ইম্পিচমেন্ট, বাংলায় যাকে আমরা অভিশংসন বলে জানি, সেটি সাধারণত সংরক্ষিত থাকে সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের জন্য। আক্ষরিক অর্থে রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়নকারী সংস্থা, বা সংসদ তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে সরকারি ব্যক্তিদের বরখাস্ত করতে পারে। তবে এ রকম কিছু করার যৌক্তিক কারণও থাকা লাগবে। আইনের সংজ্ঞামতে তাই সরকারি যেকোনো কর্মকর্তাই অভিসংশনের সম্মুখীন হতে পারেন। তবে অভিসংশনের কথা উঠলে সবার আগে আমাদের মাথায় রাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তার চিন্তাই আমাদের মাথায় আসে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই ব্যক্তি হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট। শীর্ষ কর্মকর্তারা অনেক দেশেই দায়িত্ব পালনকালে তাদের আইনগত সুরক্ষা দেয়া হয়, ফলে পদে থাকাকালে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা চালানো যায় না। অপেক্ষা করতে হয় তাদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে সংসদ সদস্যরা সংবিধান মোতাবেক তাকে সরিয়ে দিতে পারেন, ফলে দেশের আদালতে তার বিরুদ্ধে বিচারিক কার্যক্রম চালানোর পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বোধকরি বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। পাঁচ বছর মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে সারা পৃথিবীর উপর ছড়ি ঘোরানোর ক্ষমতা অর্জন করেন তারা। এমন শক্তিধর ব্যক্তি যাতে লাগামছাড়া হতে না পারেন সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ইম্পিচমেন্টের ব্যবস্থা রেখেছে। এই প্রক্রিয়া তারা ধার করেছে পূর্ববর্তী ঔপনিবেশিক প্রভু ইংল্যান্ডের থেকে, আজ আমরা ইম্পিচমেন্ট বলতে যা বুঝি তা উদ্ভাবনের কৃতিত্ব এই ইংরেজদেরই।
বাংলাদেশের সংসদ এককক্ষ বিশিষ্ট। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যেসহ অন্য অনেক দেশের সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রে নিম্নকক্ষ পরিচিত হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ নামে, যা ইউএস কংগ্রেস নামেই সমধিক পরিচিত। এর উপরে রয়েছে সিনেটরদের কক্ষ। মার্কিন সংবিধানের প্রথম আর্টিকেলের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অভিসংশনের প্রস্তাবনা আনার ক্ষমতা বর্তেছে কংগ্রেসের উপরে, আর বিচারের ভার দেয়া হয়েছে সিনেটকে। প্রথম আর্টিকেলেরই তৃতীয় অনুচ্ছেদ সিনেটের রায় কার্যকর করার জন্য অন্ততপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সিনেটরের সমর্থনের সীমা বেধে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট নিয়ে বেশি মাতামাতি হলেও ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে যেকোনো সরকারি কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের ইম্পিচমেন্ট প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে পারেন।
ইম্পিচমেন্টের উৎপত্তি
অন্য অনেক কিছুর মতো ইংল্যান্ডই ইম্পিচমেন্ট প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়। চতুর্দশ শতকে একে একটি রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়, যেখানে সাংসদদের কণ্ঠভোটে ইম্পিচমেন্টের প্রস্তাব পাশ এবং রায় অনুমোদিত হতো। ব্রিটিশ সংসদের নিম্নকক্ষ হাউজ অফ কমন্স, যারা ইম্পিচমেন্টের প্রস্তাব আনবে, আর উচ্চকক্ষ হাউজ অফ লর্ডস সব পক্ষের বক্তব্য শুনে রায় দেবে।
