Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রেডিয়াম গার্লস: নিজের অজান্তেই মৃত্যু ডেকে এনেছিল যে তরুণীরা (পর্ব – ১)

গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের কথা; আমেরিকা ও কানাডায় তখন রেডিয়ামের প্রলেপ দেয়া ঘড়ির বিশাল চাহিদা। সমাজের অভিজাত শ্রেণীতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চেয়ে বিলাসবহুল দ্রব্যের চাহিদা বেশি থাকে। এটা তো অর্থনীতির মৌলিক নিয়ম যে মানুষ তার জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে সমর্থ হলে এরপর বিলাসবহুল দ্রব্যের পেছনে ধাবিত হয়। আমেরিকা ও কানাডার সমাজও অর্থনীতির এই নিয়মের বাইরে ছিল না। রেডিয়ামের প্রলেপ দেয়া ঘড়ি কেনার মতো সামর্থ্য সবার ছিল না, এজন্য সমাজে সব শ্রেণীর মানুষের মাঝে নিজের অবস্থান আলাদাভাবে জানান দেয়ার জন্য রেডিয়ামের প্রলেপ দেয়া ঘড়ি ছিল মোক্ষম জিনিস।

সেসময়ে রেডিয়ামের ব্যবহার শুধু ঘড়ির মাঝে আটকে ছিল না। নারীদের অনেক প্রসাধনীতেও রেডিয়ামের মিশ্রণ দেয়া হতো। ক্যান্সারের চিকিৎসায় সফলভাবে রেডিয়ামের প্রয়োগের পর সমাজে সাধারণ মানুষের মাঝে এই ধারণা প্রচলিত হয় যে, রেডিয়াম কোনোভাবে শরীরে প্রবেশ করাতে পারলে নিশ্চিতভাবে আয়ু বৃদ্ধি পাবে। এই ভ্রান্ত ধারণার সুযোগ নিয়েছিল তৎকালীন প্রসাধনী উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনকি আমেরিকায় খাবার পানি প্রক্রিয়াজাতকারী একটি প্রতিষ্ঠানও তাদের প্রতি লিটার পানিতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রেডিয়াম ব্যবহার করতে শুরু করে। অসুস্থ মানুষকে রেডিয়ামমিশ্রিত পানি খাওয়ানোর চল শুরু হয় আমেরিকান সমাজে। ধারণা ছিল এই পানি অসুস্থ ব্যক্তিকে অসুখের হাত থেকে সেরে তোলার পাশাপাশি ভবিষ্যতে অন্যান্য রোগ থেকেও সুরক্ষা দেবে। দাঁত পরিষ্কার করার জন্য যেসব টুথপেস্ট প্রস্তুতকারক কোম্পানি ছিল, তারাও টুথপেস্টের রেডিয়াম মেশানোর সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে ক্রেতাদের দাঁত অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করে।

হচহতজআ
রেডিয়ামের ডায়ালবিশিষ্ট ঘড়িগুলো আমেরিকার অভিজাত সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে; image source:blogs.hmns.org

১৯১৪ সালে ইউনাইটেড স্টেটস রেডিয়াম কর্পোরেশন (United States Radium Corporation) নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে আমেরিকায়। তাদের প্রধান কাজ ছিল ডায়ালে রেডিয়ামের প্রলেপ দেয়া ঘড়ি উৎপাদন করা। বাজারে এসব ঘড়ির বিপুল চাহিদা ছিল– এ কথা আগেই বলা হয়েছে। প্রথমদিকে প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা চালিয়েছিল কীভাবে ঘড়ির ডায়াল রং করলে তা অন্ধকারেও পরিষ্কার দেখা যাবে, তা নিয়ে। জিংক সালফাইডের সাথে রেডিয়াম মিশিয়ে ঘড়ির ডায়াল রং করে তারা সফল হয় এবং পরবর্তীতে তাদের সমস্ত ঘড়ির ক্ষেত্রে এই নিয়ম অনুসরণ করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ সালে শুরু হলেও আমেরিকা ১৯১৭ সালের আগে যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে মিত্রপক্ষে যোগ দেয়নি। আমেরিকান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে নিজেদের নিরপেক্ষ থাকার ঘোষণা দেন। কিন্তু পরবর্তীতে জার্মানি আমেরিকাকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে শুরু করলে নিজ দেশের জনগণের চাপে আমেরিকা তার নিরপেক্ষ নীতি থেকে সরে আসে এবং পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আমেরিকার যুদ্ধে অংশগ্রহণের ঘটনা ইউনাইটেড স্টেটস রেডিয়াম কর্পোরেশনের জন্য শাপে বর হয়ে দাঁড়ায়।

