খনিজ সম্পদ বা প্রাকৃতিক সম্পদ একটি দেশের জন্য অনেক বড় আশীর্বাদ। বর্তমান যুগে আধুনিক নগরায়ন, শিল্পায়ন, পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় খনিজ সম্পদের প্রয়োজনীয়তা উত্তরোত্তর বেড়েছে। শিল্পায়নের এই যুগে আমাদের ব্যবহার্য প্রতিটি দ্রব্যেই কোনো না কোনোভাবে খনিজ সম্পদের অবদান রয়েছে। পৃথিবীতে যদি একদিনের জন্য খনিজ সম্পদ উত্তোলন বন্ধ করে দেওয়া হয়, পৃথিবী একপ্রকার অচল হয়ে পড়বে। খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশগুলোর উপর শিল্পোন্নত দেশগুলো অনেকাংশে নির্ভরশীল। বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতি শুধুমাত্র খনিজ সম্পদের উপর নির্ভর করে টিকে আছে। এই সম্পদকে পুঁজি করে অনেক দেশ চরম দরিদ্র থেকে ধনী বনে গিয়েছে।
কিন্তু ধনী হওয়ার এই সহজ সূত্র সবার ক্ষেত্রে খাটে না। কিছু দেশ এমনও আছে, যারা নিজেদের বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ থাকার পরও বিভিন্ন কারণে সেগুলো উত্তোলন করতে পারছে না। এমনই এক হতভাগ্য দেশ আফগানিস্তান।
আফগানিস্তান নামটি শুনলে হয়তো আপনার প্রথমেই যুদ্ধ কিংবা জঙ্গি কিংবা সন্ত্রাসের কথা মনে আসবে। পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখী দেশগুলোর মধ্যেও আফগানিস্তান একটি। বর্তমানে আফগানিস্তানের অর্ধেকের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। দারিদ্র্যতা, রোগ, শোক, নিরাপত্তাহীনতা, অশিক্ষা, দুর্নীতি, জাতিগত সংঘাত ও যুদ্ধ নিয়ে আফগানিস্তান যেন পৃথিবীর বুকেই এক টুকরো নরক! কিন্তু এই আফগানিস্তানেই রয়েছে খনিজ সম্পদের বিশাল আধার। ধারণা করা হয়, আফগানিস্তানে প্রচুর পরিমাণে অনাবিষ্কৃত ও অব্যবহৃত খনিজ সম্পদ রয়েছে। দেশটির এই অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ দেশটিকে স্বনির্ভরতা ও উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে পারে, মুক্তি দিতে পারে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে।
প্রায় ছয় লক্ষ বায়ান্ন হাজার বর্গকিলোমিটারের আফগানিস্তানকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ খনিজ সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেশটিতে আনুমানিক ১৪০০-র অধিক বিভিন্ন খনিজ ক্ষেত্র রয়েছে। খনিজ ক্ষেত্রগুলোর আনুমানিক মূল্য ১ থেকে ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিছু তথ্য অনুযায়ী সেটা সাত ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। স্বর্ণ, রৌপ্য, প্লাটিনাম, ইউরেনিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, তামা, লোহা, ক্রোমাইট, লিথিয়াম ইত্যাদি আছে খনিজ পদার্থের তালিকায়। সেই সঙ্গে রয়েছে উচ্চ মানের পান্না, রুবি, নীলকান্তমণি, ফিরোজা ইত্যাদি রত্ন-পাথরের মজুদও।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ (ইউএসজিএস) এর গবেষণা অনুযায়ী, আফগানিস্তান ৬০ মিলিয়ন মেট্রিক টন তামা, ২.২ বিলিয়ন টন লোহা, ১.৪ মিলিয়ন টন দুর্লভ বস্তু (যেমন ল্যান্থানাম, সেরিয়াম, নিউডিমিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম) রয়েছে। আর রয়েছে সোনা, রূপা, দস্তা, পারদ ও লিথিয়াম। দেশটিতে এত বেশি পরিমাণে লিথিয়াম আছে যে, দেশটি বিশ্বের লিথিয়ামের রাজধানী হয়ে উঠতে পারে।
দুর্লভ বস্তু বা রেয়ার আর্থ ইলিমেন্ট (REE) হচ্ছে বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু। প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে REE-র আবেদন বাড়ছে। হাতের মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ থেকে শুরু করে মহাকাশে পাঠানো স্যাটেলাইট, এমনকি হাইপারসনিক অস্ত্র তৈরি ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে আরইই’র ব্যবহার করা হয়। হাই-টেক শিল্পের উন্নয়নের সাথে সাথে আরইই-এর প্রয়োজনীয়তাও বাড়ছে।
