![](https://assets.roar.media/assets/VNTaKcZSzEkqDidx_kami-rita-1280x720.jpg?w=1200)
হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত থামু গ্রামের এক আদিবাসী পরিবারে জন্ম কামি রিতা শেরপার। বর্তমান বয়স ৪৯ বছর। ১৯৭০ সালে যখন তিনি জন্মগ্রহণ করেন, তখন হয়তো কেউ ভাবেননি, তার পেশাই একদিন তাকে বিশ্ব রেকর্ডের খ্যাতি এনে দেবে।
ছোটবেলায় তিনি স্বপ্ন দেখতেন, একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হয়ে ধর্ম সেবা করবেন। সেই অনুসারে থেম ডিচেন চকোহরলিং নামের এক বৌদ্ধ মঠে গুরুর সান্নিধ্য গ্রহণ ও ধর্ম সাধনা শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য তাকে সেই পথে বেশি দূর যেতে দেয়নি; টেনে এনেছে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায়।
কোনো এক ছুটির দিনে মঠ থেকে এভারেস্টের কাছে ছুটে আসলেন তিনি। তখন তার বয়স মাত্র ১২ বছর। এভারেস্ট নিয়ে কাজ করতে আসা একদল যুবকের সাথে পরিচয় হয়ে যায় তার। সেই যুবক দলের তাবুতে কয়েকদিন কাজ করার সুযোগ পান তিনি। তখনই তার মনের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন ঘটে যায়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, না, সন্ন্যাসী হবেন না; তিনি হবেন মাউন্ট এভারেস্টের আদর্শ একজন গাইড।
![](https://assets.roar.media/assets/VvSTNE81HvuK4Fvp_kami-rita-0.jpg)
রিতা শেরপার মনের এই পরিবর্তন কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। কারণ তার পরিবারের অনেকেই এই গাইড পেশার সাথে জড়িত ছিল বা আছে। তার বাবা এভারেস্টের প্রথম পেশাদার গাইড ছিলেন। ১৯৫০ সালে যখন সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক পর্যটকদের এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণের অনুমতি দেয়া হয়, তখনই তার বাবা পেশাদার গাইডের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
তার ভাই লাকমা রিতা সর্বমোট সতেরবার এভারেস্ট বিজয় করেছেন। এছাড়া তার পরিবার ও নিকটাত্মীদের মধ্যে প্রায় সকল পুরুষই কমপক্ষে একবার করে এভারেস্ট জয় করেছেন। কিন্তু রিতা শেরপা সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। গত ১৪ই মে তেইশতমবার এভারেস্ট জয় করে তিনি বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন।
নেপালের পর্যটন দপ্তরের কর্মকর্তা মিরা আচার্য বেস ক্যাম্প থেকে এ সংবাদ গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন। হিমালয়ের দক্ষিণ-পূর্বের রিজ রুট দিয়ে তিনি এবার এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন। এ সময় তাকে প্রায় ৮,৮৫০ মিটার পথ পাড়ি দিতে হয়।
![](https://assets.roar.media/assets/Hi0LbnOt2segqIUh_1717.jpg)
এর মধ্য দিয়ে তিনি নিজেই নিজের রেকর্ড ভঙ্গ করলেন। এর আগে ২০১৮ সালের ১৬ মে তিনি বাইশতমবার এভারেস্ট জয় করেছিলেন- সেটিও এতদিন পর্যন্ত সর্বাধিকবার এভারেস্ট বিজয়ের বিশ্বরেকর্ড ছিল। রিতা শেরপার তেইশতম এভারেস্ট বিজয়ের সংবাদ গণমাধ্যমকে জানিয়ে পর্যটন কর্মকর্তা মিরা আচার্য বলেন,
রিতা ১৫ মে সকাল ৭:৫০ মিনিটে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন। এরপর তিনি সুস্থভাবে ক্যাম্পে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছেন। এ সময় তার সাথে আরও ৩০ জন পর্বতারোহী ছিল, তারাও চূড়ায় আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এ সময় আবহাওয়া আশানুরূপ ভালো ছিল।
রিতা শেরপা তার জীবদ্দশায় আরও দুবার এভারেস্টের চূড়ায় যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। মোট পঁচিশবার এভারেস্ট জয় করে তিনি এই পেশা থেকে অব্যাহতি নিতে চান। তিনি বলেন,
আমি এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী। আমি পঁচিশবার এভারেস্ট জয় করতে চাই।
![](https://assets.roar.media/assets/uPG7wmwNLk7vCNhM_IMG_8129-15052019094121-1000x0.jpg)
রিতা শেরপা সর্বপ্রথম এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন ১৯৯৪ সালে। এরপর থেকে প্রায় প্রতি বছর তিনি এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করে আসছেন। তার অধিকাংশ এভারেস্ট যাত্রা ছিল মার্চ মাসের দিকে। প্রতি যাত্রায় তার গড়ে তিন মাসের মতো সময় প্রয়োজন হয়, অর্থাৎ সাধারণত মে মাসের দিকে তিনি এভারেস্টের শীর্ষে আরোহণ করতে সক্ষম হন।
