আয়নায় হাতের ছাপ, সিঁড়িতে সদ্য হেঁটে যাওয়া মানুষের পদচিহ্ন, বাতাসে ভেসে বেড়ানো অদ্ভুত গন্ধ, জিনিসপত্র হঠাৎ করে গায়েব হয়ে যাওয়া, বিষ প্রয়োগে চাকর কর্তৃক গৃহকর্ত্রী খুন, ঝুলন্ত লাশ, গুলির আওয়াজ- ভাবছেন রগরগে কোনো হরর সিনেমার সম্ভাব্য সব উপাদান নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে? মোটেই না, বরং এই প্রত্যেকটি ঘটনা ঘটেছে আর প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে লুইজিয়ানার সেইন্ট ফ্র্যান্সিসভ্যালির মার্টলস প্ল্যান্টেশনে। বলা হয়, পুরো আমেরিকা জুড়ে এমন ভুতুড়ে বাড়ির অস্তিত্ব দ্বিতীয়টি নেই। ভূত বা ভূতুড়ে কিছু শুনলেই যারা এক ভ্রু উঁচু করে ঘটনাটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন, তারাও এই বাড়িটির ইতিহাস শুনলে চমকে যাবেন।
বলা হয়, টিউনিকা ইন্ডিয়ানদের একটি গোরস্তানের ওপর নির্মিত হয়েছে মার্টলস প্ল্যান্টেশন। বর্তমানে অবশ্য এখানে বেড এবং ব্রেড সার্ভিস প্রচলিত আছে। অর্থাৎ ১১৫ ডলার খরচ করে এক রাত থেকে পরদিন সকালে নাস্তা করে, আবার নিজ ভুবনে ফিরে যেতে পারবেন আপনি। অবশ্য যদি সে রাত আপনার ঠিকমতো কাটে, তবেই না সকালের চিন্তা! ঐতিহাসিক দিক থেকেই বাড়িটির ভৌতিক বদনাম আছে। সে বাড়িতে নাকি ১২টি প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়ায় প্রতিনিয়ত, কম করে হলেও দশটি খুন সংঘটিত হয়েছে সেখানে!
তবে রেকর্ড অনুযায়ী, প্ল্যান্টেশনের বাড়িটিতে খুন হয়েছেন শুধু উইলিয়াম উইন্টার। প্ল্যান্টেশনের বেশ উল্লেখযোগ্য চরিত্র উইলিয়াম ড্রিউ উইন্টার। ১৮৬৫ থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত অ্যাটর্নি হিসেবে ঐ বাড়িতে বসবাস করতেন তিনি। এক আগন্তুকের গুলিতে প্রাণ হারান তিনি। গুলির আঘাতে জর্জরিত শরীর নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলেন উইন্টার। কিন্তু ১৭তম সিঁড়িতে ওঠার পরই প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায় বেচারার। গড়াতে গড়াতে নিচে এসে পড়ে তার মৃতদেহ। আজ পর্যন্ত, দর্শনার্থী কিংবা বাড়ির চাকররা নাকি রাতের বেলা মারা যাওয়ার আগ মুহূর্তে তার ইতস্তত পায়ের আওয়াজ শুনতে পান।
১৭৯৬ সালে প্রায় ৬০০ একর জমির উপরে মার্টলস প্ল্যান্টেশন নির্মাণ করেন জেনারেল ডেভিড ব্র্যাডফোর্ড। তখন অবশ্য বাড়িটার নাম ছিল ‘লরেল গ্রোভ’। বেশ কয়েক বছর ধরে বাড়িটিতে একাই বসবাস করতেন ব্র্যাডফোর্ড। ১৭৯৯ সালে পেনিসিলভেনিয়ার হুইস্কি বিপ্লবে সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার পর, তিনি স্ত্রী এলিজাবেথ এবং পাঁচ সন্তানকেও এখানে নিয়ে আসেন। ১৮০৮ সালে ব্র্যাডফোর্ডের মৃত্যু হলে তার স্ত্রী ১৮১৭ সাল পর্যন্ত একাই পুরো বাড়িটি দেখাশোনা করতেন। পরবর্তীতে তিনি প্ল্যান্টেশনের যাবতীয় দেখভালের দায়িত্ব ক্লার্ক উডরাফের হাতে অর্পণ করেন। উডরাফ ছিলেন ব্র্যাডফোর্ডের আইন বিষয়ের ছাত্র এবং তাদের কন্যা সারাহ ম্যাথিল্ডার স্বামী। উডরাফদের ঘর আলো করে আসে তিনটি সন্তান- কর্নেলিয়া গেইল, জেমস এবং ম্যারি অক্ট্যাভিয়া। ১৮২৩ এবং ১৮২৪ সালে সারাহ ও তার দুই সন্তান বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এই বিষক্রিয়ার সাথে মিশে আছে প্ল্যান্টেশনের ভৌতিক কাহিনীর বীজ।