বর্তমান পৃথিবীতে বলিভিয়ায় লিথিয়ামের সর্বোচ্চ মজুদ রয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু পেন্টাগনের তথ্য অনুযায়ী আফগানিস্তানের শুধুমাত্র গজনি প্রদেশেই বলিভিয়ায় চেয়ে বেশি লিথিয়ামের মজুদ রয়েছে। ইউএসজিএস-এর তথ্য অনুযায়ী দেশটির হেলমান্দ প্রদেশে আনুমানিক ১.১ থেকে ১.৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন আরইই-এর মজুদ আছে।
আরইই সামরিক শিল্পের জন্য খুব প্রয়োজনীয় পদার্থ। এটি ট্যাংক নেভিগেশন সিস্টেম, ক্ষেপণাস্ত্র গাইডেন্সিং সিস্টেম, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা উপাদান, স্যাটেলাইট এবং বিভিন্ন সামরিক যোগাযোগ ব্যবস্থা উৎপাদনের মূল কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আফগানিস্তানে যে পরিমাণ আরইই-এর মজুদ রয়েছে তা বিশ্বের আরইই সাপ্লাই বিষয়ক সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হতে পারে। দেশটির সমৃদ্ধ খনিজ সম্পদগুলো কাজে লাগিয়ে বৈদেশিক সহায়তার উপর দেশের নির্ভরতা কমিয়ে স্বনির্ভর দেশে পরিণত হতে পারে।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ (ইউএসজিএস) ও আফগানিস্তান ভূতাত্ত্বিক জরিপ (এজিএস)-এর একটি যৌথ গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে, আফগানিস্তানের পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে পেট্রোলিয়ামের বিশাল মজুদ রয়েছে। শুধুমাত্র দেশটির উত্তরাঞ্চলেই বিভিন্ন তেল ও গ্যাসক্ষেত্রে আনুমানিক ১.৬ বিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল, ১৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস এবং ৫০০ মিলিয়ন তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে। এছাড়াও এখানে প্রচুর অনাবিষ্কৃত পেট্রোলিয়াম ক্ষেত্র রয়েছে বলে অনুমান করা হয়। বেশিরভাগ অপ্রকাশিত অপরিশোধিত তেল ও গ্যাসের অবস্থান দেশটির উত্তরাঞ্চলে আফগান-তাজিক এবং আমু দারিয়া অববাহিকায়।
আফগানিস্তানে অনেকগুলো পাললিক অববাহিকা রয়েছে। দেশটির অধিকাংশ পেট্রোলিয়াম অনুসন্ধান এবং উন্নয়ন কার্যক্রম সে দেশের উত্তরাঞ্চলের আমু দারিয়া এবং আফগান-তাজিক অববাহিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এই দুটি অববাহিকা আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলের বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। ১৯৫৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যৌথভাবে সেখানে অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল। এরপর সোভিয়েত যুগে আমু দারিয়া অববাহিকায় ছয়টি তেল ক্ষেত্র ও আটটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। এগুলোতে আনুমানিক প্রায় ৯৬৩ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল এবং ৫২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
আমু দারিয়া অববাহিকার মতোই একটি হচ্ছে আফগান-তাজিক অপরিশোধিত তেল অববাহিকা। এই অববাহিকায় অপরিশোধিত তেল দেশটির উত্তর ও উত্তর-পূর্বের প্রায় ৩১,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত। ১৯৫৮ সালে আফগান-তাজিক অপরিশোধিত তেল অঞ্চলটি আবিষ্কৃত হয়। সেসময় সেখানে আনুমানিক প্রায় ৯৪৬ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল এবং ৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ ছিল। আফগান-তাজিক পাললিক অববাহিকায় তেল ও গ্যাস অঞ্চল ১২টি ব্লকে বিভক্ত। তন্মধ্যে শুধু দুটি ব্লকেরই ৫১৪ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল এবং ৯১ বিলিয়ন ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন করার ক্ষমতা রয়েছে। শুধুমাত্র এই দুটি ব্লক দিয়েই আফগানিস্তানের জ্বালানি চাহিদা পূরণ সম্ভব।
দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে ইরান সীমান্ত থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরে প্রায় ২৬,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত ত্রিপুল তেল অববাহিকা। এই অববাহিকায় তেলের পরিমাণ সম্পর্কে সঠিক তথ্য এখনো জানা না গেলেও ভূতাত্ত্বিকদের মতে এখানে যথেষ্ট পরিমাণে গ্যাস ও তেল মজুদ রয়েছে। আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পূর্বে ৪৫,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে কাটোয়াজ তেল ও গ্যাস অঞ্চল। এই অঞ্চলটিতে এখনো ভালোভাবে অনুসন্ধান চালানো হয়নি তবে এখানেও যথেষ্ট পরিমাণ তেল ও গ্যাসের মজুদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে মরুভূমিতে প্রায় ১,৩১,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে বিশাল হেলমান্ড অপরিশোধিত তেল অববাহিকা। এখানেও বিশাল পরিমাণে খনিজ তেল ও গ্যাসের মজুদ রয়েছে।
সৌন্দর্য আর আভিজাত্য মানুষকে বরাবরই টেনেছে। বিভিন্ন রত্ন পাথরের সৌন্দর্য, উজ্জ্বলতা ও দুষ্প্রাপ্যতা তাদেরকে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মানুষ আভিজাত্যের নিদর্শন সরূপ যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন রত্ন পাথরের ব্যবহার করে আসছে। হিন্দুকুশ ও কারাকোরাম পর্বতমালার মধ্যে অবস্থিত আফগানিস্তানে এমন মূল্যবান রত্ন পাথরের বিশাল মজুদ রয়েছে। আফগানিস্তানে ৬,৫০০ বছর আগে থেকে রত্নপাথর পাওয়া যায় এবং এগুলো দেশটিকে বিভিন্ন মূল্যবান ও আধা-মূল্যবান রত্নপাথর সমৃদ্ধ করে তোলে।
নব্য প্রস্তর যুগের বণিকরা হিন্দুকুশ পর্বতমালা থেকে নীলকান্তমণি খনন করে তা মেসোপটেমিয়া, মিশর এবং ভারতে নিয়ে যান। সেই সঙ্গে বণিকরা নীলকান্তমণিসহ পান্না, রুবি ও ফিরোজা ইত্যাদি মূল্যবান রত্নপাথরও খনন করে নিয়ে যেতো। প্রাচীন সিল্ক রোড দিয়ে বাণিজ্যরত ব্যবসায়ীরা আফগানিস্তান থেকে মণি-মুক্তা নিজেদের সাথে নিয়ে যেতো। এভাবে আফগানিস্তানের রত্নপাথর বিশেষ করে নীলকান্তমণি পুরো পৃথিবীব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আফগানিস্তানের বাদাখশান প্রদেশ বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান মনি-মুক্তার জন্য বিখ্যাত। বাদাখশানের বিশ্ববিখ্যাত নীলকান্তমণি ঐতিহাসিকভাবে আফগানিস্তানের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
আফগানিস্তানে খনন করা প্রায় ৯৫ শতাংশ রত্নপাথর অবৈধভাবে উত্তোলিত হয় এবং তা কাটা ও বিক্রির জন্য অবৈধভাবে পাকিস্তানে চালান করা হয়। এরপর অবৈধভাবে পাকিস্তানের মাধ্যমে এইসব রত্নপাথর বিশ্বজুড়ে রফতানি করা হয়। অবৈধভাবে উত্তোলনের ফলে আফগানিস্তান সরকার নিজেদের খনিজগুলো থেকে যথেষ্ট পরিমাণ আয় করতে পারছে না। এর ফলে এসব রত্ন পাথরের বার্ষিক উৎপাদনের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মূল্যবান রত্নপাথরের পাশাপাশি আফগানিস্তানে স্বর্ণেরও যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। শতাব্দীকাল ধরে আফগানিস্তানের গজনী, জাবুল, কান্দাহার এবং তাখার প্রদেশ সহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে স্বর্ণ উত্তোলন করা হচ্ছে। এছাড়া বাদাখশান ও হেলমান্দ প্রদেশেও স্বর্ণের বিশাল মজুদ রয়েছে। পাহাড় সমৃদ্ধ আফগানিস্তানের বেশ কয়েকটি নদীর উপত্যকায় বিশেষ করে আঞ্জির, হাসার, নুরাবা এবং পাঞ্জ নদীর উপত্যকায় স্বর্ণের মজুদ রয়েছে। পাঞ্জ নদীর উপত্যকায় অবস্থিত সমতি খনিতে আনুমানিক প্রায় ২০ থেকে ২৫ মেট্রিক টন স্বর্ণ রয়েছে। এছাড়া দেশটির গজনি প্রদেশে থাকা স্বর্ণ ও তামার মজুদের আনুমানিক মূল্য ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত আয়নাক তামা খনিটি দেশটির অন্যতম মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত ভূতাত্ত্বিকগণ কাবুলের আশেপাশে খনিজ সম্পদ খোঁজার জন্য ম্যাপ করে। সে সময় আইনাক, দারবান্ড এবং জাওখর তামা খনিগুলো পুনরাবিষ্কার করে। সে সময়ের জরিপ অনুযায়ী শুধুমাত্র আয়নাক খনিতেই ২৪০ মিলিয়ন মেট্রিক টন ২.৩ শতাংশ মানের তামা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। আফগানিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলে তামার মজুদ থাকলেও আয়নাকের তামা বিশ্ববিখ্যাত।
