জীবনের খুব অদ্ভুত একটা সময়ে পা রেখেছিলাম মেঘালয়ের মাটিতে। কোথায় যেন পড়েছিলাম, মানুষের জীবনে কিছু ভ্রমণ আসে, যা জীবনের দর্শনকেই পাল্টে দেয়, মেঘালয় ভ্রমণের আবেদন আমার কাছে তেমনই। ছক-কাটা ক্লান্ত শহুরে জীবন থেকে এক পশলা মুক্তির স্বাদ চেয়েছিলাম মেঘকন্যার কাছে, আর পেয়েওছিলাম। মোটামুটি দিন সাতেকের সেই ভ্রমণ-বৃত্তান্ত নিয়ে ছোটোখাটো একটা সিরিজ লেখা যেতে পারে, তবে আজ বলবো শুধু নংরিয়াটের কথা।
মেঘালয়ের পরিচয় নতুন করে দেবার কিছু নেই। তবে উত্তরপূর্ব ভারতের খাসি-পাহাড়ী অঞ্চলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ‘নংরিয়াট’ এর গল্প অনেকের কাছেই অজানা। সম্ভবত ২০১০ সাল থেকে এটি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হয়, তার আগে শুধুমাত্র গুটিকতক স্থানীয় পাহাড়ি অধিবাসীরাই এখানে গড়ে তুলেছিল ছোট্ট একটি পাড়া। মোটামুটি ২০১৫ সালের পর থেকে পরিচিতি পেতে থাকে অপার্থিব সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে বসে থাকা এই নংরিয়াট ট্রেইল।
আমাদের সাতজনের দলটি আগের দিন ঘুরে দেখেছিলাম শিলং শহর। আর প্রথম থেকেই সাথে ছিলেন ভীরুদা, যার গাড়িতে চড়েই স্বপ্নের মতো কেটেছিল পুরো সাতটি দিন। পরদিন ভোরে মোটামুটি আটটার ভেতর শিলং থেকে রওয়ানা হয়ে যাই তীরনা গ্রামের উদ্দেশে, যার কাছাকাছি একটি জায়গা থেকে নংরিয়াট ট্রেইলের শুরু। যেহেতু আমরা চেয়েছিলাম নংরিয়াটে রাত কাটাতে, ভীরুদা আগেই সাবধান করে দিয়েছিলেন ব্যাগ যেন বেশি ভারি না হয়। ভাঙতে হবে প্রায় তিনহাজার সিঁড়ি, পেরোতে হবে অনেকটা জঙ্গুলে-পাথুরে পথ।
ট্রেইলের মুখেই ছোটোখাট দু-একটি দোকান, কেউ চাইলে সেখান থেকে সাহায্য নিতে পারেন স্থানীয় গাইডদের। তবে মোটামুটি একধারা রাস্তা হওয়াতে গাইড ছাড়াই রওয়ানা হলাম আমরা। খাড়া নিচের দিকে নেমে যাওয়া সিঁড়ি ধরে এগোনো শুরু হলো আমাদের, সাথে করে নিয়ে নিলাম ট্রেকিং পোল, সোজা বাংলায় বাঁশের লাঠি।
কখনও উঁচু, কখনো নিচু, কখনও খাড়া, কখনো ঢালু, যেমন সিঁড়ি, তেমনি পাথুরে, কিংবা একেবারে কাচা-মাটির পিচ্ছিল পথ, হাঁপিয়ে উঠছিলাম কিছুক্ষণ পরপরই, বেশি কষ্ট হচ্ছিল একেবারে খাড়া সিঁড়িপথগুলোতে। কিন্তু কী যেন অদেখার টানে ক্লান্তি ছুঁতে পারেনি একবিন্দু। আর চারপাশের প্রকৃতি? আমার কাছে মনে হয়, এতরকম বৈচিত্র্য একসাথে খুব কমই চোখে পড়ে। ইচ্ছে হয়, হাত-পা ছড়িয়ে ডাকতে থাকা বিশাল অস্পৃশ্য পাহাড়ের কাছে মনের আকুতিগুলোকে উজাড় করে দিই, মেঘাচ্ছন্ন অসীমতার মাঝে হাহাকারগুলোকে নতুন করে প্রাণ দিই।