১৮৩১ সালে এলিজাবেথ ব্র্যাডফোর্ড যখন মারা যান, তখন ক্লার্ক উডরাফ তার একমাত্র জীবিত সন্তান ম্যারি অক্টাভিয়াকে নিয়ে লুসিয়ানায় চলে আসেন। প্ল্যান্টেশনের দেখাশোনার জন্য তিনি একজন কেয়ারটেকার নিযুক্ত করেন। তিন বছর পরে, উডরাফ সেই বাড়ি, জমি এবং আনুষাঙ্গিক সবকিছু রাফিন গ্রে স্টার্লিংয়ের কাছে বিক্রি করে দেন। স্টার্লিং এবং তার স্ত্রী মেরি ক্যাথরিন কব পুরো বাড়িটি একদম নতুন করে সাজান। বাড়িটির জায়গা বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করে ফেলেন তারা, ঘরের আসবাবপত্র নিয়ে আসা হয় ইউরোপ থেকে। বাড়ির আশেপাশের জমিতে ক্রপ মার্টলস নামক এক ধরনের উদ্ভিদের আধিক্যের কারণে বাড়িটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘দ্য মার্টলস’। ১৮৫৪ সালে স্টার্লিংয়ের মৃত্যুর পর প্ল্যান্টেশনের দায়িত্ব পান তার স্ত্রী।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সাক্ষী এই দ্য মার্টলস। যুদ্ধের সময় ঘরবাড়িতে যে হারে লুটতরাজ শুরু হয়, তা প্রতিহত করতে ১৮৬৫ সালে ম্যারি কব উইলিয়াম ড্রিউ উইন্টারকে তার উকিল এবং প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে স্টার্লিংয়ের মেয়ে সারাহর সাথে বিয়ে হয় উইন্টারের। সারাহ এবং উইন্টারের সংসারে জন্ম নেয় ছয় সন্তান, যাদের মধ্যে কেট উইন্টার তিন বছর বয়সেই টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। যুদ্ধের পরে পরিবারটির আর্থিক অবস্থার এতটাই অবনতি হয় যে, ১৮৬৮ সালে তারা প্ল্যান্টেশন বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। দু’ বছরের মধ্যেই অবশ্য বাড়িটি পুনরায় ফিরে পায় তারা। ১৮৭১ সালে উইলিয়াম হান্টার কীভাবে মারা যান, তা শুরুতেই বলা হয়েছে। খুব সম্ভবত তার খুনির নামই এস ওয়েবার। ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত মা এবং সন্তানদের নিয়ে প্ল্যান্টেশনেই থাকেন ম্যারি। বছর দুয়েক পরে ম্যারির মৃত্যু হলে, বাড়িটির মালিক হন তার ছেলে স্টিফেন। ততদিনে বেশ বড় অঙ্কের ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে পড়ে প্ল্যান্টেশন। ১৮৮৬ সালে বাধ্য হয়ে স্টিফেন এটি বিক্রি করে দেয় ওরান ডি ব্রুকসের কাছে। ব্রুকস আবার তিন বছরের মধ্যে বাড়িটি বিক্রি করে দেন আরেকজনের কাছে। এভাবে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকবার হাত বদল হয় মার্টলস প্ল্যান্টেশন। এরপর বাড়িটির মালিকানা লাভ করেন হ্যারিসন মিল্টন উইলিয়ামস।