রডোডেনড্রন বললেই বাঙালির মনে পড়তে পারে অমিত-লাবণ্যের শুভ্র রোম্যান্স কিংবা মহীনের ঘোড়াগুলির ‘শহরের উষ্ণতম দিনে… বৃষ্টির বিশ্বাস’ মাখা রডোডেনড্রনের কথা। ১৯৩৮ সালে ড্যাফনি ডু মরিয়ে’র লেখা ‘Rebecca’ উপন্যাসজুড়ে রডোডেনড্রন রেবেকার তপ্তযৌবনের রঙে লাল। এই উপন্যাস অবলম্বনেই হিচকক বানিয়েছিলেন তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘Rebecca’। কিন্তু বাঙালি প্রণয়কাব্যে স্বল্পখ্যাত ‘রডোডেনড্রন’কে ভাস্বর করে তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তার ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে “পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি… উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রনগুচ্ছ” কবিতায়।
রডোডেনড্রন মূলত দেখা যায় পর্বতে, পাহাড়ে, তরাই অঞ্চলের শীতল থেকে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায়। ইউরোপের আল্পস পর্বত, অস্ট্রেলীয় উপদ্বীপ, জাভা-সুমাত্রা, আমেরিকার উত্তরাংশ, এশিয়ার হিমালয় পর্বতভূমির ভারত, চীন, জাপান রডোডেনড্রনের চারণভূমি। বর্তমানে গোটা বিশ্বে প্রায় ১১০০ প্রজাতির রডোডেনড্রন রয়েছে।
আমি প্রথম রডোডেনড্রন দেখি বসন্তের শেষে গ্রীষ্মের এক বিকেলে, নিউ জার্সিতে। বাড়ির সামনে নাতিউচ্চ ঝোঁপজুড়ে যেন উপচে পড়ছে উজ্জ্বল বেগুনি রঙের রডোডেনড্রনগুচ্ছ। আমেরিকার এই অঞ্চলেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় দেখা পেয়েছিলেন রডোডেনড্রনের (‘বাঙালের আমেরিকা দর্শন’ বইতে)। রডোডেনড্রন সাধারণত গুল্মজাতীয় গাছ, চিরহরিৎ এবং পত্রমূলাবর্ত অর্থাৎ গোলাকারে সুসজ্জিত দীঘলপত্র। ফুলটি পুষ্পমঞ্জরী, অর্থাৎ গুচ্ছাকার, কখনো সুরভিত। লাল, বেগুনি, সাদা রঙের ফুলই বেশি দেখা যায়। অ্যাজালিয়া প্রজাতির ক্ষেত্রে মূলত ফুল পাঁচটি পরাগধানীযুক্ত হয়।
গ্রিক শব্দ ‘রডোন’-এর শব্দার্থ গোলাপ এবং ‘ডেনড্রন’ মানে গাছ। নামকরণ করেন ‘মর্ডান ট্যাক্সোনমি’র জনক কার্ল ফন লিনিয়াস (জন্ম-১৭০৭, মৃত্যু-১৭৭৮) তার ‘Species Plantarum’ গ্রন্থে (১৭৫৩ সাল)। তৎপূর্বে এই ফুলকে ইউরোপে আলপাইন রোজ, আলপেন রোজ কিংবা স্নো রোজ বলা হতো। আমেরিকায় পরিচিত ছিল গ্রেট লরেল, সোয়াম্প হানিসাকেল নামে।
রডোডেনড্রনের সঙ্গে ব্রিটেনের প্রথম পরিচয় ঘটে প্রবাদপ্রতিম উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ ক্যারোলাস ক্লুসিয়াসের (১৫২৬-১৬০৯) হাত ধরে। ইনি ছিলেন ব্রিটেনে বোটানিক্যাল গার্ডেন স্থাপনের পুরোধাদের মধ্যে অন্যতম। আমেরিকায় রডোডেনড্রন শ্রেণীকরণ নিয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেন জন বারট্রাম (১৬৯৯-১৭৭৭)। ইনি ছিলেন আমেরিকার প্রথম বোটানিক্যাল গার্ডেনের স্থপতি। ছেলে উইলিয়াম বারট্রামের (১৭৩৯-১৮২৩) সঙ্গে মিলিতভাবে আমেরিকার পেনসিলভেনিয়া, জর্জিয়া, দক্ষিণ ক্যারোলিনার সামুদ্রিক অঞ্চল থেকে নানা প্রজাতির রডোডেনড্রন আবিষ্কার করেন। তার মধ্যে বেশ কিছু বীজ এবং চারা দেন পিটার কলিনসনকে (১৬৯৪-১৭৬৮)। কলিনসন ছিলেন ব্রিটেনে ‘রয়্যাল সোসাইটি’র অন্যতম সদস্য। তার ‘পেকহ্যাম গার্ডেন’, পরবর্তীকালে ‘দ্য মিল হিল গার্ডেন’ ছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি ব্রিটেনের সেরা এবং দুষ্প্রাপ্য ফুলের বাগান।
ষোড়শ-সপ্তদশ শতক থেকেই ইউরোপ, আমেরিকায় বোটানিক্যাল গার্ডেন স্থাপিত হতে থাকে, এবং শুরু হয় বাণিজ্যিকভাবে হাইব্রিডাইজেশন বা সংকরায়ণ। বিভিন্ন গাছ, গোলাপ, টিউলিপ ইত্যাদি ফুলসহ অভূতপূর্ব সৌন্দর্য্যের কারণে রডোডেনড্রনেরও চাহিদা বাড়তে থাকে। ফলতঃ উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞরা গাছ, ফুল, চারা ইত্যাদি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশে অভিযান শুরু করেন। হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল, চীন, বৃহত্তর ভারতবর্ষ ক্রমশঃ উঠে আসে অভিযাত্রীদের পছন্দের উপরের তালিকায়। ভারতে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র আধিপত্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয়রা আসতে শুরু করেন। তাদের মধ্যে রডোডেনড্রন সংগ্রাহক হিসেবে উল্লেখযোগ্য হলেন, ভারতীয় উদ্ভিদবিজ্ঞানের জনক হিসেবে পরিচিত ড. উইলিয়াম রক্সবার্গ (১৭৫১-১৮১৫)। তিনি রডোডেনড্রনসহ প্রায় ৫০০০ ভারতীয় বৃক্ষের নমুনা তালিকাভুক্ত করেন। পরবর্তী বিশিষ্ট নাম উইলিয়াম গ্রিফিথ (১৮১০-১৮৪৫)। তার আসাম, সিকিম, ভুটান, ব্রহ্মদেশ (অধুনা মিয়ানমার) থেকে সংগৃহীত ৯,০০০ বৃক্ষের তালিকায় রয়েছে ভুটানের আটটি দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির রডোডেনড্রন।
তবে রডোডেনড্রনের বিশ্বজোড়া মুগ্ধতার নেপথ্যে রয়েছে ভারতের অঙ্গরাজ্য সিকিম এবং একজন স্যার জোসেফ ডাল্টন হুকার (১৮১৭-১৯১১)। ১৮৪৮ থেকে ১৮৫১ সাল পর্যন্ত সিকিমসহ হিমালয়ের গভীর পার্বত্য অরণ্য থেকে তিনি ৪৫টি বিরল প্রজাতির রডোডেনড্রন আবিষ্কার করেন এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেন। তার পিতা উইলিয়াম হুকার ছিলেন কিউয়ের বিখ্যাত রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেনের ডিরেক্টর। অ্যান্টার্কটিকা এবং অ্যাটলান্টিক দ্বীপপুঞ্জ অভিযান সেরে পিতার নির্দেশে কিউ গার্ডেনের জন্য বৃক্ষ সংগ্রহে হুকার পাড়ি দেন ভারতবর্ষে।
১২ই জানুয়ারি, ১৮৪৮। হুকার সাহেব পা রাখলেন পান্থপাদপ (Fan Palm), অর্জুন (Terminalia), তালগাছে (Toddy Palm) ঘেরা সুন্দরবনের লবণাক্ত বনাঞ্চলে। এলেন কলকাতায়, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন তৎকালীন ‘কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ড. ম্যাকলেল্যান্ড এবং এশিয়াটিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট জেমস কোলভিক। তার প্রদত্ত পালকি চড়ে লাল সুড়কি ঢাকা গ্র্যান্ড ট্যাঙ্ক রোড দিয়ে যাত্রা শুরু হল হুকারের। তিন বছর ধরে বাংলা এবং হিমালয়ের পার্বত্য এলাকা থেকে সংগৃহীত ৬০০০ বৃক্ষনমুনা এবং অভিজ্ঞতার কথা তিনি লিখেছেন ‘হিমালয়ান জার্নালস’-এ। দেখলেন আম-কাঁঠাল-ঘোড়ানিম-অশ্বত্থে ঘেরা বাংলার গ্রাম, ‘সবুজ হ্রদের মতো পোস্তর ক্ষেত’, দিগন্তবিস্তৃত নীলের ক্ষেত, বটের ছায়ায় শাপলাভর্তি দীঘি, উজ্জ্বল সূর্যমুখী, সর্ষের ক্ষেত, লাক্ষার বন। গেলেন কয়লা অধ্যুষিত দামোদর অববাহিকায় বর্ধমান রাজার দরবারে, জৈনদের পবিত্র তীর্থ পরেশনাথ পাহাড়, হিন্দুতীর্থ বেনারস। হাতির পিঠে পৌছলেন বীরভূম, বিহারের শাল (Vateria robusta) মহুয়া, পলাশ (Butea), সোনালী শিমুলের (Cochlospermum) পত্রঝরা অরণ্যে।
হুকার সাহেব লিখেছেন বঙ্গদেশের আর্দ্রতাময়, তপ্ত গ্রীষ্মের দাবদাহের কথা, আরও লিখেছেন রাতের স্বচ্ছ তারাভরা আকাশ, মিঠে গাঙ্গেয় হাওয়ার কথা। দীর্ঘ যাত্রাপথে কখনো ধূলোর ঝড়, কখনো দুর্ধর্ষ ঠগীদের আক্রমণ পেরিয়ে শিলিগুড়ির তরাইয়ে দিকচক্রবালে প্রথম দেখলেন হিমালয়ের রেখা। এরই মধ্যে এঁকে চলেছেন একের পর এক ছবি যা রয়েছে ‘হিমালয়ান জার্নালস্’-এর পাতা জুড়ে। এগিয়ে চললেন দার্জিলিংয়ের দিকে। নরম মোরামপথ বদলে গেল আঁকাবাঁকা পাথুরে উচ্চতায়। তেঁতুল, টোপাকুল (Jujube), তাম্রপুষ্প (রক্তকাঞ্চন, Bauhinia), স্বর্ণলতা (Cuscuta), বাবলার ঝোপ (Acacia) পরিবর্ধিত হল জুনিপার, মঞ্জিষ্ঠা (Rubia) বার্চ, ম্যাপল গাছের বিশাল আয়োজনে। দার্জিলিংয়ে মি. হাডসনের বাড়ির জানলা দিয়ে হিমালয় দেখার সাবলাইম বা মহোত্তম অনুভূতির কথা জানিয়ে হুকার সাহেব লিখছেন,
‘দূরে স্পষ্ট তুষারাবৃত পর্বতরেখায় কখনো সদ্যোত্থিত কখনো অস্তসূর্যের গলিত আভায় মেঘের প্রতিচ্ছটায় কমলা, সোনালী, চুনির রঙে রাঙানো, কখনো আবার তাতে গোধূলির পান্ডুবর্ণের খেলা। এমন বায়বীয় দৃশ্য যেন বর্ণনাতীতভাবে অপ্রশমিত মনোময়তায় দিনের পর দিন কেবল দেখে যেতে ইচ্ছে করে।’
দার্জিলিংয়েই নদীবিধৃত বালাশোন উপত্যকায় ৭,৩০০ ফুট উচ্চতায় অশোক (Honeysuckle), করবী (Laurels), বাসন্তীকুসুম (Primrose), নীলাবা পুষ্পের (Hydrangea) মাঝে প্রথম দেখলেন সুবাসিত শ্বেতশুভ্র রডোডেনড্রনগুচ্ছ (Rhododendron Dalhousiae), পাশে রডোডেনড্রনের চিরসখা ম্যাগনোলিয়া। হুকারের আঁকা স্কেচগুলির মধ্যে বিখ্যাত এই রডোডেনড্রন ডালহৌসি, যা পরে তার ‘রডোডেনড্রনস অফ সিকিম-হিমালয়’ বইতে স্থান পায়।