রাজধানী কাবুল থেকে ১৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে বামিয়ান প্রদেশে বিখ্যাত হাজিগাক নামক লোহার খনির অবস্থান। ১৯৬০ সালে একটি সরকারি জরিপ অনুসারে হাজিগাক খনিটিতে ৬২ শতাংশ ঘনত্বের প্রায় ১.৮ বিলিয়ন টন লোহা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে যা সেটিকে বিশ্বমানের লোহার খনি হিসাবে চিহ্নিত করে। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলীয় হেলমান্দ প্রদেশে বেরিলিয়ামের একটি খনি পাওয়া গেছে, যা অ্যালুমিনিয়ামের চেয়ে হালকা এবং বিমান, হেলিকপ্টার, জাহাজ, মিসাইল এবং মহাকাশযানে ব্যবহৃত স্টিলের চেয়ে শক্তিশালী। সেখানে আনুমানিক ৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের বেরিলিয়াম রয়েছে।
কিন্তু আফগানিস্তানে এত বেশি পরিমাণে মূল্যবান খনিজ সম্পদের মজুদ থাকা সত্ত্বেও দেশটি পৃথিবীর সবচেয়ে গরিব দেশগুলোর একটি। দেশটিকে চলতে হয় বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভর করে। দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছর ধরে আফগানিস্তান বৈদেশিক আগ্রাসন ও গৃহযুদ্ধে জর্জরিত।
আফগানিস্তানে সংঘাতের অন্যতম কারণ তাদের খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য। সম্পদের এই বিশাল সম্ভাবনা কে-ই বা হাতছাড়া করতে চায়? দেশটির খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ প্রদেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি অস্থিরতা। ফলে অবৈধভাবে এসব খনিজ সম্পদ উত্তোলিত হয়ে বিদেশে পাচার হচ্ছে। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও পরবর্তীতে তিনি অবস্থান পরিবর্তন করেন, ধারণা করা হয় আফগানিস্তানের খনিজ হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা থেকে মার্কিন প্রশাসন পুরোপুরি সৈন্য প্রত্যাহার থেকে বিরত থেকেছে।
দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ফলে আইনের সঠিক ব্যবহার নেই, অভাব রয়েছে মানুষের নিরাপত্তা ব্যবস্থারও। সেই সঙ্গে রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি। আফগানিস্তান বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এছাড়া সঠিক খনিজ আইন প্রণয়নে সরকারের ব্যর্থতা খনিজ সম্পদ উত্তোলন ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়েছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও মিলিশিয়া সংগঠনকে দমনে সরকারের ব্যর্থতা তো রয়েছেই। দেশটির বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন ও মিলিশিয়া গ্রুপগুলোর অর্থের প্রধান উৎস হচ্ছে অবৈধভাবে খনিজ উত্তোলন। ফলে বিভিন্ন খনির নিয়ন্ত্রণ নেওয়াকে কেন্দ্র করে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
তালিবান ও আইসিস আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ থেকে ব্যাপকভাবে লাভবান হচ্ছে। এক তথ্য অনুযায়ী শুধুমাত্র তালিবান বছরে আড়াই থেকে দশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের খনিজ সম্পদ উত্তোলন করে যা আফিমের পর তাদের আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস। মাইনিং কোম্পানিগুলোর আফগানিস্তানের প্রতি অনাগ্রহের অন্যতম প্রধান কারণ, যেখানে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারকে ট্যাক্স দিয়েই পার পাওয়া যায় না, তার উপর দিতে হবে স্থানীয় বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও মিলিশিয়া গ্রুপকেও। অনেকসময় কোম্পানিগুলো স্থানীয় সংগঠনকে অর্থ দিতে অস্বীকার করলে তারা কোম্পানির কর্মচারীদের জিম্মি বানিয়ে অর্থ আদায় করে। ফলে সঠিক ও শক্তিশালী আইন না থাকায় দেশিয় ও আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে না।