পথের মাঝে মাঝে দেখতে পেলাম আদিম অকৃত্রিম বড়-ছোট বেশ কিছু রুট-ব্রিজ, আর সাসপেনশন বা ঝুলন্ত ব্রিজ। তবে নংরিয়াটের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো ‘ডাবল-ডেকার রুট ব্রিজ’, যাকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রুট-ব্রিজ। শত-সহস্র বছরের পুরনো গাছের মূলগুলো জটা পাকিয়ে তৈরি হয় রুট-ব্রিজ, যার উপর দিয়ে হেঁটে সহজেই পার হওয়া যায় নংরিয়াটের বিপজ্জনক রাস্তা কিংবা নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি খরস্রোতা খাল। এছাড়াও হঠাৎই চোখে পড়তে পারে একটি-দুটি স্থানীয় চা-বিস্কুটের টং, যেখানে জিরিয়ে নিতে পারেন অল্প কিছুক্ষণ।
প্রায় পৌনে একঘণ্টা হাঁটার পর দেখা পেলাম ডাবল-ডেকার রুট ব্রিজের। প্রকৃতি বুঝি নিজের হাতেই তৈরি করে দেয় মানুষের সাথে মৈত্রীর পথ। হঠাৎ করে তাকিয়ে মনে হয়, কোনো বিশাল মাকড়সা বুঝি একটু একটু করে বুনেছিল এই বিশাল বিস্তৃত জাল। আবার কখনো মনে হয়, গাছেরা যেন বহু বছর ধরে জমে থাকা কথাগুলো একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বলতে চাইছে।
দুই ধার দিয়ে উঠে যাওয়া পাথুরে পাহাড়ের মাঝে দুর্দান্ত ছন্দে পড়তে থাকা পানির ফোয়ারা আর চারপাশের সবুজের উষ্ণ আমন্ত্রণ নিমেষেই মন ভালো করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ঝর্ণার নিচে পানির স্রোতে তৈরি হওয়া পুলের মত বিশাল অংশ, সেখানে পা অথবা শরীর ডুবিয়ে আরাম করে এক কাপ চা খাওয়া কিংবা যদি হয়, এতটা পথে হেঁটে আসার পর এক-বাটি নুডুলস বা দুপুরের খাবার, তাহলে তো কথাই নেই। কখন যে দেড়-দুই ঘণ্টা কেটে গেল, আমরা টেরই পাইনি। এর মাঝে সহযাত্রী অভি সামনে এগিয়ে গিয়ে ঠিক করে এসেছিল আমাদের রাতে থাকার ‘হোম-স্টে’, দলনেতার মতোই কাজ বটে! স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘরেই পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা হয়, এটাই মূলত ‘হোম-স্টে’।
এরপর ‘রেইন-বো ফলস’ দেখার ক্ষণ গণনা শুরু, যদিও অনেক পর্যটকই শুধু মাত্র ডাবল-ডেকার রুট-ব্রিজ দেখেই আবার ফিরতি পথের যাত্রা শুরু করে। মাঝে ‘হোম-স্টে’তে ভেজা কাপড়গুলো বদলে নিয়েছিলাম আমরা। শুরুটা বিশাল বিস্তৃত সমতল মাঠ দিয়ে হলেও রেইন-বো ফলসে যাওয়ার রাস্তা তুলনামূলক কষ্টকর। তবে মোটামুটি ধৈর্য ধরে আরো দেড়-থেকে দুই ঘণ্টা ট্রেক করলেই দেখতে পাবেন প্রকৃতির গহীনে সৃষ্টিকর্তার লুকিয়ে রাখা অদ্ভুত সৌন্দর্যের নিদারুণ চিহ্ন। পথিমধ্যে জিরিয়ে নিয়েছিলাম প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হওয়া পুলের মত নিশ্চুপ শান্তির জায়গায়, যেখানে কথা বললে মনে হবে, প্রকৃতি বুঝি বিরক্ত হচ্ছে।
আমরা যে ‘রেইন-বো ফলস’ এর খুব কাছাকাছি, এটা বুঝতে একটুও ভুল হয়নি। কারণ অনেক দূর থেকেই শুনতে পাওয়া যায়, রেইন-বো ফলসের ঝঙ্কার। সারাদিনের ট্রেকিংয়ের পর আমরা তখন অনেকটাই ক্লান্ত, হঠাৎ করেই থেমে গেলাম এক বিশাল পাথরের কিনারায়। সামনে দৃষ্টি মেলে চাইতেই কী যেন হাহাকারে মন ভরে উঠলো, এ এক ভয়ংকর আনন্দ! আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার মাঝে বেশ ভালোই ব্যবধান, তবু মনে হবে কিছু সামনেই আরো উঁচু কোনো পাহাড়ের চূড়া থেকে বীর-বেগে ধেয়ে আসছে রেইন-বো ফলস।
সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে গড়িয়ে পড়া পানির স্রোত আছড়ে পড়ছে ঠিক নিচেই রাজাসনে বসে থাকা বিরাট পাথরের ওপর, মনে হবে- কেউ যেন নিজ হাতে পাথরটিকে সেখানে বসিয়ে রেখেছে। উচ্চতাটা এতই বেশি যে, অনেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকার পরেও ছিটকে আসা পানি ভিজিয়ে দিচ্ছিল আমাদের।
পাথরের কিনারার নিচ ঘেঁষেই খাড়া ঢালু পথ, যেখান থেকে নেমে গেলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে রেইন-বো ফলসের অনেকখানি কাছে। তবে পথ দারুণ পিচ্ছিল, একটুখানি অসাবধান হলেই বিপদ। রেইন-বো ফলসের গর্জনে কেমন যেনো ঝিম লেগে যায়, উদ্ভাসিত আনন্দ পংক্তিমালা হয়ে প্রকাশ পেতে চায়, এ এক অদ্ভুত ভালোলাগার মুহূর্ত। মনে হয়, আমরা যেন পাহাড়ের মতোই বিশাল; ঝর্ণার মতোই সরল, অথচ চপল!
কতটা সময় কাটিয়েছিলাম সেখানে, মনে নেই। ঘোর ভাঙতেই মনে হলো, এবার ফেরার পালা। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই ফিরে এলাম নির্ধারিত হোম-স্টে’তে। গোসল সেরে বসতেই জমে উঠল আড্ডা, সেই সাথে হালকা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। রাতের বেলার খাবারের আয়োজন ছিল অসাধারণ। হোম-স্টে’র মানুষেরা আমাদের আপন করে নিয়েছিলো, স্থানীয় আয়োজনে এমন অসাধারণ স্বাদ!
ঝিঁঝিঁ পোকা বা অন্য কোনো নাম না জানা পতঙ্গের ডাক, মৃদুমন্দ বাতাস, দূর পাহাড়ের কোনো এক অজানা ফোয়ারার ছন্দময় গুঞ্জন, ভেঙেও যেন ভাঙতে পারেনি রাতের নিস্তব্ধতা। এক জীবনে এমন মুহূর্ত খুব কমই বোধহয় আসে।
পরদিন ভোরেই ফিরতি ট্রেইলের যাত্রা, পথিমধ্যে দেখা পেয়েছিলাম হরিয়ানা থেকে আসা একটি কর্মজীবী নারী দলের, যাদের সাথে কেটেছিল আড্ডামুখর কিছু সময়। দুপুরের আগেই পৌঁছেছিলাম তীরনা বাজারে, গিয়ে দেখি হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের সবার প্রিয় ভীরুদা!