১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের আগে ও পরে বিহার থেকে বিপুল সংখ্যক মুসলিম অভিবাসী পূর্ববাংলায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। তাদের সবাইকে সাধারণভাবে বিহারি বলা হয়। পাক সরকার বিহারিদের পূর্ববাংলায় পুনর্বাসিত করে। তাদের জন্য জমি বরাদ্দ দেয়। বিহারিরা পাকিস্তানের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল এবং তারাও রীতিমতো পাকিস্তানিতে পরিণত হয়। ১৯৬৯ সালেও মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে বাঙালিবিরোধী দাঙ্গা হয়। সে সময় বিহারিদের হাতে বেশ কজন বাঙালি হতাহত হয়। ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালে অধিকাংশ বিহারিই পাকিস্তানের পক্ষ নেয় যাদের একটা বড় অংশ থাকতো মিরপুরে।
বিহারি অধ্যুষিত হওয়ায় পাক বাহিনী নিশ্চিন্তে যুদ্ধের সময় মিরপুরের জলাঞ্চলকে ব্যবহার করেছিল তাদের মৃতদেহ গায়েব করার স্থান (বধ্যভূমি) হিসেবে। কিন্তু ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করলেও তাদের অনুগত বিহারি, মিলিশিয়ারা আত্মসমর্পণ করে না। বরং মিরপুরকে তারা রীতিমতো ঘাঁটি বানিয়ে রাখে। এছাড়াও দলছুট পাক সেনারা সাদা পোশাকে এসে আশ্রয় নেয় এই এলাকায়। সাথে আগে থেকেই অবস্থান করা রাজাকাররাও ছিল। পাক সেনা, রাজাকার ও বিহারিদের নিয়ে এই এলাকা রাষ্ট্রের ভেতর আরেক রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তানিরা ২০ হাজার বিহারিকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘সিভিল আর্মড ফোর্সেস’ (সিএএফ) গঠন করে। তাদেরও বড় অংশ ছিল মিরপুরে।
প্রচুর অস্ত্র থাকায় মিরপুর পরিণত হয় এক মিনি-ক্যান্টনমেন্টে। সুযোগ পেলেই চলত বাঙালি হত্যা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১০ বিহার রেজিমেন্ট মিরপুর ঘিরে অবস্থান নিলেও সম্মুখ অভিযানে যায় না। তাছাড়াও স্বাধীন দেশে সে দেশের সেনাবাহিনীই সামরিক অভিযান পরিচালনা করুক এটাই চাইছিল সবাই। মিরপুরের সাথে বাইরের জগৎ ছিল প্রায় বিচ্ছিন্ন, ভেতরে বাঙালি ছিল না বললেই চলে। ফলে গোয়েন্দা তথ্যও আসে না বললেই চলে। যেকোনো যুদ্ধ শুরু করার আগে শত্রুর ভেতরকার খবর যেন এক এক টুকরো স্বর্ণ! আর বিহার রেজিমেন্টের এক মেজর জানায় মিরপুরের অস্ত্রের সংখ্যা দু-চারটা হবে! এটা তেমন মাথা ব্যথার কারণ নয়।
কাদের সিদ্দিকীর কাছে অস্ত্র চাইলে তিনি জানিয়ে দেন, একমাত্র বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র দেবেন এবং তার আগে বিহারিদের অস্ত্র দিতে হবে। তারপর বিহারি ইস্যু আমলে নেওয়া শুরু হয়। দীর্ঘদিন ধরে মিরপুরে বাস করা বিহারিদের মিরপুরের জলাঞ্চল, জঙ্গল সবই নখদর্পণে। সবমিলে মিরপুর যেন এক দুর্ভেদ্য ঘাঁটি।
বাড়ির দেয়ালে ছিদ্র করে বাড়িগুলোকে pillbox এর মতো বানানো হয়। মিরপুর ১২, কালাপানি, মিরপুর সিরামিক্স ও বর্তমান মিরপুর সেনানিবাস ছিল পাক-বিহারিদের মূল ঘাঁটি। অস্ত্র উদ্ধারে প্রথমে শুধু ২ ইস্ট বেঙ্গলের তিন প্লাটুন সেনা মিরপুরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলেও পরে আলোচনা হয় ২ ইস্ট বেঙ্গল একা যথেষ্ট নয়। পরে ২ ইস্ট বেঙ্গলকে মিরপুর ১০, ১১ ও ১২ নং সেক্টর; আর ৪ ইস্ট বেঙ্গলকে মিরপুর ১ ও ২ নং সেক্টর এবং ৯ ইস্ট বেঙ্গলকে মিরপুর ৬, ৭ ও ৮ নং সেক্টর শত্রমুক্ত করতে পাঠানো হয়।
২৭ জানুয়ারি তারা মিরপুরের সব প্রবেশপথে (বর্তমান টেকনিক্যাল, রোকেয়া স্বরণি) অবস্থান করে। বিহার রেজিমেন্টকে পেছনে সরে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ফ্রন্টলাইনে চলে আসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তাদের সাথে ছিল ঢাকা জেলার ডেপুটি পুলিশ সুপার (ডিএসপি) জিয়াউল হক লোদীসহ ৩০০ জন পুলিশ। ৩০ তারিখ পর্যন্ত বারবার মাইকিং করে অস্ত্র জমা দিতে বললেও মিরপুর থেকে কোনো উত্তর আসে না।
২৯ জানুয়ারি সেনাবাহিনী আগ্রসর হয়ে মিরপুর ১ মাজারের পার্শ্ববর্তী স্কুল ঘরে এবং ২ নং সেকশনের ‘বায়তুল আমান’ নামে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে অবস্থান নেয়। সন্ধ্যায় তৎকালীন হাবিলদার ওয়াজিদ আলী মিয়া বারকীর নেতৃত্বে এক প্লাটুন সৈন্য সাড়ে ১১ নং সেকশনের পুলিশ চেকপোস্টের কাছে মোতায়েন করা হয়।
মিরপুর মুক্ত করার জন্য যে ধরনের অভিযানের প্রয়োজন ছিল সেটাকে বলা হয় door to door fight। এ ধরনের অভিযানে শত্রু শহরের প্রত্যেকটা বাড়িতে অবস্থান করতে পারে।
আক্রমণকারী বাহিনীকে পায়ে হেঁটে, ভারি কোনো সামরিক যান ছাড়াই প্রত্যেকটা বাড়িতে close quarters combat এর সম্মুখীন হতে হয়। ইরাকের ফালুজায় এ রকম যুদ্ধে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মার্কিন বাহিনীকেও নাকানিচুবানি খাইয়ে ছেড়েছিল ইরাকিরা যোদ্ধারা।
৩০শে জানুয়ারি মিরপুরে প্রবেশ করতে শুরু করে সেনাবাহিনী। মিরপুর ১২ নম্বর দিয়ে আগ্রসর হচ্ছিল একটা দল। নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন লেফটেন্যান্ট সেলিম মোহাম্মদ কামরুল হাসান। ৩০শে জানুয়ারি সাড়ে এগারোটা নাগাদ হঠাৎই অ্যামবুশের ফাঁদে পড়েন তারা। হেলাল মোর্শেদ (বীর বিক্রম, পরে মেজর জেনারেল) তাকে টেনে কভারে নিয়ে আসেন। আহত শরীর নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও পরে শহীদ হন লেফটেন্যান্ট সেলিম। নিজে কাভার ফায়ার দিয়ে অন্যদের নিরাপদে যাওয়ার পথ করে দেন তিনি। ধারণা করা হয় সেদিন বিহারিদের অ্যামবুশে ৪২ জন শহীদ হয়েছিলেন। ডি ব্লকে প্রবেশের সাথে সাথেই আশেপাশের সব বাড়ি থেকে হামলা শুরু করেছিল তারা।
সাড়ে এগারোতে অবস্থান নেওয়া হাবিলদার বারকীর প্লাটুনের সাথে বাংলা কলেজ এলাকায়ও হামলা হয়। সফল্ভাবে প্রতিহত করতে পারেন তারা। দ্রুত একটা খাল সাঁতরে শক্ত অবস্থানে যায় তারা, নাহলে তাদের ভাগ্যেও লেফটেন্যান্ট সেলিমের পরিণতি হতো। মিরপুর ১২ নম্বরের অস্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ির দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে বিহারি বাহিনী। তুমুল যুদ্ধ হয় সেখানেও।
এদিকে হামলার খবর শুনে মেজর মইনুল তার বাহিনী ১২ নং সেকশনের উল্টোদিকে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কাছে অবস্থান নেন। সেখানে গিয়ে ১২ নং সেকশনের ভেতরে আটকে পড়া সৈন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরপর মিরপুর এক্সচেঞ্জ থেকে সাড়ে ১১ নং সেকশনে অবস্থিত পুলিশ ফাঁড়িতে ফোন করে হাবিলদার বারকীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখনো তার ওপর এবং মেজর মইনুলের অবস্থানের দিকে লক্ষ্য করে বিহারিরা গুলি ছুড়ছিল। হাবিলদার বারকী তাকে বিস্তারিত জানান এবং দ্রত রিইনফোর্সমেন্ট চান।
