
২০০১ সালে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’র অংশ হিসেবে তালিবান–নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানে আক্রমণ চালায়, তখন আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় ও দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান সক্রিয়ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন করে, স্থলবেষ্টিত আফগানিস্তানে মার্কিন–নেতৃত্বাধীন জোটের সৈন্যদের রসদপত্র সরবরাহের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, বহু সংখ্যক মিলিট্যান্টকে গ্রেপ্তার করে মার্কিন কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয় এবং বিনিময়ে ১,০০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি আর্থিক সহায়তা লাভ করে। এতকিছুর পরও ২০০১ সালের নভেম্বরে অভিযোগ উত্থাপিত হয় যে, পাকিস্তানি বিমানবাহিনী আফগানিস্তান থেকে কয়েক হাজার তালিবান ও আল–কায়েদা সদস্যকে তাদের নিজস্ব বিমানে করে পাকিস্তানে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে গেছে! পাকিস্তানের এরকম দ্বিমুখী আচরণের কারণ কী ছিল? কিংবা এই ঘটনার প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াই বা কীরকম ছিল?
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর একটি সুসমন্বিত সন্ত্রাসী আক্রমণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থিত ‘বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র’ ধ্বংস হয় এবং ভার্জিনিয়ার আর্লিংটন কাউন্টিতে অবস্থিত মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর ‘পেন্টাগন’ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই আক্রমণের ফলে ২,৯৯৭ জন নিহত ও প্রায় ২৫,০০০ জন আহত হয়, এবং প্রায় ১,০০০ কোটি (বা ১০ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার সমমূল্যের ক্ষয়ক্ষতি হয়। এটি ছিল বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী আক্রমণ এবং ১৯৪১ সালে জাপান কর্তৃক পার্ল হারবার আক্রমণের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিতে প্রথম বড় মাত্রার আক্রমণ। একই সঙ্গে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর ইতিহাসেও সবচেয়ে ভয়াবহ দিন। এই ঘটনাটিকে সংক্ষেপে ‘৯/১১’–এর ঘটনা নামে আখ্যায়িত করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই আক্রমণের জন্য আন্তর্জাতিক মিলিট্যান্ট গ্রুপ আল–কায়েদাকে দায়ী করে। এসময় আল–কায়েদার মূল ঘাঁটি ছিল আফগানিস্তানে, আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে তালিবান–নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানে। উল্লেখ্য, এসময় আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ চলছিল এবং আফগানিস্তানে দুটি সরকারের অস্তিত্ব ছিল। তালিবান আফগানিস্তানের ৯০% অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত এবং তালিবান–নিয়ন্ত্রিত ‘আফগানিস্তান ইসলামি আমিরাত’কে পাকিস্তান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত স্বীকৃতি প্রদান করেছিল। অন্যদিকে, আফগানিস্তানের বাকি ১০% অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত তালিবান–বিরোধী ‘উত্তরাঞ্চলীয় জোট’ বা ‘নর্দার্ন অ্যালায়েন্স’, এবং নর্দার্ন অ্যালায়েন্স–নিয়ন্ত্রিত ‘আফগানিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র’কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আফগানিস্তানের বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকার করত।

এসময় তালিবান–নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান আল–কায়েদার সবচেয়ে বড় ঘাঁটি হয়ে ওঠে এবং ৯/১১–এর ঘটনার সময় আল–কায়েদার প্রধান সৌদি–বংশোদ্ভূত ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানে অবস্থান করছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালিবানকে আহ্বান জানায় বিন লাদেনকে মার্কিন কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর এবং আফগানিস্তান থেকে আল–কায়েদাকে বহিষ্কার করার জন্য। তালিবান কর্তৃপক্ষ ৯/১১–এর ঘটনায় বিন লাদেনের জড়িত থাকার প্রমাণ দাবি করে এবং বিনা প্রমাণে তাকে হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়।
যুক্তরাষ্ট্র তালিবানকে কোনো ধরনের প্রমাণ সরবরাহ করতে অস্বীকার করে এবং আল–কায়েদাকে আফগানিস্তান থেকে উচ্ছেদ ও তালিবানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আফগানিস্তান আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। উল্লেখ্য, ৯/১১–এর ঘটনার আগ পর্যন্ত ভারত, রাশিয়া, ইরান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে সহায়তা করে আসছিল এবং ৯/১১–এর ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে সমর্থন করতে আরম্ভ করে।
