
বাংলাদেশি সাইক্লিস্ট এবং লেখক মোহাম্মাদ আশরাফুজ্জামান এর পৃথিবী যেন ভ্রমণকে ঘিরেই আবর্তিত।
“প্রত্যেকের জীবনেই কিছু প্রাধান্য কিংবা ঝোঁক থাকে, আমার ক্ষেত্রে সেটা ভ্রমণ”- জোরালো কণ্ঠে বলছিলেন মোহাম্মাদ আশরাফুজ্জামান। বাংলাদেশি এই ভ্রমণকারী প্রায় ১৮ টি বছর ধরে ৬ টি উপমহাদেশের মোট ৫৪ টি দেশে ঘুরেছেন। আত্মস্বীকৃত এই পর্যটকের ভ্রমণপিপাসা ও আন্তরিকতা প্রায় সন্দেহাতীতভাবেই সত্য। ১৯৯৪ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ১৮ বছরের ভ্রমণকালীন সময়ের বেশিরভাগই তিনি পাড়ি দিয়েছেন তার অন্যতম প্রিয় বাহন, তার বিশ্বস্ত বাইসাইকেলে! তার মতে “বাইসাইকেলে থাকার সময় মানুষ আপনার সাথে কথাবার্তায় লিপ্ত হওয়া থকে বিরত থাকবে।”

নিজের সাইকেলের সাথে আশরাফুজ্জামান; Image Courtesy: Mohammed Ashrafuz Zaman
“বাইসাইকেলে পরিভ্রমণের জন্য আপনার খুব বেশি প্রশিক্ষণ পেতে হবে না। তারচেয়ে বেশি জরুরি কীভাবে কাজটির জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে সাইকেল চালাতে হয় তা জানা। যখন আমি এটা করছিলাম আমার পরিবার এবং বন্ধুরা ভেবেছিলেন আমি উন্মাদ। কিন্তু আমি নিজেকে সত্যিই দূর্ভাগ্যবান ভাবতাম যদি আমি স্রষ্টার সৃষ্টি করা চারপাশের এই সকল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য না দেখতে পারতাম।”- বলছিলেন ৪২ বছর বয়সী এই ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। ল্যাটিন আমেরিকাতে তার আসন্ন সফরের জন্য বিভিন্ন দূতাবাস হতে ভিসা আবেদনার্থে তিনি কুয়ালালামপুর গিয়েছিলেন। এটি ছিলো মালয়েশিয়ায় তার দ্বিতীয় সফর, প্রথমটি ছিল ২০০৫ সালে। এছাড়াও তিনি অলিম্পিক কাউন্সিল অব মালয়েশিয়ার (ওসিএম) আয়োজনে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের যতদূর যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে, ততদূর ভ্রমণের আশা নিয়ে ১৯৯৭ সালে যখন তিনি তার প্রথম বাইসাইকেল সফর শুরু করেন। তখন তার পুঁজি ছিলো মাত্র সাড়ে নয়শ ইউএস ডলার (বর্তমান বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৭৫০০০)। দশ মাসে তিনি প্রায় ১৯ টি দেশ ভ্রমণ করে ফেলেন এবং নিজের অনেক প্রত্যাশাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজের পুঁজি নিঃশেষিত না করে তিনি যখন দেশে ফিরলেন তার সংগ্রহে ছিলো ১১০০ ইউএস ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৮৭০০০ টাকা)।
তিনি বলেন, “এই দশ মাসের মধ্যে মাত্র তিনদিন আমি হোটেলে ছিলাম। বাকি সময় থেকেছি বাস স্টেশন, ফোন বুথ, গ্যাস স্টেশন, বিভিন্ন মানুষের বাড়ি এমন নানান জায়গায়।” তিনি আরো বলেন, “মিশরে থাকার সময় আমি কুড়ি দিনে মোট ৮ টি জায়গায় থেকেছি এবং তা প্রতি রাত্রে ১ ইউএস (৭৯ টাকা) ডলারেরও কম খরচে। আমি মনে করি এটি মূলত টিকে থাকার কলাকৌশল জানার উপরেই নির্ভর করে। কিন্তু আমি কখনোই সমস্যা বা কস্টগুলোর জন্য অভিযোগ করিনি কেননা, আমি শুরু থেকেই জানতাম এই কাজে এগুলো আসবেই এবং আমি তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম।”

