পদ্মা নদীর আরেক নাম কীর্তিনাশা। রাজা রাজভল্লবের গড়া কীর্তি এই পদ্মার ভাঙ্গনে ভেসে গিয়েছিল। সেই থেকে এই নাম। তবে পদ্মার ভাঙন কিংবা পদ্মার পাড়ের জীবনের বিশ্বস্ত গল্প সর্বপ্রথম উঠে আসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে। পদ্মার জোয়ার-ভাটা, সুখ-দুঃখ, জীবনযাত্রা সবকিছু উঠে আসে কুবের মাঝির জীবনের গল্প দিয়ে। বহুল আলোচিত ও জনপ্রিয় সেই উপন্যাস বাংলার পদ্মার তীর ঘেঁষে গড়ে উঠলেও, বিশ্বব্যাপী নদীর পাড়ের গল্পগুলোও প্রায় কাছাকাছি। কখনও নৃগোষ্ঠীদের জনপদ, কখনও শিল্প নগরী, কখনও বা একটি নদী কেবলই পশুপাখির।
নদী তার আপন গতিতে চলতে গিয়ে প্রতি ঢেউয়ে লিখে যায় পরিবর্তনের গল্প। লিখে যায় নতুন সংস্কার, কখনও বা পুরনো সংস্কারকে ভেঙেও দিয়ে যায়। তবে আধুনিক সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠার পিছনে যে নদীর কোনো তুলনা নেই, তা নিয়ে কোনো সন্দেহও নেই। কখনও কখনও একটি নদী একটি দেশকে নিয়ে গেছে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে, কখনো বা একটা নদীই হয়ে উঠেছে একটি দেশের দুঃখ। পৃথিবীব্যাপী এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ, প্রাচীন ও দীর্ঘতম নদীর গল্প নিয়েই এই আয়োজন।
সেপিক নদী (পাপুয়া নিউগিনি)
পাপুয়া নিউ গিনির মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা সেপিক নদী সেখানকার দীর্ঘতম নদী। দেশটির সেন্ট্রাল মাউন্টেনের ভিক্টর ইমান্যুয়েল রেঞ্জ থেকে জন্ম হয়েছে এই নদীর। আমাজন নদীর মতোই সাপের মতো একেবেকে বয়ে চলেছে সেপিক নদী। শেষ হয়েছে বিসমার্ক সাগরে গিয়ে। সব মিলিয়ে সেপিকের দৈর্ঘ্য ১,১২৬ কিলোমিটার কিংবা ৭০০ মাইল। নদীর তীরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর গ্রামগুলোকে বলা হয় এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে টিকে থাকা শান্তিপূর্ণ আবাসস্থল।
মিসিসিপি মিসৌরি (উত্তর আমেরিকা)
উত্তর আমেরিকার দীর্ঘতম ও বিশ্বের চতুর্থ দীর্ঘতম নদী মিসিসিপি মিসৌরি। দৈর্ঘ্য ২,৩২০ মাইল কিংবা ৩,৭৩০ কিলোমিটার। মিসিসিপির উৎপত্তি লেক ইতনাস্কা থেকে; শেষ হয়েছে নিউ অরলিন্সে (গালফ অব মেক্সিকো)। বলে রাখা ভালো, মিসিসিপি অর্থ মহানদী।
১৮২০ সালের দিকে এই নদীতে বাষ্পচালিত নৌকা ছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। কাঠ, খাবার, তুলাসহ অন্যান্য দ্রব্য এই নদীর মাধ্যমেই আনা-নেওয়ার কাজ করা হতো। কিন্তু ১৮৮০ সালে রেললাইন আসার পর স্টিমবোটের কদর কমতে থাকে। ১৯২০ সালের দিকে তা গিয়ে ঠেকে শূন্যের কোঠায়। তারপরও ডেল্টা কুইনের মতো আরও কিছু স্টিমবোট পরিবহন সংস্থা এখনও নিজেদের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রেখেছে।
ভলগা নদী (রাশিয়া)
বলা হয়, ইউরোপ মহাদেশের দীর্ঘতম নদী ভলগা। তবে মহাদেশের যে দেশটির মধ্যে দিয়ে ভলগা বয়ে চলেছে, সেই রাশিয়া অবশ্য নিজেদের দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী হিসেবে একে উল্লেখ করে থাকে। রাশিয়ার প্রধান ২০ শহরের মধ্যে রাজধানী মস্কোসহ মোট ১১টি শহরের মধ্যে দিয়ে ভলগা নিজের পথ খুঁজে নিয়েছে। মস্কোর ভালদে পাহাড় থেকে নেমে ৩,৬৪৫ কিলোমিটার কিংবা ২,২২৫ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ভলগা গিয়ে থেমেছে কাস্পিয়ান সাগরে। যদিও তীব্র ঠাণ্ডার কারণে বছরের ৩ মাস ভলগা নদীর পানি জমে বরফ হয়ে যায়, তারপরও রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ নৌ-যোগাযোগ ও পরিবহনের জন্য অত্যন্ত এটি গুরুত্বপূর্ণ।
জামবেজি নদী (আফ্রিকা)
আফ্রিকার চতুর্থ দীর্ঘতম নদী জামবেজি। দৈর্ঘ্যে ৩,৫৪০ কিলোমিটার (২,২০০ মাইল) লম্বা। জাম্বিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি কালো জলাভূমি থেকে জন্ম নেওয়া জামবেজি সফর করে চলেছে অ্যাঙ্গোলা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ের মোজাম্বিক ও আবারও জাম্বিয়ার মধ্যে। শেষমেশ গিয়ে মিলেছে ভারত মহাসাগরে। জামবেজির সঙ্গে যুক্ত আছে বিখ্যাত জলপ্রপাত ভিক্টোরিয়া। বিশ্বের সুন্দরতম ১০ জলপ্রপাতের তালিকায় এই ভিক্টোরিয়ার নাম রয়েছে।
বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল এই জামবেজি নদী। জলহস্তির অভয়ারণ্য বলা যায় এই নদীকে। কেবল কুমিরের প্রজাতিই রয়েছে কয়েক রকমের। মাছ রয়েছে কয়েকশত প্রজাতির। এই নদীতে রয়েছে হিংস্রতম হাঙর বুল শার্ক। প্রায়ই নদীতে থাকা জেলেরা এই হাঙরের মাধ্যমে আক্রান্ত হয়েছে।
মেকং (চীন থেকে কম্বোডিয়া)
বিশ্বের ১২ তম দীর্ঘ নদী মেকংয়ের দৈর্ঘ্য মোটামুটি ৪,৩৫০ কিলোমিটার কিংবা ২,৭০৩ মাইলের কাছাকাছি। তিব্বতের প্লাবনভূমি থেকে শুরু করে মেকং নদী চীনের ইউনান প্রদেশ, লাওস, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় গিয়ে শেষ হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে নদীর অতিরিক্ত গতীপথ পরিবর্তন এবং একাধিক জলপ্রপাতের কারণে নদীতে নৌযান চালানো কঠিন ব্যাপার।
আমাজনের চেয়েও যদি কোনো নদী জীববৈচিত্রের দিক থেকে বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে সেটা মেকং। তবে চীনে নদীটির উপর নির্মাণ হওয়া প্রথম বাঁধের কারণে ডলফিন ও মানাতির মতো বেশ কিছু সামুদ্রিক প্রাণী হুমকির মুখে পড়েছে।
গঙ্গা (ভারত)
হিমালয়ের পাদদেশ থেকে জন্ম নিয়ে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে গঙ্গা। এর প্রধান শাখা নদী পদ্মা, যা কি না বাংলাদেশের ২য় দীর্ঘতম নদী। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে গঙ্গা পবিত্রস্থান। তারা বিশ্বাস করেন, এই নদীতে একবার গোসল না করলে জীবন পরিপূর্ণ হবে না। প্রিয়জনের মরদেহের ছাই তারা গঙ্গায় ভাসিয়ে থাকেন। ঐতিহাসিকভাবেও গঙ্গা বেশ সমৃদ্ধ। গঙ্গার তীরে কালের পরিক্রমায় গড়ে উঠেছে একাধিক শহর, বন্দর ও জনপদ। শুধু তা-ই নয়, গঙ্গাকে বলা হয় বিশ্বের বিশুদ্ধতম নদী।
নীল নদ (আফ্রিকা)
পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ নদী এই বিখ্যাত নীল নদ। পূর্ব আফ্রিকা থেকে শুরু হয়ে ৬,৬৫০ কিলোমিটার কিংবা ৪,১৩২ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে থেমেছে ভূমধ্যসাগরে। নীল নদের দুটি উপনদী আছে। একটি শ্বেত নীল নদ, অপরটি নীলাভ নীল নদ। নীলাভ নীল নদ শুরু হয়েছে ইথিওপিয়ার টানা লেক থেকে। অন্যদিকে, শ্বেত নীল নদ শুরু হয়েছে সেন্ট্রাল আফ্রিকার গ্রেট লেক থেকে।
নীল নদ মিশসীয় সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। নীল নদের কারণে এখানকার মাটি উর্বর হয়েছে। কারণ বছরে একবার নীল নদের কারণে বন্যা হয়। পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে পলিমাটি থেকে যায়, যা বিভিন্ন ফসল, বিশেষ করে গম উৎপাদনে বড় ভূমিকা রাখে।
প্রাচীন মিশরের মানুষ এই নীল নদকে তাদের আধ্যাত্মিক জীবনের অংশ মনে করতো। মনে করা হতো ফারাও রাজারা এই নীল নদের পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করেন।
আমাজন (ব্রাজিল)
৪ হাজার মাইল লম্বা আমাজন নদী পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী। নীল নদের চেয়ে দৈর্ঘ্যে খানিকটা ছোট হলেও আমাজন তার জীববৈচিত্র, শাখা নদী ও পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ বিশুদ্ধ পানির উৎসের কারণে শ্রেষ্ঠ।
বিশাল এই নদী আটলান্টিক মহাসাগরে গিয়ে পড়ার আগপর্যন্ত বলিভিয়া, পেরু, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল ও ইকুয়েডর পাড়ি দিয়েছে। এই নদীতে আছে অন্তত ৩ হাজার প্রজাতির মাছ। বিজ্ঞানীদের গবেষণার খাতায় নাম উঠেছে আরও অনেক নতুন প্রজাতির। নদীর পানিতে জীবনযাপন করা ডলফিনদের জন্য ওরিনোকো নদীর পাশাপাশি আমাজন অন্যতম জায়গা।
আমাজন নদীর ডলফিনের গড় দৈর্ঘ্য সাড়ে ৮ ফুট। হিংস্র বুল শার্কের পাশাপাশি পিরানহা মাছ আমাজনের আরেকটি হিংস্র জলজ প্রাণী। যদিও কয়েকটি প্রজাতির পিরানহা এখন পর্যন্ত মানুষকে আক্রমণ করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ফিচার ইমেজ- BBC.com