২০০১ সালের ৭ অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন আফগানিস্তান আক্রমণ করে, এবং অভিযানটির সাঙ্কেতিক নাম দেয়া হয়েছিল ‘অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম’। পরবর্তীতে তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও পোল্যান্ডও ইঙ্গ–মার্কিন জোটের পক্ষে আফগানিস্তানে সৈন্য প্রেরণ করে, যদিও এই রাষ্ট্রগুলোর অংশগ্রহণের মাত্রা ছিল সীমিত।

মার্কিন–নেতৃত্বাধীন জোট এবং নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের তীব্র আক্রমণের ফলে তালিবান এবং আল–কায়েদা দ্রুত পিছু হটতে থাকে। ৭ নভেম্বর কাবুল এবং ৯ নভেম্বর মাজার–ই–শরিফ শহর মার্কিন–সমর্থিত নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের হস্তগত হয়। ১১ নভেম্বর নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের সৈন্যরা মার্কিন স্পেশাল ফোর্সের উপদেষ্টা এবং মার্কিন বিমানবাহিনীর সহায়তায় উত্তর আফগানিস্তানের কুন্দুজ শহরটি অবরোধ করে। শহরটি থেকে পশ্চাৎপসরণের সকল রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। অবরুদ্ধ তালিবান সদস্যরা আলোচনার প্রস্তাব দিলে মার্কিন সরকার সেটি প্রত্যাখ্যান করে।
এসময় কুন্দুজে প্রায় ১০,০০০ তালিবান এবং প্রায় ৩,০০০ বিদেশি মিলিট্যান্ট (বা মতান্তরে, প্রায় ৮,০০০ তালিবান ও বিদেশি মিলিট্যান্ট) ছিল, যারা নর্দার্ন অ্যালায়েন্স ও মার্কিন–নেতৃত্বাধীন জোটের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। অবরুদ্ধদের মধ্যে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘ইন্টার–সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স’ বা ‘আইএসআই’ এর শত শত কর্মকর্তা, যারা তালিবান মিলিট্যান্টদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিত। তদুপরি, তালিবান মিলিট্যান্টদের মধ্যে ছিল প্রচুর পাকিস্তানি স্বেচ্ছাসেবক, যাদের অনেকেই ছিল পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর প্রাক্তন সৈনিক। এছাড়া, কুন্দুজে অবরুদ্ধ আল–কায়েদা ও অন্যান্য বিদেশি মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোতে ছিল আরব, উজবেক, চেচেন এবং পাকিস্তানি মিলিট্যান্টরা।
বস্তুত, ১৯৯০–এর দশকে পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তালিবান গড়ে উঠেছিল এবং পাকিস্তানি সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা ছিল তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হওয়ার একটি বড় কারণ। প্রখ্যাত পাকিস্তানি সাংবাদিক আহমেদ রাশিদের মতে, ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে ৮০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং স্বেচ্ছাসেবক হয় তালিবান মিলিট্যান্টদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে নয়তো তাদের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধ করেছে।

২০০১ সালের ৯/১১–এর ঘটনার পর পাকিস্তান তালিবানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন করতে বাধ্য হয় এবং আফগানিস্তানে তাদের নীতিতে ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন আসে। কিন্তু কুন্দুজে অবস্থানরত পাকিস্তানি শত শত সেনা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা যদি নর্দার্ন অ্যালায়েন্স বা মার্কিন–নেতৃত্বাধীন জোটের হাতে ধরা পড়ত, তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানের মান-সম্মানের ভরাডুবি হত (কারণ পাকিস্তান সবসময়ই তালিবানকে সহযোগিতার কথা অস্বীকার করে এসেছে) এবং পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিপদের সম্মুখীন হতেন।
তদুপরি, নর্দার্ন অ্যালায়েন্স ঘোষণা করেছিল, আফগানিস্তানে অবস্থানরত বিদেশি মিলিট্যান্টদের তারা আফগান মিলিট্যান্টদের তুলনায় কঠোরভাবে শাস্তি দেবে। কুন্দুজে অবস্থানরত পাকিস্তানি ও অন্যান্য বিদেশি মিলিট্যান্টদের অনেকেই তালিবান–বিরোধীদের গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল এবং এজন্য নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের হাতে বন্দি হলে তাদের প্রাণের প্রতিও হুমকি দেখা দিত। এমতাবস্থায় পাকিস্তান এয়ারলিফটের মাধ্যমে কুন্দুজ থেকে পাকিস্তানি সৈন্য ও মিলিট্যান্টদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে শুরু করে।
পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর ৬টিরও বেশি পরিবহন বিমান রাতের বেলায় কুন্দুজে অবস্থিত বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করে এবং কয়েক দিনের মধ্যে প্রায় ৫,০০০ পাকিস্তানি সৈন্য ও মিলিট্যান্ট এবং তালিবান ও আল–কায়েদা সদস্যদের সেখান থেকে সরিয়ে নেয়। পাকিস্তানের বর্তমান খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে অবস্থিত চিত্রল বিমানঘাঁটি এবং গিলগিট–বালতিস্তান অঞ্চলে অবস্থিত গিলগিট বিমানঘাঁটি থেকে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী এই অভিযানটি পরিচালনা করে।

পাকিস্তানিদের কর্মকাণ্ড কুন্দুজ শহরটি অবরোধ করে রাখা নর্দার্ন অ্যালায়েন্স সৈন্যদের নজর এড়ায়নি। এসময় ভারতীয় বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং’ (RAW বা ‘র’) সদস্যরা নর্দার্ন অ্যালায়েন্স সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে ছিল এবং তারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কুন্দুজে পাকিস্তানিদের গতিবিধি সম্পর্কে জানতে পেরেছিল। ‘র’–এর তথ্যমতে, কমপক্ষে ৫টি পাকিস্তানি পরিবহন বিমান সেসময় কুন্দুজ বিমানঘাঁটি দেখে উড্ডয়ন করেছিল। নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই এয়াললিফটের সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ে এবং মার্কিন গণমাধ্যম এটিকে ‘শয়তানের এয়ারলিফট’ (‘Airlift of evil’) নামে আখ্যায়িত করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান উভয়েই দাবি করে যে, এ ধরনের কোনো ‘এয়ারলিফট’ আদৌ ঘটে নি। ২০০১ সালের ১৬ নভেম্বর মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড এই এয়ারলিফটের কথা অস্বীকার করেন এবং ২৬ নভেম্বর মার্কিন সশস্ত্রবাহিনীর জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফের সভাপতি জেনারেল রিচার্ড বি. মায়ার্স দাবি করেন যে, কুন্দুজ বিমানঘাঁটির অংশবিশেষ ব্যবহারের উপযোগী অবস্থায় থাকলেও পরিবহন বিমানের অবতরণের জন্য সেটি অনুপযুক্ত। পাকিস্তানি সরকারের মুখপাত্র আনোয়ার মেহমুদ এয়ারলিফটের ঘটনাটিকে সম্পূর্ণ বানোয়াট বলে দাবি করেন।
কিন্তু ২৫ নভেম্বর নর্দার্ন অ্যালায়েন্স সৈন্যরা কুন্দুজ দখল করে নেয়ার পর মার্কিন ও পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের দাবির সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দেয়। কুন্দুজে প্রায় ৩,৩০০ তালিবান সদস্য নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের জাতিগত উজবেক কমান্ডার আব্দুল রাশিদ দোস্তামের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং আরো কিছু তালিবান সদস্য স্থানীয় গোত্রীয় নেতাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু বাকি তালিবান ও বিদেশি মিলিট্যান্টরা গেল কোথায়?
মার্কিন তদন্ত প্রতিবেদক সাইমুর হার্শ বেশ কিছু মার্কিন ও ভারতীয় সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং কূটনীতিবিদের সাক্ষাৎকার নেন এবং এর ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, কুন্দুজ এয়ারলিফট সত্যিই সংঘটিত হয়েছিল।

মার্কিন সামরিক, গোয়েন্দা ও স্পেশাল ফোর্স কর্মকর্তাদের মতে, কুন্দুজ অবরোধ আরম্ভ হওয়ার পর পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি পারভেজ মোশাররফ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কুন্দুজ থেকে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি নাগরিকদের সরিয়ে নেয়ার অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন এবং তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ. বুশ ও উপরাষ্ট্রপতি ডিক চেনি মার্কিন মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্যকে না জানিয়েই মোশাররফকে এই এয়ারলিফট আরম্ভ করার অনুমতি দেন। শুধু পরোক্ষ অনুমোদন নয়, মার্কিন সরকার মার্কিন সশস্ত্রবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডকে কুন্দুজ থেকে পাকিস্তানের দক্ষিণ–পশ্চিম কোণ পর্যন্ত একটি বিশেষ ‘এয়ার করিডোর’ স্থাপনের নির্দেশ দেয় এবং পাকিস্তানি বিমানবাহিনী এই করিডোর ব্যবহার করে কুন্দুজ থেকে অবরুদ্ধ সৈন্য ও মিলিট্যান্টদের সরিয়ে নেয়।
পাকিস্তানি বিমানবাহিনী কুন্দুজ থেকে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং স্বেচ্ছাসেবকদের পাশাপাশি তালিবান ও আল–কায়েদা মিলিট্যান্টদেরও সরিয়ে নেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে তালিবান ও আল–কায়েদাকে ধ্বংস করার জন্যই আফগানিস্তানে এসেছিল, তাহলে তারা পাকিস্তানকে কেন তালিবান ও আল–কায়েদা মিলিট্যান্টদের সরিয়ে নিতে দিল?
