টানেল বা সুড়ঙ্গের কথা শুনলেই কি আপনার গা ছমছম করে? বদ্ধ আর অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে যাবার ভয়ে অস্থির হয়ে ওঠে মন? তবে চলুন পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মনোমুগ্ধকর কিছু সুড়ঙ্গের কথা জেনে আসি, যে সুড়ঙ্গগুলো কেবলমাত্র অন্ধকারাচ্ছন্ন বা বদ্ধ নয়, বরং আলো আর রঙের প্রাচুর্যে ভরপুর। গাছপালা দিয়ে নির্মিত এসব সুড়ঙ্গ এতটাই দৃষ্টিনন্দন যে, এসবের কথা জানলে সুড়ঙ্গ সম্পর্কে আপনার ধারণাই পাল্টে যাবে। মন থেকে সুড়ঙ্গভীতি তো দূর হবেই, উপরন্তু সেসব সুড়ঙ্গে জীবনে একটিবারের জন্য হলেও প্রিয়জনের হাত ধরে হেঁটে আসার ইচ্ছে হবে।
টানেল অফ লাভ, ইউক্রেন
প্রথমেই যে সুড়ঙ্গটির কথা বলতে চাই, তার নাম ‘টানেল অফ লাভ’ বা ‘ভালবাসার সুড়ঙ্গ’। ইউক্রেনের ক্লেভেন ও ওর্জিভ গ্রামের মধ্যে অবস্থিত একটি রেললাইনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এ সুড়ঙ্গটি। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এটি গড়ে তোলেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রেললাইনের দু’পাশ দিয়ে ঘন সারিতে লাগানো হয়েছিল অসংখ্য গাছ। গাছগুলো লাগানো হয়েছিল রেলপথে মিলিটারি ক্যাম্পের অস্ত্রশস্ত্র আনা-নেওয়ার ব্যাপারটা গোপন করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পরবর্তীতে রেললাইনের দু’পাশের গাছগুলো বেড়ে ওঠে, নিয়মিত ট্রেন চলাচলের কারণে দু’পাশের গাছগুলোর মাথা এক হয়ে সুড়ঙ্গের আকৃতি ধারণ করে।
ইউক্রেনের এই সুড়ঙ্গটি দেখতে খুবই চমৎকার। ইউক্রেনের তো বটেই, সারাবিশ্বের দর্শনার্থীদের কাছে এই সুড়ঙ্গটি অন্যমত আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে । শুধু সৌন্দর্যের কারণেই নয়, এ সুড়ঙ্গটিকে ঘিরে বিভিন্ন জনশ্রুতিও প্রচলিত আছে, যার কারণেই ইউক্রেনের অসংখ্য প্রেমিক-প্রেমিকা এবং নবদম্পতি এখানে বেড়াতে আসেন। মনে করা হয়ে থাকে, ভালবাসার মানুষকে সাথে নিয়ে যদি সুড়ঙ্গে গিয়ে কিছু চাওয়া হয়, তবে সেই চাওয়া পূর্ণ হয়।
উইস্টেরিয়া টানেল, জাপান
জাপানের কিটাকিয়াসুর কাওয়াচি ফুজি গার্ডেনে একটি টানেল বা সুড়ঙ্গ রয়েছে, যার নাম উইস্টেরিয়া টানেল। নানারকম উইস্টেরিয়া ফুলের সমাহারের কারণে এ টানেলের নিচ দিয়ে হাঁটতে গেলে, যে কারোরই নিজেকে ফুলের বাগানে হারিয়ে যাওয়া রূপকথার রাজকুমার বা রাজকুমারী মনে হতে পারে।
১৫০ প্রজাতির উইস্টেরিয়ার গাছে, ২০টিরও বেশি ভিন্ন ভিন্ন রঙের ফুলের সমাহার টানেলটিকে দিয়েছে বর্ণের প্রাচুর্যতা। ধাতুর তৈরি জালিকে ঘিরে বেড়ে ওঠা বর্ণিল এবং সুশোভিত ওয়েস্টেরিয়া ফুলের সৌন্দর্যের বর্ণনা ব্যাখ্যাতীত। এই ফুল ফোটে এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে। তাই, জাপানের কাওয়াচি ফুজি গার্ডেনের এ সুড়ঙ্গ বা টানেলের সৌন্দর্য কেউ নিজ চোখে দেখতে চাইলে এপ্রিল-মে মাসই সবথেকে উৎকৃষ্ট সময়।
জ্যাকার্যানডাস ওয়াক, দক্ষিণ আফ্রিকা
দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বড় শহর জোহানসবার্গকে সবুজ করে রেখেছে এখানে জন্ম নেওয়া দশ মিলিয়নেরও বেশি ছোটবড় গাছ। অনেকের মতে, জোহানসবার্গই বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং মনুষ্যসৃষ্ট বনভূমি। সেখানে কমপক্ষে ৪৯ প্রজাতির জ্যাকার্যানডাস গাছ রয়েছে। এর বেশিরভাগেরই উৎপত্তি দক্ষিণ আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় এ গাছগুলো দক্ষিণ আফ্রিকায় আনা হয়েছিল আজ থেকে এক শতাব্দীরও পূর্বে। বর্তমানে, জ্যাকার্যানডাসকে দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতির গাছ বললেও ভুল হবেনা।
প্রতিবছর অক্টোবর মাসে হাজার হাজার জ্যাকার্যানডাস গাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়। সে সময় জোহানসবার্গ এবং প্রিটোরিয়া, বেগুনী রঙের জ্যাকার্যানডাস ফুলের শহরে পরিণত হয়। সে শহরগুলোতে সত্তর হাজারেরও বেশি জ্যাকার্যানডাস গাছের সমাহার এক অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে, যা অতুলনীয় ।
ইউ টানেল (যুক্তরাজ্য)
আঠারো শতকে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ডায়ার পরিবার ইউ টানেলের এ বিশেষ ধরণের গাছগুলো রোপণ করেছিল বলে অনুমান করা হয়। এ গাছের গুঁড়ি গুলো মোটা হয়ে একটা অন্যটার সাথে মিশেছে এবং শাখাগুলো এমনভাবে মিশে গেছে যে, এখন এগুলোকে আলাদা করা অসম্ভবপ্রায় ।
প্রায় আড়াই শ’বছর ধরে গড়ে ওঠা গাছগুলো বেঁকে উল্টো ইউ এর মত আকৃতি নিয়ে টানেল তৈরি করেছে। টানেল তৈরির উদ্দেশ্যে এই গাছ লাগানো হয়েছিল এমনটি হয়ত নয়। প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হয়েছে টানেলগুলো। তবুও এ টানেল বিশ্বের অল্পকিছু বিখ্যাত টানেলগুলোর মধ্যে একটি বলে পরিচিত। অনেক দিনের পুরনো ঐতিহ্য এবং গাছগুলোর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য টানেলটিকে অনন্যতা দান করেছে।
অটাম ট্রি টানেল (যুক্তরাষ্ট্র)
যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্টে যে অটাম ট্রি টানেলটি আছে , শরতে এর লাল, কমলা, হলুদ এবং বাদামী রঙের ফুলগুলোর ওপর যে সোনালী রঙের প্রলেপ পড়ে তা সৌন্দর্য পিপাসুদের মনকে দ্রবীভূত করতে যথেষ্ট। হলিউডের প্রচুর মুভিতে এ ট্রি টানেলের সৌন্দর্য দেখানো হয়েছে।
জিঙ্কগো ট্রি টানেল (জাপান)
জিঙ্কগো ট্রি টানেল, জিঙ্কগো বিলোবা গাছ দিয়ে ঘেরা। জাপানের টোকিওতে মেইজি মন্দিরের বাইরের বাগানে এই জিঙ্কগো গাছের সুড়ঙ্গ বা ট্রি টানেলটি রয়েছে। নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ছাড়াও জাপানের এ ট্রি টানেলটির ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্বও রয়েছে।
জাপানী সংস্কৃতিতে জিঙ্কগো গাছকে খুবই পবিত্র মনে করা হয়। এই গাছ বহু বছর বেঁচে থাকে। জাপানের রাস্তার পাশে, গার্ডেনে এবং পার্কগুলোতে ৬৫ হাজারেরও বেশি জিঙ্কগো বিলোবা গাছ রয়েছে। বলা হয়, জাপানের হিরোশিমাতে যখন বোমা ফেলা হয়েছিল, মানুষ এবং গাছপালাগুলো ভয়াবহভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সে অবস্থায়ও সেখানে ৬টি জিঙ্কগো গাছ বেঁচে ছিল। সেই গাছগুলো এখনো বেঁচে আছে এবং অনেকেই এই গাছগুলো দেখতে আসে। এত দুর্যোগ কাটিয়েও কি করে এখনো এ গাছগুলো বেঁচে আছে সেটাই বিস্ময়কর। জাপানের লোকেরা এ গাছগুলোকে…”বেয়ারার অব হোপ”, ’দ্য সারভাইভার’ বা ”দ্য লিভিং ফসিল” বলে থাকে।
দ্য ডার্ক হেজেস (উত্তর আয়ারল্যান্ড)
উত্তর আয়ারল্যান্ডের দ্য ডার্ক হেজেস টানেলটিও সত্যিই প্রশংসনীয়। দুনিয়ার সকল দেশের দর্শনার্থীদের কাছে উত্তর আয়ারল্যান্ডের এই প্রাকৃতিক বিস্ময়টি খুবই আকর্ষণীয়। এখানে আসা শিল্পীরা আঁকেন এ টানেলের খুব সুন্দর সুন্দর ছবি, সাধারণ দর্শনার্থীরা তুলেন অসাধারণ সব ছবি।
ওয়েডিং ফটোগ্রাফির জন্য আয়ারল্যান্ডের অধিবাসীদের কাছ এ টানেলটি খুবই জনপ্রিয়। এছাড়া জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘গেইম অফ থ্রোন্স’এর মধ্য দিয়ে ‘কিংস রোড’ হিসেবে খ্যাত এই টানেলটি সকলের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
সবাম্বু পাথ (জাপান)
জাপানের কিয়োটোর আরাশিয়ামা জেলায় একটা বাঁশের বাগান বা বন রয়েছে, যার নাম স্যাগানো। এই অনন্য সুন্দর এই বাঁশ বাগানের মাঝখান দিয়ে তৈরি হয়েছে ৫০০ মিটার লম্বা একটি পথ। জাপান সরকার এ বাঁশ বাগানটিকে সেদেশের ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে। লম্বা লম্বা, ঝকঝকে সবুজ বাঁশগাছের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা মনোমুগ্ধকর এক দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে।
স্যাগানোর খুব কাছেই রয়েছে বিখ্যাত সব মন্দির এবং উপাসনালয়। যখন টানেলের মধ্যে দিয়ে মৃদু-মন্দ বাতাস প্রবাহিত হয়, ঐশ্বর্যময় সৌন্দর্য আর গুঞ্জনে মুখরিত হয় টানেলটি। জাপানের সেরা একশ টি সংরক্ষিত এলাকার একটি এই বাম্বু টানেল।
রু গনসালো ডে কারভালহো (ব্রাজিল)
রু গনসালো ডে কারভালহো ব্রাজিলের রিও গ্রান্ডে দো সুল রাজ্যের রাজধানী পোর্তো অ্যালেগ্রার একটি রাস্তা। এ রাস্তায়ই গড়ে উঠেছে অনন্য সুন্দর এক ট্রি টানেল। একশটিরও বেশি রোজউড গাছের সারি দিয়ে তৈরি হয়েছে এ টানেলটি।
সাম্প্রতিককালে ব্রাজিলের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে টানেলটি। রোজউড গাছ এ এলাকায় এয়ার কন্ডিশনের চাহিদা ত্রিশ শতাংশেরও বেশি কমিয়ে দিয়েছে। এই গাছগুলো ব্রাজিলের এই শহরটির মানুষের সুস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে দীর্ঘ সময় ধরে। স্থানীয়দের মতে, রোজউড গুলো লাগানো হয়েছিল ১৯৩০ সালের দিকে। সেগুলো লম্বা হয়ে একটার সাথে অন্য মিশে তৈরি করেছে দৃষ্টিনন্দন এ টানেলটি।
চেরী ব্লসম টানেল (জার্মানি)
জার্মানির বন শহরে রয়েছে চেরী ব্লসম টানেল। শান্ত-নিরিবিলি রাস্তার পাশে চেরী গাছের সমাহারের অবর্ণনীয় সৌন্দর্য টানেলটিকে অনন্যতা দান করেছে। শরতে যখন ফুলগুলো পূর্ণোদ্দমে ফুটতে শুরু করে তখন এক অকল্পনীয় সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয় সেখানে। শহরের দুটি রাস্তার পাশে এমন চেরি গাছের টানেল রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে বেশি সুন্দরটির নাম হেয়ারস্ট্রেব। বলা হয়, চেরি ফুল ফোটে মাত্র ৭-১০ দিন, কিন্তু এই অল্প সময়েই যে ছবির মত সৌন্দর্যের দেখা দিয়ে যায় তা বর্ণনাতীত!
জাপান থেকে আনা এই চেরী গাছগুলো জার্মানির বন শহরে রোপণ করা হয়েছিল ১৯৮০ সালের দিকে। বর্তমানে সারা শহরেই ছড়িয়ে আছে অসংখ্য চেরী গাছ, যা শহরটির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুণ।