ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বালি এক স্বপ্নপুরীর নাম। ইন্দোনেশিয়ার স্বর্গখ্যাত বালি সত্যিকার অর্থেই যেন স্বপ্নপুরী। কী নেই বালিতে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত জাহাজে করে ঘুরে দেখতে পারেন সুবিস্তৃত প্রবাল প্রাচীর বা ছড়িয়ে থাকা সাদা বালিতে পা রেখে করতে পারেন সূর্যস্নান। উবুদের শৈল্পিক রাজধানীতে উপভোগ করা যাবে স্থানীয় সাংস্কৃতিক নৃত্য অথবা ক্লান্তি দূর করতে যোগ দিতে পারেন ইয়োগা ক্লাসে। তবে শুধু ঘুরে দেখলেই তো আর হবে না, থাকার জন্য চাই মনের মতো একটা জায়গা। বালিতে যেন কোনো কিছুরই কমতি নেই। বালির কিছু চমৎকার হোটেলের খবরাখবর নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
ফোর সিজনস রিসোর্ট বালি (Four Seasons Resort Bali at Sayan)
উপকূল থেকে কিছুটা দূরে, ঘন বাঁশঝাড়ে ঘেরা জঙ্গল আর পবিত্র ইয়ুং নদীর অপরূপ সৌন্দর্য আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে বালির এই হোটেলটিকে। গাড়িতে গেলে হোটেল থেকে বালির আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের কেন্দ্রস্থল- ‘উবুদ’ মাত্র ১০ মিনিটের দূরত্ব। বিকাল পাঁচটা অবধি হোটেলের নিজস্ব শাটল ব্যবস্থা চালু থাকে। যানজট পাড়ি দিয়ে এয়ারপোর্ট যেতে চাইলে সময় লাগবে প্রায় দুই ঘণ্টা। তবে হোটেল থেকে দেওয়া চামড়া পরিহিত আসন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও ওয়াইফাই সুবিধা সম্বলিত আরামদায়ক লিমুজিন গাড়ি নিঃসন্দেহে আপনার যাত্রার কষ্টকে লাঘব করবে।
হোটেলে রয়েছে ৪২টি খড় নির্মিত ছাদ বিশিষ্ট ভিলা ও ১৮টি বিশেষায়িত স্যুইট। প্রতিদিনের সম্পূরক সুবিধাদির মাঝে রয়েছে ইয়োগা, গ্রাম ভ্রমণ, সাইকেল ট্যুর ও স্থানীয় বালিনিজ নৃত্য পরিদর্শন। নীরবতার মাঝে নিজের সঙ্গ উপভোগ করতে চাইলে পুরোটা সকাল আপনি ইনফিনিটি পুলেই কাটাতে পারেন। অন্যান্য সুবিধার মাঝে পাবেন বার, শরীর চর্চা কেন্দ্র, রেস্তোরাঁ, পার্কিং, লন্ড্রি এবং পবিত্র ইয়ুং নদীতে বিশেষ স্পা।
যারা ভোজনরসিক তাদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। শুধু প্রাতরাশের মেন্যুটা শুনলেই মুখে হাসি ফুটবে নিশ্চিতভাবে। তাজা ফল, স্মুদি, পনির, পেস্ট্রি, পাউরুটি ইত্যাদি। আর সাথে ইন্দোনেশিয়ান স্পেশাল খাবার তো সাথে থাকছেই। সবচেয়ে ইতিবাচক বিষয়টি হলো, আপনার সাথে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন কোনো ব্যক্তি থাকলে তার জন্য আলাদাভাবে সব ধরনের সুবিধাযুক্ত রুমের ব্যবস্থাও রেখেছে হোটেল কর্তৃপক্ষ।
ডব্লিউ বালি, সেমিনিয়াক (W Bali – Seminyak)
বালির সর্বাধিক জনপ্রিয় হোটেলগুলোর অন্যতম এই হোটেলটিতে স্পা’র সুবিধা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ছানজুকে (Canggu) বলা হয়ে থাকে সার্ফিংয়ের স্বর্গরাজ্য। হোটেল থেকে অল্প সময়ে ট্যাক্সিযোগেই যাওয়া যায় ছানজুতে। হোটেলের আশেপাশে রয়েছে প্রচুর দোকানপাট। সঙ্গীতপ্রেমীদের জন্য রয়েছে বিশেষ সুবিধা।
রেকর্ডিং ও মিক্সিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সকল আধুনিক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সুরের ভূবনে হারিয়ে যেতে। সপ্তাহের প্রতিদিন সার্বক্ষণিক সুবিধা রয়েছে হট স্টোন বাথ ও ফিটনেস সেন্টারের। বিজনেস সেন্টারে রয়েছে উচ্চ গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধা ও অসংখ্য বই ও ডিভিডি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। এই হোটেলের বিশেষ আকর্ষণ হলো এর স্টিম রুম বা হাম্মাম।
আয়ানা রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা (AYANA Resort and Spa)
অধিকাংশ পর্যটকের মতে, বালির সবচেয়ে নয়নাভিরাম সূর্যাস্ত দেখা যায় এই হোটেল থেকে। ভারত মহাসাগর থেকে বেশ উঁচুতে অবস্থিত এই হোটেলটি জিমবারান উপসাগরের কাছাকাছি। হোটেলটির অন্যতম আকর্ষণ হলো এর রকবার। উপত্যকামুখী এই হোটেল থেকে অস্তগামী সূর্যের সৌন্দর্য উপভোগ করেন পর্যটকরা। আর আঁধার নেমে এলে ডিস্ক জকিরা সুর আর তালের ছন্দে ছন্দে আমোদিত করেন অভ্যাগতদের।
হোশিনোয়া (Hoshinoya)
হোশিনোয়া মূলত জাপান ভিত্তিক রিসোর্ট কোম্পানি। দেশের বাইরে তাদের দুটি ব্যবসায়িক কার্যক্রম আছে। একটি তাহিতিতে ও অন্যটি বালিতে। হোটেলের রুমে কাঠের তৈরি দেয়ালের গায়ে উবুদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চিত্রিত করা হয়েছে। তিন ধরনের ভিলা রয়েছে এই হোটেলে- বুলান, সখা ও জালাক।
রুমগুলোর পার্থক্য মূলত আকারে, বিলাসিতার দিক থেকে চিন্তা করলে একটার চেয়ে অন্যটা কোনো অংশে কম নয়। প্রাতরাশের জন্য রয়েছে তিন ধরনের সুবিধা – জাপানী, আমেরিকান ও ইন্দোনেশিয়ান। রয়েছে অফুরন্ত তরতাজা ফলের রস, কফি ও চায়ের সুব্যবস্থা।
গাজাহ মিনা বিচ রিসোর্ট (Gajah Mina Beach Resort)
এয়ারপোর্ট থেকে আড়াই ঘণ্টার দূরত্বে এই হোটেলটি অবস্থিত। এই রিসোর্টের রয়েছে নিজস্ব সমুদ্র সৈকত। উপকূলের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখতে চাইলে এর স্পা সেন্টার থেকেই তা অবলোকন করা সম্ভব। বিভিন্ন স্পট ঘুরে দেখা, কেনাকাটা কিংবা সার্ফিং সব হোটেল কর্তৃপক্ষই ব্যবস্থা করে দেবে। তবে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের সুবিধার্থে কোনো আলাদা ব্যবস্থা রাখা হয়নি, এটি হোটেলটির একটি নেতিবাচক দিক।
আলিলা ভিলাস, উলুওয়াতু (Alila Villas Uluwatu)
