নাম শুনেই হয়তো মনে হতে পারে, এ আবার কেমন সিঁড়ি? অনেকেই হয়তো ভেবে বসবেন, এ বুঝি সত্যিই স্বর্গে নিয়ে যাবে। ধারণাটা অবশ্য ভুল নয়, তবে এ স্বর্গ পৃথিবীতেই। সিঁড়ির ৩০০টি ধাপ পেরিয়ে যে রূপ দেখতে পাবেন, তাকে নির্দ্বিধায় স্বর্গ বলাই যায়।
অবস্থান
চট্টগ্রাম বিভাগের খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় অবস্থিত এই অদ্ভুত নামের সিঁড়িটি। পাহাড়ি নদী চেঙ্গী ও মাইনীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা। পাহাড়ের আনাচে-কানাচে বিভিন্ন ঝর্ণা, ঝিরি ও সবুজ অরণ্যের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে পার্বত্য এ জনপদ। ২৬৯৯.২৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ পার্বত্য জেলায় পর্যটন কেন্দ্রের সংখ্যা দেশের অন্যান্য পার্বত্য জেলার তুলনায় কম। দিন দিন এখানে পর্যটকের সংখ্যা বাড়লেও, বাড়েনি পর্যটন কেন্দ্রের সংখ্যা। সাজেক ভ্যালি, রিছাং ঝর্ণা ও আলুটিলা ইত্যাদি খাগড়াছড়ির নামকরা কিছু পর্যটন স্থল। তবে বর্তমানে আরেকটি নাম বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, আর তা হলো হাতিমুড়া বা স্বর্গের সিঁড়ি পাহাড়। খাগড়াছড়ির পেরাছেরা ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে পাহাড়ের গা বেয়ে এই সিঁড়ি।
এর নাম স্বর্গের সিঁড়ি কেন?
এ পাহাড়ের আরেক নাম হাতিমুড়া। স্থানীয়দের মতে, এর অবয়ব দেখতে অনেকটা হাতির মতো। পাহাড়ে বসবাসকারী ত্রিপুরারা এ পাহাড়ের নামকরণ করে ‘মাইয়োং কপা’। আবার চাকমারা এ পাহাড়কে ‘এদো শিরে মোন’ নামে জানে। চাকমা ও ত্রিপুরা ভাষায় এ শব্দ দুটির মানে হলো, ‘হাতির মাথা পাহাড়’। স্থানীয়দের দেওয়া যত নামই থাকুক না কেন, পর্যটকেরা এ পাহাড়কে ‘স্বর্গের সিঁড়ি’ নামেই চেনে। আর তাদের ধারণা, এ সিঁড়ির উপর থেকে দেখা যায় খাগড়াছড়ির সকল পাহাড়ের সবুজ ঢেউয়ের খেলা। খাগড়াছড়ি জেলার অনেকাংশই দেখা যায় এ পাহাড়ের চূড়া থেকে, যা দেখতে স্বর্গীয়। আর এ থেকেই হয়তো এর নামটা এমন হয়েছে।
কেন এ সিঁড়ি নির্মিত হয়?
সুউচ্চ এ পাহাড় পার হলেই স্থানীয় আদিবাসীদের গ্রাম, তাই এ খাড়া পথ পাড়ি দিয়েই তাদের চলাচল করতে হতো এবং গাছের গুঁড়ি নিয়েও যাতায়াত করতে হতো। এ কষ্ট লাঘব করতেই চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ২০১৫ সালে এ সিঁড়ি নির্মাণ করে দেয়। ১১০-১২০ ডিগ্রি কোণে নির্মিত এ সিঁড়ির রয়েছে ৩০০টি ধাপ, যা প্রায় ৩০৮ ফুটের কাছাকাছি। বর্তমানে যাতায়াতের পথ হিসেবে প্রায় ১৫টি আদিবাসী গ্রামের বাসিন্দা এ সিঁড়ি ব্যবহার করছে। আদিবাসীদের সুবিধার জন্য তৈরি হলেও বর্তমানে পর্যটকদের এক বিরাট আকর্ষণে পরিণত হয়েছে এটি। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক আসেন এ সিঁড়ি দেখতে।
খাগড়াছড়ির পেরাছেরা গ্রামের পরই প্রবাহিত হয়েছে খরস্রোতা পাহাড়ি নদী চেঙ্গি। এ নদী পার হয়েই যেতে হবে হাতিমুড়ায়। নদীর উপর চলাচলের জন্য কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সাঁকো।
চেঙ্গি নদীর পরেই বিস্তৃত পাহাড়ি সমতল ভূমি। কোথাও দু’পাশে পাহাড়ি চাষাবাদ করা হয়েছে, আবার কোথাও ধু ধু প্রান্তর। এসব মাঠ পেরিয়ে গেলেই দেখা মিলবে আরেকটি পাহাড়ি গ্রামের। এ গ্রামের নামও বেশ বৈচিত্র্যময়, ‘বানতৈসা’। নৃতাত্ত্বিক ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীরা মূলত এ গ্রামের বাসিন্দা। বানতৈসা গ্রামের পর স্বর্গের সিঁড়ি পৌঁছানোর আগপর্যন্ত আর কোনো লোকালয়ের দেখা মিলবে না, তবে পাহাড়ের আনাচে-কানাচে ছোট ছোট মাচাঘর দেখা যাবে। বানতৈসার পর পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে হবে স্বর্গের সিঁড়ি দেখতে। অধিকাংশ পাহাড়ের একপাশেই বিরাট বিরাট খাদ, তাই সতর্কতা আবশ্যক।
পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়বে আদিবাসীদের জুমচাষ। এ এলাকায় অধিকাংশ লোকের পেশা কৃষিকাজ। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতে ভিন্ন ভিন্ন রূপ নেয় এখানকার পরিবেশে। গ্রীষ্মে রুক্ষ হয়ে যায় প্রকৃতি, বর্ষায় প্রকৃতির সবটুকু সবুজ যেন এখানে জড়ো হয়, আর শীতে কুয়াশায় চাদর গায়ে দিয়ে বিশ্রাম নেয় এ পাহাড়।
এ এলাকার আশেপাশে কোনো ঝর্ণা বা ঝিরি না থাকায় পানির সংকট দেখা যায়। পাহাড়ি কুয়া থেকে সংগৃহীত পানি দিয়েই পানির চাহিদা মেটান স্থানীয়রা। পাহাড়ি কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করাও খুব সহজ কাজ নয়। পানি সংগ্রহ করতে অনেক পথ নিচে নেমে আসতে হয়, তারপর আবার সেই পানিসহ কলসি ওঠাতে হয় পাহাড় বেয়ে। এসব কুয়া কৃত্রিম কুয়ার মতো বিশাল বা গভীর নয়, বরং পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট গর্ত করে তৈরি করা হয়। তারপর তাতে ধীরে ধীরে পানি জমতে থাকে, আর এ পানিই ব্যবহৃত হয় দৈনন্দিন কাজে।
কুয়ার পানি কাচের মতো স্বচ্ছ আর বরফের মতো ঠাণ্ডা, পান করতেও আরাম। পানির সংকট ছাড়াও রয়েছে পাহাড়ে পথ হারানোর ভয়। এ ভয় স্থানীয়দের জন্য নয়, বরং যারা ঘুরতে যায়, তাদের জন্য। কিছু কিছু জায়গায় দেখা যায়, একেকটা পথ একেক দিকে চলে গিয়েছে, সেসব জায়গাতেই হতে পারে বিপত্তি। তাই পর্যটকদের দলবদ্ধভাবে চলাচল করা উচিত।
হাতিমুড়া পাহাড়ের মোট উচ্চতা ১,২০৮ ফুট, যার প্রায় ৯০০ ফুট পথ উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা আর অবশিষ্ট ৩০৮ ফুট জুড়ে এই স্বর্গের সিঁড়ি। দেখতে যতটা সুন্দর আর সহজ মনে হয়, তত সহজ নয় ৩০০ ধাপের এই সিঁড়ি পাড়ি দেওয়া। এ পথ বেশ খাড়া। তবে উঠে গেলেই দেখতে পাবেন, চারিদিকে সবুজের ছড়াছড়ি। সিঁড়ির একেবারে শেষপ্রান্তে উঠলেই দেখা যাবে পুরো খাগড়াছড়িকে, আর পিছনে ফিরে তাকালেই দেখতে পাবেন, বিশাল এক পাহাড় পায়ে হেঁটে পেছনে ফেলে এসেছেন। সামনে তাকালেই সবুজ পাহাড় ও সাদা মেঘের ছড়াছড়ি।
কীভাবে যাবেন?
প্রথমেই চলে যেতে হবে খাগড়াছড়ি সদরে। শহর থেকে পানছড়ি যাওয়ার সময় চোখে পড়বে জামতলী যাত্রী ছাউনি। ছাউনির বাঁ-পাশের রাস্তা ধরে হাঁটলে দেখা মিলবে চেঙ্গি নদীর। এই নদী পার হয়ে হাতের ডানপাশের রাস্তা ধরে হাঁটতে হবে। অল্প কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেখা যাবে পল্টনজয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলের কাছেই একটি দোকান আছে। এবার এই দোকানের পাশের মেঠোপথ ধরে আগাতে হবে। এ পথে দুটো সাঁকো পার হওয়ার পর একটি ধান ভাঙার কল চোখে পড়বে। কলের ডানপাশের রাস্তা ধরে হাঁটলে আরেকটি সাঁকো পার হতে হবে।
সাঁকো পার করে মূল রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাবেন বগড়া পাড়ায়। বগড়া পাড়ার পর এক বিশাল ছড়ার দেখা মিলবে। ছড়া পেরিয়ে অল্প কিছুদূর হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন আরেকটি লোকালয়ে, যার নাম কাপতলা পাড়া। এ পাড়ার একটি স্কুলের নাম ‘কৃষকের মাঠ স্কুল’। এবার স্কুলের ডানদিকের ঢালু রাস্তা দিয়ে নেমে সোজা হাঁটতে হবে। আশেপাশের প্রকৃতি উপভোগ করতে করতে দেখবেন পৌঁছে গিয়েছেন স্বর্গের সিঁড়ির কাছে।
কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশনা
১. এলাকায় পানির সংকট, তাই নিজের প্রয়োজনমতো পানি নিতে হবে। সাথে শুকনো খাবার বা গ্লুকোজ রাখতে পারেন।
২. স্থানীয়দের সাথে নমনীয় ব্যবহার করবেন। তাদের সাথে ছবি তুলতে চাইলে অবশ্যই অনুমতি চেয়ে নেবেন।
৩. পরিবেশের ক্ষতি করে, এমন কোনো অপচনশীল দ্রব্য, যেমন- পানির প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট বা পলিথিন যেখানে সেখানে ফেলে আসবেন না।
৪. যারা প্রথমবার যাবেন, অবশ্যই দলবদ্ধভাবে থাকবেন।