Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সুসং দুর্গাপুরে একা একদিন

‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে…’

আমি রবীন্দ্রনাথের খুব বড় কোনো ভক্ত নই, কিন্তু এই বিশেষ লাইনটি ছোটবেলা থেকেই আমার পছন্দের। একটাই জীবন। অন্যের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে সময় নষ্ট করাটা পোষায় না। তাই গত বছর থেকেই ‘সোলো ট্রাভেলিং’ বা একাকী ভ্রমণ শুরু করি। এজন্য বেশ সাহসের প্রয়োজন ছিল, আর শুরুতে বেশ ভয়ও করতো। এখনও করে। তবে এখন এটাই আমার সবচেয়ে বড় শখে পরিণত হয়েছে। আর সেই ধারা বজায় রাখতেই এবারের গন্তব্য ছিল নেত্রকোনা জেলার সুসং দুর্গাপুরের বিজয়পুর ও বিরিশিরি অঞ্চল।

দুর্গাপুর বাজারের একটি রেস্তোরাঁয় সকালের নাস্তা © লেখক

প্রথমেই প্রস্তুতি ও নিরাপত্তা সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই। সোলো ট্রাভেলিং মেয়েদের জন্য বিশ্বজুড়েই বিপজ্জনক। আর আমাদের দেশে তো কথাই নেই। তার উপরে সীমান্তবর্তী ও আদিবাসী অঞ্চল হওয়ায় এই এলাকার নিরাপত্তা নিয়ে সবার মাঝেই কিছুটা দ্বিধা কাজ করে। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ নিতে হলে ঝুঁকি আবশ্যক, তবে সাহস আর দুঃসাহসের পার্থক্যটুকুও মাথায় নিয়েই চলতে হবে।

তাই একা কোথাও যাওয়ার আগে আমি চেষ্টা করি যত বেশি সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করতে। কোন ধরনের যানবাহনে সুবিধা বেশি, ভাড়া কোথায় কত পড়তে পারে, খাবার ও ওয়াশরুমের ব্যবস্থা, টিকেটের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করে তবেই যাত্রা শুরু করি। আর এই ব্যাপারেও নিশ্চিত থাকি যে, যতই প্রস্তুতি নিই না কেন, পরিকল্পনার বেশ খানিকটাই বদলে যাবে। তাই পরিকল্পনার দিকে ততটা নজর না দিয়ে আমি চেষ্টা করি নিরাপদে মূল লক্ষ্য পূরণ করতে।

কুয়াশা ঢাকা গ্রাম্য শীতের সকাল © লেখক

বিরিশিরি অঞ্চলটিকে একা একজন মেয়ের জন্য এককথায় ‘নিরাপদ’ বলব না। ঐ অঞ্চলের পুরো পর্যটন ক্ষেত্রটিই সামাজিক ও ভৌগলিক কারণে এমনভাবে তৈরি যে আমি নিজে যথেষ্ট ভাল অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসলেও, অন্য কেউ সমস্যায় পড়বে না- সেটা নিশ্চিত নয়। তবে আত্মবিশ্বাস ও চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং কিছুটা কৌশলের সমন্বয়ে এই কথিত ‘বিপজ্জনক’ অঞ্চলেও বেশ বন্ধুসুলভ মানুষের সন্ধান আমি পেয়েছি। কৌশলের ক্ষেত্রে বলবো, সামাজিক গণমাধ্যমগুলোতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভ্রমণকারী মেয়েরা তাদের ভাল-খারাপ অভিজ্ঞতা শেয়ার করে থাকে।

যেমন- বেশিরভাগ মেয়েই অবিবাহিত হয়েও অনামিকাতে একটি আংটি পরে থাকে, যেন তার একা ভ্রমণ নিয়ে কোনো আপত্তিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে না হয়। সেই সাথে, কোনো এক অজানা কারণে বিবাহিত মেয়েরা কিছুটা কম বিপদে পড়ে। এই ভ্রমণে আমিও এই ধরনেরই কিছু কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলাম।

