১৯৭৮ সালে মনোবিজ্ঞানী এলিজাবেথ লফটাস মানুষের স্মৃতির উপর বেশ বিখ্যাত একটি পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। সেখানে অংশগ্রহণকারীদেরকে একটি সড়ক দূর্ঘটনার ভিডিও দেখানো হয়েছিল। এরপরে ভিডিওর ব্যাপারে তাদেরকে বেশ কিছু প্রশ্ন করা হয়। দূর্ঘটনার পরে পুলিশ কিংবা তদন্তকারী দল যেভাবে প্রত্যক্ষদর্শীকে প্রশ্ন করে, তা অনুসরণ করে এই প্রশ্নগুলো সাজানো হয়েছিল। সেখানে এমন একটি প্রশ্ন ছিল,
গাড়িগুলো যখন একে অপরকে আঘাত করে, তখন তারা কেমন বেগে যাচ্ছিল?
কিছু প্রত্যক্ষদর্শীকে একই প্রশ্ন সামান্য ভিন্নভাবে করা হয়েছিল।
গাড়িগুলো যখন একে অপরকে চূর্ণ-বিচূর্ণ দেয়, তখন তারা কেমন বেগে যাচ্ছিল?
গবেষকেরা বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করেন যে, ‘আঘাত’ শব্দের পরিবর্তে ‘চূর্ণ-বিচূর্ণ’ ব্যবহারের ফলে অংশগ্রহণকারীদের স্মৃতিতে এই দূর্ঘটনার ভিডিওটি ভিন্নভাবে জমা হয়েছে।
এক সপ্তাহ পরে তাদেরকে দূর্ঘটনার ভিডিওতে কোনো ভাঙা কাঁচ দেখতে পেয়েছিল কিনা তা জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারীই সঠিক উত্তর দিয়েছিল। সেটি হচ্ছে, ভিডিওতে কোনো ভাঙা কাঁচ ছিল না। কিন্তু যাদের প্রশ্নে ‘চূর্ণ-বিচূর্ণ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল, তারা ভাঙা কাঁচ দেখেছে, এই দাবি করছিল। অর্থাৎ, এই শব্দটি তাদের স্মৃতিতে দূর্ঘটনার সম্পূর্ণ চিত্রটি কিছুটা পরিবর্তন করে দিয়েছিল। এভাবে, ঘটনার পরের বিভিন্ন তথ্য মূল ঘটনার স্মৃতিতে প্রভাব ফেলার ব্যাপারটিকে ‘মিসইনফরমেশন ইফেক্ট’ বলা হয়। সামান্য তথ্যও অনেকসময় মূল ঘটনার স্মৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন রাখতে পারে। এই এক্সপেরিমেন্টটি তার একটি প্রমাণ।
আমাদের স্মৃতি কত সহজে ভুল করে, কত সহজে তা পরিবর্তন করে ফেলা যায়, মিসইনফরমেশন ইফেক্ট তার একটি ধারণা দেয়। ব্যাপারটি বেশ ভয়ানক। কারণ, এর ফলে আমরা নিজেদের স্মৃতির উপরেও ভরসা হারিয়ে ফেলার একটি গাঢ় সম্ভাবনা তৈরি হয়। প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতির উপরে নির্ভর করে অনেক সময়ই অপরাধীর সাজা দেওয়া হয়। মিসইনফরমেশন ইফেক্টের ফলে, প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতির উপর নির্ভর করার ব্যাপারটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে।
মিসইনফরমেশন ইফেক্ট কেন ঘটে তার পেছনে বিভিন্নরকম থিওরি আছে। এ রকম একটি ধারণা হচ্ছে, মূল ঘটনার তথ্য ও ভুল তথ্যগুলো স্মৃতিতে একত্রিত হয়ে বসে যায়। আরেকটি থিওরি হচ্ছে, বিভ্রান্তিকর তথ্যগুলো মূল ঘটনার স্মৃতিকে প্রতিস্থাপন করে। আবার, বিভ্রান্তিকর তথ্য যেহেতু মূল ঘটনার পরে স্মৃতিতে আসে, এটা তুলনামূলক নতুন স্মৃতি। তাই এই স্মৃতিটি পুনরুদ্ধার করাও তুলনামূলক সহজ। আরেকটি সম্ভাবনা হচ্ছে, মূল ঘটনার