অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই বাংলাদেশ। প্রকৃতি তার সবটুকুই দিয়েছে এ দেশকে। বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর স্থানগুলোর তালিকায় বগা লেকের নাম থাকবে উপরের কাতারে। প্রকৃতির কিছু জায়গায় তার অপরূপ সৌন্দর্যের সবটুকুই ঢেলে দিয়েছে। তার মধ্যে কিছু স্থান যেমন সৌন্দর্যে ভরপুর, তেমনি তা বহু বছর ধরে মানুষের কাছে অনেক রহস্যময়। তেমনি অসাধারণ সুন্দর আর প্রকৃতির অপরূপ এক স্থান বগা লেক। তবে বগা লেককে বেশিরভাগ মানুষ যথেষ্ট রহস্যময় করে রাখতে পছন্দ করে। সেটা বগা লেকের উচ্চতা, ধরন, অবস্থানের কারণেও হতে পারে।
বগা লেকে যাবার জন্য প্রথমেই বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে আপনাকে বান্দরবানে পৌঁছাতে হবে। বান্দরবান শহর থেকে সেখানকার সবগুলো স্পটে যাবার রাস্তা শুরু হয়। পাহাড়ি আকাঁবাকাঁ রাস্তা আর সবুজে ঘেরা পাহাড়ের প্রেমে পড়ে যেতে আপনি বাধ্য। পাহাড় না কি সমুদ্র, এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কে না গিয়ে পাহাড়প্রেমীদের পক্ষ নিয়ে কথা বললে, বান্দরবান তাদের প্রথম প্রেম বলা যায়। বান্দরবান যেন এক স্বর্গরাজ্য। এর ভেতর থাকা হাজারো রহস্যের মাঝে বগা লেক নামক এক রহস্য বাসা বেঁধে আছে।
বান্দরবান শহর থেকে চান্দের গাড়ি অথবা বাসে করে আপনাকে রুমা বাজার যেতে হবে। যাবার পথে আপনার পরিচয়পত্র সাথে রাখতে হবে। যাবার পথেই পেয়ে যাবেন মিলনছড়ি এবং ওয়াই জাংশন আর্মি চেক পোস্ট। ওয়াই জাংশনের Y-এর এক মাথা ধরে যাওয়া হয় রুমা বাজারে, আরেক মাথা দিয়ে থানচি।
চেকপোস্টে চেক-ইন করে রওনা দিতে হবে সেই কাঙ্ক্ষিত রুমা বাজারের পথে। পথ চলতে চলতে বান্দরবানের আকাবাঁকা সরু পথে আপনি হারিয়ে যেতে বাধ্য। কখনো এক পাশে পাহাড়, অপর পাশে মেঘ। আবার কখনো দুই পাশেই মেঘের ভেতর হারিয়ে যাওয়া। যাবার সময় দেখা যায় বিভিন্ন আদিবাসী গ্রাম এবং বাজার। বান্দরবান শহর থেকে বগালেক পর্যন্ত প্রায় ৮৭ কিলোমিটারের যাত্রাপথ।
রুমা বাজার পৌঁছে আপনাকে আর্মি চেকপোস্টে চেক-ইন করতে হবে এবং সেখান থেকেই একজন স্থানীয় গাইডের সাথে যেতে হবে। বান্দরবানের বিভিন্ন গহীন এবং দুর্গম স্থানে গাইড আপনার একমাত্র ভরসা। গাইড নেবার পর আপনাকে অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করতে হবে। সেখানে শর্ত থাকে, মূলত আপনি বগা লেকের পানিতে নামবেন না এবং যদি নেমেও থাকেন, আপনার মৃত্যুর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। খুব কঠিন শর্ত মনে হলেও আদতে এটি আপনার নিরাপত্তার জন্যই করা। বগা লেকে ডুবে মৃত্যু হয়েছে, এমন নজির যথেষ্ট পরিমাণে আছে। তাই সবার আগে নিজের জীবনের নিরাপত্তা প্রয়োজন।
রুমা বাজারে খাওয়া-দাওয়া করে নিতে পারেন। চাইলে বগা লেক গিয়েও করা যায়। রুমা বাজার থেকে চান্দের গাড়ি পরিবর্তন করতে হবে। বান্দরবান সদর থেকে রুমা বাজার পর্যন্ত যেসব চান্দের গাড়ি চলে, এগুলো বগা লেক যাবার উপযোগী নয়। স্থানীয় এক চালকের ভাষ্যমতে, রুমা বাজার থেকে বগা লেক পর্যন্ত গাড়িগুলো প্রধানত শক্তিশালী ইঞ্জিন এবং ব্রেক সমৃদ্ধ। সেনাবাহিনী থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েই এরা এসব গাড়ি চালানোর অনুমতি পায়। কিছু দূর গাড়িতে করে যাবার পরই এ কথার মর্ম বুঝা যায়। প্রচণ্ড খাড়া পাহাড় এখানে গাড়ি দিয়ে উঠতে হয়। এত ভয়ংকর খাড়া পাহাড় পার হয়ে যখন বগালেকে পৌঁছাবেন, তখন এর সৌন্দর্যে নিজেকে সার্থক মনে হয়। এখানে নেমেই আগে চেক-ইন করতে হবে।