প্রথমত, মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতে, মার্কিন সরকার কুন্দুজ থেকে কেবল পাকিস্তানি নাগরিকদের সরিয়ে নেয়ার জন্য পাকিস্তানকে অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু পরিবহন বিমানগুলো কুন্দুজে পৌঁছানোর পর এগুলোতে কারা উঠবে তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। পাকিস্তানি সেনা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সেসব তালিবান ও আল–কায়েদা মিলিট্যান্টদের সম্ভাব্য মৃত্যুর মুখে ফেলে রেখে যেতে চায়নি, যাদেরকে তারা নিজেরাই প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, মার্কিন গোয়েন্দা বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, সরিয়ে নেয়া তালিবান নেতাদের তারা মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করবে কিংবা অন্ততপক্ষে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে এসব নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেবে। এজন্য পাকিস্তানিরা কুন্দুজ থেকে তালিবান নেতাদের সরিয়ে নিলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাতে বাধা দেয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে পাকিস্তান এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি।

সর্বোপরি, সাইমুর হার্শের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং অঞ্চলটিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল এবং এই লক্ষ্য পূরণের অংশ হিসেবেই মার্কিনীরা কুন্দুজ থেকে অবরুদ্ধ তালিবান মিলিট্যান্টদের সরিয়ে নিতে দিয়েছিল। বস্তুত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালিবানকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে আগ্রহী ছিল না। ওয়াশিংটন চেয়েছিল তালিবানের উগ্রপন্থী অংশকে ধ্বংস করে যুদ্ধ–পরবর্তী আফগানিস্তানের সরকারের মধ্যপন্থী তালিবান নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করতে। এতে করে একদিকে যেমন আফগানিস্তানের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতো, অন্যদিকে তেমনি আফগানিস্তান পুরোপুরি ভারত বা পাকিস্তান কারোরই প্রভাবাধীন হতো না (অন্যদিকে, নর্দার্ন অ্যালায়েন্স একাকী সরকার গঠন করলে আফগানিস্তান ভারতীয় প্রভাব বলয়ে চলে যেত, যেটি মার্কিন মিত্র পাকিস্তানের প্রতি হুমকি হয়ে উঠত)।
কৌতূহলের বিষয় এই যে, প্রায় ১৯ বছর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবার আফগানিস্তানে তালিবানের সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং এই প্রচেষ্টা সফল হলে আফগানিস্তানে ভারতীয় প্রভাব হ্রাস পাবে ও পাকিস্তানি প্রভাব বৃদ্ধি পাবে।
ভারত ‘কুন্দুজ এয়ারলিফট’ এবং এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন সমর্থন সম্পর্কে জানত, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটার আশঙ্কায় প্রকাশ্যে এর কোনো নিন্দা জানায়নি। ভারতীয় সরকার এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কাছে ‘কূটনৈতিক নোট’ প্রেরণ করেছিল, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেন কেউই এই নোটের জবাব দেয়নি।
বিবিসি কুন্দুজ এয়ারলিফট এবং এতে পাকিস্তানের ভূমিকা সম্পর্কে ‘সিক্রেট পাকিস্তান’ নামে দুই পর্বের একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছে। পর্ব দুটির শিরোনাম যথাক্রমে ‘ডাবল ক্রস’ এবং ‘ব্যাকল্যাশ’।
বস্তুত, লর্ড পামারস্টোন যখন ঘোষণা করেছিলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো স্থায়ী বন্ধু বা স্থায়ী শত্রু নেই, আছে কেবল স্থায়ী স্বার্থ, তখন তিনি শতকরা ১০০ ভাগ সঠিক ছিলেন।