যুদ্ধক্ষেত্রে রাতের আঁধারে মার্কিন সৈন্যদের সময় ও দিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বেশ ঝামেলায় পড়তে হতো। গতানুগতিক পদ্ধতিতে তৈরি করা ঘড়িতে কোনো আলোর ব্যবস্থা ছিল না যাতে করে রাতের বেলা সময় দেখতে সুবিধা পাওয়া যাবে। ইউনাইটেড স্টেটস রেডিয়াম কর্পোরেশনের মাধ্যমে রেডিয়াম পেইন্টিং আবিষ্কারের পর মার্কিন সেনাবাহিনী এই দিকে নজর দিতে শুরু করে। সে সময়ে পুরো মার্কিন মুল্লুকে মাত্র একটি প্রতিষ্ঠানই এই ধরনের ঘড়ি তৈরি করতে শুরু করেছিল। মার্কিন সেনাবাহিনীর এই প্রতিষ্ঠানটির সাথে ঘড়ি সরবরাহের জন্য চুক্তি করে। যেহেতু যুদ্ধটি ছিল বিশ্বযুদ্ধ এবং মার্কিন সেনাবাহিনী ছিল কলেবরে অনেক বড়, তাই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রচুর ঘড়ির চাহিদা আসতে থাকে। কোম্পানি তাদের নিউ জার্সিতে অবস্থিত কারখানায় আরও বেশি করে কর্মচারী নিয়োগ দিতে শুরু করে।

য়ননসহসহহ
আমেরিকার নিউ জার্সিতে যে ফ্যাক্টরি গড়ে ওঠেছিল, সেখানে কাজ করত অসংখ্য তরুণী; image source: waterburyobserver.com

ইউনাইটেড স্টেটস রেডিয়াম কর্পোরেশন অল্পবয়সী (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টিনেজার) নারীদের তাদের ফ্যাক্টরিতে নিয়োগ দিতে শুরু করে। আরও অবাক করা বিষয় হলো, অন্যান্য ফ্যাক্টরিতে নারী শ্রমিকরা যা বেতন পেত, এই ঘড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাজ করা মেয়েরা পেত তার তিনগুণ! পুঁজিবাদ যেখানে শ্রমিক শোষণের মাধ্যমেই টিকে থাকে, সেখানে নারী শ্রমিকদের সমসাময়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় এত বেশি বেতন দেয়া রীতিমতো বিস্ময়কর শোনায়। অল্প সময়ের মধ্যেই মার্কিন নিম্নবিত্ত সমাজের মেয়েরা ইউনাইটেড স্টেটস রেডিয়াম কর্পোরেশনে চাকরি করতে পারার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।

কিন্তু সমস্যা ছিল আসলে অন্য জায়গায়। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কখনও তার নারী শ্রমিকদের বলা হয়নি, জিংক সালফাইড মিশ্রিত রেডিয়াম শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ঘড়ির ডায়াল রং করার আগে তুলি বা ব্রাশকে নিজের ঠোঁটের মাধ্যমে সঠিক আকার দিতে বলা হতো। এতে  দেখা যেত, কোনো তরুণী যখন তুলি বা ব্রাশ ঠিক করার জন্য ঠোঁটে নেয়, তখন খানিকটা রেডিয়াম মিশ্রিত জিংক সালফাইড তাদের দাঁতে লেগে যায়, খানিকটা আবার গলা দিয়ে পেটেও নেমে আসে। যেহেতু তখনকার সমাজে প্রচলিত ছিল যে রেডিয়ামের মধ্যে ঐশ্বরিক গুণ আছে, এটি আয়ু বাড়ায়, শরীরকে আরও রোগমুক্ত করে তোলে– তাই এগুলো পেটে যাওয়ার বা দাঁতে লেগে থাকার বিষয়কে কেউ গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। সবাই ভেবেছিল এগুলো শরীরের জন্য মোটেও ক্ষতিকর নয়, বরং উপকারী। প্রতিষ্ঠানটি তার গবেষকদের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সামগ্রী সরবরাহ করলেও নারী শ্রমিকদের প্রতি ছিল চরম উদাসীন।

