ভোরের স্নিগ্ধ আলোতে পাহাড়ের উঁচু-নিচু, আঁকা-বাঁকা রাস্তায় ছুটে চলা বাসের একজন যাত্রী আমি। আধেক খোলা বাসের জানালা দিয়ে আসা হুটহাট বৃষ্টির ঝাপটায় মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম চারপাশের প্রকৃতি। পাশে তাকালেই শত ফুট গভীর পাহাড়ি খাদ আর কিছু দূরেই দেখা যায় মেঘ আর পাহাড়ের মেল-বন্ধন। এভাবেই পাহাড় আর মেঘের জেলা বান্দরবান আমাদের স্বাগত জানায়। প্রকৃতি-দেবী যেন নিজ হাতে ঢেলে সাজিয়েছেন বান্দরবানকে। মেঘের থেকে উঁচু পাহাড়, পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা নদী থেকে রহস্যময় গুহা কি নেই এখানে!
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দিকে চলে যাওয়া রাস্তাটা ধরে চকরিয়া থেকে বামে বান্দরবানের রাস্তা। চকরিয়া থেকেই শুরু হয় পাহাড়ের বাঁকের পর বাঁক নেয়া ক্রমশ উপরে উঠতে থাকা রাস্তা। দক্ষ হাতের চালকদের’ও শক্ত পরীক্ষা নেবে এই সড়ক। কিছুক্ষণ গেলেই দেখা মিলে রাস্তার দু’পাশে গভীর খাদ!
রোমাঞ্চকর এই রাস্তায় বেশ কিছু সময় চলার পরই আমরা সকাল সাতটায় নামলাম লামায়। নাস্তা খেয়ে তৈরি হয়ে মাহিন্দ্রা (একধরনের মাঝারি গাড়ি) করে আমরা রওনা দিলাম আলীকদমের উদ্দেশ্যে। যাবার ইচ্ছা রূপমুহুরী ঝর্ণাতে। এই ঝর্ণাতে যেতে হলে আলীকদমে মাতামুহুরী ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করতে হয়।
প্রায় চল্লিশ মিনিট পর আমরা নামলাম আলীকদম সেনা ক্যাম্প চেকপোস্টে। ক্যাম্পের পাশেই মাতামুহুরী নদী বয়ে যাচ্ছে। নদীর ও’পাশেই কিছু দূরে পাহাড়, তার উপর মেঘ। সে এক অসাধারণ দৃশ্য!
রূপমুহুরী যেতে হলে এই ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনীর অনুমতি নিয়ে যেতে হয়। সেখানকার ক্যাপ্টেন জানালেন, রূপমুহুরীর দিকে কিছুদিন ধরে শান্তিবাহিনী ঝামেলা শুরু করেছে। রাতে থাকব শুনে তিনি কিছুতেই যেতে দিবেন না আমাদের। বাধ্য হয়েই আমাদের পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন আনতে হলো।
আলীকদম গুহা
ঠিক হলো আমরা প্রথম দিনই আলীকদমের বিখ্যাত আলীর গুহাতে যাবো, যেখানে আমাদের দ্বিতীয় দিন যাবার কথা ছিল। আলীর সুড়ঙ্গ নিয়ে রহস্যের শেষ নেই। আলীকদম নাম নিয়ে যেমন নানা কথা, উপকথা আর অভিমত চালু আছে, তেমনি রহস্যময় এই গুহা নিয়েও মজার মজার সব গল্প আর কিংবদন্তি পাওয়া যায়। বান্দরবানের অন্যতম আকর্ষণ এই আলীর গুহা। সরকারী নথিপত্রে এই গুহাকে চিহ্নিত করা হয়েছে পুরাকীর্তি হিসেবে। আলীকদমে আলীর পাহাড়ের মধ্যে এই আলীর গুহা একই সূত্রে গাঁথা বলে ধারণা করা হয়। আরবিতে কদম অর্থ পা, স্থানীয়দের মধ্যে বিশ্বাস যে আলী নামক এক ধর্ম প্রচারক কোনো একসময় এই পার্বত্য অঞ্চলে ধর্ম প্রচার করতে আসেন। সেই থেকে উপজেলা এবং পাহাড়ের নামে আলী জড়িয়ে আছে। অনেকগুলো গুহা সম্বলিত আলীর পাহাড়ে যেতে হলে টোয়াইন খাল পার হয়ে যেতে হয়।