প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন ক্ষুদ্র তথ্য স্মৃতিতে একসাথে বসতে পারে না। তাই যখন বিভ্রান্তিকর বা ভুল তথ্য সামনে আসে, সেগুলো এই মূল ঘটনার তথ্যের ফাঁকে বসে পূর্ণাঙ্গ স্মৃতি গঠন করে। এভাবে, সঠিক ও ভুল তথ্য একত্রে স্মৃতিতে গেঁথে যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, মিসইনফরমেশন ইফেক্টকে বিভিন্ন উপাদান প্রভাবিত করতে পারে। এ রকম একটি উপাদান হচ্ছে, অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে ঘটনাটি নিয়ে কথা বলা। এই ব্যাপারটি মূল ঘটনাটি একজন যেভাবে দেখেছিল, তা পরিবর্তন করে দিতে পারে। কারণ অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শী ঘটনাটি অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করে থাকতে পারে। এই নতুনরকম ব্যাখ্যাটি মূল স্মৃতিটির বিকৃতি সাধন করে।
সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশনে কোনো ঘটনার রিপোর্টও মিসইনফরমেশন ইফেক্টে অবদান রাখতে পারে। মানুষ প্রায় সময়েই ঘটনার মূল উৎস ভুলে যায়। এর ফলে, অনেকেই অবচেতনভাবে নিজেকে সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ভেবে থাকে। অথচ, তারা ঘটনাটি সম্পর্কে জেনেছে কোনো সংবাদ প্রতিবেদন থেকে। মানুষ যত বেশি বিভ্রান্তিকর তথ্যের সান্নিধ্যে থাকে, ততোই তারা মূল ঘটনার অংশ হিসেবে সেই তথ্যটিকে বিশ্বাস করে।
ভুল তথ্যটি যদি মূল ঘটনার বেশ কিছু সময় পরে প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতিতে স্থাপন করা হয়, সেক্ষেত্রে তা নতুন স্মৃতি হিসেবে সেখানে জায়গা নেয়। পরবর্তীতে এই ঘটনাটির ব্যাপারে চিন্তা করতে গেলে অপেক্ষাকৃত এই নতুন স্মৃতিটি পুনরুদ্ধার করা সহজতর হয়, যা মূল স্মৃতিকে সচেতন মনে আসতে বাধা দেয়।
মিসইনফরমেশন ইফেক্টের প্রতি সবাই সমানভাবে সংবেদনশীল না। বিভিন্নরকম কারণে এই সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পেতে বা কমতে পারে। কিছু স্টাডি থেকে দেখা গেছে, এ রকম ভ্রান্তি বিভিন্ন বয়সের লোকের উপর বিভিন্নভাবে দেখা যায়। কমবয়সী বাচ্চাদের মধ্যে এই সংবেদনশীলতা অনেক বেশি দেখা যায়। এই প্রভাবটার মাত্রা বেড়ে যাবে যদি মূল ঘটনার উৎসটি প্রশ্নমূলক না হয়ে ন্যারেটিভমূলক হয়। তবে কিছু স্টাডিতে আবার ভিন্ন ব্যাপার দেখা গেছে। সেখানে কিশোরদেরকে এই ইফেক্টের সামনে তুলনামূলক বেশি দূর্বল হতে দেখা যায়। আবার, প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, যাদের বয়স বেশি তারা মিসইনফরমেশন ইফেক্টের শিকার হয় কম। এটা অবশ্য প্রশ্ন এবং স্মৃতির দক্ষতার উপরে নির্ভর করে।