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে হ্যারিসনের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায় বাড়িটি। ১৯৫০ সালে মারজো মুনসন বাড়িটি ক্রয় করেন, প্রথমবারের মতো তিনিই বাড়িটিকে ঘিরে অশরীরী কোনো কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করেন। এরপর আরও কয়েকবার হাতবদল হয় প্ল্যান্টেশনটি, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কেউই বেশিদিন টিকতে পারছিলেন না সেখানে। দুর্ভাগ্য, ভয়, আতঙ্ক তাদের গ্রাস করে ফেলে, বাধ্য হয়ে বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যান তারা। ১৯৭০ সালে ফ্রান্সেস কারমিন মায়ার্স বাড়িটিকে ‘বেড এন্ড ব্রেকফাস্ট’ পদ্ধতিতে পরিচালনা করেন। এই সুদীর্ঘ সময় ধরে বাড়িটিতে ঘটে যাওয়া নানা দুর্ঘটনা নিয়ে একটি বই লিখে ফেলেন ফ্রান্সেস।
এবার আসা যাক মার্টলসের ভৌতিক ঘটনাগুলোর প্রসঙ্গে। মার্টলসের অন্যতম বিখ্যাত প্রেতাত্মা ক্লোয়ি, সারাহ উডরাফের চাকর ছিল সে। জানা যায়, সারাহর স্বামী ক্লার্ক ক্লোয়িকে তার আশ্রিতা হতে বাধ্য করে। মতান্তরে, ক্লোয়ি ক্লার্কের ব্যবসায়িক কথাবার্তা আড়ি পেতে শোনার সময় সারাহ ও ক্লার্কের কাছে ধরা পড়ে। শাস্তিস্বরূপ, ক্লোয়ির একটি কান কেটে নেন এই দম্পতি। সবুজ একটি মাস্ক পরে সেই কাটা কানের জায়গাটি ঢেকে রাখত ক্লোয়ি। এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে অলিন্ডার গাছের পাতা দিয়ে একটি জন্মদিনের কেক তৈরি করে ক্লোয়ি। প্রসঙ্গত, অলিন্ডার গাছের পাতা ফুটালে তা প্রচণ্ড বিষাক্ত একটি পদার্থে পরিণত হয়। আশ্রিতার পদ থেকে গৃহকর্ত্রী হওয়ার জন্যও সে এমনটা করতে পারে বলে প্রথম মতে বিশ্বাসীরা দাবি করেন। সারাহ এবং তার দুই সন্তান ঐ কেক খান। শুরুতে যে বিষক্রিয়ার ফলে সারাহদের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছিল, সেটি মূলত ক্লোয়ির চক্রান্ত ছিল। ঘটনা টের পেয়ে বাড়ির বাকি চাকররা মিলে ক্লোয়িকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরে ফেলে এবং তার মৃতদেহ মিসিসিপি নদীতে ফেলে দিয়ে আসে। কানে সবুজ মাস্ক পরিহিত এক নারী প্ল্যান্টশনে এখনো ঘুরে বেড়ায়- এ কথা মোটামুটি সর্বজনবিদিত।
এছাড়াও মার্টলসের কিংবদন্তী আত্মাদের নিয়ে আরও অনেক ঘটনা প্রচলিত আছে। টিউনিকা ইন্ডিয়ানদের গোরস্তানের উপর নির্মিত এই প্ল্যান্টেশনে এক ইন্ডিয়ান তরুণীর আত্মাকে দেখা যায় বলে জানান রাতের বেলা থাকতে যাওয়া অতিথিরা। গৃহযুদ্ধের সময় ইউনিয়নের সৈন্যরা বাড়িজুড়ে তোলপাড় চালায়। সেসময়, ঐ বাড়িটিতেই তিনজনকে মেরে ফেলা হয় বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। আর বর্তমানে প্রায় সময়ই খালি পড়ে থাকা বাড়িটি যে দুর্বৃত্তদের জন্য অভয়াশ্রম হয়ে উঠেছে, তা বলাই বাহুল্য। প্ল্যান্টেশনের দরজার চৌকাঠে একটি রক্তের দাগ আছে। মানুষের আকৃতির সে রক্তের দাগ কেউ মুছতে পারে না। ঐ জায়গাটিতে নাকি পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ঝাড়ু বা কাপড় নাড়াতেই পারেন না।
