তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। পাতলা সরের মতো কুয়াশায় ঘেরা দূরের নীলচে পাহাড়। পাহাড়ের সন্ধ্যা অদ্ভুত রহস্যময় মনে হয় আমার সব সময়। আমরা সে সময় মাউলিনং গ্রাম থেকে শিলং মুখি বাসে করে ছুটছি। সিলেটের ডাউকি সিমান্ত পার করে এখানে এসেছি প্রথমবারের মতো। সন্ধ্যা যত গাঢ় হয়, একটু একটু করে উঠতে থাকে শুক্লপক্ষের চাঁদ।
চাঁদের আলো আর ভারি কুয়াশায় অদ্ভুত ঘোর লাগা সব দৃশ্য। আমি গাড়ির জানালার কাঁচ মুছে বাইরে ভাল করে দেখার চেষ্টা করি। আধো আলো-ছায়া মেশানো পাহাড়। ঝোপঝাড় আর গাছপালার ছায়াগুলোতে চারপাশে ভৌতিক পরিবেশ। চাঁদ যখন আরো উপরে, তখন দেখলাম দূরের এক সাদা পাহাড়। আমার কেন জানি মনে হলো, ওটা একটা ঘোড়া। জীবনানন্দ ভর করলো মাথায় বরাবরের মতো। “মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে, প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন- এখনও ঘাসের লোভে চরে”।
লাইনগুলো মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল। হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছিলাম এমন মাদকতাময় সময়ের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু একসময় সব অস্পষ্ট হয়ে গেল। কাঁচ মুছেও কাজ হলো না। আরে, ম্যাজিক নাকি? নাহ, মেঘালয় আমাদের বরণ করে নিচ্ছে মেঘের মধ্যে দিয়ে। মেঘ ভেদ করে আমরা যাচ্ছি একদল মানুষ। কীসের সন্ধানে? কে জানে?
সকালেই আমরা হেঁটে হেঁটে পার হয়েছি সিলেটের ডাউকি সীমান্ত। এপাড়ের ডাউকি নদীর তীর ধরে এগিয়েছি পড়শি দেশের নতুন মুলুকে। ডাউকি নদী দেখে নীল নদের কথা মনে আসে আমার। ছেলেবেলায় মিশরের নীল নদ পড়তাম আর ভাবতাম, এমন নীল রঙের পানিই হবে সে অদেখা নদীর। তবে এই নদীর নাম দিতে ইচ্ছে করলো আমার ‘আয়না’। কাঁচের মতো স্বচ্ছ যে, তাই!
নদী রেখে আমরা এশিয়ার সবচাইতে পরিচ্ছন্ন গ্রাম, যার নাম মাউলিনং, সেখানে গিয়েছিলাম। ফুলে আর নানা বাহারি গাছে ঘেরা ছবির মতো এক গ্রাম। সেখান থেকেই শিলংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। পথিমধ্যে চাঁদের আলোয় হাতছানি দেয় বুনো পাহাড়। সে ডাক উপেক্ষা করার সাধ্য কার?
চাঁদের আবছা আলো ভেদ করে কখনও কখনও চোখে পড়ছিল দূরে নিয়ন বাতির মতো টিমটিমে আলো। সেই আলোতে দেখা যায় মায়াবী ছোট্ট বাড়ি। মায়া ভরা ঘরদোর সব। আমার যেতে ইচ্ছে করে সেইসব জনমানবহীন প্রান্তরে, পাহাড়ের কিনারায় থাকা বাড়িতে। সেখানের সেই পাহাড়ি জীবন কেমন? জানতে খুব ইচ্ছে করে। জানা হয় না। এসব প্রান্তর পেরিয়ে একসময় আমাদের চোখের সামনে আসে শিলং শহর। নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে পাহাড়ের গায়ে আলোর পসরা নিয়ে অপেক্ষা করছে অচেনা শহর।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলং, যাকে বলা হয় প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড। রাত দশটায় শহরের সেন্ট্রাল পয়েন্টে নামি আমরা। আমাদের ভবঘুরে এই দলটি কখনও পরিকল্পিতভাবে কিছু করে না। আমাদের আগে থেকে ঠিক করা থাকে না কিছু। যখন যেদিক পানে মন চায় চলে যাই। আমাদের অঞ্চলে একটা প্রবাদ আছে, ‘যেখানে রাত, সেখানে কাত’। অনেকটা এই প্রবাদে ভর করে ঘুরি আমরা। তবে সে রাতে তার খেসারত দিতে প্রস্তুত ছিলাম না কেউ। না কোনো হোটেল আর না কোন হোম-স্টে! কিছুই খালি নেই পূজোর বন্ধের কারণে। সারা বছরও প্রায় খালি থাকে যেসব সরাইখানা, সেগুলোতে হাজার রকম মানুষ গিজ গিজ করছে এই সময়ে। সে রাতের ঠান্ডায় কাহিল না হলে রাস্তাতেই থাকার জোগাড় হয়েছিল প্রায়। এরপর ঘন্টা দুয়েকের পরিশ্রমে এক ড্রাইভার নিয়ে গেল ডাবল ভাড়ার তিন কামরার এক মোটেলে। সেটাও মাত্র এক রাতের জন্যে। পরদিনই সেখানে আসবে দখল দিয়ে রাখা মেহমান।
পরদিন পুরো সকাল বরবাদ করে পেলাম বেশ দশাশই ছোট্ট খালি বাড়ি। সেখানে কেবল আমরাই। এরপর সেখান থেকে বের হয়ে গেলাম শিলং শহরের সুলুক সন্ধানে। শহরটিতে ঘোরার জন্য ট্যাক্সি আর ছোট-বড় গাড়ি পাওয়া যায় হরহামেশাই। আমরা সংখ্যায় বেশি। তাই টাটা সুমো গাড়ি নিলাম ভাড়ায়। খাসিয়া পাহাড় বেয়েই গড়ে উঠেছে শিলং শহর। কখনও ঢালু, কখনও উঁচু; শহরের পাহাড়ি রাস্তায় এসেই মনে হলো, এমন কোনো রাস্তাতেই বুঝি দেখা হয়েছিল শেষের কবিতার অমিত-লাবণ্যের। রবি বাবু লিখেছিলেন সেই বাণী। ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী’।
আমরা গেলাম অল সেন্টস ক্যাথিড্রালে। একশ বছরের চেয়েও পুরনো চার্চ। স্থানীয় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের জমায়েত ছিল সেদিন কোনো উৎসব উপলক্ষে। এই রাস্তাতেই আসতে পথে পড়েছে ওয়ার্ড’স লেক ও ডন বস্কো মিউজিয়াম।
সবই ইতিহাস আর প্রাকৃতিক প্রাচুর্যের সমারোহ। ঘন্টাখানেক দূরত্বেই শিলং শহরকে পাখির চোখে দেখতে পাওয়া যায় মেঘালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া থেকে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে ৬ হাজার ফুট উঁচু শিলং থেকে দেখা যায় মেঘে ঢাকা শহর।
দিন শেষে গেলাম বিখ্যাত শিলং গলফ কোর্সে। ভারতে দ্বিতীয় সবচেয়ে পুরাতন ১৮ গর্তওয়ালা গলফ কোর্স। মনে হয় যেন সবুজ কার্পেটে মোড়ানো চারপাশ।
শেষ বিকেলের আলো মাখানো মখমলের কোমলতায় ভরা। কী ভীষণ শান্ত আর শান্তিময় জায়গা। দেবদারু গাছের লম্বা ছায়া পড়া ঘাসের কিনারায় নিঃশব্দে বসে থাকি আমরা। দিগন্তজোড়া সবুজ। তার ওপরে মেঘ জমে আছে। পেছনে ব্রিটিশদের গড়া কারুকার্যময় বিশাল ভবন। দেবশিশুর মতো বাচ্চারা খেলছে চারদিকে।
আহা, জীবন যেন এখানে থমকে গেছে স্থিরতায়। কারো কোনো তাড়া নেই। সবাই উপভোগ করছে যেন থমকে থাকা সময় ও সৌন্দর্যকে।
শহরে ফিরে আসি আমরা সন্ধ্যায়। সেন্ট্রাল পয়েন্টে ততক্ষণে বসে গেছে হরেক রকম পথ খাবারের পসরা। বাতাসে ভাসছে তার খুশবু। আমাদের ক্ষিদে পেতে বেশিক্ষণ লাগল না। কাবাবের দোকান থেকে শুরু করে বাদ গেল না স্থানীয় ফলমূল। সব চেখে দেখলাম। কিন্তু ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। তাই সে রাতে বাঙালি হোটেলে ভাত খেয়েই ফিরলাম।
পরদিন সকালে রওনা দিলাম চেরাপুঞ্জির উদ্দেশ্যে। পথেই থামলাম এলিফ্যান্ট ফলসে। এরপর চেরাপুঞ্জিতে দেখলাম নোহকালিকাই ফলস, নংথিমাই ইকো পার্ক, সেভেস সিস্টার ফলস ও মাউসমাই কেভ। এসব ঝর্ণাধারা দেখলে কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়। মনে হয়, জীবন এরকম বাধাহীন ও উচ্ছল, কিছুর জন্যেই থেমে থাকে না।
অক্টোবর মাসে চেরাপুঞ্জির বৃষ্টি পাইনি আমরা। তবে যা পেয়েছি তার বর্ণনা দেওয়া শুধু দুঃসাধ্য নয়, ভীষণ দুরুহ ব্যপার। শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি যাওয়ার এই রাস্তার ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যে আমি নির্বাক হয়ে ছিলাম কতক্ষণ তার ঠিক নেই।
দু’পাশের বৈচিত্র্য ভরা পাহাড়, পেজা তুলোর মতো লেপ্টে থাকা মেঘের দল, নীল পানির জলাশয়, আর কত যে বর্ণিল বুনো পাহাড়ি ফুলে ঘেরা সেই উপত্যকা। আর সেসবের মাঝে মাঝে দরজা, জানালায় সাদা লেইসের পর্দা দেওয়া ছবির মতো ঘরবাড়ি। সব বাড়িতেই মায়াবি ফুলের দল।
আর এসবের মাঝ দিয়ে যেতে যেতে মনে হয়, জীবন সুন্দর, সুন্দর এই বেঁচে থাকা।