এছাড়া এখানকার অনুন্নত অবকাঠামো ব্যবস্থা পরিবহণ ও পণ্য রপ্তানি ব্যবস্থাকে কঠিন করে তুলেছে। পণ্য পরিবহনের জন্য ভালো মানের রেল ও সড়ক ব্যবস্থা নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল অবস্থার ফলে পরিবহণ ব্যয় হয় বেশি। সেই সঙ্গে আফগান সরকার কর্তৃক আরোপিত উচ্চ কর ব্যবস্থার ফলে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছে। বর্তমানে খনিজ সম্পদ থেকে দেশটির জিডিপির সর্বোচ্চ দশ শতাংশ আসে, যেখানে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারলে সেটা ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
দেশটিতে উন্নত প্রযুক্তি ও দক্ষ বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে। বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তি খনিজ সম্পদের উত্তোলন ব্যবস্থাকে অত্যন্ত সহজ করে দিয়েছে। খনিতে মজুদের পরিমাণ নির্ণয়, ভূতাত্ত্বিক মডেলিং, খনির নকশা ও লেআউট তৈরি করা, ভূ-প্রযুক্তিগত তথ্য ও সামগ্রিক খনির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে আধুনিক প্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই। ফলে বিশ্বব্যাপী আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ ও ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
খনি একটি বহুমুখী ক্ষেত্র, এটি বুঝতে অনেক জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ খনির ইঞ্জিনিয়ার এবং বিশেষজ্ঞরা ভূপৃষ্ঠ এবং ভূগর্ভস্থ খনির টেকনিক্যাল কাজগুলো, খনির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সেজন্য প্রয়োজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ও বিশেষজ্ঞের। আফগানিস্তানের খনিগুলোতে নেই আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। দেশটিতে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ও বিশেষজ্ঞের অভাবের ফলে সর্বক্ষেত্রে বিদেশিদের উপর নির্ভর করতে হয়। ফলে খনিজ সম্পদ উত্তোলনে ব্যয় বৃদ্ধি পায়।
আফগানিস্তানে খনিতে কর্মরত প্রায় সবাই অদক্ষ শ্রমজীবী ও শিশু যাদের মাইনিং বিষয়ক কোনো জ্ঞানই নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রশিক্ষণহীন শ্রমিকরা দশ থেকে বারো ঘন্টা কোনো আধুনিক সরঞ্জাম ছাড়াই কাজ করে। সেজন্য প্রায়ই আফগানিস্তানে খনিতে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। উপরন্তু যে সামান্য পরিমাণ দক্ষ কর্মকর্তা রয়েছে তারাও মাসে এক বা দুই বার খনির কাছে আসেন। ফলে যে সামান্য কিছু খনি চালু আছে তাতে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটা অনিরাপদ অবস্থায় শ্রমিকরা কাজ করেন। এ রকম বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার ফলে দেশটির বিশাল খনিজ সম্পদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
আফগানিস্তানে যদি একটি স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারা যদি দেশের জাতিগত সমস্যা, দুর্নীতি সমস্যা, অবকাঠামোগত সমস্যা ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক সমস্যা সমাধান করতে পারে তবে আফগানিস্তান হতে পারে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশ। খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে, কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদের উপর বসে আফগানরা দরিদ্র জীবনযাপন করছে!