পাতাল ফেড়ে নামব আমি
উঠব আমি আকাশ ফুঁড়ে,
বিশ্বজগৎ দেখব আমি
আপন হাতের মুঠোয় পুরে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই কবিতা পড়েই হোক আর না পড়েই হোক, ৬ জানুয়ারি ২০০৪ সালে দুবাইয়ে আক্ষরিক অর্থেই আকাশ ফুঁড়ে ওঠার কাজ শুরু হয়! পাতাল ফুঁড়ে বেরিয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে উঠতে একসময় মেঘেদের রাজ্যে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় পৃথিবীর উচ্চতম স্থাপনা। ছয় বছর পূর্ণ হবার ঠিক দু’দিন পূর্বে ৪ জানুয়ারি ২০১০ সালে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৮২৮ মিটার (এন্টেনা সহ ৮২৯.৮ মিটার) উপরে গিয়ে নিজের যাত্রা শেষ করে দুবাইয়ের ভুবনখ্যাত আকাশচুম্বী অট্টালিকা ‘বুর্জ খলিফা’। ভূমি ছেড়ে এটি এতোই উপরে উঠেছে যে, সূর্যাস্তের পরও ভবনের উপরতলার লোকজন আরো দু’মিনিট ধরে দেখতে পায় সূর্যটাকে! ফলে রমজান মাসে দুবাইয়ের ভূমিতে মুসল্লিরা যখন ইফতার শুরু করেন, ৮০ তলার উপরে বসবাসরত মানুষজন ইফতার করেন তার দুই মিনিট পর!
দুবাইয়ের সরকার তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে। সরকারের লক্ষ্য ছিল দেশের অর্থনীতিতে সেবা ও ভ্রমণের প্রভাব বাড়ানো। বুর্জ খলিফার টাওয়ার ছিল সেই পরিকল্পনার একটি অংশ। এই সুবিশাল অট্টালিকাটি তৈরি করা হয় একাধিক কাজে ব্যবহারের জন্য। প্রাথমিকভাবে ভবনের নকশায় যুক্ত করা হয় ১৯টি হোটেল, ৯টি আবাসিক টাওয়ার, ৩০ হাজার ঘর, ৭.৫ একর পার্ক, ১২ একর কৃত্রিম লেক এবং দুবাই মল। উদ্বোধনের আগ পর্যন্ত এর নাম ছিল ‘বুর্জ দুবাই’। পরবর্তীতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সম্মানে এর নামকরণ করা হয় বুর্জ খলিফা। তবে বুর্জ খলিফা নির্মাণকালীন অর্থ সংকটে পড়েছিল দুবাই। ২০০০ সালে অর্থনীতি বহুমুখীকরণ শুরু করার পর দুবাই ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নিয়েছিল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশের কাছে। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৭-১০ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক সংকটে ছিল দেশটি।
দুবাইয়ের মূল বাণিজ্যিক শহর ‘ডাউনটাউন দুবাই’ এর শেখ জায়েদ রোডে তৈরি হয় পৃথিবীর উচ্চতম ভবন বুর্জ খলিফা। ভবনের প্রধান স্থপতি ছিলেন আদ্রিয়ান স্মিথ। বিল বেকার ছিলেন প্রধান নির্মাণ প্রকৌশলী আর সকল প্রকার প্রকৌশলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সুফিয়ান আল জাবিরি। আর ভবন নির্মাণের দায়িত্ব পায় ‘এসওএম’ বা স্কিডমোর, ওয়িংস অ্যান্ড মেরিল নামক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান বুর্জ খলিফার আগে সিয়ার্স টাওয়ারের মতো গগণচুম্বী অট্টালিকা তৈরি করেছিল। বুর্জ খলিফায় বাংলাদেশি স্থপতি ফজলুর রহমান খান কর্তৃক আবিস্কৃত ‘বান্ডেলড টিউব’ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যা তিনি সিয়ার্স টাওয়ার তৈরির সময় আবিস্কার করেছিলেন। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের চেয়ে উচ্চতায় প্রায় দ্বিগুণ হয়েও বুর্জ খলিফা টাওয়ার নির্মাণে মোট ব্যবহৃত লোহার পরিমাণ ছিল পূর্বতন ভবনটির অর্ধেক! সুবিশাল এই ভবন নির্মাণে লোহা ব্যবহৃত হয় মাত্র ৪ হাজার টন। এটি সম্ভব হয় ফজলুর রহমান খানের আবিস্কৃত পদ্ধতির জন্য।
ভবনের মূল নকশা ইসলামিক নির্মাণশৈলি থেকে উদ্ভূত। ইরাকের সামারায় অবস্থিত নবম শতকে তৈরি একটি মসজিদের সর্পিলাকার মিনার থেকেই বুর্জ খলিফার সর্পিল নকশা অনুপ্রাণিত হয়েছে। ভবনটি যতই উপরের দিকে গিয়েছে, এর সাথে সংযুক্ত এক একটি টাওয়ার মোট ২৭টি ধাপে শেষ হয়েছে এবং মধ্যভাগের কেন্দ্রীয় টাওয়ারটি উঠে গেছে ৮২৮ মিটার উচ্চতায়। আর এর চারপাশ ঘিরে তৈরি হয়েছে একটি সর্পিলাকার আকৃতি। ধাপে ধাপে টাওয়ারগুলো শেষ হওয়ায় তাদের উপর তৈরি হয়েছে মনোরম ছাদ। তবে এই সর্পিল ধাপগুলোর মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। ধাপগুলোকে এমনভাবে সজ্জিত করা হয়েছে, যেন সেগুলো মরুভূমির ঘূর্ণিবায়ু সহনশীল হয়। তবে ‘কাউন্সিল অব টল বিল্ডিংস অ্যান্ড আরবান হ্যাবিটেন্ট’ এর সমীক্ষায় উঠে এসেছে একটি মজাদার তথ্য। তাদের মতে, বুর্জ খলিফার মূল উচ্চতা ৫৮৫ মিটার। অবশিষ্ট ২৪৪ মিটার হলো ভবনের চূড়ায় যে স্পায়ার বা কুণ্ডলী সৃষ্টি করা হয়েছে, তার উচ্চতা। এই অংশটি নিষ্প্রয়োজনীয় এবং তা বাদ দিলেও বুর্জ খলিফার ব্যবহারযোগ্য স্থান কমবে না।
পুরো বুর্জ খলিফা টাওয়ারকে বাছাইকৃত বিখ্যাত ১০০০ চিত্রকর্ম দিয়ে সাজানো হয়। আবাসিক লবিগুলো সাজানো হয় প্রখ্যাত স্প্যানিশ চিত্রকর এবং ভাস্কর হাউমি প্লেঞ্জার চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্য দিয়ে। পুরো ভবনের ১ লক্ষ ৭৪ হাজার বর্গ মিটার দেয়াল জুড়ে রয়েছে বিশালাকায় ২৬ হাজার শক্ত প্রতিসারক কাঁচ এবং অ্যালুমিনিয়ামের রংবেরঙের পাত। এসব কাঁচ অন্যান্য সাধারণ কাঁচের মতো নয় মোটেও। এগুলো তাপ কুপরিবাহী। ফলে ভবনের ভেতরে আলো প্রবেশ করলেও বাইরের প্রখর তাপমাত্রা দ্বারা ভেতরের পরিবেশ প্রভাবিত হয় না। আবার কাঁচগুলো সোলার প্যানেল হিসেবেও কাজ করে। ফলে সারাদিনের প্রখর রৌদ্রে বেশ ভালো পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। তবে এই কাঁচ যে কেবল সূর্যের তেজ থেকেই রক্ষা করে তা কিন্তু নয়। বুর্জ খলিফার চূড়ার দিকে বাইরের তাপমাত্রা থাকে মাত্র ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এক্ষেত্রে শীত নিরোধক হিসেবেও কাজ করে এই কাঁচগুলো।
বুর্জ খলিফার প্রথম ৪০ তলার মধ্যে ১৫টি ফ্লোরই রয়েছে চারটি আরমানি হোটেলের দখলে। ৫০-১০৮ তলার মধ্যে রয়েছে ৯০০টি বিক্রয়যোগ্য অ্যাপার্টমেন্ট। তবে বিক্রয়যোগ্য শুনেই ভাববেন না যেন আপনি সেগুলো কিনতে পারবেন। বুর্জ খলিফা উদ্বোধনের মাত্র আট ঘণ্টার মধ্যেই যে সেগুলো বিক্রি হয়ে গিয়েছিল! ৭৬ তলায় রয়েছে একটি বিশাল ‘বিচ এন্ট্রি সুইমিং পুল’। এ ধরনের পুলে কোনো সিঁড়ি থাকে না, সমুদ্র তীরের মতোই যত সামনে যাওয়া যায়, তত গভীর এবং ঢালু হতে থাকে এই পুলগুলো। অনুরূপ একটি সুইমিং পুল রয়েছে ৪৩ তলায়ও, যা আকারে ছোট। ১২২-২৪ তলায় রয়েছে ‘অ্যাট.মসফিয়ার’ স্কাই রেস্টুরেন্ট যা পৃথিবীর উচ্চতম রেস্টুরেন্টও বটে। এসবের বাইরে অধিকাংশ স্থানই কর্পোরেট অফিস ও আবাসিক স্যুটের দখলে। ১৬০ তলা বুর্জ খলিফায় মোট ২,৯০৯টি সিঁড়ি আছে। রয়েছে ৫৭টি ডাবল-ডেক এলিভেটর বা লিফট এবং আটটি এস্কেলেটর। এলিভেটরগুলোর প্রতি কেবিনে ১২ থেকে ১৪ জন মানুষ পরিবহন করতে পারে, এগুলো ১০ মিটার/সেকেন্ড গতিতে ওঠানামা করে, রয়েছে এলসিডি টিভি ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা।
পুরো বুর্জ খলিফায় প্রতিদিন গড়ে সাড়ে নয় লক্ষ লিটার পানির প্রয়োজন হয়, যা ১০০ কিলোমিটার পাইপের মধ্য দিয়ে সরবরাহ করা হয়। আরো ২০০ কিলোমিটার পাইপ জালের মতো ছড়িয়ে আছে পুরো ভবনে, জরুরী অবস্থায় আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য। অন্যদিকে এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেমের জন্য কনডেন্সেট উপায়ে পানি সরবরাহের জন্য রয়েছে আরো বাড়তি ৪৬ কিলোমিটার পাইপ। কুলিং সিস্টেমের বাতাস পুরোটাই আসে বুর্জ খলিফার ১০০ তলার উপর থেকে, যেখানে আবহাওয়া অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা এবং বাতাস যথেষ্ট ধুলিমুক্ত। প্রতিদিন বুর্জ খলিফার কুলিং সিস্টেম দ্বারা উৎপন্ন তাপ প্রায় ১,৩০০ টন বরফ গলনের উৎপন্ন তাপের সমান! ভবনের মোট ২৪,৩৪৮টি জানালা পরিস্কার করার জন্যও রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা।
মরুর বুকে ঝর্ণা দেখতে চাইলে যেতে হবে বুর্জ খলিফায়। হোক না কৃত্রিম, মরুর দেশ দুবাইয়ে যে ঝর্ণা হতে পারে, তা কে কোনকালে কল্পনা করেছিল? ২১৭ মিলিয়ন ডলার খরচ করে আমেরিকার ‘ওয়েট এন্টারপ্রাইজ’ তৈরি করে একটি কৃত্রিম ঝর্ণা, যা বুর্জ খলিফার মূল প্রবেশপথের পাশেই অবস্থিত। স্বচ্ছ নীলাভ পানির এই ঝর্ণাকে রাতের বেলা আলোকিত করে ৬,৬০০টি রঙিন বৈদ্যুতিক বাতি। আর পুরো ভবনকে ঘিরে রয়েছে বিস্তৃত মনোরম বুর্জ খলিফা পার্ক, যা মূল ভবনের মতোই ‘হাইমেনোক্যালিস’ নামক এক প্রকার মরু উদ্ভিদের ফুলের আকৃতিতে তৈরি করা হয়েছে। এই পার্কের গাছগুলোর জন্য বছরে প্রায় ৬ কোটি ৮০ লক্ষ লিটার পানি সরবরাহ করে বুর্জ খলিফার কুলিং সিস্টেম। ২০১০ সালে উদ্বোধনের পর থেকেই বুর্জ খলিফা হয়ে ওঠে পৃথিবীর অন্যতম টুরিস্ট আকর্ষণ। শুধু উচ্চতাই নয়, বুর্জ খলিফার আভিজাত্য আর নির্মাণশৈলী এক কথায় চোখ ধাঁধানো। পার্ক, ঝর্ণা, স্কাই হোটেল, সুইমিং পুল আর অবজারভেশন লবি, দুবাই যদি কখনো গিয়ে থাকেন তাহলে এসবের টানে আপনাকে সেখানে যেতেই হবে।