বালির সর্বদক্ষিণে অবস্থিত এই হোটেলটির প্রধান আকর্ষণ হলো সার্ফিং। হোটেলের কাছেই রয়েছে সমুদ্র। আর সমুদ্র এখানে উত্তাল হওয়ায় সার্ফারদের জন্য স্বাভাবিকভাবেই তা আগ্রহের কেন্দ্রস্থল। এছাড়াও রয়েছে উলুওয়াতু মন্দির। সমুদ্রের গর্জন সত্ত্বেও হোটেলের চারপাশ বালির অন্যান্য রিসোর্টের তুলনায় বেশ নীরব ও শান্ত। ভারত মহাসাগর থেকে প্রায় ৩০০ ফুট উঁচুতে এই হোটেলটি অবস্থিত। এয়ারপোর্ট থেকেও খুব বেশি দূর নয়, ৪৫ মিনিটেই পৌঁছাতে পারবেন এই হোটেলে।
হোটেলের নিজস্ব যে সৈকতটি রয়েছে সেখানে পৌঁছাতে হলে আপনাকে ৬০০টি সিঁড়ি মাড়াতে হবে। এটুকু শুনে কেউ যদি দমে যান তাহলে বলছি, ভয় পাবেন না। সিঁড়ি মাড়াতে নিতান্ত অনিচ্ছা থাকলে পাশেই রয়েছে ৫০ মিটার দীর্ঘ সুইমিং পুল। স্পা’র সুব্যবস্থা আছে সেখানেও। বিশেষ একটি স্পা হলো শিরদাঁড়া স্পা। দুটি রেস্তোরাঁ রয়েছে এই হোটেলে। চেখে দেখতে পারবেন স্যুপ, ভেড়ার মাংস, মোমো অথবা বালি থেকে সদ্য ধরা যেকোনো সামুদ্রিক মাছ।
কোমো শামভালা এস্টেট (COMO Shambhala Estate)
ডেনপাসার এয়ারপোর্ট থেকে ৯০ মিনিট ও সেন্ট্রাল উবুদ থেকে ১৫ মিনিট লাগবে গাড়িযোগে এই হোটেলে পৌঁছতে। কিছুটা অরণ্যের আদলে তৈরি করা হয়েছে হোটেলটি। পুরো হোটেলের নকশা করা হয়েছে এমনভাবে যাতে প্রকৃতির সাথে সকল পর্যটক একটি নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন। চারদিক দিয়েই দেখা মিলবে ইনিফিনিটি পুলের।
পর্যটকদের প্রতি হোটেল কর্তৃপক্ষ এতটাই নিবেদিত যে, তারা প্রত্যকের জন্য আলাদাভাবে সহকারী নিয়োগ করেন এবং তারা খুব দ্রুত আপনার ব্যক্তিগত পছন্দ, অপছন্দ জেনে নেবেন। বালির সর্বাপেক্ষা ভালো স্পা সুবিধা ভোগ করতে চাইলে আপনাকে এই হোটেলেই আসতে হবে। সর্বমোট ৯টি রুম আছে। এছাড়াও বিবাহিতদের কথা চিন্তা করে রয়েছে আলাদা ৩টি রুম। আকুপাংচার, আয়ুর্বেদ, হট স্টোন ম্যাসেজ এবং রিফ্লেক্সোলোজি ইত্যাদি সুবিধা পাবেন আপনি স্পা সেন্টারে।
স্টোন হাউজ (Stone House)
ডেনপাসার এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িযোগে ১ ঘণ্টার দূরত্বে এই হোটেলটি বালির সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র উবুদে অবস্থিত। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে আপনার চোখে পড়বে কখনো সুপ্রাচীন মন্দির, কখনও স্থানীয় নকশায় তৈরিকৃত বাড়িঘর আর কখনও রাস্তার দুই ধারে সুবিস্তৃত ধানক্ষেত।
তাছাড়া এখানে রয়েছে গরম পানির পুল, যার মাঝে থাকা অনিন্দ্যসুন্দর পাথরগুলো জাভা থেকে এনে স্থাপন করা হয়েছে। এই হোটেলে সকালের নাস্তা সেরে নিতে পারেন তরতাজা ডাবের পানি দিয়ে। বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে রয়েছে পেঁয়াজ পাতা আর শুকনো মরিচ দিয়ে রান্না করা ডিম ভুনা।
ঘুরে দেখুন পৃথিবীকে। একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চষে বেড়ান অফুরান প্রাণশক্তি নিয়ে। তবে অবশ্যই যেখানেই ভ্রমণ করুন না কেন, প্রকৃতির যত্ন নিতে ভুলবেন না যেন!
ফিচার ইমেজ: bali-indonesia.com