এভারেস্ট বিজয়ের জন্য মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়কে আদর্শ ধরা হয়। এ সময় পর্বতের আবহাওয়া তুলনামূলক ভালো থাকে। তবুও দুর্গম ও বরফাচ্ছাদিত হিমালয়ে আরোহণের জন্য পর্যটকদের গাইডের সহায়তা নিতে হয়। গাইড হিসেবে নেপালের শেরপাদের সুখ্যাতি বিশ্বব্যাপী। আর রিতা শেরপার সুখ্যাতি তো স্বাভাবিকভাবেই সবার উপরে; কেননা তার রয়েছে সর্বোচ্চ অভিজ্ঞতা ও জানাশোনা।
এভারেস্ট ছাড়াও তিনি বিশ্বের আরও প্রায় দুই ডজন উচ্চ পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করেছেন। এর মধ্যে কে-২, চু-ইয়ো, মানাসলু এবং লটসি অন্যতম।
![](https://assets.roar.media/assets/EZT4es0gUxH42E2o_everest3.jpg)
তবে রিতা শেরপার এই পথচলা যতটা রোমাঞ্চকর, ততটাই বিপদজ্জনক। ২০১৫ সালে এভারেস্টে তুষার ধসে যখন উনিশজন পর্বতারোহী নিহত হয়, তখন রিতা শেরপাও সেই বেস ক্যাম্পে ছিলেন। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর পরিবারের চাপে তিনি এই পেশা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু বেশিদিন তিনি এভারেস্টকে ত্যাগ করে থাকতে পারেননি। অল্প কিছুদিন পর পুনরায় গাইড পেশায় ফিরে আসেন এবং এভারেস্ট যাত্রা অব্যহত রাখেন। তেইশতম এভারেস্ট যাত্রায় রওয়ানা করার আগে বার্তা সংস্থা এপিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,
মাউন্ট এভারেস্টের পথঘাট আমার ভালোভাবে চেনা। বাইশবার এর শীর্ষে আরোহণ করছি। কিন্তু আমি এটাও জানি যে, আমি সেখান থেকে ফিরে আসতে পারি, আবার না-ও আসতে পারি।
প্রতিবার গাইড হিসেবে রিতা শেরপা ১০,০০০ মার্কিন ডলার নিয়ে থাকেন। বর্তমানে তিনি ‘সেভেন সামিট ট্রেকস’ নামের একটি কোম্পানির সাথে কাজ করছেন। এই কোম্পানি মূলত এভারেস্টের পর্যটকদের নিয়ে কাজ করে।
![](https://assets.roar.media/assets/qX9LaNscGfv8qzvd_kami.jpg)
এভারেস্টে আরোহণের আনুষ্ঠানিক অনুমতি মেলার পর ১৯৫৩ সালে নিউজিল্যান্ডের স্যার এডমন্ড হিলারি ও নেপালের শেরপা তেনজিং নরগে প্রথমবারের মতো এভারেস্টের শীর্ষে আরোহণ করেন। এরপর থেকে প্রায় নিয়মিত রোমাঞ্চকর অভিযাত্রায় বিমোহিত পর্যটকরা এভারেস্ট যাত্রা করেছেন। এ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫,০০০ পর্যটক এভারেস্ট চূড়ায় আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছেন। আপনারা যখন এই আর্টিকেলটি পড়ছেন, তখনও শতাধিক মানুষ এভারেস্ট শীর্ষে পৌঁছার জন্য চেষ্টারত আছেন।
নেপাল ও চীনের তিব্বত অঞ্চল থেকে এভারেস্টের শীর্ষে যাত্রা করা যায়। এই যাত্রাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বড় ধরনের পর্যটন ব্যবসা। তিব্বতের চেয়ে নেপাল থেকেই অধিক সংখ্যক পর্যটক এভারেস্টের চূড়ায় যেতে পছন্দ করেন। এর অন্যতম কারণ, নেপালের অভিজ্ঞ শেরপাদের গাইড হিসেবে গ্রহণের সুবিধা। এছাড়া বিশ্বের ১৪টি সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের ৮টিই নেপালে অবস্থিত। ফলে এটি বর্তমানে নেপালের প্রধান রাজস্ব উপার্জনের খাতে পরিণত হয়েছে।
যদিও এতে রিতার মতো অভিজ্ঞ গাইডদের ভাগ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। সরকার তাদের জন্য বিশেষ কোনো প্রণোদনাও ঘোষণা করেনি। রিতা শেরপা আক্ষেপ করে বলেন,
সরকার কখনো আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। আমরা সারা বিশ্বে বিখ্যাত, অনেক বিদেশি আমাদের চেনেন, অথচ আমাদের সরকার আমাদের কোনো গুরুত্ব দেয় না।
![](https://assets.roar.media/assets/R9p0tOr6DM5dcTaC_1557906848-Kami-Rita-Getty.jpg)
তিনি জানান, ২০১৭ সালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হলেন। তখনও সরকার তার পাশে দাঁড়ায়নি। বিশ্বের সব দেশের প্রকৃত নায়কদের গল্প যেন রিতা শেরপার মতো অবহেলায় ভরপুর। এজন্যই হয়তো রিতা শেরপার স্ত্রী লাকমা জাংমু বলেন,
আমি বারবার তাকে অন্য কোনো চাকরি খুঁজতে বলেছি অথবা ছোট কোনো ব্যবসা শুরু করতে। কিন্তু সে আমার কথা শোনে না।
স্ত্রীর অভিমানের জবাবে রিতা শেরপা শুধু এতটুকু বলেই থেমে গেলেন,
হ্যাঁ, ভেবে দেখছি!