বিশ্বের বিভিন্ন দিশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে নানা ধরনের সংগ্রহশালা। তবে সংগ্রহশালায় ‘বাড়ি’ বললে বেশ অবাকেই হতে হয় বৈকি! এ ধরনের গ্রামীন বাড়ির সংগ্রহশালা রয়েছে জাপানে।
জাপানের এক ব্যস্ততম শহর টোকিও। এই শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে কাওয়াসাকির ইকুটা রয়োকুচি পার্ককে ঘিরে নির্মিত হয়েছে জাপানি বাড়ির এক অত্যাশ্চর্য সংগ্রহশালা ‘নিহন মিনকা এন’। প্রায় তিন হেক্টর পাহাড়ি এলাকা জুড়ে এই সংগ্রহশালা অবস্থিত। এই অনন্য জাদুঘরটি দেখতে ভিড় জমায় দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক।
১৯৬৭ সালে এই সংগ্রহশালার সূচনা। জাপানের প্রাচীন ঐতিহ্য তুলে ধরা এবং পরবর্তী প্রজন্মকে এ বিষয়ে ধারণা দেয়ার জন্য এই সংগ্রহশালার জন্ম। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন সময়ে বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে আর্কিটেকচারাল যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তা-ই তুলে আনা হয়েছে এই জাদুঘরে। প্রথমদিকে ১৬০৩ সাল থেকে ১৮৬৭ সালে পর্যন্ত বাড়িগুলোর এক রেপ্লিকা এই সংগ্রহশালায় তুলে ধরা হয়।
সময়ের সাথে সাথে বাড়ির আর্কিটেকচারাল পরিবর্তনগুলো জাদুঘরে আগত দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। ১৬টি বাড়ি নিয়ে শুরু করা এই জাদুঘরে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। বর্তমানে ২৫টিরও বেশি বাড়ি রয়েছে এই সংগ্রহশালায়। এখানেই বাড়িগুলো সযত্নে রক্ষিত আছে। বাড়িগুলোকে জাপান সরকার জাতীয় সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করেছে।
সংগ্রহশালার প্রত্যেকটি বাড়ির সাথে জুড়ে রয়েছে একটি নির্দেশিকা। এই ভবন তৈরির উদ্দেশ্য, কোথা থেকে বাড়িটি তুলে আনা হয়েছে, বাড়িটি তুলে আনার আগে কী অবস্থায় ছিল সেই ছবি, বাড়ির প্রকৃত মালিক সম্পর্কে নানা তথ্য, কখন ও কীভাবে বাড়িটি কোন ধরনের উপকরণে নির্মিত হয়েছিল, এর মেঝে এবং ছাদ নির্মাণে কী ধরনের প্রযুক্ত ব্যবহৃত হয়েছে- এসবের এক সামগ্রিক চিত্র বাড়িতে ঢোকার শুরুতে দেয়া রয়েছে। ফলে দর্শনার্থীরা খুব সহজেই বাড়ির সাথে জড়িয়ে থাকা নানা ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং বাড়ির নির্মাণকৌশল সম্পর্কে একটি পরিস্কার ধারণা লাভ করে থাকে। জাপানী এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই তথ্যগুলো সেই নির্দেশিকায় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
সংগ্রহশালার প্রধান প্রবেশপথের ধারেই রয়েছে একটি প্রদর্শনী হল, যেখানে বাড়িগুলো তৈরির নানা যন্ত্রপাতি, বাড়ি নির্মাণের প্রাচীন প্রক্রিয়াগুলো সম্পর্কে ধারণা, নির্মাণ উপকরণ, বাড়িগুলোর দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সম্পর্কিত জাপানী ও ইংরেজি ভাষায় প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়ে থাকে।
বাড়িগুলোর সামনের দিকে এবং চারপাশে গাছপালা আর বাগান দিয়ে বেশ সুন্দরভাবে সাজানো। দেখে চোখ ফেরানো যায় না। এই সংগ্রহশালায় জাপানীদের পুরনো ধাঁচের বাড়ি টাটেনার পাশাপাশি আছে প্রাচীন স্থাপত্যকলায় তৈরি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষদের বসবাসের জন্য বাড়ি সামুরাই।
বাড়িগুলোর বেশিরভাগ কাঠামোই সংগ্রহ করা হয়েছে জাপানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। বাড়িগুলো সেখান থেকে গাড়িতে তুলে আনার সময়ে কাঠামো ভেঙে ফেলা হয়েছিল। পরে বাড়িগুলো ঐ ধাঁচেই আবার তৈরি করা হয়।
জাপানের বাড়িগুলো আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। তাই মোটামুটিভাবে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলের বাড়িগুলো সেখানকার জলবায়ুর ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। জাপানীদের পুরনো ধাঁচের বাড়ি টাটেনার মেঝে শীতকালে বাড়িকে গরম রাখতে সাহায্য করলেও, গ্রীষ্মকালের পক্ষে তা অনুপযুক্ত। তাই ক্রমে ক্রমে সাধারণ মানুষ তৈরি করতে থাকে উঁচু মেঝের বাড়ি, যে ধরনের বাড়িতে আগে অভিজাত শ্রেণীর মানুষ ও যোদ্ধারা বসবাস করতো।
