বিগত কয়েক বছর ধরে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্যটকদের কাছে যেসব ঝর্ণা আকর্ষণীয় এবং উপভোগ্য হিসেবে ধরা দিয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের নাপিত্তাছড়া ঝর্ণা। সীতাকুণ্ড-মিরসরাই অঞ্চলের ঝর্ণাগুলোর মধ্যে খৈয়াছড়ার পর এ ঝর্ণায় সবচেয়ে বেশি পর্যটকের আনাগোনা। নাপিত্তাছড়ার রূপ-লাবণ্য এবং সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটকেরা এখানে এসে ভিড় জমান।
ঢাকা থেকে এ ঝর্ণায় আসতে চাইলে চট্টগ্রামগামী বাসে মিরসরাইয়ের নয়দুয়ার বাজার এসে নামতে হবে। চট্টগ্রাম থেকে যেতে চাইলে কদমতলী বা একে খান থেকে মিরসরাইয়ের বাসে উঠে নয়দুয়ার বাজার নামতে হবে। স্থানীয় ভাষায় যেটি ‘নদুয়ার বাজার’, ‘নাদুয়ার বাজার’ ইত্যাদি নামে পরিচিত। তেমন একটা বড় স্টেশন না হওয়ায় খুব একটা পরিচিত নয় বাজারটি। তাই গাড়ির অ্যাসিস্ট্যান্ট বা ড্রাইভারকে বলে রাখা উচিত।
চট্টগ্রাম শহর থেকে যাওয়ার পথে নয়দুয়ার বাজারটি মূলত মিরসরাইয়ের শুরুতে নিজামপুর অতিক্রম করা মাত্রই। যে পাশে গাড়ি থেকে নামতে হবে, সে পাশেই রয়েছে খুব সুন্দর একটি স্থানীয় মসজিদ আর কয়েকটি দোকান। রাস্তার অপরপাশে দেখা যাবে নাপিত্তাছড়া জলপ্রপাত নামে ঝোলানো ব্যানার। এখান থেকেই মূলত নাপিত্তাছড়ার পথ শুরু। নাপিত্তাছড়ার পথে আর তেমন কোনো ভালো দোকানপাট নেই, তাই নয়দুয়ার বাজারেই নাশতা সেরে সাথে কিছু শুকনো খাবার নিয়ে নিতে পারেন।
পুরো নাপিত্তাছড়া ট্রেইল জুড়ে আপনার অন্যতম বন্ধু হবে বাঁশ। কর্দমাক্ত আর পিচ্ছিল পথ পাড়ি দিতে বাঁশ কিংবা লাঠির প্রয়োজন আছে, তাই নয়দুয়ার বাজার থেকেই ছোট ছোট বাঁশ কিনে নেবেন। গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় অনেক গাইডের দেখা পাবেন, প্রয়োজন মনে করলে একজন গাইড সাথে নিতে পারেন। গ্রামীণ পথ অতিক্রম করতে করতে কিছুদূর পরেই পেয়ে যাবেন একটা রেললাইন। ঠিক এ জায়গায় কয়েকটি ভাতের দোকান আছে। ঝর্ণা থেকে ফেরার পথে এখানেই সেরে নিতে পারেন দুপুরের খাওয়াদাওয়া।
রেললাইনের ওপারে সোজা যে মেঠোপথটি চলে গেছে, সেই পথ ধরে ২০-২৫ মিনিট হাঁটলেই পেয়ে যাবেন মূল নাপিত্তাছড়ার দেখা। স্বচ্ছ পানির নিচে ছোট ছোট পাথরের সমন্বয় আপনাকে মনে করিয়ে দেবে সিলেটের বিছানাকান্দি কিংবা জাফলংয়ের কথা। পাথরের বিছানায় শুয়ে থাকা স্বচ্ছ জলে পা ভিজিয়ে অনুভব করতে পারেন এক শীতল অনুভূতি। নাপিত্তাছড়া বলতে আমরা একটি ঝর্ণা বুঝলেও এখানে মোট তিনটি ঝর্ণা রয়েছে। ঝর্ণাগুলোতে যাওয়ার ঝিরিপথ, ছড়া সবমিলিয়ে একে নাপিত্তাছড়া ট্রেইল বলা হয়। ঝর্ণা তিনটির নাম নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি থাকলেও মূলত কুপিকাটাখুম, মিঠাছড়া, বাঘবিয়ানী নামত্রয় বেশ পরিচিত।
পাহাড়ি পথ ধরে ২০ মিনিটের মতো হাঁটলেই পেয়ে যাবেন প্রথম ঝর্ণা কুপিকাটাখুম। এ ঝর্ণায় পানির পরিমাণ অনেক বেশি। গভীরতা বেশি হওয়ায় ঝর্ণার একেবারে সামনে যেতে হলে সাঁতার কেটে যেতে হবে। নাপিত্তাছড়ার প্রথম আকর্ষণ ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করবে না কারোরই। কারণ ঝর্ণার অবিরত জলধারা আর জলাধার মোহাবিষ্ট করে রাখে ভ্রমণপিপাসুদের। এবার বাকি ঝর্ণাগুলো দেখার পালা। দ্বিতীয় আর তৃতীয় ঝর্ণায় যাওয়ার জন্য কুপিকাটাখুম ঝর্ণার বাঁদিকের পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে হবে। সেখানে স্থানীয় মারমা অধিবাসীদের ছোট্ট টং দোকান পেতে পারেন।
