জানি যে, পৃথিবীতে স্থলের চেয়ে জলের পরিমাণ বেশি। ফলে সাগরে যার সামরিক শক্তি বেশি, সে-ই অন্যদের উপর ছড়ি ঘুরানোর মতো শক্তিশালী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ব্যবহারযোগ্য সামরিক শক্তি হলো তাদের বিশাল ও দুর্ধর্ষ নৌবাহিনী। কেননা বিশাল সেনাবাহিনী, উন্নত অস্ত্রশস্ত্র ও প্রযুক্তি, নিউক্লিয়ার বোমা ইত্যাদি যুক্তরাষ্ট্রের যেমন আছে, তেমন আরো অনেক দেশেরই আছে। কিন্তু এটি সর্বদা ব্যবহার করার মতো বিষয় নয়। কেউ নিশ্চয়ই অপরাধীদের আস্তানা ধ্বংস করতে ইন্টারকন্টিনেটাল ব্যালাস্টিক মিসাইল ছুঁড়বে না।
উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কথাই বলা যায়। তাদের শক্তিশালী সেনা ও বিমানবাহিনী ছাড়াও বিভিন্ন দেশে আট শতাধিক সামরিক ঘাঁটি থাকলেও বিশ্বের যেকোনো স্থানে অভিযান চালাতে চাইলে নৌবাহিনীর কথা সবার আগে আসবে। যুদ্ধজাহাজের সংখ্যার দিক দিয়ে চীনের কাছে সম্প্রতি অবস্থান হারালেও বাস্তবিক অর্থেই মার্কিন নৌবাহিনী এখনও বিশ্বের সর্ববৃহৎ।
প্রত্যেক দেশের নৌবাহিনী তাদের ফ্লিটকে ছোট ছোট একাধিক স্ট্রাইক/ব্যাটল গ্রুপে বিভক্ত করে থাকে। প্রতিটি গ্রুপের ফ্ল্যাগশিপ বা প্রধান যুদ্ধজাহাজ হচ্ছে তাদের ফ্লিটের সেরা যুদ্ধজাহাজ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলোকে স্ট্রাইক গ্রুপগুলোর ফ্ল্যাগশিপ হিসেবে নিযুক্ত করেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ১১টি ফ্লিট ক্যারিয়ার থাকলেও ২০১৬ সাল থেকে ৯টি ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ সচল আছে। নতুন সার্ভিসে আসা ক্যারিয়ারকে কেন্দ্র করে আরো একটি স্ট্রাইক গ্রুপ খোলা হতে পারে। প্রতিটি গ্রুপে কমপক্ষে একটি ফ্লিট ক্যারিয়ার, দুটি ক্রুজার, কয়েকটি ডেস্ট্রয়ার ও সাবমেরিন থাকে। ফুয়েল সাপ্লাই, লজিস্টিক শিপ নিয়ে একটি স্ট্রাইক গ্রুপ হয়। ক্রুজার, ডেস্ট্রয়ার শ্রেণীর জাহাজের সংখ্যা কম-বেশি হয়ে থাকে।
এ স্ট্রাইক গ্রুপগুলো সারাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মোতায়েন করা হয়। অনেকে মজা করে বলে, “পুরো পৃথিবীই যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর রাডার, মিসাইল, যুদ্ধবিমানের আওতাভুক্ত।” কথাটি কিন্তু এক অর্থে ভুল নয়।
এই সিরিজের আগের লেখায় বিভিন্ন শ্রেণীর এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। আজকে সংক্ষেপে আলোচনা করা হবে বিভিন্ন দেশের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের সক্ষমতা নিয়ে। প্রথমেই যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে শুরু করতে হবে। কেননা বর্তমানে যে ১৪টি দেশের হাতে ৪৪টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আছে তার মধ্যে ২১টিই যুক্তরাষ্ট্রের! আবার তাদের হাতে যেসব ক্যারিয়ার আছে তার সমতুল্য আর কারো নেই। একেকটি নিমিটজ ক্লাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার একসাথে যে পরিমাণ যুদ্ধবিমান বহন করতে পারে তা পৃথিবীর অর্ধেক দেশের একক বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমানের চেয়ে বেশি! হয়তো মনে হতে পারে, লেখক বুঝি বাড়িয়ে বলছেন। এই লেখা পড়া শেষ করলেই আপনার ধারণা পরিস্কার হয়ে যাবে।
নিমিটজ ক্লাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার নিয়ে আলাপ শুরু করা যাক।