বিজয়পুরগামী রাস্তার পাশের দৃশ্য © লেখক

এবারে আসা যাক মূল ভ্রমণে। নির্ধারিত দিনে রাত ১২টায় বাস ছাড়ার সময় ছিল। সকাল থেকে একাধিক উপায়ে রাতের এই বাসযাত্রা সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের পরেও বেশ দ্বিধায় ছিলাম, কারণ আমার হাতে ভ্রমণের জন্য সময় ছিল খুবই সীমিত। এমনকি বিকালে বাসের রিজার্ভ করেও দ্বিধান্বিত ছিলাম। শেষপর্যন্ত যখন বাসে চড়ে বসলাম, তখন একইসাথে আনন্দ ও ভয় মিশ্রিত পরিচিত অনুভূতি গ্রাস করলো। ঢাকা থেকে দুর্গাপুর, এমনকি সীমান্ত অঞ্চল লেঙ্গুরা পর্যন্ত সরাসরি বাস রয়েছে। আমি নিশিতা পরিবহনে দুর্গাপুর পর্যন্ত গিয়েছিলাম। ভাড়া ৩৫০ টাকা।

চীনামাটির পাহাড়ের প্রথম দর্শন © লেখক

পৌঁছাতে মোটামুটি ৪-৫ ঘন্টা লাগলেও রাস্তায় কাজ চলার কারণে পুরো ৬ ঘন্টা লেগেছিল। যদিও আমি এই দেরিটা হওয়ার জন্যই প্রার্থনা করছিলাম। কারণ দুর্গাপুর বাজারে বাসটি থামে, যা কোনো প্রতিষ্ঠিত বাসস্ট্যান্ড নয়। নাইট গার্ড ছাড়া আর একটি মানুষও ভোর সাড়ে চারটা-পাঁচটার সময়ে ঐ অঞ্চলে থাকে না। আর ঐ বাসে দুর্গাপুরের যাত্রী একমাত্র আমিই ছিলাম। উল্লেখ্য, বর্তমানে ঐ রাস্তায় সংস্কার ও নির্মাণকাজ চলছে, যা শেষ হলে যাতায়াতের সময় আরও অনেক কমে যাবে। পুরো যাত্রাজুড়েই বেশ দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম, কারণ রাতের অন্ধকারে একা ঐ বাজারে আলো ফোটার অপেক্ষা করাটা কোনোভাবেই নিরাপদ হবে না- এটা নিশ্চিত ছিল।

দুশ্চিন্তা তাড়াতে আরও বেশি তথ্য সংগ্রহের চেষ্টায় আশেপাশের যাত্রীদের সাথে কথা বলছিলাম। জানতে চাচ্ছিলাম যে, আমার সাথে নামার জন্য কাউকে পাওয়া যায় কি না। যদিও সবাই সেখানে অপরিচিত, তারপরেও এই ধরনের যাত্রায় প্রায়ই কিছু সম্পর্ক তৈরি হয়, যা দীর্ঘস্থায়ী না হয়েও একধরনের আস্থা তৈরি করে। তবে উল্টোটাও হতে পারে। কথা বলে জানতে পারলাম, এক ভাই দুর্গাপুর নেমে যাবেন, যদিও তার পরিবারের গন্তব্য লেঙ্গুরা। ঠিক হয়েছিল, বাস থেকে নেমে প্রথম ঘাট পর্যন্ত তিনি আমার সাথেই থাকবেন। কিন্তু বাস থেকে নামার পর তার দেখা আর পাইনি।

সবুজ লেকের পাহাড় © লেখক

ভোর ছ’টায় যখন দুর্গাপুর বাজার পৌঁছলাম, জানুয়ারির শেষ সময়ে গ্রামের সেই ভোরে ছিল হাড়কাঁপানো শীত। রেস্তোরাঁসহ একটিমাত্র চায়ের দোকান খোলা ছিল। আমার সৌভাগ্যই বলতে হবে, একটি পরিবার এই রেস্তোরাঁটি পরিচালনা করে, আর চা বানাচ্ছিলেন একজন মহিলা। বেশ কিছুক্ষণ চায়ের দোকানে চুলার ধারে বসে, চা পান করে নিজেকে সচল করার চেষ্টা করছিলাম। আর দেখছিলাম দ্বিতীয় একটি দোকান খুলছে। সেটিও ছিল একটি ছোট রেস্তোরাঁ। সকালের নাস্তার ব্যবস্থা এই দ্বিতীয়টিতেই ছিল। এমন সময়ে এলাকার ‘বাইকার’ দলের সাথে পরিচয় শুরু হয়।