১৩৭৬ সালে ব্রিটিশ সংসদে সর্বপ্রথম নথিভুক্ত ইম্পিচমেন্টের প্রমাণ পাওয়া যায়। অভিযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন উইলিয়াম, লাটিমারের চতুর্থ ব্যারন। তিনি একসময় রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ডের একজন উপদেষ্টা ছিলেন। সরকারি পদের প্রভাব কাজে লাগিয়ে উইলিয়াম নিজের নানা দুর্নীতি করেছেন বলে সংসদ তাকে অভিসংশনের মুখোমুখি করে। অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হলে তাকে বরখাস্ত করে জরিমানা করা হয়, নিক্ষেপ করা হয় কারাগারে।
এরপর আরো বেশ কয়েকটি ইম্পিচমেন্টের ঘটনা ঘটে। পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী অবধি ইংল্যান্ডে ইম্পিচমেন্ট সংঘটিত হবার কথা জানা যায় না। তবে এরপর অনেকটা রাতারাতি এই প্রক্রিয়া জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মূল উদ্দেশ্য ছিল অজনপ্রিয় মন্ত্রিদের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া। এখানে রাজনৈতিক খেলাই ছিল মুখ্য, কেউ সত্যিকারেই দোষী কিনা তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা ছিল না। সংসদের মূল টার্গেট ছিল রাজার আজ্ঞাবহ কর্মকর্তাদের যেকোনোভাবে পদ থেকে হটানো।
১৬২১-৭৯ সাল পর্যন্ত তারা এ রকম অনেক মানুষকেই বিচারের সামনে দাঁড় করায়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বাকিংহ্যামের প্রথম ডিউক (১৬২৬), স্ট্র্যাফোর্ডের আর্ল (১৬৪০), আর্চবিশপ উইলিয়াম লড(১৬৭৮), ক্ল্যারেন্ডনের আর্ল (১৬৬৭) এবং ১৬৭৮ সালে ডানবির আর্ল থমাস অসবর্ন। শেষোক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে রাজকীয় ক্ষমাও তাকে ইম্পিচমেন্ট থেকে বাঁচাতে পারেনি। তবে এরপর থেকে আবারো ইম্পিচমেন্ট অনেকটা দুর্লভ হয়ে যায় এবং ১৮০৬ সালের পর অনেকটাই পরিত্যক্ত হয়।
এদিকে ইংল্যান্ডের থেকে স্বাধীনতা লাভের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথারা নিজেদের শাসনকাঠামো ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে ১৭৮৭ সালের ২৫ মে ফিলাডেলফিয়াতে এক সম্মেলনে মিলিত হন। লক্ষ্য ছিল দেশ চালানোর মূলনীতি, বা সংবিধান প্রণয়ন। সবকিছু যখন প্রায় ঠিকঠাক তখন গোল বাধালেন ভার্জিনিয়ার প্রতিনিধি জর্জ ম্যাসন। তিনি মন্তব্য করলেন প্রেসিডেন্টকে এত ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে যে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা না রাখলে একদিন কোনো প্রেসিডেন্ট একনায়কে রূপ নিতে পারেন। সেপ্টেম্বরের ৮ তারিখে তিনি তার বক্তব্য পেশ করেন। তার সাথে ভার্জিনিয়ার অন্য দুই প্রতিনিধিও যোগ দেন।
ততক্ষণ পর্যন্ত কেবল দেশদ্রোহিতা এবং অবৈধ অর্থ আদায়ের অভিযোগে প্রেসিডেন্টকে সরানোর নিয়ম করা হয়েছিল। ম্যাসনের চাপাচাপিতে এর সাথে যুক্ত করা হলো ভয়ঙ্কর রকমের কোনো খারাপ কাজের (other high crimes and misdemeanors ) কথাও। যদিও ঠিক কীভাবে একে সংজ্ঞায়িত করা হবে তা পরিষ্কার করা হয়নি, ফলে এই দায়িত্ব থেকে যায় মার্কিন কংগ্রেসের হাতে। তারা যদি কোনো কাজকে ভয়ঙ্কর রকম খারাপ মনে করে তাহলে তারা ইম্পিচমেন্টের প্রস্তাবনা তুলতে পারে। ফিলাডেলফিয়ার সম্মেলন থেকে তৈরি সংবিধান অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে এক অরেগন ছাড়া অন্য সমস্ত রাজ্যই ইম্পিচমেন্টের ব্যবস্থা রেখেছে, যার দ্বারা প্রতিটি রাজ্যেই সরকারি কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করা সম্ভব।
অভিশংসনযোগ্য অপরাধ
মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য তিন ধরনের অপরাধ অভিশংসনের যোগ্য বলে বিবেচিত: দেশবিরোধী কাজ, ঘুষ খাওয়া এবং অন্য যেকোনো ভয়াবহ অপরাধ। কোনো অপরাধ অভিশংসনের যোগ্য সেই সিদ্ধান্ত দেবার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে কংগ্রেসকে। তবে অভিযোগ আনলেই প্রেসিডেন্টকে সরে দাঁড়াতে হয় না, তিনি স্বাভাবিকভাবে তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবার অভিশংসনের সম্মুখীন হলেও দিব্যি তার কাজ চালিয়ে গিয়েছেন। ২০২০ সালে জো বাইডেনের বিরুদ্ধে ঠিকই রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তিনি।
প্রক্রিয়া
মার্কিন ইম্পিচমেন্ট একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এখানে দোষী নির্দোষের থেকে বড় হলো রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল। আগেই বলা হয়েছে, ইম্পিচমেন্টের সূচনা করে ইউএস কংগ্রেস। তারা তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে নির্ধারণ করে অভিশংসনের প্রস্তাব আনা হবে কিনা। যেকোনো কংগ্রেস সদস্যই ইম্পিচমেন্টের প্রস্তাব তুলতে পারেন, তবে তা গৃহীত হবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত নেন স্পিকার। সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে এরপর তৈরি হয় আর্টিকেল অফ ইম্পিচমেন্ট, যা অনেকটা পুলিশি চার্জশিটের মতো। এখানে অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধের বিস্তারিত বয়ান থাকে এবং প্রমাণ সংযুক্ত করা হয়।
আর্টিকেল অফ ইম্পিচমেন্ট এরপর চলে যায় ইউএস সিনেটে। কংগ্রেস যেখানে পুলিশ, সিনেট সেখানে বিচারক। বিচারকাজে সভাপতিত্ব করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি, বর্তমানে যে পদে আসীন জন রবার্টস। এখানে আদালতের মতোই বাদী-বিবাদীর পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন তাদের উকিলেরা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজের স্বপক্ষে যে কাউকে নিয়োগ দিতে পারেন। সমস্ত কিছু শুনে সিনেটরেরা ভোট দেন। দুই-তৃতীয়াংশ বা ৬৭ জন সিনেটর একমত হলেই কেবল প্রেসিডেন্ট বা অন্য যেকোনো অভিশংসিত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হন। তবে তাদের জেলে পাঠানো হয় না। শাস্তি হিসেবে সিনেট কেবল তাদের বরখাস্ত এবং ভবিষ্যতে সরকারি পদ অধিকার করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে। দোষী সাব্যস্ত হবার পর বরখাস্ত করার প্রক্রিয়া অনেকটাই স্বয়ংক্রিয়, তবে সরকারি পদে পরবর্তীতে অধিষ্ঠিত হওয়া প্রতিরোধ করতে আরেকটি ভোটের প্রয়োজন হয়, যেখানে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যথেষ্ট। প্রেসিডেন্ট দোষী প্রমাণিত হয়ে বরখাস্ত হলে সংবিধান অনুযায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি নতুন আরেকজন ভাইস প্রেসিডেন্টকে নিযুক্ত করেন যাকে আবার সংসদের দুই কক্ষ থেকেই অনুমোদিত হতে হয়।
অভিশংসিত প্রেসিডেন্টরা
অ্যান্ড্রু জনসন