নিমিটজ ক্লাস
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ১০টি নিমিটজ ক্লাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার রয়েছে। এর নামকরণ করা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিখ্যাত মার্কিন অ্যাডমিরাল চেস্টার ডব্লিউ নিমিটজ এর নামানুসারে। উল্লেখ্য, তার নেতৃত্বে মার্কিন নৌবাহিনী মিডওয়ের যুদ্ধের মাত্র ১৫ ঘণ্টায় জাপানি নৌবাহিনীর ৪টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ডুবিয়ে দেয়। এই যুদ্ধের পর জাপানি নৌবাহিনী আর মেরুদন্ড শক্ত করে দাঁড়াতে পারেনি। এজন্য তার সম্মানে নিমিটজ ক্লাসের ১০টি ফ্লিট ক্যারিয়ার নির্মাণ করা হয়। প্রথম জাহাজ ‘ইউএসএস নিমিটজ’ ১৯৭৫ সালে এবং দশম জাহাজ ‘ইউএসএস জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ’ ২০০৯ সালে মার্কিন নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
প্রতিটি নিমিটজ ক্লাসের গড় নির্মাণব্যয় ৪.৫ বিলিয়ন ডলার! তবে প্রতি বছর রক্ষণাবেক্ষণ ও আপগ্রেড করতে হয় বিধায় ২০১২ সালের হিসাবে প্রতিটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের পেছনে এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৮.৫ বিলিয়ন ডলার, যা সর্বশেষ হিসাব (২০১৮) অনুযায়ী হয়েছে ৯.৩৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার সার্ভিসে রাখা আর সাদা হাতি পোষা একই কথা। শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ না হলে এ ধরনের জাহাজ নির্মাণ ও সার্ভিসে রাখা অসম্ভব।
নিমিটজ ক্লাসের প্রতিটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের ডিসপ্লেসমেন্ট ১ লক্ষ টনের বেশি। ফুয়েল, যুদ্ধবিমান, জনবল, বোমা-মিসাইল মিলিয়ে সংখ্যাটি ১,০১,৬০০ টন থেকে ১,০৬,৩০০ টন পর্যন্ত হতে পারে। এজন্য এগুলোকে ‘সুপার ক্যারিয়ার’ নামেও ডাকা হয়। কেননা এক লক্ষ টনের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার অন্য কোনো দেশের নেই। প্রতিটি জাহাজ লম্বায় ১,০৯২ ফুট, প্রস্থে ২৫২ ফুট এবং ড্রাফট ৪১ ফুট। এজন্যই একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারকে ভাসমান দ্বীপ বা চলন্ত বিমানঘাঁটি বলা হয়। নিমিটজ ক্লাসের প্রতিটি জাহাজ চালাতে ৩,৫৩২ জন ক্রু লাগে। এয়ার অপারেশন উইংয়ের জন্য ২,৪৮০ জন ক্রু লাগে। অর্থাৎ প্রতিটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ২৪ ঘণ্টা অপারেশনাল রাখতে ৬ হাজারের বেশি ক্রুর দরকার হয়।
আপনার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জেগেছে, এত বড় জাহাজ চালাতে কেমন জ্বালানী লাগে? প্রথাগত জ্বালানী দিয়ে এত বড় জাহাজ চালানো একেবারে অসম্ভব। প্রচুর জ্বালানী তো লাগবেই, তার উপর সাগরে থাকাবস্থায় নিয়মিত জ্বালানী সরবরাহের প্রয়োজন। এত ঝামেলা না করে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট বসিয়ে দিলেই তো জ্বালানীর চিন্তা থেকে মুক্তি লাভ করা যায়! তাই প্রতিটি নিমিটজ ক্লাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে ২টি করে Westinghouse A4W নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর রয়েছে যা ২ লক্ষ ৬০ হাজার হর্সপাওয়ার বা ১৯৪ মেগাওয়াট শক্তির যোগান দিতে পারে। ফলে এই জাহাজের রেঞ্জ আনলিমিটেড, ২০-২৫ বছরের আগে নিউক্লিয়ার জ্বালানী শেষ হবে না। ৫০ বছরের সার্ভিস লাইফে প্রতিটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার দুবার মাত্র ইউরেনিয়াম জ্বালানী গ্রহণ করে। এই শক্তির জোগানের কারণে এটি সর্বোচ্চ ৩০ নট বা ঘণ্টায় ৫৬ কিলোমিটার বেগে চলতে পারে। প্রতিটি নিমিটজ এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার প্রায় ৩ মিলিয়ন গ্যালন এভিয়েশন ফুয়েল, ৬ হাজার ক্রুয়ের জন্য পর্যাপ্ত খাবার বহন করে। তারপরও বিমানের জ্বালানী, ক্রুদের খাদ্য সরবরাহ, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণজনিত কাজের কারণে একটানা দুই মাসের বেশি এসব জাহাজ সাগরে অবস্থান করে না।
যেকোনো এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে এর যুদ্ধবিমান। বিমানগুলো হ্যাংগার বা ফ্লাইট ডেকে সাজানো থাকে এবং চারটি বিশাল লিফটের মাধ্যমে সেগুলো ওঠা-নামা করানো হয়। নিমিটজ ক্লাসের যুদ্ধজাহাজগুলো ৮৫-৯০টি এয়ারক্রাফট বহন করে, যার মধ্যে ৬৫-৭৫টির মতো হচ্ছে যুদ্ধবিমান। বাকিগুলো বিভিন্ন হেলিকপ্টার, আর্লি ওয়ার্নিং রাডারবাহী বিমান, ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার ও মেরিটাইম পেট্রোল বিমান। তবে যুদ্ধ বা অন্য কোনো সাংঘাতিক অবস্থা না থাকলে সাধারণত ৬৪টি ফাইটার জেট বহন করে।
মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের মূল যুদ্ধবিমান হচ্ছে F/A-18 Hornet ও তার উন্নত সংস্করণ Super Hornet। এরা আকাশ, ভূমি ও সাগরে সমানভাবে শত্রুর উপর হামলা করতে পারদর্শী। এসব যুদ্ধবিমানের ডানা ভাঁজ করা যায় বিধায় এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের ছোট্ট হ্যাঙার ও ফ্লাইট ডেকে এগুলো অনায়াসে পার্কিং করে রাখা যায়। এই সুবিধার কারণে অন্যান্য এয়ারক্রাফট বাদ দিলে একেকটি নিমিটজ ক্লাসে সর্বোচ্চ ১৩০টি হরনেট/সুপার হরনেট বহন করা যাবে। আশা করি এবার বুঝতে পারছেন কেন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারকে ‘ভাসমান বিমানঘাঁটি’ বলা হয়।
এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার কখনও একা অপারেশন চালাতে যায় না। তাকে শত্রুর হামলা থেকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য কমপক্ষে একটি ক্রুজার ও দুটি ডেস্ট্রয়ার শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজসহ ক্ষেত্রবিশেষে সাবমেরিনও থাকে। তবে নিমিটজ ক্লাসের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যে নেই তা কিন্তু নয়। এতে ১৬-২৪টি Sea Sparrow মিসাইল ও ৩-৪টি Phalanx CIWS মাল্টিব্যারেল মেশিনগান থাকে শত্রুর বিমান, ড্রোন ও মিসাইলের হামলা ঠেকানোর জন্য। এছাড়া জ্যামারসহ অন্যান্য কাউন্টারমেজার তো আছেই। এর বাইরেও জাহাজটির স্পর্শকাতর জায়গায় ২.৫ ইঞ্চি কেভ্লার আর্মার যোগ করা হয়েছে।
এতসব দুর্দান্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকায় একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে হামলা করে ডোবানো বেশ কষ্টকর। তাই চীন, রাশিয়ার মতো পরাশক্তিগুলো নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডযুক্ত টর্পেডো, সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল ও হাইপারসনিক ব্যালাস্টিক মিসাইল বানিয়েছে। এজন্য মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলো চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, ইরানসহ বিভিন্ন দেশের জলসীমায় যাওয়া নিয়ে বাঁকযুদ্ধের খবর আপনারা প্রায়ই খবরে শিরোনামে দেখে থাকেন।
