আল্পসের গাঁ ঘেঁষে ইউরোপের দক্ষিণে বয়ে চলেছে সুদীর্ঘ কনস্ট্যান্স হ্রদ। এই হ্রদের একদিকে আল্পসের পাহাড় আর বাকি তিনদিক জুড়ে আছে সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও জার্মানির এক বিস্তৃত অঞ্চল। এই কনস্ট্যান্স লেকের পূর্ব দিকের বিস্তৃত জলরাশির মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোট্ট এক দ্বীপ লিন্ডাউ। দ্বীপটি জার্মানির বাভারিয়া প্রদেশে অবস্থিত।
দ্বীপটির অজানা ইতিহাস
৮৮২ খ্রিস্টাব্দে সেন্ট গ্যালনের এক পাদ্রী তার একটি লেখায় সর্বপ্রথম লিন্ডাউয়ের কথা উল্লেখ করেন। প্রথম শতকে রোমান অধিবাসীরা দ্বীপটিতে প্রথম বসতি স্থাপন করেন। ১১৮০ সালে এই দ্বীপের সবচেয়ে পুরনো গির্জা সেন্ট স্টিফেন চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১২২৪ সালে এই দ্বীপে প্রথম একটি মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১২৭৫-৭৬ সালে সম্রাট রুডল্ফ (প্রথম) তার রাজত্বকালে লিন্ডাউকে ইম্পেরিয়াল ফ্রি সিটি বলে ঘোষণা করেন। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৮০২ সালে লিন্ডাউ তার এ মর্যাদা হারিয়ে ফেলে।
এই সময় লিন্ডাউ অস্ট্রিয়া রাজ্যের অধীনে চলে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স দ্বীপটিকে করায়ত্ত্ব করে। এরপর বহু উত্থান-পতন আর ক্ষমতার পালাবদলের পর ১৯৫৫ সালে লিন্ডাউ জার্মানির বাভারিয়া প্রদেশের সাথে পুনরায় যুক্ত হয়।
আপন সৌন্দর্য ও স্বকীয়তায় উজ্জ্বল লিন্ডাউ
প্রতিটি দ্বীপেরই তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য থাকে। লিন্ডাউ দ্বীপটিও তেমন। ছোট হলেও বেশ ছিমছাম আর আকর্ষণীয়। ৩,৪০০ হেক্টরের ছোট্ট এই দ্বীপটিতে লোকসংখ্যা প্রায় পঁচিশ হাজার। দ্বীপের একদিকে কনস্ট্যান্স লেকের তীর ঘেঁষে বিরাট এক সিংহের স্ট্যাচু নীরব প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। এই সিংহ বাভারিয়ার অন্যতম প্রতীক। বিখ্যাত ভাস্কর য়োহ্যান ভন হ্যালবিগের এটি অন্যতম সৃষ্টি। দ্বীপের অন্যদিকে হাজারো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দন্ডায়মান ৩৩ মিটার উঁচু লাইটহাউজ। ১৮৫৩-৫৬ সালের মধ্যে এটি নির্মিত হয়। এটি বাভারিয়া অঞ্চলের একমাত্র লাইটহাউজ।
টিকিট কেটে লাইটহাউজের ওপরে ওঠা যায়। লাইটহাউজের ওপর থেকে দেখা লেক আর চারদিকের দৃশ্য এককথায় অতুলনীয়। দ্বীপটির পশ্চিমপ্রান্তে ১৫০৮ সালে তৈরি পাউডার টাওয়ারটি প্রতিরক্ষা টাওয়ার হিসেবে একসময় ব্যবহৃত হতো। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত দুর্গটিতে প্রতিরক্ষা কাজে ব্যবহৃত গোলাবারুদ মজুদ রাখার ব্যবস্থা ছিল।
উনবিংশ শতকে দুর্গটি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বর্তমানে দুর্গটি সভা এবং নানা সামাজিক অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য ভাড়া দেয়া হয়ে থাকে। দ্বীপটির আরও একটি দর্শনীয় স্থান হচ্ছে ম্যাগনাম টাওয়ার। দ্বাদশ শতকে তৈরি ২০ মিটার লম্বা দুর্গটি মধ্যযুগের এক অনন্য নিদর্শন।