যেসব ব্যক্তির স্মৃতির ক্ষমতা যতো ভালো, তারা স্মৃতিতে মূল ঘটনার ততো ভালো প্রতিচ্ছবি তৈরি করতে পারে। একটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদেরকে দুইটি কাজ করতে দেওয়া হয়েছিল: একটি শব্দতালিকা মনে রাখা ও একইসাথে কোনো গাণিতিক বিবৃতির সঠিকতা যাচাই করা। যেসব অংশগ্রহণকারী দুটো কাজ একসাথে যত ভালো করতে পেরেছিল, তারা মিসইনফরমেশন ইফেক্টের প্রতি তত কম সংবেদনশীল হতে দেখা গেছে।
মায়ার্স ব্রিগস ইন্ডিকেটর হচ্ছে ব্যক্তিত্ব মূল্যায়নের একটি পরীক্ষা। এই ইন্ডিকেটর দিয়ে নির্ণয় করা আলাদা আলাদা ব্যক্তিত্বের মানুষকে এলিজাবেথ লফটাসের এক্সপেরিমেন্টের মতো ভুল তথ্য পরিবেশন করা হয়েছিল। সেখানে দেখা গেছে, অন্তর্মুখী মানুষেরা মূল ঘটনার পরের সঠিক ও ভুল উভয় ধরনের তথ্যই গ্রহণ করার মানসিকতা দেখায়। বহির্মুখী মানুষের তুলনায় তারা নিজেদের স্মৃতির ব্যাপারে কম আত্মবিশ্বাস রাখে। তাই, এই ভ্রান্তির প্রতি তুলনামূলকভাবে তারা বেশি সংবেদনশীল।
কল্পনা করার ক্ষমতার দিক দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মানুষের উপরে মিসইনফরমেশন প্রভাবের বিভিন্নতা নিয়েও পরীক্ষা হয়েছে। যারা বেশি কল্পনাপ্রবণ, তাদের মধ্যে মিসইনফরমেশন প্রভাবের সংবেদনশীলতা বেশি দেখা যায়। মনোবিজ্ঞানীরা দাবি করছেন, কল্পনাপ্রবণ মানুষেরা স্মৃতি পুনরুদ্ধারের সময়ে ভুল তথ্যের একটি প্রগাড় ছবি তৈরি করে। এভাবে, তাদের এই ভ্রান্তির প্রতি সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পায়।
ঘুমের উপরেও এই ভ্রান্তির সংবেদনশীলতা নির্ভর করে। এই ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, মিসইনফরমেশন ইফেক্টের প্রতি সংবেদনশীলতা সবচেয়ে বেশি থাকে যখন একটি ঘুমের চক্র সম্পূর্ণ হয়। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যারা এই ভ্রান্তির শিকার হয়েছিল সবচেয়ে কম, তারা মূল ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করার পর থেকে আর ঘুমায়নি। আবার, অন্য একটি স্টাডি দাবি করে, ঘুম পরিপূর্ণ না হলে মিসইনফরমেশন ইফেক্টের প্রতি সংবেদনশীলতা বেশি দেখা যায়। তাই, ঘুমের সাথে এই প্রভাবের সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
মিসইনফরমেশন ইফেক্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বেশ বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এর ফলে বিভিন্নরকম পরিস্থিতিতে ক্ষতিকর পরিণতি দেখা যায়। কিন্তু এই প্রভাবটি এড়ানো একটি বড় রকমের চ্যালেঞ্জ। একটি সমস্যা হচ্ছে মানুষের স্মৃতি বেশ জটিলভাবে কাজ করে। মস্তিষ্ক বা স্মৃতির ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন না। যেখানে সঠিক ও ভুল উভয় ধরনের তথ্যই বেশিরভাগ সময়ে ভ্রান্তিকর তথ্যটি সমর্থন করে। ফলে, সমস্যাটির মূলোৎপাটন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেকক্ষেত্রে আবার দেখা যায়, মানুষ আশা করে, তার জানা ভুল তথ্যটি যেন সঠিক হয়। সেক্ষেত্রে এই প্রভাবটি এড়ানো অনেকটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