রঙ্গিত নদীর ধার ঘেঁষে চড়াই-উৎরাই পথে কখনো চা বাগান, অধিত্যকায় লেপচাদের আলু, বুনো স্ট্রবেরি, জোয়ার, জিরে, গাঁজার ক্ষেত, বেতের সাঁকো, ‘ওঁ মণিপদ্মে হুঁ’ বৌদ্ধমন্ত্র খোদিত গিরিপ্রস্তর পেরিয়ে পৌঁছালেন সিকিম। সেখানে রডোডেনড্রন পরিচিত ‘গুরাস’ নামে। এর পাঁপড়ি দিয়ে তৈরি হয় অসাধারণ শরবত। শুধু বৃক্ষ সংগ্রহই নয়, হুকার তার সঙ্গে দিয়েছেন হিমালয়ের বিভিন্ন পার্বত্য জাতির জীবনযাপনের বর্ণনা, যার মধ্যে রয়েছে লেপচা, গোর্খা, মুর্মি, মারগা, ভুটিয়া, তিব্বতি, খাসিয়া, গারো ইত্যাদির মতো পার্বত্য জাতিরা। নেপালে গাছের শেকড় থেকে তৈরি কুখ্যাত বিষ ‘বিখ’, প্রাচীন বৌদ্ধগুম্ফায় মানুষের জানুর হাড় দিয়ে তৈরি বাদ্যযন্ত্র, খাসিয়াদের শিলালিপি সমন্বিত প্রস্তর শবাধার, লেপচাদের দুর্ধর্ষ ছুরি ‘কুকরি’, তিব্বতি শিশুদের বহন করবার জন্য রডোডেনড্রন পাতা দিয়ে তৈরি ঝুরি, লেপচাদের সঙ্গে ম্যাপল গাছের শেকড় দিয়ে বানানো পাত্রে মাখন, নুন মিশিয়ে চা খাওয়ার অভিজ্ঞতা, বইটির পাতায় পাতায় রয়েছে এমন বিস্ময়। সিঙ্গালীলা পর্বতমালার ৭০০০ থেকে ১৫০০০ ফুট উচ্চতায় খুঁজেছেন রডোডেনড্রনসহ স্থানীয় বিরল প্রজাতির বৃক্ষরাজি, আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় ব্যবহৃত জটামানসী (Potentilla), লোধ্র (Symplocos), তৃণগন্ধা (Convolvuli), ধাতকী (Wood fordia), সোনালু (রবীন্দ্রনাথ যার নামকরণ করেছিলেন অমলতাস, Cassia), জায়ফল (Screwpine), বিছুটি (Nettles), ঝলৈ (Hoya), করমচা (Carissa) ইত্যাদি।
সারাদিন চলতো অভিযান, রাতে কখনো বুনো পাতার ছাউনিতে, কখনো পাথরের খাঁজে তাঁবুতে শুয়ে দেখতেন জঙ্গল জুড়ে বহ্ন্যুৎসব, বাঁশফাটার আওয়াজ, ব্যাঙ, ঝিঁঝিঁর অন্তহীন কলতান, কখনো দিনভোর বৃষ্টির আওয়াজ, সবুজ পাতায় মিশে থাকা লাউডগা সাপ, কস্তুরী মৃগের সুগন্ধ, উচ্চিংড়ের উৎপাত। মে মাসের এক সকালে সংকীর্ণ গিরিচূড়া পেরিয়ে মসঘেরা উপত্যকায় সন্ধান পেলেন ‘অলঙ্কারের মতো অপরূপ বেগুনি পুষ্পমঞ্জরী’ সমন্বিত ৪০ ফুট উঁচু রডোডেনড্রন মহীরূহের (R. Barbatum)। সঙ্গে ঘন সবুজ পর্ণরাশি, ম্যাগনোলিয়া, বাতাসে এলাচের (Zingiberales) সুবাস। কাঞ্চনজঙ্ঘা যাবার পথে ওয়ালচুন গ্রাবরেখায় অভ্রখচিত গিরিখাতে পেলেন উত্তর হিমালয়ের বিশেষ প্রজাতির পান্ডুর বর্ণের রডোডেনড্রন(R. Hodgsoni), ১৩,২৯০ফুট উচ্চতায় ছাঙ্গুতে দেখলেন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে রডোডেনড্রনের পুষ্পসজ্জা।
পরের বছর গ্রীষ্ম কাটালেন খাসিয়া, গারো, জয়ন্তিয়া পাহাড়ে। লাল গ্রানাইট পাথরে মোড়া খাসিয়া পাহাড়ের অরণ্য সম্পদ মুগ্ধ করেছিল হুকারকে। তারমধ্যে রয়েছে লাল, সাদা রডোডেনড্রনগুল্ম, ঝুমকোলতা (Buttercup), কেয়া (Pandanus), রক্তমন্দার বা পারিজাত(Erthrina), গুয়ামৌরি(Actinidia), বনচম্পা (Astilbe), ফলসা (Grewia), চক্রফুল (Illicium) ইত্যাদি। সংগ্রহ করলেন প্রায় ১৫ ধরণের ওক, ২৫০ টি প্রজাতির অর্কিড। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারতের শ্রেষ্ঠ এবং বিরলতম অর্কিড ‘Vanda Coerulea’। জেমস প্রিন্সেপের নামান্বিত অর্কিড কারঞ্জ (যার নামে কলকাতার বিখ্যাত দ্রষ্টব্যস্থল প্রিন্সেপ ঘাট, Prinsepia Utilis)। শিলঙ অভিযান শেষে হুকার তার পরমবন্ধু এবং কালজয়ী বির্বতনবাদের প্রবক্তা চার্লস ডারউইনকে ২৬শে ডিসেম্বর, ১৮৫০ তারিখে লেখা চিঠিতে জানাচ্ছেন ‘উদ্ভিজ্জ এবং জৈব প্রার্চুয্যে খাসিয়া পাহাড় যেন মিনিয়েচার হিমালয়ের মতো মনোমুগ্ধকর’। হুকার তার বিখ্যাত ‘হিমালয়ান জার্নালস্’ উৎসর্গ করেছিলেন ডারউইনকেই।
হুকারের পরবর্তীকালে রডোডেনড্রন আবিষ্কারে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন রেখেছিলেন আইরিশ বৃক্ষবিশারদ অগাস্টাইন হেনরি (১৮৫৭-১৯৩০), ব্রিটেনের ফ্রান্সিস কিংডন-ওয়ার্ড (১৮৮৫-১৯৫৮)। তারা হিমালয়ের পার্বত্যভূমিতে খুঁজে পেয়েছিলেন বিশেষ প্রজাতির রডোডেনড্রন, যা নামাঙ্কিত হয়েছে তাদের নামে (R. Augustinii, R. Wardii)। তবে জোসেফ হুকার কেবল উদ্ভিদবিজ্ঞানীই ছিলেন না, বৃক্ষ অন্বেষণসূত্রে ভারতীয় হিমালয়ভূমির ভূতত্ত্ব, জনজাতিদের নৃতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বিষয়ে সর্বাঙ্গীন পর্যালোচনা করেছিলেন তার ‘হিমালয়ান জার্নালস্’ বইতে, যা অভিযানমূলক সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত। তার স্মরণে দার্জিলিংয়ে রয়েছে ‘হুকার রোড’। পরবর্তীকালে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি ব্রিটেনের ঐতিহাসিক কিউ বোটানিক্যাল গার্ডেনের ডিরেক্টর পদে সম্মানিত হন, এবং উনিশ শতকের বিজ্ঞানের পুরোধা পুরুষদের মধ্যে পরিগণিত হন।
রডোডেনড্রন অন্বেষণ কিন্তু থেমে নেই। ২০১৩ সালে অরুণাচল প্রদেশে দেখা মিলেছে সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির একটি রডোডেনড্রন (R. Mechukha)। প্রতি বছর বসন্তের শেষ থেকে গ্রীষ্ম পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে ভারতেও দেখা যায় এই ফুলের অপরূপ সমারোহ। ‘আন্তর্জাতিক রডোডেনড্রন উৎসব’ পালিত হয় সিকিমে, প্রতি বছর মার্চ মাসে। এটিকে সিকিমের জাতীয় ফুলের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। সত্যজিৎ রায় তার ‘সিকিম’ নামের তথ্যচিত্রে (১৯৭১ সালে বানানো) রডোডেনড্রনকে বলেছিলেন ‘গ্লোরি অফ সিকিম’।
একটি রডোডেনড্রন গাছে প্রথম ফুল আসতে সময় নেয় প্রায় ৩-৪ বছর। ফুল হয় সাধারণত বছরে একবারই, এবং তারও স্থায়িত্ব ১-২ সপ্তাহ (প্রজাতিভেদে তারতম্য রয়েছে)। তারপরেই বিচ্ছেদকাতর হয়ে পাঁপড়ি ঝরে যায় একে একে। আবার দীর্ঘ বছরের প্রতীক্ষার প্রহর গোনা। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে,
“তব অন্তর্ধানপটে হেরি তব রূপ চিরন্তন।
অন্তরে অলক্ষ্যলোকে তোমার পরম-আগমন।
লভিলাম চিরস্পর্শমণি;
তোমার শূন্যতা তুমি পরিপূর্ণ করেছ আপনি।”