পানি কম থাকায় অর্ধেক নৌকা দিয়ে আর অর্ধেক হেঁটে পার হলাম আমরা। সেখান থেকে প্রায় সত্তর ফুটের মতো খাড়া পিচ্ছিল পথ উঠে যেতে হলো। তারপর কিছুটা নেমে একটা ছোট সাঁকো পার হলেই গিরিখাতের দেখা পাওয়া যায়। পানির ছোট একটি ঝিরিধারা বয়ে চলছে এই গিরিখাত ধরে। এই গিরিখাত দেখলে মনে হয়, কেউ যেন নিপুণ হাতে পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে হাঁটার জন্য! পাহাড়ের উপরের অংশ সবুজ গাছপালায় ছেয়ে আছে।
গিরিখাতের মাঝে ছোট ছোট নুড়ি পাথর আর সাথে বড় বড় পচতে শুরু করা গাছের গুড়ির দেখা পাওয়া গেল, যা প্রবল বর্ষায় এখানে ভেসে এসেছে। এই গুড়িগুলোর আকার দেখলেই বোঝা যায়- প্রবল বর্ষণে গিরিখাতের অবস্থা কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।
এরকম বড়-ছোট গাছের গুড়ি পার হয়ে গিরিখাত ধরে এগিয়ে চললাম আমরা। শুরুতে বেশ চওড়া থাকলেও আস্তে আস্তে সরু হতে থাকে দুপাশের পাহাড়। এভাবে মিনিট দশেক হাঁটার পর আমরা দুটো রাস্তার মুখোমুখি হলাম। ডানপাশের রাস্তা কিছুদূর গিয়েই শেষ, সেখানে একটি সেনাবাহিনীর তৈরি করা লোহার সিঁড়ি রয়েছে, যা প্রথম গুহার সাথে সংযুক্ত হয়েছে। শুরুতে আমরা সবাই সেই সিঁড়ির দিকেই এগিয়ে গেলাম।
সেই গুড়িতে সাবধানে পা দিয়ে সিঁড়িতে উঠলাম আমরা। গুহার ভেতরের পাথরের দেয়াল এবড়ো-থেবড়ো আর স্যাঁতস্যাঁতে। এই গুহায় কিছুদূর যাবার পর খুব সরু পথ যায়, যার সামনে যাওয়া সম্ভব না। গুহায় কিছুক্ষণ ঘুরে নিচে নেমে আসলাম আমরা।
এবার গন্তব্য দ্বিতীয় গুহায়। এই দ্বিতীয় গুহাটি বেশ বড়। সেই দুই রাস্তার মোড়ে এসে এবার বামের পথ ধরলাম আমরা। এই পথের দু’পাশের পাহাড় বেশ সরু। কিছুদূর যাবার পরই সেনাবাহিনীর তৈরি ঝুলন্ত সিঁড়ির দেখা পাওয়া যায়। কাঠ আর মোটা দড়ির এই সিঁড়ি বেশ বিপদজনক। সিঁড়ির সাথে পাথরের দেয়ালে পানির ঝিরি চলতে থাকায় বেশ পিচ্ছিল থাকে এই জায়গাটি। সিঁড়িটি সাবধানে উঠে কিছুদূর এগোলেই দেখা মেলে সেই বিখ্যাত গুহার প্রবেশ-মুখ।
বেশ ছোট প্রবেশ-মুখ হওয়ায় হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করতে হয় এখানে। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে সিঁড়ির মতো একটা জায়গা দিয়ে উঠলেই মূল গুহার দেখা পাওয়া যায়। বেশ বড় এই গুহার আকার, এই গুহার অনেক শাখা-প্রশাখা আছে বলে জানতে পাড়ি আমরা। এই গুহায় আরও কিছুক্ষণ ঘুরে আমরা আবার ফিরে চললাম।
খাল পার হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা দিলাম লামায়। যেতে যেতে সিদ্ধান্ত নিলাম তাঁবু যেহেতু আছে, আজকে রাতে আমরা কোথাও ক্যাম্পিং করলে কেমন হয়! ঠিক হলো লামাতেই টিএনটি পাহাড় নামে ছোট্ট একটি পাহাড় আছে সেখানেই রাতে ক্যাম্পিং হবে।
তাঁবু আর বার-বি-কিউ করার সরঞ্জাম নিয়ে আমরা রওনা দিলাম টিএনটি পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। টিএনটি পাহাড় বেশ ছোট্ট একটি পাহাড়। নিচ থেকে দশ মিনিট টানা হাঁটলেই পাহাড়ের চূড়ায় উঠা যায়। পাহাড়ে উঠে আমরা তিনভাগে ভাগ হয়ে গেলাম। এক ভাগ ক্যাম্প-ফায়ার, আরেক ভাগ বার-বি-কিউ এবং বাকিরা তাঁবু খাটানোর কাজ করছিল। রাতের অর্ধেকটা গান আর আড্ডায় কেটে গেল, এরপর ঘুমাতে গেলাম আমরা, কাল যে বেরোতে হবে!
মাতামুহুরী ভ্রমণ
আজকের উদ্দেশ্য নৌকায় মাতামুহুরী নদী ভ্রমণ। লামা বাজার থেকে দুপুরে খেয়েই পাশের ঘাট থেকে দুটো নৌকায় উঠলাম আমরা। দু’পাশে বড় বড় পাহাড় আর মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে আঁকাবাঁকা নদী। কিছু কিছু জায়গায় চর ভেসে আছে।
এভাবে নদী ও পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে একসময় মানিকনগর বাজার নামে একটা জায়গায় আসলাম, যার পাশে ছিল বিশাল চর। খালি পায়ে কিছুক্ষণ চরে হাঁটার লোভ সামলাতে পারলাম না!
এই বাজার থেকে নৌকা আবার ঘুরে গেল লামা বাজারের দিকে। ততক্ষণে টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমরা ছাতা নিয়ে নেমে, বাগান ঘুরে স্থানীয় দোকানে চা খেয়ে আবার নৌকায় ফেরত আসলাম। এরপর মিনিট দশেকের মতো নৌকা চলার পর চলে এলাম লামা বাজারে। ততক্ষণে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা।
বাজারে পৌঁছানোর পর খাবার হোটেলে বসে ঠিক হলো, পরদিন দামতুয়া যাবার কথা। দামতুয়া হলো বান্দরবানের অন্যতম বড় ঝর্ণা। ঝর্ণাটি দেখতে যতটা সুন্দর, সেখানে যাওয়া ততটাই কষ্টকর। স্থানীয় একজনের পরামর্শ অনুযায়ী প্রথমবার পাহাড়ে আসা পর্যটকদের দামতুয়ার দুর্গম রাস্তায় না যাওয়াই ভালো। তাই সিদ্ধান্ত হলো, যাদের অভিজ্ঞতা আছে তারাই শুধু দামতুয়া যাবে। আর বাকিরা মিরিঞ্জা (একটি পর্যটন স্থান) সহ আশেপাশের কিছু পাহাড় ঘুরে আসবে।
পাহাড়ে প্রথমবার আসায় আমি দ্বিতীয় দলে পড়লাম।
মিরিঞ্জা ভ্রমণ
তৃতীয় দিনে সকালবেলা উঠেই দেখলাম দামতুয়া দল ভোরেই বেরিয়ে গেছে। আমরাও খেয়ে দেয়ে দুপুরের দিকে বের হলাম মিরিঞ্জার উদ্দেশ্যে। লামা বাজার থেকে মাহিন্দ্রা নিয়ে মিরিঞ্জা যেতে সর্বোচ্চ চল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টার মতো লাগে। পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তা পাশের পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেই একসময় মিরিঞ্জা পৌঁছে গেলাম।
শুনেছিলাম আকাশ পরিষ্কার থাকলে নাকি মিরিঞ্জা থেকে বঙ্গোপসাগর দেখা যায়! তার সত্যতা পেলাম মিরিঞ্জায় উঠে।
পাহাড়ের মাঝে সিঁড়ি তৈরি করে উপরে একটি চাতালের মতো করে দেয়া আছে, দৃশ্য উপভোগ করবার জন্য। সেখান থেকে আশেপাশে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল এবং ভালো করে তাকালে বঙ্গোপসাগর দেখা যায়!
তুমুল বাতাস আর প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্য দেখে নিচে নামতে নামতে বিকেল হয়ে গেল। এবার আশেপাশের পাহাড় ঘোরার পালা। অজানা কিছু পাহাড় কাটা রাস্তা ধরে চলল আমাদের অটো দুটি। সন্ধ্যায় এক পাহাড়ের গায়ে চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে গল্প করা হলো স্থানীয় বাচ্চাদের সঙ্গে। তারপর বাসায় ফিরবার পালা। লামায় ফিরে দেখি দামতুয়া দল কিছুক্ষণ আগেই এসেছে।
তাদের কাছ থেকে পরে দামতুয়া ভ্রমণ অভিজ্ঞতা শুনলাম।
দামতুয়া ভ্রমণ
দামতুয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও নাকি ছিল অসাধারণ!