অভিকর্ষজ ত্বরণের বিরুদ্ধে কাজ করতে গিয়ে ইতোমধ্যে বেশ কিছু শক্তি খরচ করে ফেলেছেন, তাই এখানে হালকা কিছু খেতে পারেন। কিছুক্ষণের জন্য জিরিয়েও নিতে পারেন বাঁশের বৈঠকখানায়, আর চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে নিতে পারেন প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন এখানকার ইতিহাস। নাপিত্তাছড়ার এই পাহাড়ে বাস করা অধিকাংশ মারমা, মাত্র দুয়েকটি পরিবার চাকমা। যুগ যুুগ ধরে বংশপরম্পরায় তারা টিকে আছেন এই সুউচ্চ পাহাড়ের প্রতিকূল পরিবেশে। এখানকার গাছ, বাঁশই মূলত তাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান মাধ্যম। অনেকে বড়তাকিয়া কিংবা মিরসরাই বাজারেও কাজ করেন।
বাকি ঝর্ণাগুলোতে যাওয়ার জন্য পাহাড়ি পথ বেয়ে ঝিরিপথে নামতে হবে। এভাবে ১০-১৫ মিনিট হাঁটলেই পেয়ে যাবেন একটি পয়েন্ট, যেখানে দুটো পথ। সোজা যে পথটি চলে গেছে, সেটি দ্বিতীয় ঝর্ণা বা মিঠাছড়া যাওয়ার পথ, আর বাঁদিকের পথটি তৃতীয় ঝর্ণা বাঘবিয়ানি যাওয়ার।
কোনটাতে আগে যাবেন, তা নির্ভর করছে আপনার ইচ্ছার উপর। যদি মিঠাছড়া ঝর্ণায় আগে যেতে চান, তাহলে সোজা পথ ধরে ২০ মিনিট হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন। ছবির মতো সুন্দর ঝর্ণাটি খুব সহজেই অভিভূত করে মনকে। নাপিত্তাছড়ার সবচেয়ে সুন্দর ঝর্ণা হচ্ছে এটি। এ ঝর্ণার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, বেশ উচ্চতা থেকে পড়ন্ত ঝর্ণার পানি অর্ধেক পার হবার পর দু’ভাগে ভাগ হয়ে নিচে পড়ে। এ যেন কোনো পাহাড়ি রমণীর এলিয়ে দেয়া জলভেজা চুল। ঝর্ণার নিচে পানির পরিমাণ খুব বেশি নয়। এ পানিতে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে তৃপ্ত হতে পারেন অনায়াসেই। বেশ কিছুক্ষণ মিঠাছড়ার সঙ্গে মিতালি করে যাত্রা শুরু করতে পারেন তৃতীয় ঝর্ণা বাঘবিয়ানির উদ্দেশে।
আগের টার্নিং পয়েন্ট থেকে পাশের ঝিরিপথ ধরে ২৫-৩০ মিনিট হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন তৃতীয় ঝর্ণা বাঘবিয়ানির কাছে। এ ঝর্ণায় আসার পথ খুব একটা মসৃণ নয়। ঝিরিপথে বড় বড় পাথর, গাছের ডালপালা ইত্যাদি পড়ে থাকতে পারে। তাই এ ঝিরিপথ পাড়ি দেওয়ার সময় অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। তিনটি ঝর্ণার মধ্যে এ ঝর্ণার উচ্চতা সবচেয়ে বেশি এবং ত্রিভুজ আকৃতির। অনেক উঁচু থেকে পানির পতন আর গতির জন্য এ ঝর্ণাটি বেশ উপভোগ্য। ঝর্ণার নিচে বেশিরভাগ পানি গড়িয়ে চলে যায়, ফলে খুব বেশি পানি জমে থাকতে পারে না। তাই ঝর্ণার পড়ন্ত পানির নিচে যেতে পারেন অনায়াসেই। প্রকৃতির বিশ্বস্ত কোলে এলিয়ে দিতে পারেন আপন দেহ।
নাপিত্তাছড়ার তিন সন্তানের চেহারা একেবারে ভিন্ন ভিন্ন। এই বৈচিত্র্যই নাপিত্তাছড়া ট্রেইলকে এক অনন্য রূপ দিয়েছে। বেশ তৃপ্ত মন নিয়ে এবার একই পথে ফিরে আসতে পারেন। ফেরার পথে রেললাইনের ওখানে খাবারের দোকানগুলোতে দুপুরের খাবারও খেয়ে নিতে পারেন।
বর্ষাকালেই এ ঝর্ণার প্রকৃত সুন্দর রূপ দেখা যায়। তবে এ সময়ে সতর্কও থাকতে হবে বেশি। প্রথম ঝর্ণার সামনে পানির পরিমাণ বেশি থাকায় সাঁতার না জানলে কখনই নামা উচিত হবে না। পুরো ট্রেইলজুড়ে পিচ্ছিল পথ পাড়ি দেয়ার ক্ষেত্রে সাবধানে হাঁটতে হবে। পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। কোনো ধরনের ময়লা আবর্জনা ফেলে নাপিত্তাছড়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে হবে।