বিভ্রান্তিকর তথ্য মূলোৎপাটনের একটি পরিচিত উপায় হচ্ছে, বাস্তবিক ও সঠিক তথ্য উপস্থাপন করা। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, ভুল তথ্যের বিপক্ষে সরাসরি এ রকম বিরোধিতা ভুল তথ্যে বিশ্বাসের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। এর পেছনে ভুল তথ্যের জনপ্রিয়তা একটি কারণ হিসেবে কাজ করে। কিছু গবেষক অনুমান করেছেন, ভুল তথ্যের বিরোধিতা করতে হলে সঠিক তথ্যের একটি পরিপূর্ণ মডেল থাকতে হবে। মানুষ তাহলে সহজে বুঝতে পারবে, তার জানা তথ্যের মধ্যে কোনটি ভুল ছিল এবং এভাবে সে বিশ্বাসটি ভেঙ্গে ফেলা সহজ হবে।
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিক তথ্য চোখের সামনে থাকলেও মিসইনফরমেশন ইফেক্ট ঘটতে পারে। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদেরকে যখন সঠিক এবং মূল ভিডিওর উৎস দেখানো হয়েছিল, এমনকি তার সাথে ভুল তথ্যটি চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছিল, সেখানেও এরকম মিসইনফরমেশন ইফেক্ট দেখা গেছে। এই স্টাডি থেকে বুঝা যায়, সঠিক তথ্যটি মানুষের সামনে থাকলেও মানুষ ভুল তথ্য থেকে নিজেকে এড়াতে পুরোপুরি সক্ষম নয়।
কিছু স্টাডিতে দেখা গেছে, যারা মিসইনফরমেশন ইফেক্টে আক্রান্ত, তারা অনেকসময়েই অনুভব করতে পারে যে, তাদের রিপোর্ট করা তথ্যগুলোতে ভুল রয়েছে। কিন্তু, এই অনুভূতির পেছনে পর্যাপ্ত আত্মবিশ্বাস কাজ না করায় তারা তা প্রকাশ করতে পারে না। এই গবেষণাগুলো তাই দাবি করে, আত্মবিশ্বাস বাড়ালে এবং আত্মস্বীকৃতির মাধ্যমে নিজেকে পজিটিভ ফিডব্যাক দিলে মিসইনফরমেশনের প্রভাবকে দূর্বল করে ফেলা যায়।
আরেকটি মডেলে দাবি করা হয়েছে যে, প্রশ্নের ব্যবহার করে এই ভ্রান্তিকে দূর করার উপায় দেখা যায়। যেকোনো বিবৃতি দেওয়ার আগে যদি সেটিকে প্রশ্ন করা হয়, তাহলে ভুল তথ্য স্মৃতিতে গড়ে উঠবার আগেই তাকে বাঁধা দেওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে, দুইটি ভিন্ন সিনারিওতে যদি একই তথ্য থাকে, তবুও এই প্রশ্ন করা অব্যাহত রাখতে হবে। যেকোনো তথ্য জানার পরে প্রশ্নের ব্যবহার সঠিকভাবে স্মৃতি মনে করতে পারার সাথে সম্পর্কযুক্ত। এই মডেলটির পেছনে একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, আমাদের মন নির্ধারিত ও সুনির্দিষ্ট তথ্যগুলো সহজেই স্মৃতিতে অন্তর্ভুক্ত করে ফেলে। অন্যদিকে, প্রশ্ন করলে সে তথ্যটি আমাদের মস্তিষ্ক সুনির্ধারিত হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে না। সে তথ্যটি স্মৃতিতে গেঁথে ফেলা তার জন্যে সহজ নয়।
আমাদের স্মৃতির উপরে এই ভ্রান্তিটি একটি গভীর ছাপ ফেলতে সক্ষম। বিভিন্ন কৌশল অনুসরণ করলেও আমরা কখনোই সম্পূর্ণভাবে এর প্রভাব থেকে বের হতে পারব না। সবসময়ে মনে রাখতে হবে যে, স্মৃতিশক্তি ভালো হলেও মিসইনফরমেশন ইফেক্টের প্রতি আমরা সবাই সংবেদনশীল।