আব্রাহাম লিঙ্কনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জনসন লিঙ্কনের মৃত্যুর পর সপ্তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। লিঙ্কন রিপাবলিকান পার্টির লোক হলেও জনসন ছিলেন ডেমোক্র্যাটপন্থি। মার্কিন গৃহযুদ্ধের সময় অনেক ডেমোক্র্যাট কনফেডারেট পক্ষে যোগ দিলেও জনসন লিঙ্কনের পক্ষে রয়ে গিয়েছিলেন, যদিও তার রাজ্য টেনেসি ছিল দক্ষিণে।
গৃহযুদ্ধের পর বিজয়ী উত্তরের রাজ্যগুলো দক্ষিণের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন কিছু আইন পাশ করতে চাইলেও জনসনের বাধার মুখে তা সম্ভব হয়নি। ফলে কংগ্রেসের সাথে তার মন কষাকষি ছিল। প্রেসিডেন্ট হবার পর একপর্যায়ে জনসন যুদ্ধসচিব এডুইন স্ট্যান্টনকে প্রতিস্থাপন করলে একে পুঁজি করে কংগ্রেস তার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগল। স্ট্যান্টন লিঙ্কনের সময় নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন। তার সম্পর্ক ছিল উগ্রপন্থী রিপাবলিকানদের সাথে, যারা মুক্ত আফ্রিকান আমেরিকানদের ভোটাধিকার ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধাপ্রাপ্তির বিরোধী। ফলে জনসন তাকে প্রতিস্থাপন করে কিন্তু ভুল করেননি।
কিন্তু এতে আঁতে ঘা লেগে গেল কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রক রিপাবলিকান পার্টির। তারা Tenure of Office Act নামে এক আইনের ধুয়ো তুললেন, যেখানে ফেডারেল কর্মকর্তাদের বরখাস্তের ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের কর্তৃত্বের সীমারেখা বেধে দেয়া হয়েছে। কংগ্রেস অভিযোগ করলে স্ট্যান্টনের ব্যাপারে জনসন এই আইনের বাইরে কাজ করেছেন। দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনে অভিযোগ পাশ হয়ে সিনেটে চলে গেল। এখানে সাতজন রিপাবলিকান ডেমোক্র্যাটদের সাথে যোগ দিয়ে জনসনের পক্ষে ভোট দেন। একটিমাত্র ভোটের ব্যবধানে জনসন বেঁচে যান।
বিল ক্লিনটন
বিয়াল্লিশতম মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন অভিশংসনের মুখে পড়েন চারিত্রিক দুর্বলতার জেরে। ১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে মনিকা লিউনস্কি নামে হোয়াইট হাইজের এক ইন্টার্নের সাথে তার শারীরিক সম্পর্কের কথা ফাঁস হলে ক্লিনটন তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েন।
প্রথমে তিনি ফেডারেল তদন্তকারীদের সামনে জোর দিয়ে সম্পর্কের কথা অস্বীকার করলেও পরে ঠিকই স্বীকার করতে বাধ্য হন। ফলে রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। তাদের বক্তব্য ছিল প্রেসিডেন্ট মিথ্যে বলে বিচারিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছেন। সিনেট কিন্তু তাকে বেকসুর খালাস দেয়। অধিকাংশ সিনেটরের মত ছিল ক্লিনটন যা করেছেন তা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়, কিন্তু অভিশংসনের যে মাপকাঠি সংবিধানে দেয়া আছে তার মধ্যে এটি পড়ে না। মজার ব্যাপার হলো- এই সময় ক্লিনটনের জনপ্রিয়তা কিন্তু কমেনি, বরং বিভিন্ন জরিপে দেখা যায় সাধারণ আমেরিকানরা লিউনস্কির সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে তেমন চিন্তিত নয়। ফলে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে আসতে ইম্পিচমেন্ট বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প
