ফরাসি ঔপনিবেশিকতার কালো থাবায় জর্জরিত পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাঁসো। এই দেশের বেশিরভাগ মাটিই অনুর্বর। এই অনুর্বর মাটিতেই সোনা ফলানোর স্বপ্ন দেখতেন ক্ষণজন্মা এক কিংবদন্তী। নাম তার থমাস সাংকারা। সোনা ফলাতেও শুরু করেছিলেন। তবে পিশাচের কালো থাবায় তাকে মাঝপথেই থেমে যেতে হয়, চলে যেতে হয় অকালে। ১৯৪৯ সালের ২১ ডিসেম্বর আপার ভল্টার (বর্তমান বুরকিনা ফাঁসো) ইয়াকোতে জন্ম নেওয়া এই ক্ষণজন্মা নায়কের কথাই আজ বলব।
১৮৮৮ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে ফরাসি কলোনিতে পরিণত হওয়া আপার ভল্টা (পরবর্তীতে বুরকিনা ফাসো) ১৯৬০ সালের ৫ আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর থেকেই নানা ঘাত-প্রতিঘাত আর অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সময় পার করতে থাকে দেশটি। সময়ে সময়ে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নড়বড়ে হতে থাকে।
১৯৬৬ সালে লে. কর্ণেল সাঙ্গোলি লামিজানা (পরবর্তীতে জেনারেল) এক সেনা-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মরিস ইয়ামোগোর নির্বাচিত সরকার উৎখাত করে ক্ষমতায় বসেন। তিনি ১৯৮০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। একসময় তার শাসনে (আসলে শোষণ) ক্ষিপ্ত হয়ে সর্বশ্রেণীর মানুষ একের পর এক আন্দোলন করতে থাকে। এই সুযোগে আরেক সেনা অফিসার কর্নেল সায়ে জেবোর লামিজানাকে হঠিয়ে ক্ষমতায় বসেন। তার শাসনকাল অবশ্য তেমন দীর্ঘ হয়নি। ১৯৮২ সালের নভেম্বরে নন-কমিশন্ড সেনা অফিসাররা আরেক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেবোরকে সরিয়ে মেজর জিন-ব্যাপটিস্ট ওয়েডেরোগোকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করে।
কিছুদিনের মধ্যেই দেশটি রাজনৈতিকভাবে দু’ভাগ হয়ে যায়। একদল রক্ষণশীল মনোভাব নিয়ে আগের প্রেসিডেন্টের পক্ষে থাকে, আরেকদল পরিবর্তনের সংকল্পে ন্যাশনাল রেভ্যলুশনারি কাউন্সিল গঠন করে। পরবর্তীতে তারা আরেকটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে, আরেক সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন থমাস সাংকারাকে হেড অভ দ্য স্টেট ঘোষণা করে ক্ষমতায় নিয়ে আসে।
সাংকারা ক্ষমতায় এসেই পরিবর্তনের ধারা শুরু করেন। প্রথমেই তিনি দেশের নাম পরিবর্তন করেন, যেটা আজকের বুরকিনা ফাসো, যার অর্থ দুর্নীতিমুক্ত মানুষের দেশ। তার নেওয়া উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শিশুদের বিভিন্ন রোগের টিকাদান, নাগরিকদের জন্য গৃহায়ণ প্রকল্প, সাহেল অঞ্চলে (যেটি সাহারা মরুভূমির কাছাকাছি একটি বনাঞ্চলহীন স্যাঁতস্যাঁতে অঞ্চল) বৃক্ষায়ণ এবং নারী শিক্ষা ইত্যাদি।
তিনি দেশের উন্নয়নের জন্য চারটি মূলনীতি গ্রহণ করেন,
- নিজস্ব সামর্থ্যের পূর্ণ ব্যবহার ও বিদেশী সাহায্য বর্জন;
- বিদেশী উন্নয়ন মডেল বর্জন;
- নারী উন্নয়ন ও তাদেরকে উন্নয়নের অংশীদার করা; এবং
- সব শ্রেণীর মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ।
