Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ছুঁয়ে এলাম গ্রেট ওয়াল অব চায়না: পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্যের একটি

চীনে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, ‘যে চীনের মহাপ্রাচীর অর্থাৎ গ্রেট ওয়াল ছুঁয়ে দেখেনি, সে পুরুষ নয়।‘ আর তাই চীনে যখন গিয়েছিই, তখন তো নিজের পৌরুষত্বের প্রমাণ দেয়ার জন্য হলেও গ্রেট ওয়ালে উঠতেই হবে। অবশ্য চিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম, তাদের শিডিউলেই ছিলো গ্রেট ওয়াল ভ্রমণ। ‘এক্সপেরিয়েন্সিং চায়না’ প্রোগ্রাম আর তাতে আয়োজকরা গ্রেট ওয়াল ঘুরে দেখাবে না সেটা কি হয়! নাহলে যে চীনের অনেকটাই এক্সপেরিয়েন্স করা বাকি থেকে যাবে।

মানুষের তৈরি বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্থাপনা হচ্ছে চীনের এই মহাপ্রাচীর। গ্রেট ওয়াল অব চায়না বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি অংশ হওয়ার পাশাপাশি এটিকে চীনের জাতীয় প্রতীক হিসেবেও বলা হয়। আর তাই এ মহাপ্রাচীরটিকে বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি হিসেবে গণ্য করা হয়। চীনা ভাষায় গ্রেট ওয়ালকে বলা হয় ছাংছং। এই ছাংছং এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে দীর্ঘ দেয়াল।

কেন তৈরি হয়েছিলো চীনের এই মহাপ্রাচীর তা অনেকেরই অজানা, আবার জানতে পারলেও অনেকে অবাক হয়ে যায়। তবে এর জন্য চীনের ইতিহাসের অনেক পুরনো অধ্যায়ে ফিরে যেতে হবে। আমরা বাড়ির পাশে দেয়াল দেই কেন? সহজ উত্তর হলো যাতে অন্য কেউ হুট করে আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়তে না পারে। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য যেমন আমরা বাড়ির চারপাশে দেয়াল দেই, তেমনি এই মহাপ্রাচীরও নির্মাণ করা হয়েছিলো চীনের নিরাপত্তার জন্য, চীনকে মঙ্গোলীয় দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য।

হাজার বছরের ইতিহাস সাথে নিয়ে চীনের বুকে দাঁড়িয়ে আছে গ্রেট ওয়াল; ইমেজ সোর্সঃ Escape

যিশুখ্রিস্টের জন্মের আগে থেকে শুরু হয় এই গ্রেট ওয়াল নির্মাণের কাজ। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ২,৮০০ বছর আগে এই মহাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কিন্তু তা একসময় ধ্বসে যায়। এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজা এই প্রাচীরের বিভিন্ন অংশ নির্মাণ করেন। তবে ২২০-২০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীরের সবচেয়ে দীর্ঘ অংশ নির্মাণ করেন চীনের সম্রাট শি হুয়াং। আর এই মহাপ্রাচীর নির্মাণের মাধ্যমে চীন অনেকাংশেই রক্ষা পায় ২ হাজার বছর ধরে চলে আসা মঙ্গোলীয়দের দস্যুপনা ও আক্রমণ থেকে। অবশ্য কেবল মঙ্গোলীয় শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্যই নয়, সীমান্ত এলাকায় সুরক্ষা ও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখাও ছিল এই প্রাচীর নির্মাণের অন্যতম উদ্দেশ্য। এই প্রাচীরের দৈর্ঘ্য ২১,১৯৬ কিলোমিটার যা প্রায় পুরো চীনদেশকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে।

১৫ দিনের প্রোগ্রামের শিডিউলে এক শনিবার ধার্য ছিল গ্রেট ওয়াল ভ্রমণের জন্য। তার আগের দিনই কর্তৃপক্ষ ও ভলান্টিয়াররা আমাদের জানিয়ে দিল যেন সাথে অবশ্যই ছাতা বহন করি, পাতলা কাপড় পরি ও যেন অবশ্যই মজবুত কেডস পরি। কেননা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে অনেকটা পথ। তারপরই দেখা পাওয়া যাবে গ্রেট ওয়ালের। শনিবার সকালে দলবেঁধে এই প্রোগ্রামে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ৩০০ এর অধিক অংশগ্রহণকারী সবাই মিলে যাত্রা শুরু করলাম গ্রেট ওয়ালের উদ্দেশ্যে। বাসে করে বেশ কিছুক্ষণ ভ্রমণের পর আমরা পৌঁছে গেলাম নির্ধারিত পয়েন্টে। বাসে যেতে যেতে প্রতি বাস ও দলের জন্য নির্ধারিত ট্যুর গাইড আমাদের আরো নানা অজানা তথ্য জানাতে লাগলেন গ্রেট ওয়াল নিয়ে।

পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্যের একটি এই গ্রেট ওয়াল অব চায়না। ছোটবেলায় সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে পড়া এই গ্রেট ওয়ালে উঠতে যাচ্ছি এটা ভেবেই রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম। গ্রেটওয়ালে উঠবার বিভিন্ন পয়েন্ট রয়েছে, যেহেতু এটা চীনের অধিকাংশ এলাকা জুড়েই বিস্তৃত। আমরা যে পয়েন্ট দিয়ে উঠেছি সেদিক দিয়ে গ্রেট ওয়ালে উঠতে পেরোতে হয় হাজারখানেক খাঁড়া সিঁড়ি। অবশ্য কেউ সিঁড়ি ডিঙাতে না চাইলে তার জন্য ক্যাবল কারের ব্যবস্থাও রয়েছে। কিন্তু তার জন্য গুণতে হবে অতিরিক্ত ১২০ ইয়েন, অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫০০ টাকা। একপ্রকার জেদ করেই ক্যাবল কারে না উঠে সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে গ্রেট ওয়ালে উঠবার সিদ্ধান্ত নিলাম। এই গ্রেট ওয়াল ছুঁয়ে দেখাটা যেহেতু পৌরুষত্বের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়, তাই নিজের পৌরুষত্বের প্রমাণ দিতেই আরো সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে উঠবার সিদ্ধান্ত নিলাম।

কিন্তু বিপত্তি বাঁধল মাঝ পথে। এভাবে খাঁড়া সিঁড়ি পেরিয়ে আমরা ঘেমে নেয়ে একাকার। অথচ আমাদের পাশ দিয়েই ইউরোপিয়ান তরুণীরা হাসতে হাসতে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠে যাচ্ছে। আর আমরা হাঁপিয়ে রেস্ট নিচ্ছি, সে বড় লজ্জার! সেদিন বুঝলাম ভেতো বাঙ্গালির স্ট্যামিনার কত অভাব! যা-ই হোক, অবশেষে অনেক পরিশ্রমের পর দেখা পেলাম গ্রেট ওয়ালের। সেই মুহুর্তটা ছিলো অসাধারণ। সকল কষ্ট ভুলে গেলাম গ্রেট ওয়ালে পা রেখে। গ্রেট ওয়ালের সৌন্দর্য পরিবর্তিত হয় ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে। ঋতু ভেদে নিজেকে ভিন্ন রূপে সাজায় গ্রেট ওয়াল। শীতকালে গ্রেট ওয়ালের কিছু অংশে তুষার পড়ে। কিন্তু গ্রীষকাল হওয়ায় তা দেখবার সৌভাগ্য হয়নি আমাদের। 

শীতকালে এক ভিন্ন রূপে গ্রেট ওয়াল; সোর্স: travel-leisure.com

পাথর ও কাঠের ফ্রেমে কাদামাটি ভরে এবং পোড়ামাটির ইট দিয়ে গড়া হয়েছিল চীনের এই মহাপ্রাচীর। সেই যুগের হাতিয়ার বলতে তো ছিল শাবল, কোদাল, ছোট ছোট খুরপি, হাতুড়ি, বাটালি, ছেনি এসব। সেসব হাতিয়ার নিয়ে পাহাড়ের উপর পাথর-ইট দিয়ে এই প্রাচীর গড়ে তোলা যে কতটা অসাধ্য সাধন ছিলো তা-ই কল্পনা করে পাচ্ছিলাম না। অবশ্য এই অসাধ্য সাধন করতে গিয়ে অনেক শ্রমিক প্রাণ হারায়, ইতিহাসের কোথাও তাদের নাম লেখা নেই।

চীনের এই মহাপ্রাচীরকে কল্পনা করা হয় এক বিশাল ড্রাগনের সঙ্গে। পূর্বে শাংহাইকুয়ান থেকে পশ্চিমে টপলেক পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। শুরুর দিকে মহাপ্রাচীরকে দেওয়া হয়েছে ড্রাগনের মাথার আকৃতি আর শেষের দিকে লেজের আকৃতি।শুধু পাহাড়ের উপর দিয়েই নয়, এই প্রাচীর গিয়েছে মঙ্গোলিয়ার যাযাবর স্তেপ, মরুভূমি আর নদীর উপর দিয়েও। নদীর উপর দিয়ে সেতুর মতো গিয়েছে এই প্রাচীর। আর মহাপ্রাচীরের ড্রাগনের লেজ গিয়ে নেমেছে সমুদ্রের পানিতে।