পাহাড়ের চূড়া থেকে সামনের বিস্তীর্ণ মাঠ © লেখক

এখানে বলে নেওয়া প্রয়োজন, বিরিশিরি ‍ঘুরতে গেলে বাইক বা অটো ভাড়া করে ঘুরতে হয়। চাইলে রিজার্ভ করেও নিতে পারেন। তবে খুব দৃঢ়তার সাথে দর কষাকষি করতেই হবে। আমি শুরু থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বাইক নিব না। হেঁটেই ঘুরে দেখার ইচ্ছে ছিল। তবে সেটাও বোকামিই হত। বাইক পুরোদিন সমস্ত স্পট ঘুরিয়ে নেত্রকোনা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১,০০০ টাকা চেয়েছিল, যা ছিল দ্বিগুণেরও বেশি! সাধারণত ৩০০ টাকার মধ্যেই পুরো পরিদর্শনের খরচ হয়ে যায়। নেত্রকোনা যেতে চাইলে আরেকটু বেশি পড়বে। আর একজন মানুষের চেয়ে দলীয়ভাবে গেলে ভাড়া এমনিতেও কম চায়।

সোমেশ্বরী নদীর নৈসর্গিক সৌন্দর্য © লেখক

বাইকারদের অতি উৎসাহ দৃঢ়তার সাথে দমন করে আমি দ্বিতীয় রেস্তোরাঁতে রসগোল্লা, ডিম ভাজি, সবজি ও গরম গরম ভাজা দুটি পরোটা দিয়ে মাত্র ৫০ টাকায় পেট পুরে সকালের নাস্তা করি। তারপর রেস্তোরাঁর মালিকের কাছে দিক নির্দেশনা নিয়ে হেঁটেই ঘাট পর্যন্ত পৌঁছাই। এই রাস্তাটি একেবারে ছোট নয়, চাইলে রিক্সা নিতে পারেন। কুয়াশা ঢাকা শীতের সকালে সোমেশ্বরী নদীর একটি মৃতপ্রায় শাখা পারাপারের জন্য ঘাট পর্যন্ত এই হাঁটা পথটিই তখনও পর্যন্ত আমার মনে চলতে থাকা সমস্ত দ্বিধা দূর করে দেয়। এই সময় থেকেই সমস্ত দুশ্চিন্তা ভুলে আত্মবিশ্বাসের সাথে এগোতে থাকি আর যাত্রাটি পুরোপুরিভাবে উপভোগ করতে শুরু করি। নদী পারাপারের খরচ এই অঞ্চলের প্রতিটি ঘাটেই এক রকম- জনপ্রতি ৫ টাকা। একই নৌকায় মানুষের সাথে গরু, সাইকেল, মোটর সাইকেলও পারাপার হয়। সময় লাগে ৫ মিনিটের মতো।

 “একা একজন মানুষের কাছে এর চেয়ে বেশি চাওয়া যায় না”

– মো: আফজাল মিয়া, অটোরিক্সা চালক, সুসং দুর্গাপুর, নেত্রকোনা

নদী পার হয়ে শুরু হলো পরবর্তী যাত্রা পথের জন্য সময় অনুযায়ী যানবাহন নির্বাচনের পালা। আগে থেকেই ঠিক করেছিলাম- চীনা মাটির পাহাড় আর সোমেশ্বরী নদী- শুধু এই দুটি স্থান ঘুরে দেখব। সেই অনুযায়ী রিজার্ভ না করে ‘লোকাল’ হিসেবে অটো ভাড়া নিয়ে বসে গেলাম। কিন্তু প্রায় আধা ঘন্টারও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এত সকালে অন্য কোনো যাত্রীই পাওয়া যায়নি। তাই বাধ্য হয়েই সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনি। আর অটোটি রিজার্ভ করে নিই। পরবর্তীতে এই পরিবর্তনটিই এই যাত্রায় আমার সবচেয়ে ভাল সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়ায়। অবাক করা বিষয় হলো, আমি একা ছিলাম, তাই অটোচালক মোঃ আফজাল মামা আমার কাছে পুরো দিনের জন্য মাত্র ৪০০ টাকা চেয়েছিলেন রিজার্ভ ভাড়া, যেখানে পুরো দিনের জন্য এই খরচ সাধারণত ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। মাত্র দুটি স্থান ঘুরে দেখব বলে ২০০ টাকা দিয়েই সকাল ১০টা পর্যন্ত ভাড়া মিটিয়ে নিই। আমি রানীখং গীর্জা, কমলা বাগান (শীতকাল কমলা ফলনের সময় নয়) ও বিজিবি ক্যাম্প দেখতে যাইনি।