সাংকারা বুঝতে পারেন, নিজেদের শক্তিতে এগিয়ে যেতে হলে বিদেশী যত উন্নয়ন মডেল আছে সেগুলোকে বর্জন করতে হবে। বুরকিনার স্বাধীনতার পর থেকে উন্নয়ের যত মডেল দাঁড় করানো হয়েছিল, সবই বিদেশী এবং সবগুলোই ব্যর্থ হয়। অন্যের বাসায় আরামের বিছানায় ঘুমানো আর মাটিতে ঘুমানো একই ব্যাপার। তাই তিনি বিদেশী উন্নয়ন মডেল বাদ দিয়ে নিজেদের সম্পদ পূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে নিজস্ব উন্নয়ন মডেল দাঁড় করান।
নিজেদের যা আছে সেটা নিয়েই তিনি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৮৩-৮৭, তার শাসনামলের এই সময়ে বুরকিনা ফাসো কোনো বিদেশী সাহায্য, এমনকি বিশ্বব্যাংকের সাহায্যও নেয়নি। এই সময়ের মধ্যে দেশে পানির অভাব দূর করার লক্ষ্যে দেশব্যাপী ২৫০টি খাল এবং ৩০০টির মতো কূপ খনন করেন। কৃষি, গৃহায়ণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা সব খাতেই তিনি নিজেদের সর্বোচ্চটা ব্যবহার করেন। শিক্ষার হার ১৩% থেকে ৭৮% এ উন্নীত করেন। তিনি নারীশিক্ষার উন্নয়নের পাশাপাশি নারীদেরকে সরকারি উচ্চপদে আসীন করতে থাকেন। বন্ধ করেন জোরপূর্বক নারীবিবাহ।
বন্ধ হয়ে যাওয়া জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি পুনরায় চালু করে এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি হাম, পীতজ্বর ও মস্তিষ্কের প্রদাহের জন্য প্রায় ১০ লাখ শিশুকে টিকাদানের আওতায় নিয়ে আসেন। ১৯৮৪ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা এই জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি শেষ হতে হতে প্রায় ২৫ লক্ষ শিশুকে এসব রোগের টিকা দেওয়া সম্ভব হয়। টিকাদানের প্রোগ্রামটি ১৯৮০ সালে চালু হলেও, ততদিনে দেশের মোট শিশুর মাত্র ১৯ ভাগ এই সেবা পায়। সেটাকে তিনি মাত্র দুই সপ্তাহের কিছু বেশি সময়ে প্রায় ৭৭ ভাগে উন্নীত করেন। তাছাড়া তার সময়ে শিশুমৃত্যুর হার ২০.৮% থেকে কমে ১৪.৫% এ নেমে আসে।
নিজেদেরকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে সাংকারা কৃষি উন্নয়নে বেশি মনোযোগ দেন। সামন্ততান্ত্রিক জমিদারদের কাছ থেকে জায়গা নিয়ে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের মধ্যে জায়গা বন্টন করে দেন। আগে যেখানে প্রতি হেক্টর জমিতে ১,৭০০ কেজি গম উৎপন্ন হতো, তিন বছর পর সেটা দাঁড়ায় প্রতি হেক্টরে ৩,৮০০ কেজিতে! তিন বছরে খাদ্য উৎপাদন সার্বিকভাবে আগের চেয়ে ৭৫% বৃদ্ধি পায়।
দেশের আবাসনহীন নাগরিকদের জন্য বৃহৎ সব গৃহায়ণ প্রকল্প চলতে থাকে। বাড়ি তৈরির জন্য শহরের দিকে না তাকিয়ে প্রান্তিক এলাকায় ইট ভাটা নির্মাণ করেন, সেগুলোর সাহায্যে চলতে থাকে দেশের মানুষের জন্য ঘর নির্মাণ। দেশকে মরুকরণের হাত থেকে বাঁচাতে সাংকারা সরকার চার বছরে প্রায় এক কোটি বৃক্ষরোপণ করে। রেলের উন্নয়নে নির্মাণ করেন প্রায় ৭০০ কিলোমিটার রেলরোড। এ সবই হতে থাকে পুরোপুরি নিজস্ব অর্থায়নে।
সরকারি কাজে ব্যবহারের জন্য সরকারের গাড়িবহরের সব মার্সিডিজ বিক্রি করে দিয়ে রেনল্ট ৫ দিয়ে গাড়িবহর সাজান। রেনল্ট ৫ ছিল সেসময়ে বুরকিনা ফাসোতে বিক্রি হওয়া সবচে কম দামি গাড়ি। নিজের পাশাপাশি সব পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন হ্রাস করেন। উঠিয়ে নেওয়া হয় ব্যক্তিগত গাড়ির ড্রাইভার ও প্রথম শ্রেণীর এয়ার টিকেট সুবিধা। সরকারি চাকুরিজীবিদের পুরো বছরের এক মাসের বেতন জনউন্নয়নমূলক প্রকল্পে দান করতে বাধ্য করেন। ওগাডাগোতে সেনাবাহিনীর প্রভিশন স্টোরকে সুপারমার্কেটে রূপান্তর করে দেশের নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। এটিই ছিল দেশটির প্রথম সুপারমার্কেট।
নিজ অফিসে তিনি এসি ব্যবহার করতেন না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, একজন গরীব দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসি ব্যবহার করার মতো বিলাসিতা দেখানোর সুযোগ তার নেই। ব্যক্তিগতভাবে তিনি একটি একটি গাড়ি, চারটি মোটরবাইক, তিনটি গিটার এবং একটি ভাঙা ফ্রিজের মালিক ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিমাসে ৪৫০ ডলার করে বেতন নিতেন, যেটি দেশটির ইতিহাসের যেকোনো প্রেসিডেন্টের তুলনায় সবচেয়ে কম। একজন সঙ্গীতানুরাগী এবং গিটারিস্ট হিসেবে তিনি নিজের দেশের জন্য নতুন করে জাতীয় সংগীত রচনা করেন।
এতসব উন্নয়ন দেশকে খুবলে খাওয়ার সুযোগ না পাওয়া স্বার্থান্বেষী মহল সহ্য করতে পারেনি। রয়ে গিয়েছিল ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের প্রেতাত্মারাও। ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে তারা ধীরে ধীরে। সাংকারারই একসময়ের সহকর্মী ব্লেইস কম্পাওহের নেতৃত্বে ১৫ আগস্ট ১৯৮৭ সালে আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটান হয়। পরবর্তীতে এই অভ্যুত্থানের কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, সাংকারা প্রতিবেশী দেশসমূহ এবং সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স এবং আইভরি কোস্টের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে।
সেদিন এন্টেঞ্জের এক কাউন্সিল মিটিং চলাকালে সাংকারাসহ আরো বারোজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। বুলেট দিয়ে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয় সাংকারার দেহকে। তার দেহকে টুকরো টুকরো করে গোপনে মাটিচাপা দিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ওগাডাগোতে তাঁর সমাধির খোঁজ মেলে।
তিনি বলতেন,
যে তোমাকে খাওয়াবে, সেই তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তাই নিজের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতে হলে নিজের শক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার বিকল্প নেই।
অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলেও বুরকিনা ফাসোর জনগণ সাংকারাকে জাতীয় বীরের মর্যাদার আসনে বসিয়েছিল। বিপ্লব ও ভালোবাসার জন্য তাকে আফ্রিকার চে গুয়েভারা বলা হয়। তিনি চাইতেন তার দেশের জনগণ নিজেদের প্রয়োজন বুঝুক। চেয়েছিলেন প্রয়োজনানুসারে কীভাবে নিজেদের গড়ে তুলতে হয় সেই আত্মবিশ্বাস তাদের মধ্যে জন্ম নিক। এমনই এক স্বপ্নবাজ দেশনায়ককে মাত্র ৩৮ বছর বয়সেই চলে যেতে হয়েছে, স্বদেশের জনগণকে স্বৈরাচারের কবলে রেখে। এলেন, দেখলেন, জয় করলেন; আবার চলেও গেলেন। তবে দেশ নয়, থমাস ইসিডোর নোয়েই সাংকারা জয় করেছিলেন জনগণের হৃদয়।