িতওতওগও
ইউনাইটেড স্টেটস রেডিয়াম কর্পোরেশনের ভেতরের একটি ছবি; image source: streettotheleft.weebly.com

ইউনাইটেড স্টেটস রেডিয়াম কর্পোরেশনের নিউ জার্সিতে অবস্থিত কারখানায় কাজ করা নারী শ্রমিকরা কারখানার বাইরেও ভালো সম্মান পেতেন। কাজ করার সময় তাদের পোশাকে রেডিয়ামমিশ্রিত জিংক সালফাইড লেগে যেত। কাজ শেষে করে অবসরে যখন তারা কোনো বারে নাচতে যেতেন, তখন অন্ধকারে তাদের শরীরের পোশাক বেশ ভালোই জ্বলজ্বল করতো, অনেক মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে। যেহেতু কাজের খাতিরে তাদেরকে প্রতিদিনই ঠোঁটে ও দাঁতে রেডিয়াম লাগাতে হতো, তাই অন্ধকারে তাদের দাঁতও জ্বলজ্বল করে উঠত। এজন্য রাতের বেলা তাদের ভৌতিক অবয়বের জন্য ‘ঘোস্ট গার্লস’ নাম পড়ে যায়। তবে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি সমাজে তাদের অবস্থানের উন্নয়ন ঘটিয়েছিল তা হচ্ছে তুলনামূলক উচ্চবেতন। অল্পবয়সী হিসেবে তাদেরকে যে পরিমাণ বেতন দেয়া হতো তা দিয়ে নিজেদের সমস্ত ইচ্ছা পূরণ করা তো সম্ভব হতোই, পাশাপাশি পরিবারকেও সহায়তা করতে পারত তারা।

কিন্তু তারা নিজেদের অজান্তেই যে কত বড় বিপদ ডেকে আনছিল, সেটি জানলে হয়তো কখনোই এই প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হতো না। সাধারণ মানুষ রেডিয়ামকে একেবারে স্বাভাবিক পদার্থ হিসেবে গ্রহণ করলেও বাস্তবে এটি পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর জন্য কুখ্যাত ছিল বিজ্ঞানী মহলে। এমনকি এর আবিষ্কারক মাদাম কুরি এবং পিয়েরে কুরিও এই রাসায়নিক পদার্থের তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হন, ভবিষ্যতের জন্য সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেন আবিষ্কারের পরপরই। কিন্তু সাধারণ মানুষের মাঝে যে ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত ছিল তার উপর ভর করেই ইউনাইটেড স্টেটস রেডিয়াম কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠানটি তার নারীশ্রমিকদের কোনো সুরক্ষাব্যবস্থা ছাড়াই পেইন্টিং চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়, যা পরবর্তীতে তাদের জীবনে বিপর্যয় বয়ে আনে। পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই অনিরাপদ পদ্ধতিতে কাজ করার ফলে রেডিয়াম নারীশ্রমিকদের শরীরে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে হাড়ের ভেতরে প্রবেশ করে, হাড়গুলোকে নষ্ট করে ফেলে।

এই সিরিজের পরবর্তী পর্ব:

রেডিয়াম গার্লস: নিজের অজান্তেই মৃত্যু ডেকে এনেছিল যে মেয়েরা (শেষ পর্ব)

Related Articles