বগা লেকের আরেক নাম বগাকাইন হ্রদ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১২৪৬ ফুট বা ৩৮০ মিটার উপরে অবস্থিত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উচ্চতার স্বাদু পানির হ্রদ। এর গঠন দেখে একে মৃত আগ্নেয়গিরির মুখের মতো মনে হয়। এর গভীরতা নিয়ে আছে বিভিন্ন মতবিরোধ। কারো মতে, এর গভীরতা কখনো মাপা যায়নি; আবার অনেকের মতে এটি ১২৫ ফুট গভীর। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভূগোল ও পরিবেশ’ বিভাগের অধ্যাপক ড.মো. শহীদুল ইসলাম ২০০৫ সালে প্রথম বগালেকের গভীরতা পরিমাপ করেন। তার দাবি অনুযায়ী, বগালেকের গভীরতা ১১৫ ফুট। এছাড়াও এ লেককে ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন জল্পনা-কল্পনা এবং রহস্য, যা একে আরো রহস্যময় করে তুলেছে।
তবে এখানে বসবাসরত স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, এর উৎপত্তির কিছু তথ্য। কারো মতে, এখানে একটি ড্রাগন বাস করত, যাকে হত্যার কারণে এই বগা লেকের উৎপত্তি। ‘বগা’ শব্দের আরেক অর্থ ‘ড্রাগন’, যা দ্বারা এই ঘটনার অনেকটা মিল পাওয়া যায়। আবার অনেকের মতে, এখানে এক বিরাট সাপ বাস করত, যাকে হত্যার মাধ্যমে এটির উৎপত্তি। বহুকাল ধরে এসব কথা প্রচলিত হয়ে আসছে, যার কারণে বগা লেককে সর্বদা রহস্যে আকর মনে হয়।
স্বাভাবিকত বগা লেকের পানি স্বচ্ছ নীল হলেও তিন থেকে চার বছর পরপর পানি ঘোলা হয়ে যায়। রং অনেকটা কাদামাখা পানির মতো ঘোলাটে লাগে। তিন থেকে চারদিন পানির রং ঘোলাটে থাকার পর ফের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তবে কেন এমন ঘটনা, তা এখনো অজানা। বছরের আবার একটা নির্দিষ্ট সময়ে এর পানি একদম লাল রং ধারণ করে। স্থানীয়রা তখন পবিত্র দিন হিসেবে পালন করে থাকে। আমাদের গাইডের সাথে কথা বলে জানা গেল, কয়েক বছর আগে তিনি এই বগালেক পাড়ায় এসে রাতে গোসল করার জন্য পাড় ধরে বগা লেকে নামেন। তখন তার কাছে মনে হয়েছে, কিছু একটা তার পা পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে এবং নিচের দিকে টানার চেষ্টা করছে। পরে উপরে উঠে এসে সবাইকে ঘটনাটি বললে অনেকেই নাকি বলেছে, এখানে অনেক ধরনের প্রাণী আছে। একটা বদ্ধ জায়গায় এত বছর ধরে পানি জমে থাকলে সেখানে বিভিন্ন উদ্ভিদ জন্মে থাকে, যার কারণে পানিতে নামলে শেকড়, লতায় আটকে যাবার সম্ভাবনা থাকে। তবে প্রকৃতির কিছু রহস্যকে তার মতো করে থাকতে দেওয়া উচিত। প্রকৃতির হয়তো কিছুটা রহস্য পছন্দ।
বগা লেক পাড়ায় বেশ কিছু কটেজ এবং দোকান আছে। এখানে জেনারেটর এবং সোলার প্যানেলের ব্যবস্থাও আছে। খাবারের দাম একটু বেশি হলেও এখানের খাবারের অসাধারণ একটা স্বাদ রয়েছে। রাতে থাকার জন্য কাঠের তৈরি দোতলা কটেজ। রাত ৮ টার পরেই একদম নিরিবিলি জনশূন্য গা ছমছমে একটা পরিবেশ তৈরি হয়ে যায়। তবে আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকেই খোলা চোখে আকাশগঙ্গার ছায়াপথ আর হাজারো তারার অস্তিত্ব দেখতে পাবেন। আজকাল যান্ত্রিক জীবনে এত আকাশ ভরপুর তারা দেখা সত্যিই সৌভাগ্য বলা যায়। রাতের বেলা হিম বাতাস, পাহাড়ের শব্দ আর বিভিন্ন অদ্ভুত সব ডাকে আপনি হারিয়ে যেতে বাধ্য। দিনের তুলনায় রাতের বেলাতেই বগা লেককে আরো বেশি সুন্দর, শান্ত, রহস্যময় মনে হয়। এখান থেকেই পর্যটকরা চাইলে কেওক্রাডং জয় করে আসতে পারেন।
চাইলে বগা লেকে কায়াকিং বোট নিয়েও ঘুরে বেড়াতে পারেন এবং এতে করে এর সৌন্দর্য আরো কাছ থেকে উপভোগ করতে পারবেন। এখানে সেনাবাহিনী সবসময় নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে সতর্ক অবস্থানে থাকে। তাই পানিতে না নামাটাই উচিত। যেকোনো সময় দুর্ঘটনায় মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। সাঁতার না জানলে এর আশেপাশে না যাওয়াই উত্তম। পানিতে কায়াকিং অথবা বোটিং করার সময় লাইফ জ্যাকেট বাধ্যতামূলক। আপনি বগা লেকে যতদিন খুশি থাকতে পারেন। ফিরে আসার সময় আগে চান্দের গাড়িতে করে রুমা বাজার এবং পরে বান্দরবান আসা যায়।
প্রকৃতির রাজ্যে আর আদিম যুগে হারিয়ে যেতে চাইলে বগা লেক আপনার জন্য আদর্শ জায়গা। অল্প পরিশ্রমে পাহাড়, লেক, মেঘের রাজ্যে কাটানোর মতো একটি আদর্শ জায়গা বলা যায় এই বগা লেককে। বগা লেকের সৌন্দর্য, এর রহস্যময়তার জন্য ভ্রমণপিয়াসী মন বারবার এখানে ছুটে আসতে বাধ্য।