দামতুয়া যেতে হলে প্রথমে বাইক, অটো বা মাহিন্দ্রায় করে আসতে হবে আলীকদম বাজার। এখান থেকে চান্দের গাড়ি বা বাইকে ডিম পাহাড়ের রাস্তা ধরে আদুপাড়া পর্যন্ত যেতে হয়। আদুপাড়াতে নেমে গাইড, সবচেয়ে প্রয়োজনীয় লাঠি এবং কিছু শুকনা খাবার সংগ্রহ করে হাঁটা শুরু করতে হয়।
দামতুয়ার পথে প্রথমে কিছুটা সমতল রাস্তা হেঁটে যাবার পর পামিয়া পাড়া নামে একটি মুরং পাড়া পড়ে। জুম চাষের জন্য এখানে বেশির ভাগ ঘরই খালি। যারা ঘরে থাকে, ছোট বাচ্চা সামলায়। তারপর কিছুটা এগিয়ে গেলেই, বেশ অনেকটা রাস্তা পাহাড়ে ওঠানামা। দূর পাহাড়ে লক্ষ্য করলে মাথায় ঝুড়ি বাঁধা পাহাড়ি মেয়েদের দেখা পাওয়া যায়। অনেকখানি রাস্তা এমন পাহাড়ে ওঠানামার পর পাহাড়ি ঝর্ণার শব্দ পাওয়া যায়।
কিছুদূর যাবার পরই ওয়াংপা ঝর্ণার বিশাল ধারা দেখা যায়। এই ঝর্ণা কম-বেশি সত্তর ফুট লম্বা হবে। চারটি আলাদা ধারায় এই ঝর্ণার পানি নিচে পড়ছিল। ওটার নিচে যেতে খাঁড়া পাহাড় বেয়ে নিচে নামা লাগে। সেখান থেকে শুরু হয় ঝিরিপথ। ভীষণ পিচ্ছিল ঝর্ণার বড় বড় ধাপ পেরিয়ে এগুতে হয়। হিমশীতল পানির স্রোত অনেক জোরালো, বেকায়দায় পা পড়লেই সর্বনাশ! গনগনে রোদে এতক্ষণ হাঁটার পর এই হিমশীতল পানি মনে প্রশান্তিই এনে দেয়।
এই পথ ধরে ত্রিশ মিনিট যাবার পর মেম্বার পাড়া নামে একটা জায়গা পড়ে। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার ঝিরিপথ ধরে হাঁটা। ঝিরিপথ দিয়ে অনেকক্ষণ হাঁটার পর আবার পাহাড় আবার ঝর্ণা, তা পার হবার আবার পাহাড় বাওয়া একটানা। এভাবে ওঠানামা চলতে থাকল বেশ কিছুক্ষণ।
আরও বেশ কিছুদূর এভাবে যাওয়ার পর আসে কাখৈ পাড়া। এই পাড়াটি যেন কেউ নিজ হাতে এঁকেছেন! প্রচণ্ড বেগে একটি ঝর্ণা পাড়াটির ঠিক পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। কাখৈ পাড়া পার হলেই বোঝা যায় মূল নির্ঝর বেশি দূরে না। পানির প্রচণ্ড শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়! এভাবে কিছুদূর যাবার পর মূল নির্ঝরের দেখা পাওয়া যায়। এই নির্ঝরে প্রাকৃতিক সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে নিচে নামা যায়।
আগে থেকেই জানা ছিল, নির্ঝরটি পার করে কিছুদূর এগোলেই দামতুয়া। আরো মিনিট বিশেক হাঁটার পর দেখলাম পাহাড়ের নিচে দামতুয়া! পনের মিনিট পাহাড় বেয়ে স্বচক্ষে উপভোগ করা হলো দামতুয়ার সৌন্দর্যকে। তিনদিক থেকে অনেক উঁচু থেকে বিশাল পানির ধারা সশব্দে নিচে আছড়ে পড়ছে।
পানিতে নামার পরে মনে হবে সমস্ত কষ্ট সার্থক। ঝর্ণার নিচে পানির স্রোত শরীরে কাঁটার মতো বিঁধে। সাতার না জানলে এগোনোই মুশকিল।
ঝর্ণায় ঘণ্টাখানেক থেকে আসা হলো সেই ধাপ করা নির্ঝরে। সেখানে ত্রিশ মিনিট থেকে একই রাস্তা ধরে আবার আলীকদম ফেরত আসা।
ডিম পাহাড়
আমাদের পরের দিনের গন্তব্য ডিম পাহাড়। পরদিন সকালে খেয়েদেয়ে লামা থেকে রওনা দিলাম আলীকদম। ডিম পাহাড় আর দামতুয়া যেতে শুরুটা আলীকদম থেকেই করতে হয় চান্দের গাড়ি অথবা মোটরসাইকেল দিয়ে। ডিম পাহাড়ে যাবার রাস্তাটা বড় অদ্ভুত।