এই সংগ্রহশালায় থাকা বাড়িগুলোকে কেন্দ্র করে বছরের বিভিন্ন সময়ে জাপানের প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। উৎসবের অঙ্গ হিসেবে সেসব অনুষ্ঠানে প্রথাগত জিনিসপত্রও তৈরি করা হয়। যেমন- মকচি বা চালের পিঠে তৈরি হয় নতুন বছরের জন্য, ডাঙ্গো বা চালের পুডিং তৈরি করা হয় সেপ্টেম্বর মাসে যখন পূর্ণচাঁদ দেখা যায় তখন।
এছাড়া ওসব অনুষ্ঠানে নানা ধরনের জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। খেলনা এবং প্রতিদিনের কাজে লাগে এমন নানা জিনিসপত্রও তৈরি হয় কাঠ, খড় এবং বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে। আসলে এসব উৎসবের মূল উদ্দেশ্য হলো দর্শনার্থীরা যাতে সংগ্রহশালায় আসতে পারেন এবং ওই বাড়িগুলো সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারেন।
বাড়ির ভেতরে ঢোকার রাস্তা, রান্নাঘর এবং আস্তাবল ইত্যাদির মেঝে মাটির তৈরি। সাধারণত মাটি থেকে ৫০ সেন্টিমিটার উঁচুতে মেঝেগুলো কাঠের পাটাতন বা বাঁশ দিয়ে তৈরি হতো। পরে এটি টাটামিয়ন মেঝেতে পরিণত হয়। প্রতিটি টাটামি মাদুর ১৮০ সেন্টিমিটার লম্বা, ৯০ সেন্টিমিটার চওড়া এবং ৫ সেন্টিমিটার পুরু। এই টাটামি তৈরি হয় খড়ের গুচ্ছ এবং ইগুসা ঘাস দিয়ে।
জাপানীদের বাড়ির ভেতরে একটি ঘরকে আলাদা করার জন্য কাঠের দরজা, ফুসুমা এবং হোজি ব্যবহার করা হয়। বাড়িতে মোটামুটিভাবে আছে তিনরকম ব্যবস্থা। থাকার ঘর, খাওয়ার ঘর এবং শোয়ার ঘর। বাড়ির চাল আগে তৈরি হতো কায়া (একধরনের লম্বা ঘাস), খড়, কাঠ এবং গাছের ছাল দিয়ে।
যদিও পরে এসেছে টালির চলন, কাঠ বা বাঁশের কাঠামোর ওপর খড় বা গোলপাতার ছাউনি। বহুদিন ধরে তাদের বাড়ি তৈরি হয়ে আসছে সাধারণ কাঠ, বাঁশ, মাটি এবং কাগজ দিয়ে। যদিও কাঠ দিয়ে তৈরি কাঠামো ভূমিকম্পের হাত থেকে বাড়িকে টিকিয়ে রাখে, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাড়িগুলোকে আগুনের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব ছিল না।
তাই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বাড়িগুলোকে কীভাবে আগুনের হাত থেকে বাঁচানো যায় সেই ভাবনা শুরু হয় এবং বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে আনা হয় নানা বৈচিত্র্যও। এই সংগ্রহশালায় থাকা জাপানের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থাপত্যশৈলীর কাঠামোগত নানা নান্দনিকতায় মোড়া বাড়িগুলো সত্যিই অসাধারণ।
কাওয়াসাকি শহরে এক ধনী ব্যক্তির মালিকানাধীন ‘হারা হাউস’ নির্মিত হয়েছিল ১৯১১ সালে। টালির তৈরি বাঁকানো ছাদ এই বাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ‘সুজুকি হাউস’ নামক বাড়িটি নির্মিত হয়েছিল অষ্টাদশ শতকে। ফুকুশিমার মাতসুকাওয়া শহর থেকে বাড়িটি তুলে আনা হয়েছে। এটি মূলত ছিল এক ঘোড়া বিক্রেতার। নিচতলায় ঘোড়াদের আবাসস্থল এবং উপরতলায় বাড়ির মালিকের পরিবারের সদস্যরা বাস করতেন।
সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে নির্মিত সাকুডা হাউসের মূল অবস্থান ছিল চিবের বোসো পেনিসুলার কুজুকুরি বিচ এলাকায়। জেলে সম্প্রদায়ের সদস্যরা এ ধরনের বাড়িতে বাস করতেন। উনবিংশ শতকের শেষের দিকে স্টিলট নির্মিত এক অসাধারণ খাদ্য গুদামঘর ওয়াদোমারি থেকে তুলে আনা হয়েছে। জাপানের দক্ষিণ সমুদ্র উপকূল অঞ্চলে এ ধরনের ঘরের কাঠামো দেখতে পাওয়া যায়।
সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের বান্টো স্টাইলের খামার বাড়িগুলো কাসামা শহরের ইবারাকি অঞ্চল থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন স্থানের গৃহে স্থাপত্যশৈলির নানা বৈচিত্র্য দেখতে পাওয়া যায় বাড়িগুলোতে।
ফিচার ইমেজ- YouTube.com