সোমেশ্বরী নদীর তীরবর্তী সোনালি বালুর চর © লেখক

চীনামাটির পাহাড়টি বিজয়পুর অঞ্চলে অবস্থিত, অটো স্ট্যাণ্ড থেকে প্রায় ১০ কি.মি পথ। বিজয়পুর পর্যন্ত রাস্তাটি অত্যন্ত সুন্দর, ড্রাইভিংয়ের জন্য আদর্শ। মসৃণ রাস্তার দুদিকে ছিল সদ্য কেটে নেওয়া ধান গাছের অবশিষ্টাংশ সম্বলিত ক্ষেত। মাঝে মাঝে হালকা জঙ্গল ও ঘরবাড়ি। কিন্তু প্রচন্ড ঠান্ডায় আর বাতাসে আশেপাশের দৃশ্য দেখতে গিয়েও চোখে জ্বালা ধরে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য স্থানীয় একটি বাড়িতে অনুমতি চাইলে তারা আতিথেয়তার মত করেই সাহায্য করেছিল।

এসকল বাড়ি ছাড়া এই অঞ্চলে ওয়াশরুমের কোনো ব্যবস্থা নেই। পাহাড়ে পৌঁছাতেই বছর দশেকের দুটি শিশু আমার সাথে ‘গাইড’ হিসেবে যোগ দেয়। এটি আমার জন্য সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারির প্রথমদিন থেকে শুরু হতে যাওয়া ‘রাশিমণি’ নামক বার্ষিক মেলাটি পর্যাপ্তভাবে উপভোগের জন্য এই ‘গাইডিং’ ছিল তাদের ‘বাড়তি’ উপার্জনের পন্থা। আর এজন্য তারা স্কুল কামাইও করছিল।

সোমেশ্বরী নদী © লেখক

চীনামাটির পাহাড়, সাদামাটির পাহাড়, গোলাপী পাথরের পাহাড়, সবুজ লেকের পাহাড় ইত্যাদি বিভিন্ন নামে এই চুনাপাথরের অঞ্চলটি পরিচিত। পাশাপাশি ৩-৪টি পাহাড় ও ২-৩টি লেক নিয়ে এই অঞ্চলটি গঠিত। পাহাড়ের সৌন্দর্য ভাষা দিয়ে প্রকাশ করতে চেষ্টাও করব না। আর ক্যামেরার কৃত্রিম লেন্সের পক্ষে কখনই তা ধরে রাখা সম্ভব নয়। লেকের একপাশে পাহাড় আর অন্যপাশে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে মাঠ। ঐ স্থানে অবস্থানের আনন্দ শুধুমাত্র বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই অনুধাবন করা সম্ভব। তাই আমিও অন্যসব চেষ্টা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ঐ মুহুর্তটিকে মনে গেঁথে রাখার চেষ্টাই করে যাচ্ছিলাম। তবে আমার ভ্রমণের আনন্দ সবসময়ই দ্বিগুণ হয়ে যায় স্থানীয়দের সাথে কথোপকথনের মাধ্যমে। জানতে পারি, নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যমণ্ডিত স্রোতহীন ঐ লেকটি ততটাও নিরীহ নয়। এর গভীরতা সঠিকভাবে আন্দাজ করতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।

এক গ্লাস খেজুরের রস ছাড়া শীতকাল অসম্পূর্ণ © লেখক

সবুজ পানির লেকের ধারে বসে আলাপের সময়েই আফজাল মামা জানালেন, এক বড় ভাইয়ের সাথে মিলে তিনিই এই অঞ্চলে রিক্সা ও অটো চলাচলের সূচনা করেছিলেন। বহু বছর আগের বেশ জটিল সেই ইতিহাস নিয়ে এখানে আর কথা বাড়াবো না। কিন্তু কথার মাঝেই লক্ষ্য করলাম, আমার অনুরোধে একটা-দুইটা ছবি তুলতে গিয়ে তিনি বেশ কিছু সুন্দর ছবিই শুধু তোলেননি, বরং তিনি বেশ দক্ষ একজন ফটোগ্রাফার বললেও ভুল হবে না। নাক উঁচু না করে, আমার শখের মুঠোফোনটি তার হাতে দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে আমার ভ্রমণ আর গল্প উপভোগ করতে থাকি। শুধু মাঝে মাঝে আমার প্রয়োজন অনুযায়ী ফ্রেমিং আর কিছু ফটোগ্রাফির জন্য তার হাত থেকে ফোনটি ফেরত নিচ্ছিলাম। আর বাকিটা সময় তার নির্দেশনানুযায়ী ‘পোজ’ দিয়ে যাচ্ছিলাম। এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক এই পিতা পুরোটা সময় জুড়েই আমার প্রতি বেশ সদয় ছিলেন।

বিজয়পুর যাওয়ার অটোস্ট্যাণ্ডের আগে গ্রামের বাজার © লেখক

বাচ্চা দুটোর হাতে ২০ টাকা দিয়ে আমি আর আফজাল মামা আমাদের দ্বিতীয় ও শেষ গন্তব্য সোমেশ্বরী নদীর উদ্দেশ্যে রওনা দিই। পৌঁছে যে দৃশ্য দেখলাম তা স্বর্গীয় বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। সুদূরে জাফলংয়ের পাহাড়ের হাতছানি আর নদীর মাঝে জেগে ওঠা সোনালি বালুর চর মিলে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করেছিল। যে স্থানে আমি নদীর একদম ধারে এসে উপস্থিত হলাম সেখানে কুল্লাগড়া অঞ্চলের কামারখালী গ্রামের দুজন হিন্দু নারী নদীর পানিতেই কাপড় ধুচ্ছিলেন। পানি এত স্বচ্ছ আর পরিষ্কার ছিল যে আমি পরনের পোশাকের বা ঠান্ডার কথা চিন্তা না করে পানিতে নেমে যাই।

মেইল ট্রেনের টিকেট- এক অবর্ণনীয় আনন্দের নাম © লেখক

হিমশীতল পানির হালকা স্রোতধারা এক অন্যরকম ভাললাগার অনুভূতি জাগিয়েছিল। কাপড় ধুতে থাকা মাসী আমাকে দেখে আমার মতোই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। তার অনুরোধে তার সাঁতারকালীন কিছু ছবিও আমাকে তুলতে হয়েছিল।

সোমেশ্বরী নদীর সৌন্দর্য এতটাই মোহনীয় যে, ঘন্টার পর ঘন্টা এখানে অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা নিজ গতিতে চলছিল। তাই আমাকেও স্থিতি পরিবর্তন করতে হলো। মামার সাথেই অটো স্ট্যাণ্ডে ফিরে এলাম। যাত্রা শুরুর সময়ে মামাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, খেজুরের রস পাওয়া যাবে কি না। তিনি “না” বলায় হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম এবং ভুলেও গিয়েছেলাম। অটো স্ট্যাণ্ডে পৌঁছে দেখি একজন মানুষ তার কাঁধে বেশ বড় সাইজের, মাঝখান থেকে কাটা দুটি প্লাস্টিকের ড্রাম বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সন্দেহ হলেও খেজুরের রস এভাবে বিক্রি হতে পারে তা আন্দাজও করিনি। কিন্তু আফজাল মামা শুধু লক্ষ্যই করেননি, আমার চাহিদার কথা মাথায়ও রেখেছিলেন। তাই খেজুরের রস পানের শখটিও এ যাত্রায় পূর্ণ হয়েছিল।

সবুজ লেকের ধারে শিশু গাইড আশরাফুল, মাজহারুল ও অটোচালক মো: আফজাল মিয়া © মাজহারুল

চুক্তি অনুযায়ী দুর্গাপুর ঘাটে না নামিয়ে আমার সুবিধার জন্য আরও একটু ঘুর পথে এসে মামা আমাকে বিরিশিরি ঘাটে নামিয়ে দেন। আবারও ৫ টাকায় নদী পারাপার। তবে পরবর্তী গন্তব্যের জন্য যানবাহন নির্ধারণে বেশ সমস্যায় পড়েছিলাম। এবারেও আত্মবিশ্বাস কাজে এলো। আমার সাথেই নৌকা পার হওয়া একজন মধ্যবয়স্ক স্থানীয় চাচাকে সময় স্বল্পতার কথা ব্যাখ্যা করাতে তিনি খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলেন, ঘাট থেকে এগিয়ে রাস্তা পার হয়ে ব্রিজের ওপরে উঠে অটো নিয়ে জারিয়া রেলস্টেশনে যেতে হবে। হাতে যে সময় ছিল তাতে এবারে আর নেত্রকোনা গিয়ে গয়ানাথের বিখ্যাত ‘বালিশ’ মিষ্টি চেখে দেখা সম্ভব ছিল না। ঝোপ-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সেই রাস্তাটি অতিক্রম করার সময় চাচা আমার সাথেই ছিলেন। ব্রিজের গোড়ায় পৌঁছে দিয়ে তবেই তিনি তার গন্তব্যের দিকে রওনা হন।

সোমেশ্বরী নদীর তীরে স্থানীয় গ্রামবাসীদের সাথে লেখক © মো: আফজাল মিয়া

বিস্তর ধুলো, চারবার পুরনো যাত্রীর অবতরণ ও নতুন যাত্রীর উত্তরণ এবং অপ্রত্যাশিত যানজট পার হয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট কিছু রাস্তা পাড়ি দিয়ে, শেষপর্যন্ত আমি ও আমার সহযাত্রীরা দুপুর সাড়ে বারোটায় জারিয়া ঝাঞ্জাইল রেলস্টেশনে পৌঁছাই। ট্রেন ছাড়ার সময় দুপুর ২টা। আগে থেকেই জানতাম যে, ‘মেইল ট্রেন’ এ চেপে ময়মনসিংহ পর্যন্ত যেতে হবে। আবারও দুশ্চিন্তা- ট্রেন কতক্ষণ থামবে? উঠতে পারবো তো? বুঝলাম, এই দুশ্চিন্তাই আনন্দকে বাড়িয়ে দেয়।

তাই তাকে দূর করার আর চেষ্টা করলাম না। শরীরের ধূলোবালি পরিষ্কার করার জন্য স্টেশনের পাশের মসজিদের সামনের টিউবওয়েলটি ব্যবহার করতে চাইলে মসজিদের একজন রক্ষণাবেক্ষণকারী আমায় জানালেন, সেটি বিকল। আর আমাকে অজু করার স্থানটি ব্যবহার করতে বললেন। আমার মাথায় কোনো হিজাব ছিল না, পরনে ছিল সম্পূর্ণ পশ্চিমা পোশাক। অথচ বিনা দ্বিধায় তিনি আমাকে মসজিদের এত ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিয়ে দিলেন! অনুভূতিটা ব্যক্ত করার জন্য সঠিক শব্দ আমার জানা নেই।

বেশ অবাক করে দিয়ে ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন উপস্থিত হলো এবং ছেড়েও দিল। প্রায় পাঁচ বছর পরে রেল ভ্রমণের আনন্দ-উত্তেজনা এতটাই ছিল যে, ২০ টাকার টিকেটটিতে নির্ধারিত সিটে না বসে, সুবিধামতো ‘ডাকবগি’তে চেপে বসলাম। দুটি সিট দখল করে আরামে বসে সহযাত্রীদের সাথে গল্প করতে করতে মোট ৬টি স্টেশন পাড়ি দিয়ে অবশেষে ময়মনসিংহ জংশন পৌঁছাই। টিকেটের কোনো বাধ্যবাধকতা এই কামরায় নেই। রেলের ডাকনিয়ন্ত্রণকারী কর্মী কিছু বকশিশ চেয়েছিলেন। এই যাত্রার শুরু থেকে শেষপর্যন্ত মোট তিনবার হালকা বৃষ্টির মধ্যে পড়তে হয়েছিল। আর পুরো যাত্রা জুড়েই বেশ কিছু ভাল মানুষ আমাকে প্রতি পদে সাহায্য করেছিলেন। তাদের সবার কথা এখানে বলা সম্ভব নয়।

This is a story of a solo travel inside the coutnry by a Bangladeshi female and written in Bengali. It provides the readers with useful insights to travel to Susang Durgapur, Netrokona.

Feature image: Author

Related Articles