প্ল্যান্টেশনের অন্যতম ভৌতিক একটি জিনিস এখানকার একটি আয়না। বলা হয়, এই আয়না সারাহ উডরাফ এবং তার মৃত দুই সন্তানের আত্মাকে কব্জা করে রেখেছে। তৎকালীন রীতি অনুযায়ী, কেউ মারা গেলে বাড়ির সমস্ত আয়না সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো, যাতে আত্মারা কোথাও আটকে না যায়। কিন্তু সারাহদের মৃত্যুর পর ভুলবশত একটি আয়না ঢাকেনি চাকররা। খোলা সেই আয়না সারাহ এবং তার সন্তানদের নিজের ফাঁদে আটকে ফেলে। আয়নায় এখনো নাকি মাঝে মাঝে ছোট বাচ্চাদের দেখা যায় বলে কেউ কেউ দাবি করে, ছোট ছোট আঙুলের ছাপ পড়ে থাকে।
প্ল্যান্টেশনের অনবদ্য ভূতদের তালিকায় আরেকটি নাম প্রায়ই ঘুরেফিরে আসে। ১৮৬৮ সালে এই বাড়ির একটি কক্ষে মেরে ফেলা হয় তাকে। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ভুডুর সহায়তা নিয়ে তাকে নৃশংসভাবে মেরে ফেলে স্থানীয় এক প্রেমিক পুরুষ। জানা যায়, যে কক্ষে তাকে মেরে ফেলা হয়, সেখানে যারা ঘুমাতে আসে তাদের উপর ভুডুর বিভিন্ন মারপ্যাঁচ চালায় মেয়েটি। আরেক প্রেতাত্মা আবার সিঁড়ির ঠিক সতেরতম ধাপে হেঁটে বেড়ায়, হামাগুড়ি দেয় বলে উল্লেখ করেছেন এখানে রাত কাটাতে আসা ব্যক্তিরা। অনেকের ধারণা, এটি উইলিয়াম হান্টার ছাড়া আর কেউ নন। আগন্তুকের গুলিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার পূর্ব মুহূর্তে সতেরতম সিঁড়িতেই স্ত্রীর কোলে মাথা রাখেন তিনি। সতেরতম সিঁড়িটি তাই এই বাড়িতে বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে।
২০১৪ সালে একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে মূল বাড়িটির ঠিক দশ গজ দূরে। সৌভাগ্যবশত প্ল্যান্টেশনের তাতে কিছুই হয়নি। বর্তমানে এটি আমেরিকার জাতীয় ঐতিহাসিক স্থানসমূহের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। লোকের মুখে মুখে প্রচলিত আছে বাড়িটির আধিভৌতিক কাহিনীগুলো। অসংখ্য বই, ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র আর টেলিভিশন শোতে বলা হয়েছে মার্টলস প্ল্যান্টেশনের কথা। আনসলভড মিস্ট্রি, ঘোস্ট হান্টার, ঘোস্ট অ্যাডভেঞ্চারের মতো বিভিন্ন টেলিভিশন সিরিজের কয়েকটি এপিসোড এখানে ধারণ করা হয়, কলাকুশলীরা কাজের সময় নানা ধরনের কারিগরি ত্রুটি এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন বলে জানান। যারাই এখানে রাত কাটাতে এসেছেন, তারা বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে গেছেন বলে জানা গেছে। অনেকে আবার নাকি স্নায়ুর উপরে অতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে না পেরে অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন। সে যা-ই হোক, ভুতুড়ে এই বাড়িটি দেখার লোভ থাকলে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন সেখান থেকে।