বুর্জ খলিফার কিছু রেকর্ড-
- সর্বোচ্চ ভবন- ৮২৮ মিটার; আগে ছিল চীনের তাইপে।
- এন্টেনা ছাড়া সর্বোচ্চ ভবন- ৮২৮ মিটার; আগে ছিল সিয়ার্স টাওয়ার।
- পৃথিবীর দীর্ঘতম ইলেভেটর-৫০৪ মিটার।
- সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ফ্লোর-১৬০টি (চূড়ার অনাবাসিক স্পায়ার বা কুণ্ডলীগুলো সহ ২১১); আগে ছিল ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার-১০১টি।
- পৃথিবীর উচ্চতম অবজারভেশন ডেক- ৫৫৫ মিটার।
- পৃথিবীর উচ্চতম রেস্টুরেন্ট- ৪৪২ মিটার।
- পৃথিবীর উচ্চতম নাইট ক্লাব।
- পৃথিবীর উচ্চতম মসজিদ (১৫৮ তলায়)।
বুর্জ খলিফা টাওয়ার তৈরিতে দুবাই সরকারের খরচ হয়েছে ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে এর প্রতি বর্গ ফুট জায়গার দাম ৪,০০০ ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে! অথচ এরকম বিশাল এবং উচ্চাভিলাষী ব্যয়বহুল এক কাজে দুবাই সরকার অর্থ ব্যয়ে কৃপণতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে শ্রমিকদের সাথে। এই আকাশচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণে যে ৭,৫০০ শ্রমিক ৬ বছর যাবত কাজ করেছেন তারা দৈনিক মাত্র ২.৮৪ ডলার পারিশ্রমিক পেয়েছেন! তাছাড়া কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় অঙ্গহানি ঘটেছে আরো কত শ্রমিকের, তার তো কোনো হিসেব নেই। অথচ দুবাই সরকার এই শ্রমিকদের সাথে ন্যুনতম মানবিক আচরণটুকুও করেনি। শ্রমিকদের বাসস্থান এবং খাবারের ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। অন্যদিকে এই শ্রমিকদের একটা বড় অংশই গিয়েছে দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এসব অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিজেদের সাদাকালো জীবন পেছনে ফেলে রঙিন স্বপ্ন দেখতে দেখতে পাড়ি জমিয়েছিল দুবাই। অথচ তাদের সেই স্বপ্নের কোনো মূল্যই ছিল না দুবাই সরকারের কাছে। তাই তো ২০০৬ সালে প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক তাদের মালিকপক্ষের বিপক্ষে বিদ্রোহ করেছিল, যদিও তার ফলাফল ছিল শূন্য।
যা-ই হোক, সিয়ার্স টাওয়ার পরবর্তী সময়ে বুর্জ খলিফা টাওয়ার নির্মাণ প্রকৌশলকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। পার্ক, ঝর্ণা কিংবা লবির জন্য না হলেও, ভূপৃষ্ঠ থেকে পাহাড়সম উচ্চতায় একটি মানবসৃষ্ট স্থাপনার মেঘের রাজ্যে হানা দেওয়া দেখতে হলেও যেতে হবে দুবাই ডাউনটাউনের বুর্জ খলিফা টাওয়ারে।