Image Courtesy: Mohammed Ashrafuz Zaman
আশরাফুজ্জামান ভ্রমণের ওপর দুটি বইয়ের লেখক, এছাড়াও তিনি দুটি বইয়ের সম্পাদনা করেছেন এবং বাংলাদেশে তার প্রকাশনা সংস্থা ও ট্যুরিজম ব্যবসায় রয়েছে। ভ্রমণের জন্য যে টাকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না নিজস্ব অভিজ্ঞতাই তার এই বিশ্বাসকেই সুদৃঢ় করেছে- যা কিনা কিছুটা রমনাথ বিশ্বাস এর মতো খ্যাতনামা পর্যটকের উদাহরণে উজ্জীবিত।

Image Courtesy: Lim Chia Ying/The Star

Image Courtesy: Mohammed Ashrafuz Zaman
রমনাথ বিশ্বাস ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ এর মধ্যে পুঁজিবিহীন অবস্থায় পৃথিবীময় ঘুরেছেন এবং বাংলাদেশের কিংবদন্তি সাইক্লিস্ট হিসেবে সুবিদিত। আশরাফুজ্জামান বলেন, “যদি তারা এটা প্রায় কপর্দকবিহীনভাবে করে দেখাতে পারেন, আমি এখানে অবিশ্বাসের কোন জায়গা দেখছি না। আমি সৌভাগ্যবান যে ভ্রমণকালীন সময়ে সমর্থন পেয়ে গেছি- শুধু আবেগীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই নয় কিছু দয়ার্দ্র মানুষের কল্যাণে অর্থনৈতিকভাবেও। এ কারণেই আমি অতিরিক্ত অর্থ নিয়ে ফিরতে সক্ষম হয়েছি। এমনকি আজও আমি ওসিএম এর কাছে কৃতজ্ঞ আমার আসন্ন পুরো ভ্রমণ এর মিডিয়া কাভারেজ এর ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য”।

Image Courtesy: Mohammed Ashrafuz Zaman
তিনি বলেন বিগত কয়েক বছর ধরে সাইক্লিং বাংলাদেশে দিন দিন আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, প্রায় ৪০-৫০ হাজার তারুণ্যদ্দীপ্ত মানুষ এটিকে বেছে নিয়েছে। তার হিসেবে, সবমিলিয়ে সংখ্যাটা আরো বেশি কেননা নগরীর যানজটগ্রস্ত ধীরগতি এড়াতে বড়রাও আজকাল সাইকেলের দিকে ঝুঁকছেন।

Image Courtesy: Mohammed Ashrafuz Zaman
ভিসা আবেদন মঞ্জুর হলে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ল্যাটিন আমেরিকা ভ্রমণের কথা তার। তিনি যে একজন খাঁটি ভ্রমণপিপাসু তা বোঝাতে কাগজে কলমেই প্রমাণ রয়েছে প্রচুর। তিনি বলেন, “খাবারের স্বকীয়তা, অসাধারণ সব মানুষ, রোমাঞ্চকর সংস্কৃতি এবং বিনোদনের খোরাকের জন্য ল্যাটিন আমেরিকা আমার অন্যতম প্রিয় গন্তব্যস্থল। প্রথমবার সেখানে গিয়েছিলাম ২০০৫ সালে, তখন ১২ টির মধ্যে মাত্র ৫ টি দেশ ঘুরতে পেরেছিলাম।”

Image Courtesy: Mohammed Ashrafuz Zaman
এবারের সফরে তিনি তার দুই জ্ঞাতি ছোটভাইকে নিয়ে যাচ্ছেন যারা হলেন- তানভীর আহমেদ এবং ইসমাইল প্রধান। তারা বাংলাদেশ টাভেল রাইটার্স এ্যাসোসিয়েশন এর সাথে যুক্ত আছেন এবং তার সাথে সাইকেলে চেপে এই সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দেবেন। তিনি বলেন, “তাদের বয়স মাত্র বিশ এবং এ পর্যন্ত শুধুমাত্র বাংলাদেশেই সাইক্লিং করেছে। কাজেই এটা তাদের জন্য ভালো অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে।”
“আমাদের লক্ষ্য প্রতিদিন ভোর ৬ টা থেকে বিকেল পর্যন্ত প্রায় ৬০-৭০ কি.মি. এর মতো সাইক্লিং করা। ল্যাটিন আমেরিকার সব জায়গা সাইক্লিস্টদের জন্য মানানসই না হলেও বিভিন্ন দেশগু সাধারণত ভালোভাবে পরষ্পরসংযুক্ত।” পাশাপাশি এই ফাঁকে তিনি তার স্প্যানিশ ভাষাজ্ঞানও ঝালিয়ে নেবেন বলে ভাবছেন তিনি। শারীরিক ফিটনেস ধরে রাখার জন্য তাদের দৈনন্দিন খাবারে যেন পর্যাপ্ত (তবে খুব বেশি নয়) পরিমাণে ক্যালরি এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান থাকে তা নিশ্চিত করাও একটি শক্ত চ্যালেঞ্জ।

বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে শ্রীলংকায় বাংলাদেশ হাই কমিশনের আয়োজিত অনুষ্ঠানে; Image Courtesy: Mohammed Ashrafuz Zaman
তার বিপুল সংখ্যক অভিজ্ঞতার কল্যাণে তিনি বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ সাইক্লিং সংস্কৃতির উপর ধারণা দিতে পারেন, যেমন- তার মতে মধ্যপ্রাচ্য সাইক্লিস্টদের জন্য মোটেই সৌহার্দ্যপূর্ণ নয়। ইউএসএ তে কিছু কিছু মহাসড়কে রোড সোল্ডার না থাকায় সাইক্লিস্টদের জন্য কোন আলাদা ব্যবস্থা নেই। যদিও সবমিলিয়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক বাইক লেন রয়েছে যা গ্রামাঞ্চলের দিকেই বেশি বলে জানান তিনি। “ওহাইও তে একবার একজন পুলিশ আমাকে থামিয়ে দিয়েছিলেন কেননা আমি যে মহাসড়কে সাইকেল চালাচ্ছিলাম সেখানে আমার থাকার কথা নয়। এরপর আমাকে পিছিয়ে গিয়ে নির্দিষ্ট ও আইনসম্মতভাবে সঠিক পথটি ধরতে হয়েছিল।”- বলে স্মৃতিচারণ করেন তিনি। তার মতে ইউরোপ সাইক্লিস্টদের জন্য অবশ্যগমনীয় স্থান কেননা এই মহাদেশের সিংহভাগ দেশেই সাইক্লিং এর জন্য সুষ্ঠু লেন রয়েছে এবং এখানকার স্থানীয়রাও সাইক্লিস্টদের প্রতি খুব সহায়তাপরায়ণ আচরণ করে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কার চওড়া রোড শোল্ডার তার সাইক্লিং এর পর্যাপ্ত জায়গা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল; Image Courtesy: Mohammed Ashrafuz Zaman
তবে তার সফরে যে বিপদ বা ঝুটঝামেলা মুক্ত ছিলো তা কিন্তু নয়- বরং কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন যা তিনি মনে রাখতে চান না। তিনি বলেন, “এক দুইটি বিচ্ছিন্ন খারাপ ঘটনা কখনোই একটি পুরো দেশকে উপস্থাপন করে না।” জামান আরো বলেন, “আমি মনে করি ভালোবাসা সার্বজনীন; বর্ণ, ধর্মমত আর বিশ্বাস যাই হোক না কেন আমরা সবাই এক, স্রষ্টার সৃষ্টি। আমার সত্যিই খারাপ লাগে যখন শান্তি বিঘ্নিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে, ধর্মগুরু এবং রাজনীতিকদের কারণেই মানুষ বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে পড়ে।”

এই ডিসেম্বর কিংবা আগামী জানুয়ারী মাসে অ্যান্টার্কটিকা যাবার পরিকল্পনা করছেন তিনি। সময়টা গ্রীষ্মকালীন হলেও এ সময় সেখানে তাপমাত্রা থাকবে -৫০ ডিগ্রিরও বেশ নিচে। কাজেই সেখানে যাবার সম্ভাব্য খরচ হচ্ছে প্রায় ১৫০০০ ইউএস ডলার (প্রায় ১১ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা), তাই এটি এখনো পরিকল্পনা পর্যায়েই রয়েছে। “যদি আমি এটা করে ফেলতে পারি তাহলে, সফলভাবে পৃথিবীর সাতটি মহাদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাই হয়ে যাবে আমার।”- বলেন তিনি। তিনি আরো যোগ করেন- “প্রত্যেকের নিজেদের জন্যই ভ্রমণ এবং কোন দেশ ঘোরাটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ। অনেকসময়ই গণমাধ্যমগুলো যা প্রচার করে তা পূর্ণ সত্যি নয়। আপনি শুধু তখনই একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবেন যখন আপনি নিজে ঘুরে দেখবেন।”
যারা আশরাফুজ্জামান এর সাথে যোগাযোগ করতে চান, তাকে ইমেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]।