নিচের বিখ্যাত এই ছবিটি অনেকেই দেখেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউক্লিয়ার পাওয়ারের প্রদর্শনী বলা যায় এই ছবিকে।
১৯৬৪ সালের ৩১ জুলাই Operation Sea Orbit চলাকালে তোলা ‘Task Force One’ এর ছবিতে সবার উপরে ইউএসএস বেইনব্রিজ, মাঝে বিশ্বের প্রথম নিউক্লিয়ার যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস লংবিচ ও সবার নিচে ফ্লাইট ডেকে আইনস্টাইনের বিখ্যাত ভরশক্তি সমীকরণ ‘E=mc^2’ লেখা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ‘ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ’কে দেখতে পাবেন। এটিই বিশ্বের প্রথম নিউক্লিয়ার শক্তিচালিত এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যা ৫৫ বছর সার্ভিস দেয়ার পর ২০১২ সালে রিজার্ভে এবং ২০১৭ সালে পুরোপুরি অবসরে পাঠানো হয়।
এই ছবিটি তোলা হয় ৬৫ দিনে কোনো প্রকার রিফুয়েলিং ছাড়া সারা বিশ্বে ২৬,৫৪০ নটিক্যাল মাইল (৪৯,১৯০ কি.মি.) পাড়ি দেয়ার পর! তিনটি জাহাজই ছিল নিউক্লিয়ার শক্তিচালিত, ফলে এদের কোনোপ্রকার জ্বালানির দরকার ছিল না।
জেরাল্ড ফোর্ড ক্লাস
প্রতিটি নিমিটজ ক্লাসের সার্ভিস লাইফ ৫০ বছর, এরপর ৫ বছর রিজার্ভে থেকে অবসরে যাবে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলো। সেই হিসেবে ১৯৭৫ সালে সার্ভিসে আসা প্রথম জাহাজ ‘ইউএসএস নিমিটজ’ ২০৩০ সালে অবসরে যাবে। তাই নিমিটজ ক্লাসের রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে জেরাল্ড ফোর্ড ক্লাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বানানো শুরু করে। ২০১৭ সালে এই শ্রেণীর প্রথম জাহাজ ‘ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড’ সার্ভিসে আসে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের নামানুসারে এই শ্রেণীর নামকরণ করা হয়েছে।
মূলত নিমিটজ ক্লাসে বিপুল সংখ্যক ক্রু ও এগুলো চালানো ও রক্ষণাবেক্ষণের পেছনে ব্যাপক অর্থ ঢালতে হয় বিধায় উন্নত প্রযুক্তির এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বানানো শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। নিমিটজ ক্লাসের ১০টি ক্যারিয়ারকে ধীরে ধীরে প্রতিস্থাপন করবে জেরাল্ড ফোর্ড ক্লাস। বর্তমানে একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার সার্ভিসে ও আরেকটি পরিক্ষামূলক পর্যায়ে আছে। আরো দুটি বানানোর কাজ চলছে। মোট ১০টি বানানো হবে।
এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলো চালনার সামগ্রিক খরচ কমানোর উদ্দেশ্য হলেও জেরাল্ড ফোর্ড ক্লাস যেন আরেক সাদা হাতি। এই প্রজেক্টের প্রোগ্রাম খরচ ৩৭.৩০ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৮ সালের দেয়া হিসাব অনুযায়ী জেরাল্ড ফোর্ড ক্লাসের জাহাজ বানাতে খরচ পড়েছে ১২.৯৯৮ বিলিয়ন ডলার! যুদ্ধ না চলা সত্ত্বেও এত বিপুল পরিমাণ খরচ করে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বানানোর পরিকল্পনা করায় মার্কিন সরকারের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক সমালোচনা হয়। তবে এক লক্ষ টনের এসব দানবীয় যুদ্ধজাহাজ চালাতে মাত্র ২,৬০০ জন ক্রুর দরকার হবে, যা নিমিটজ ক্লাসের অর্ধেকেরও কম। এয়ার উইং মিলিয়ে সংখ্যাটা প্রায় ৫ হাজারের মতো হবে। এছাড়া ক্যাটাপুল্ট সিস্টেমের বদলে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক এয়ারক্রাফট লঞ্চ সিস্টেম (EMALS) থাকায় এসব জাহাজে ২৪ ঘণ্টায় ২৭০ বার (নিমিটজে ২৪০ বার) বিমান ওঠা-নামা করার সক্ষমতা থাকবে যা একটি মাঝারি আকারের বিমানবাহিনীর সমান।
নিমিটজের রেকর্ড ভেঙে দিয়ে জেরাল্ড ফোর্ড ক্লাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম যুদ্ধজাহাজ। এটি লম্বায় ১,১০৬ ফুট, উচ্চতায় ২৫০ ফুট যার মধ্যে ড্রাফট হলো ৩৯ ফুট। এটি দৈর্ঘ্যের পাশাপাশি প্রস্থেও নিমিটজের চেয়ে চওড়া। জেরাল্ড ফোর্ড ক্লাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের ফ্লাইট ডেকের প্রস্থ ২৫৬ ফুট, ওয়াটারলাইন ১৩৪ ফুট। খরচ কমানোর জন্য এতে ৯০টি এয়ারক্রাফট বহনের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ৭৫টি বহন করবে এবং দিনে ১৬০ বার ওঠা-নামা করবে (নিমিটজে ১৫০ বার করা হয়)।
উল্লেখ্য, এন্টারপ্রাইজ নামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ছিল (CV-6)। এই এন্টারপ্রাইজ (CVN-65)-কে অবসরে পাঠানোর পর জেরাল্ড ফোর্ড ক্লাসের আরেকটি ক্যারিয়ার এন্টারপ্রাইজ (CVN-80) নামকরণ করা হয়েছে যা এ বছর নির্মাণ শুরু হয়ে ২০২৫ সালে সার্ভিসে আসবে। ১,১২৩ ফুট লম্বা এখন পর্যন্ত নির্মিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ ৬০-৯০টি যুদ্ধবিমান বহন করতে পারতো। ১১০৬ ফুটের জেরাল্ড ফোর্ড ক্লাস ক্যারিয়ার ২য় স্থানে আছে।
জেরাল্ড ফোর্ড ক্লাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের পারমাণবিক শক্তির উৎস হিসেবে A1B reactor ব্যবহার করা হয়, যা নিমিটজের চেয়ে প্রায় ৩ গুণ বেশি শক্তি উৎপাদন করতে পারে। এটি ৫৫০ মেগাওয়াট শক্তির জোগান দিতে সক্ষম, যা একটি শহরের জন্য যথেষ্ট। বর্তমানে যেকোনো এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের মধ্যে এটিই সবচেয়ে শক্তিশালী নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর যা নিমিটজের দুর্বল ইলেক্ট্রিক্যাল পাওয়ার সাপ্লাইয়ের সমস্যা দূর করেছে।
ষাটের দশকে ডিজাইন করা নিমিটজ ক্লাসের তুলনামূলক কম বৈদ্যুতিক শক্তি লাগতো। কিন্তু জেরাল্ড ফোর্ড ক্লাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলো ২১০৫ সালের আগে অবসরে যাবে না। এছাড়া শক্তিশালী রাডার, লেজার ওয়েপন সিস্টেম চালানোর জন্য ব্যাপক শক্তির প্রয়োজন। তাই এত শক্তিশালী নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর বসানো হয়েছে। তবে ১ লাখ টনের বিশালাকার জাহাজটির গতি নিমিটজের মতো সর্বোচ্চ ৩০ নট বা ঘণ্টায় ৫৬ কিলোমিটার থাকবে।
আধুনিক প্রযুক্তির উন্নত রাডার ও সোনার সিস্টেম, ইলেক্ট্রনিক কাউন্টারমেজার অ্যান্ড জ্যামিং সিস্টেম, স্টেলথ ডিজাইন, অত্যাধুনিক এয়ার ডিফেন্স মিসাইলসহ এফ-১৮ সুপার হরনেট ও এফ-৩৫সি যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি চালকবিহীন লংরেঞ্জ কমব্যাট ড্রোনের কারণে জেরাল্ড ফোর্ড ক্লাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলো নিমিটজের চেয়ে কয়েকগুণ উন্নত ও শক্তিশালী।
পরবর্তী লেখায় অন্যান্য দেশের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার নিয়ে আলোচনা করা হবে।