আলিকদম থেকে থানচি (৩৩ কি.মি.) রাস্তাটি বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু সড়ক। পাহাড়ের উপর এঁকে-বেঁকে চলা রাস্তাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২,৫০০ ফুট উপরে অবস্থিত। পথিমধ্যে বিজিবির চেকপোস্ট রয়েছে।
এই রাস্তায় চান্দের গাড়ি এবং মোটরসাইকেল ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন চলাচল করে না। পাহাড়ের উপর সড়কটি হওয়ার রাস্তার দু’পাশে খাড়া বিশাল খাদের দেখা পাওয়া যায়। কাছেই পাহাড়ের চূড়া কিন্তু মেঘে ঢেকে আছে বলে তা দেখা যাচ্ছে না। এরকম প্রায় ঘণ্টা দেড়েক চলার পর হঠাৎ দেখলাম আমরা মেঘের মধ্য দিয়ে চলছি!
এটাই ডিম পাহাড়, মেঘ যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে এই পাহাড়ের উপর। চান্দের গাড়ি থেকে নেমেই আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘুরতে লাগলাম। নিজ হাতে মেঘ ধরবার সুযোগ জীবনে কবার মিলে!
পাহাড়ের পাশে নিচে তাকালে দেখা যায় সেখানে বৃষ্টি হচ্ছে, অথচ আমাদের গায়ে দু-এক ফোটা পড়ছে, কারণ মেঘের উপরেই আছি আমরা! সে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য। কিছুক্ষণ থাকলেই মনে হয় সারাজীবন এই পাহাড়ে কাটিয়ে দিলে মন্দ হয় না।
শৈলকুঠিতে রাত্রিযাপন
ডিম পাহাড়ের মুগ্ধতার মায়া কাটিয়ে বিকেলে রওনা দিতে হলো আলীকদমের উদ্দেশ্যে। গান-আড্ডায় মুখরিত হয়ে সন্ধ্যায় পোঁছালাম আলীকদম শহরে। আলীকদমে শৈলকুঠি নামে বেশ সুন্দর একটা কটেজ আছে। কটেজটির পাশ দিয়েই মাতামুহুরি নদী, তার পেছনেই পাহাড়ের সারি। আমরা ঠিক করে রেখেছিলাম এই শৈলকুঠিতেই বান্দরবানের শেষরাত কাটাবো, যার ফলে আলীকদম নেমেই সবাই শৈলকুঠিতে এসে উঠলাম। বেশ সুন্দর এই কটেজে বান্দরবানে আমাদের শেষ রাত হাসি, আড্ডা আর গানেই কেটে গেল। ভোর রাতে সবাই ঠিক করল, সূর্যোদয় দেখবে। কটেজে সূর্যোদয় দেখার জন্যই হয়তো নদী আর পাহাড়কে মুখ করে কিছু বসার জায়গা ছিল। মনে হয়, এই পাহাড় আর নদীর মধ্যেই কতকাল ধরে বসবাস করছি! এই পরিবেশ মনে বারবার হাহাকারের সৃষ্টি করে।
রাতে ঘুম না হওয়ায় সবাই কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে দুপুরের পর লামার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। লামা গিয়ে কিছু কেনাকাটা করেই বাসে উঠলাম। শত শত তারায় ঢাকা আকাশ আর পাহাড় ছেড়ে আমাদের বাস ছুটে চলল যান্ত্রিক ঢাকার দিকে। অপরূপ প্রাকৃতিক নৈসর্গের এই বান্দরবানে কিছুদিন থেকে জোগাড় হলো আজীবন মনে থাকার মতো ছোট বড় অনেক স্মৃতি!
পরিশেষে একটাই কথা বলার আছে। এসব অসাধারণ সুন্দর জায়গায় ঘুরতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় ময়লা ফেলবেন না। আমাদের দেশের সৌন্দর্য রক্ষা করার দায়িত্ব তো আমাদেরই।
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘ভ্রমণ’ বিভাগে এখন থেকে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/