৪ ইস্ট বেঙ্গলের ২টি কোম্পানি মাজারে এবং আরেকটি কোম্পানি ২ নম্বর সেক্টরে একটি পুকুরের পাশে অবস্থান নেয়। মিরপুর মাজারের পুকুর থেকে অনেক লাশ উদ্ধার করে সেনারা। নিজ দেশের নাগরিক হত্যার শিকার হবার নিদর্শন দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে ইস্ট বেঙ্গলের সেনারা।
৬ নম্বর সেকশনে গোলাগুলিতে শহীদ হন হাবিলদার বাশার। তীব্র হামলা ও অনেক হতাহতের পর কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায় সেনাবাহিনী। দৃঢ়ভাবে ধারণা করা হয় প্রখ্যাত লেখক ও নাট্যকার জহির রায়হানও এখানেই শহীদ হয়েছিল। তিনি তার নিখোঁজ ভাইকে খুঁজতে সেনাবাহিনীর সাথে মিরপুরের এসেছিলেন। অনেক সেনাই রাস্তায় তাকে মৃত পড়ে থাকতে দেখেছিলেন এবং যুদ্ধের পর আগের তোলা ছবি দেখে নিশ্চিত করেন ওই ব্যক্তি জহির রায়হান ছিলেন।
তিনি তার নিখোঁজ ভাইকে খুঁজতে সেনাবাহিনীর সাথে মিরপুরে এসেছিলেন এবং পরে সেনা ডিএসপি লোদির জিপে করে মিরপুরে প্রবেশ করেন। উপস্থিত প্রায় সব সেনা অফিসারের সম্মতি থাকায় ব্রিগেডিয়ার খালেদের অনুমতি নিয়ে তিনি মিরপুরে প্রবেশ করেছিল।
বিকাল থেকে বিহারিদের শক্ত অবস্থানগুলো নিউট্রিলাইজ করতে মর্টার এবং রিকয়েললেস গান দিয়ে হামলা করে সেনাবাহিনী। ২ নম্বর সেকশনের একটা বিহারি পজিশনকে মাইকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। গালাগালি করে উত্তর দিয়ে গুলি চালায় তারা। পরে সেনাবাহিনী রিকয়েললেস গান দিয়ে ওই পজিশনটি উড়িয়ে দেয় মিরপুর ১২ নম্বরে প্রচুর ৮১ মিমি মর্টার চার্জ করা হয়। শীতলক্ষা ঘেঁষেও অবস্থান নেয় ইস্ট বেঙ্গল, যাতে নদী পেরিয়ে কেউ হামলা চালাতে না পারে।
পরবর্তী ১০ দিন চলে তল্লাশি অভিযান। উদ্ধার হয় প্রায় ৪৫-৫৫ টন অস্ত্র (১১ ট্রাক)। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৪৯ জন সেনা এবং পুলিশ নিহত হয়েছিল। কিন্তু রাতের আঁধারে মৃতদেহ গুম করে ফেলে বিহারিরা। উদ্ধার হয় ৪-৫টি মৃতদেহ। বিহারি ছাড়াও পাকিস্তান মিলিটারি পুলিশ, পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টসহ নানা ইউনিটের দলছুট সেনারা গ্রেফতার হয়।
লে. কর্নেল (অব.) এইচ এম আব্দল গাফফার, বীর উত্তম মিরপুর যুদ্ধের বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “বাড়িগুলোর বিভিন্ন জানলা দিয়ে রাস্তা ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গা এমনভাবে কাভার করে এলএমজি এবং অন্যান্য অস্ত্র বসানো হয়েছিল, যা সামরিক বাহিনীর অভিজ্ঞতা ছাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না।”
যুদ্ধে যাবার প্রাক্কালে লেফটেন্যান্ট সেলিমের মা তাকে বলেছিল “যদি গুলি খাও, বুকে খাবে, পিঠে গুলি খাবে না, কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাবে না। আমি কোনো কাপুরুষের মা হতে চাই না।” এরকম বীর পুরুষের রক্তেই এসে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।