লিন্ডাউয়ের শতাব্দী প্রাচীন বন্দর নিউ হার্বার পোর্ট এখানকার প্রধান দর্শনীয় স্থানগুলোর একটি। ১৮৫৩ সালে বন্দরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আর তার সাথে তৈরি হয় রেলওয়ে ব্রিজ। লেকের পাশে সুন্দর হেঁটে চলার পথ রয়েছে, যা ধরে ঘুরে আসা যায় অনেক দূর।
আলোর ফোয়ারায় উজ্জ্বল এক দ্বীপ
ইউরোপে প্রতিনিয়ত মেঘ-রোদের খেলা চলে। আলোকোজ্জ্বল সকালের কিছু মুহূর্ত পরেই দেখা যায় মেঘের আনাগোনা। এই রোদ, তো এই বৃষ্টি। আবহাওয়া কখন কী রূপ নেবে, তা আগে থেকে বলা প্রায় অসম্ভব। তারপরও এই দ্বীপের আবহাওয়া বেশ উপভোগ্য। সূর্য অস্ত গিয়ে একটু সন্ধ্যা নেমে আসতেই হার্বারের আলো জ্বলে ওঠে। তখন চারদিকে যেন আলোর ফোয়ারা ছুটতে থাকে। গাছ, ফুল, সমুদ্রের জলরাশি আর আকাশ সব হয়ে ওঠে যেন উৎসবে মাতোয়ারা। আলোর ছোঁয়া লেগেছে সযত্নে নতুন-করা প্রাচীন ইমারতের দেওয়ালগুলোতেও।
প্রাচীন ঐতিহ্যের এক শহর
লিন্ডাউ দ্বীপকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শহরটি বেশ প্রাচীন এবং ঐতিহ্যময়। রোমান যুগের পাথরে তৈরি রাস্তা। পথের দু’ধারে বাগানওয়ালা বাড়ি, চার্চ, মিউজিয়াম আর পার্ক। সেখানে নানা রঙের ফুলের মেলা। দ্বীপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে ওল্ড টাউন হল। পঞ্চদশ শতকের তৈরী প্রাচীন রোমান ঐতিহ্য ও স্থাপত্যের নিদর্শন বহন করে চলেছে এই স্থানটি। রোমান যুগের তৈরি লম্বা ধাঁচের ইট দিয়ে বাঁধানো সরু সরু রাস্তা, পথের দু’ধারে নানা ঐতিহাসিক দালান, যার বেশিরভাগই সযত্নে সংরক্ষিত।
এরই মধ্যে রয়েছে পুলভার্টার্ম আর ডিয়েবস্টার্ম, যা প্রাচীন লিন্ডাউয়ের নগর-প্রাচীরের অংশ ছিল। পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কয়েকটি পুরনো চার্চের দেখা পাওয়া যায়। একটু পর পর চোখে পড়বে ছোট ছোট পার্ক। সেখানে ফুটে রয়েছে নানা রঙের ফুল। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কোলাহলে পার্কগুলো মুখরিত। দূর থেকে হয়তো ভেসে আসবে পাখিদের কলরব। শহরটিতে যেন শান্ত আর সুন্দর একটি পরিচ্ছন্ন পরিবেশ সব সময় বিরাজমান।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক শহর
দ্বীপের আরও একটি আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে লিন্ডাউ সিটি মিউজিয়াম। বিভিন্ন সময়ের অপূর্ব সব ভাস্কর্য আর চিত্রকর্মের এক আশ্চর্য সংগ্রহশালা রয়েছে এখানে। মিউজিয়ামের আরেকটি অন্যতম আকর্ষণ বহু রকমের আসবাবপত্র। গথিক পিরিয়ড থেকে শুরু করে বারোক পিরিয়ডের নানা ধাঁচের আবসবাবপত্র দিয়ে সাজানো এই জাদুঘরের বিভিন্ন তলা। এর মধ্য দিয়ে অষ্টাদশ এবং উনিশ শতকে এই অঞ্চলে বসবাসরত ধনী শ্রেণীর রুচি আর আর্থিক সামর্থ্য সম্পর্কে একধরনের ধারণা পাওয়া যায়।
এছাড়াও জাদুঘরটি নানা রকমারি জিনিসের সম্ভারে পরিপূর্ণ। এখানে রয়েছে রুপা, ব্রোঞ্জ, তামা, পিতল আর টিনের তৈরি প্রাচীনকালের ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র, তেমনি কাঁচ আর সিরামিকের নানা শৌখিন জিনিসের সম্ভার, যেমন- রকমারি পুরনো দিনের খেলনা। এখানে বিভিন্ন সময়ে চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়ে থাকে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যপূর্ণ এই শহরে রয়েছে লিন্ডাউ থিয়েটার হল। স্থানীয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দল নিয়মিতভাবে এখানে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এখানকার লিন্ডাউ পাপেট অপেরা এই অঞ্চলের বাইরেও ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছে।
প্রতি সপ্তাহে বসে বিকিকিনির বিশেষ হাট
দ্বীপটিতে সপ্তাহে একদিন, বিশেষ করে শনিবার আমাদের গ্রামাঞ্চলের মতোই বিশেষ হাট বসে। সেই হাটে দূরের গ্রাম আর শহরতলি থেকে বহু লোক স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন নানা জিনিসের পসরা নিয়ে আসেন। নিজের নিজের পসরা সাজিয়ে খদ্দেরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন তারা। নিজেদের সবজি বাগান থেকে সদ্য তোলা তাজা ফল আর সবজি, ডিম, মাখন, চিজ আরও কত কী! কেউ কেউ নিয়ে আসেন নিজেদের হাতে বোনা স্কার্ফ, সোয়েটার, টুপি আর রকমারি জামাকাপড়। সপ্তাহে বসা এই হাট যেন এখানকার অধিবাসীদের প্রাণ।
দ্বীপের চারপাশে হাতছানি দেয়া অতুল ঐশ্বর্যের কনস্ট্যান্স লেক
লিন্ডাউ দ্বীপে আসা ভ্রমণার্থীদের কাছে এক সুবর্ণ সুযোগ কনস্ট্যান্স লেকের অপার সৌন্দর্য উপভোগের। ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির হ্রদ এই কনস্ট্যান্স লেক, যার দৈর্ঘ্য ৫৪০ বর্গ কিলোমিটার। বহু যুগ আগে বরফ যুগের সময় রাইন গ্লেসিয়ার থেকে এই লেকের জন্ম। এটি জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, এবং অস্ট্রিয়ার এক বিশাল প্রান্ত জুড়ে বয়ে চলছে।
জার্মানির ৭৩ কি.মি, অস্ট্রিয়ার ২৮ কি.মি এবং সুইজারল্যান্ডের ৭২ কি.মি সীমান্ত জুড়ে বিস্তৃত এই লেক। ১৪ কি.মি চওড়া এই লেকের পানি দক্ষিণ জার্মানির অনেক শহরে পানীয় জলের অভাব পূরণ করে থাকে। স্থানীয় লোকেরা একে বলে থাকে সোয়াবিয়েনসি। লেকের তিনটি ভাগের তিনটি আলাদা নাম। ওপরের ভাগকে বলে ওবেরসি বা আপার লেক, আর নিচের দিকটি হলো উন্টেরসি বা লোয়ার লেক। এই দুটিকে জুড়ে দিয়েছে রাইন নদী, যার নাম সিয়ারহিন।
প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক পর্যটক এই লেকে নৌ-ভ্রমণে আসেন। লিন্ডাউ দ্বীপটি কনস্ট্যান্স লেকের পূর্বদিকে অবস্থিত। দ্বীপের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো এবং পর্যটকদের জন্য সুব্যবস্থা থাকায় বেশিরভাগ পর্যটকই কনস্ট্যান্স লেকে নৌবিহারের জন্য এই দ্বীপটিকেই বেছে নেন। ফলে লেকে নৌ ভ্রমণের সাথে সাথে দ্বীপের অপার ঐশ্বর্য দেখতে প্রতি বছর বহু পর্যটকই ভিড় করেন লিন্ডাউ দ্বীপে।