চীনের বুকে সুবিস্তৃত গ্রেট ওয়াল; সোর্স: travelerscomment.com

গ্রেট ওয়ালের মাঝে মাঝে রয়েছে খুপরির মতো কিছু ঘর। আর সেই সাথে রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। এসব খুপরি ঘরে সৈনিকরা লুকিয়ে পাহারায় থাকত। আর ওয়াচ টাওয়ার থেকে শত্রুদের চলাফেরার উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা হত। আমাদের সাথেই মঙ্গোলিয়ার এক ছেলে ছিলো। গ্রেট ওয়ালে উঠার পর থেকেই তার মুখটা বিবর্ণ দেখাচ্ছিলো। হয়ত এটাই তাকে ভাবাচ্ছিলো, সে যে প্রাচীরে দাঁড়িয়ে আছে এই প্রাচীর তার পূর্ব পুরুষদের থেকে রক্ষার জন্যই নির্মাণ করা হয়েছিলো। আর তাই সবাই মিলে গ্রেট ওয়ালের ইতিহাস নিয়ে আলোচনার সময় ও নিজেকে একটু আড়ালে রাখতে চাচ্ছিলো। গ্রেট ওয়ালের বুকে যখন আমাদের প্রোগ্রামের পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ৩০০ এর অধিক তরুণ তরুণী হেঁটে বেড়াচ্ছিল তখন নিজেকে সত্যই বিশ্ব নাগরিক মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো পৃথিবীটা কত ক্ষুদ্র। আমরা নিজেরাই একে সীমান্তের কাটা তারের বেড়ায় আবদ্ধ করে অনেক বড় করে তুলেছি।

গ্রেট ওয়ালে লাল সবুজের পতাকা হাতে লেখক

বাংলাদেশের মোট ৬ জন প্রতিনিধি ছিল এই প্রোগ্রামে। দল বেঁধে তাই লাল সবুজের পতাকা হতে নিয়ে ছবি তুলে ফেললাম। মনে হচ্ছিলো, গ্রেট ওয়ালের বুকে এক টুকরো বাংলাদেশ। গ্রেট ওয়ালের বুকে দাঁড়িয়ে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে ছবি তোলার সময় অনেকেই তাকাচ্ছিলো। অনেকে এসে বাংলাদেশ নিয়ে জানতেও চাইলো অনেক কিছু। মজার বিষয়, আমাদের প্রোগ্রামের টি শার্টও ছিলো বাংলাদেশে তৈরি। তাই যখনই বাংলাদেশ নিয়ে বলতে যেতাম তখন টিশার্টে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগটা দেখতে বলতাম। অনেকে টি-শার্ট উল্টিয়ে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ দেখে সত্যিই অবাক হতো আর গর্বে আমাদের বুকটা ভরে যেত।  

গ্রেট ওয়ালে উঠবার পয়েন্টে টিম বাংলাদেশের ৫ জন

বিশাল গ্রেট ওয়ালের বুকে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিলো। একাকীত্ব ভর করছিলো নিজের মাঝে। আবার একইসাথে গ্রেট ওয়ালের হাজার বছরের পুরনো ইটে হাত রেখে মাঝে মাঝে হারিয়ে যাচ্ছিলাম ইতিহাসের পাতায়। গ্রেট ওয়ালকে বিদায় জানাতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। ইচ্ছের বিরুদ্ধেও তাকে বিদায় জানাতে হয়েছিলো সেদিন।

আবার সেই খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয়েছে অনেকটা পথ। নামবার পথ ছিলো ভীষণ পিচ্ছিল ও বিপজ্জনক। তাই অনেক সাবধানে সময় নিয়ে নামতে হয়েছে গ্রেট ওয়াল থেকে। ইতোমধ্যে পায়ে ফোসকা পড়ে গিয়েছে। ওঠা-নামা মিলিয়ে কতটা পথ পাড়ি দিয়েছি সেটা ভাবতেও যাইনি। তখন মনের মাঝে কেবলই আনন্দ, গ্রেট ওয়াল জয়ের আনন্দ! পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্যের একটি ছুঁয়ে দেখবার আনন্দ। এ আনন্দ ভুলিয়ে দিয়েছিলো পথের সব পরিশ্রম ও কষ্ট। 

ফিচার ইমেজ: Photocrati

Related Articles