পঁয়তাল্লিশতম মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একজন বিরল ব্যক্তি, কারণ এখন পর্যন্ত তিনিই একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি দুই দুইবার ইম্পিচমেন্টের সম্মুখিন হয়েছেন, এবং মেয়াদ শেষ হবার পরেও যাকে সিনেটে বিচারে দাঁড়াতে হয়েছে। নির্বাচিত হবার পর লাগামছাড়া কর্মকাণ্ডে ট্রাম্প সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন।রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাবা ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ইউক্রেনের একটি বেসরকারি এনার্জি কোম্পানির একজন ডিরেক্টর ছিলেন। ২০১৯ সালের ২৫ জুলাই তৎকালীন ইউক্রেনিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলিনস্কিকে ফোন করেন ট্রাম্প, যা পরে ফাঁস হয়ে যায়। এই ফোনালাপে হান্টার বাইডেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ সরবরাহ করতে জেলিনস্কির উপর ট্রাম্প চাপ প্রয়োগ করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে।
এই সময় যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা প্রদান বন্ধ রেখেছিল, ফলে ট্রাম্পের প্রতিপক্ষরা বলতে থাকেন যে ট্রাম্প সামরিক সহায়তার মুলো দেখিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের নোংরা পরিকল্পনা ফেঁদেছেন। ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর ডেমোক্র্যাট সংখ্যাগরিষ্ঠ কংগ্রেসে ইম্পিচমেন্ট প্রস্তাব গৃহীত হয়। অভিযোগ প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে চাইছেন। তবে রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনেটে ট্রাম্প নির্দোষ বলে ঘোষিত হন।
দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনে জো বাইডেনের কাছে পরাজিত হওয়ার পর ২০২১ সালের জানুয়ারির ৬ তারিখ ইউএস ক্যাপিটল বিল্ডিঙে বাইডেনের জয় আনুষ্ঠানিকতা পাবার প্রাক্কালে উগ্রপন্থি ট্রাম্প সমর্থকেরা হামলা চালায়। এর জের ধরে প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো ইম্পিচমেন্টের সম্মুখিন হন ট্রাম্প। অভিযোগ ভিত্তিহীন গুজব ছড়িয়ে জনতাকে উস্কে তিনি ক্যাপিটলে হামলার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন। কংগ্রেস ইম্পিচমেন্ট প্রস্তাব সিনেটে পাঠালে, সেখানেও এই প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। সাতজন রিপাবলিকান পক্ষত্যাগ করে ট্রাম্পকে অভিশংসিত করতে ডেমোক্র্যাটিক সিনেটরদের সমর্থন করেন। তবে শেষ পর্যন্ত এবারেও দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার ফলে ইম্পিচমেন্টের উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পরে।
অন্যান্য প্রেসিডেন্ট
তিনজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইম্পিচমেন্টের সম্মুখীন হলেও আরো কয়েজন অভিশংসনের খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলেন। দশম ইউএস প্রেসিডেন্ট জন টাইলার নিজ দল হুইগ পার্টির প্রস্তাবিত আইনে ভেটো দেন, যা প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হেনরি হ্যারিসন সমর্থন করার অঙ্গীকার করেছিলেন। দল এজন্য তাকে বহিষ্কার করে এবং তার বিরুদ্ধে ইম্পিচমেন্টের আবেদন জানায়। তবে কংগ্রেস সেই পথে অগ্রসর হয়নি।
ওয়াটারগেট স্ক্যান্ডালের পর রিচার্ড নিক্সনের ইম্পিচমেন্ট ছিল অবধারিত। এবং এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে অভিশংসিত হলে তিনি দোষী সাব্যস্ত হতেন। দেয়ালের লিখন পড়তে পেরে ১৯৭৪ সালের ৯ আগস্ট নিক্সন পদত্যাগ করেন। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ফোর্ড তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকেন।