Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কলিমদ্দি দফাদার : মুক্তিযুদ্ধের নীরব নায়কদের গল্প

“কলিমদ্দিকে আবার দেখা যায় ষোলই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বাজারের চা স্টলে। তার সঙ্গীরা সবাই মুক্তি, সে-ই শুধু তার পুরনো সরকারি পোশাকে সকলের পরিচিত কলিমদ্দি দফাদার।”

বাংলাদেশের জন্মের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকরা এই ভূখণ্ডকে নিজেদের মতো পরিচালনা করতে চেয়েছিলো। ধর্মের ভিত্তিতে চালাতে চেয়েছিল বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে। কিন্তু বাঙালির প্রতিবাদী চেতনা তা হতে দেয়নি।

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন দেশের সর্বস্তরের মানুষ। তবে অনেকে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছিলো। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়াদের বলা হতো ‘মুক্তি’। মুক্তিদের তথ্য পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করতো রাজাকাররা। তাদের শত্রুদের এবং নিরীহ মানুষদের নিশ্চিহ্ন করতে তাদের হাত ছিলো।

তাদের মধ্যে যেমন ছিলেন ধর্মীয় বিশ্বাসী লোকজন। তেমনি ছিলেন সাধারণ সুবিধাবাদী অনেকে। নিজেদের স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে এবং বাড়তি সুবিধা পেতে নির্যাতনকারী সেই বর্বর বাহিনীকে সদা সাহায্য করে গেছেন তারা। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তাদের করা মাস্টারপ্ল্যান বাঙ্গালি জাতিকে পঙ্গু করে দেয়। 

১৯৭১ সালে দেশের জন্য জীবন বাজি রাখা মুক্তিরা; Image Source: The Independent 

তবে আরও একধরনের ব্যক্তিকে দেখা যায় সেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়। তখনও বাংলাদেশের শাসনভার ছিলো পাকিস্তানীদের হাতে। তাদের সেই সরকারব্যবস্থায় বাংলাদেশেও অনেক সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। উঁচু এবং নিচু পদ মিলিয়ে অনেকেই তখন চাকরি করতেন সরকারের হয়ে। তাদের অনেকে যুদ্ধের সময়ও চাকরি করে গেছেন। সাফাই গেয়ে গেছেন পাকিস্তান সরকারের।  

মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের অনেকে নিজের আপন ভূখণ্ডের জন্য সেই চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। আবার অনেকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে আশ্রয় নেন নিরাপদ কোনো আশ্রয়ে। পালিয়ে বেড়াতে থাকেন এখানে সেখানে। দেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমান।

সরকারি চাকরিজীবী এমন লোকও ছিলেন, যারা টিকে থাকার লড়াইয়ে সরকারের হয়ে কাজ করে গেছেন। কিন্তু তাদের মননে ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। তারা প্রতিনিয়ত চাইতেন, মুক্তিযোদ্ধারা সফল হোক। মুক্তিযোদ্ধাদের কাজে সহযোগিতা করতেন চুপি চুপি।

এমনই একজনের কাহিনী নিয়ে গল্প ‘কলিমদ্দি দফাদার’। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া সাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দিনের লেখা গল্প এটি। যেখানে দেখানো হয়, একজন অখ্যাত ব্যক্তি কিভাবে তার নিখুঁত কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখেন। আর বলা হয়, এসব হিরোরা কীভাবে সকলের কাছে অখ্যাত হয়ে থাকেন, হয়ে থাকেন ‘ভিলেন’ হয়ে।

প্রায় ৪০ বছর ধরে ইউনিয়ন বোর্ডের দফাদারি করে আসছেন কলিমদ্দি। চৌকিদারের উপরের পদ দফাদার। আচরণে সহজ-সরল তিনি। মনে অহংকার নেই তার। তবে রসিকতা করতে খুব ভালোবাসেন। পাঁচজনের সংসার নিয়ে একচালা ছাউনিতে থাকতে হয় তাকে। ক্ষুদ্র আয় দিয়ে পরিবারকে চালাতে হয় কষ্ট করে। কোনো কোনো সময় একবেলা না খেয়ে থাকতে হয় তাদের।

হানাদার বাহিনীর বর্বরতার শিকার হন বাংলাদেশের নারীরাও; Image Source: Guardian

পরিবার চালাতে ১৯৭১ সালের ভয়াবহ সময়েও তাকে সরকারের হয়ে কাজ করতে হয়। পাকিস্তানের খানসেনারা উপস্থিত হয় কলিমদ্দি দফাদারের এলাকায়। এলাকার বাজারসংলগ্ন হাইস্কুলে ছাউনি করে হানাদার বাহিনী। এখান থেকেই তাণ্ডব চালায় আশেপাশের পাড়াগুলোতে।

“হরিমতি সুমতিকে ওরা হত্যা করে না। রক্তাক্ত অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে খান সেনারা রাইফেল কাঁধে স্কুল ঘর ত্যাগ করে।”

কয়েকটি ঘটনার মাধ্যমে তাদের অমানবিক নির্যাতনের নমুনা দেখান লেখক আবু জাফর শামসুদ্দিন। তরুণ বা যুবক ছেলে দেখলেই গুলি করে মেরে ফেলা হতো। নির্বিচারে গুলি করে মারা হতো ক্যাম্পে নিয়ে আসা নিরীহ লোকদের। বাঙ্গালি নারীদের ভাগ্যে সরাসরি মৃত্যু নয়, মৃত্যুর আগে জুটতো অবিরত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। প্রথম দিকে হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের টার্গেট করা হলেও রেহাই মেলেনি মুলসমানদেরও।

“কলিমদ্দি দফাদারের বাল্যকালের পাতানো দোস্ত সাইজদ্দি খলিফার ষোল বছরের ছেলে একবার মাত্র মা বলে। ধরাশায়ী দেহটা থেকে আর কোনো ধ্বনি কানে আসে না।”

তবে এসব নির্যাতনের গল্পের মাঝেও লেখক বর্ণনা করেছেন বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষদের পাল্টা আক্রমণের গল্প। স্কুল ঘরে অমানবিক নির্যাতনের পর দুইজন নারীকে অজ্ঞান ফেলে বের হয় খানসেনারা। তখনই আক্রমণের উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেয় মুক্তিবাহিনী।  

“কোনদিক থেকে আসছে ঠাহর করার আগেই একজনের মাথার খুলি উড়ে যায়। ‘মুক্তি আ গিয়া, ইয়া আলী’ চিৎকার করে ফেরত বাকি চারজন ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ায়।”

মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে কোণঠাসা পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এমন চিত্রের মাধ্যমে হতাশার মধ্যেও আলোর বাণী ছড়িয়ে দেন লেখক। আর ব্যাখ্যা করেন মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের চৌকস পরিকল্পনার। তবে সম্পূর্ণ আলাদা এবং ভাবিয়ে তোলার মতো এক ছোট্ট কাহিনী রেখে দেন শেষে বর্ণনা করার জন্য।

জবাব দিতে ছাড়েনি মুক্তিসেনারা, কঠোর হস্তে দমন করেছে শত্রুশিবিরকে; Image Source: Daily sun

মুক্তিবাহিনীর এমন অতর্কিত আক্রমণের পর ছাউনিতে আসা সবাই বেশ সতর্ক হয়ে যায়। সেদিন থেকেই পাকিস্তান খানসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে বের হয় দল বেঁধে। সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসতে হয় এই কলিমদ্দি দফাদারকেই।  

“সে তার স্বাভাবিক হাসিমুখে খান সেনাদের সঙ্গী হয়ে যেদিক যেতে বলে যায়। সে আড়-কাঠি, আগে আগে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া তার ডিউটি। বাজারের লোকজন কখনও কখনও তাকে অনুযোগ দেয়, দফাদার ভাই আপনেও? কলিমদ্দি স্মিত হেসে সহজ উত্তর দেয়, আমি ভাই সরকারি লোক, যখনকার সরকার তখনকার হুকুম পালন করি। এর বেশি একটি কথাও তার মুখ থেকে বের করা যায় না।”

কিন্তু তার চেতনায় তো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তিনি কী করে নিজভূমির শান্তি বিনষ্টকারীদের মদদ দিয়ে যাবেন? এই অপবাদ থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন তিনি।

এমনি একদিন তাকে নিয়ে দূরের এক গ্রামে যাওয়ার জন্য বের হয় পাকসেনারা। সেই গ্রামে নাকি হিন্দু ধর্মের লোকদের বাস। তাদেরকে বিতাড়িত এবং নিশ্চিহ্ন করতে বের হয় মিলিটারিরা। কলিমদ্দি দফাদার তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যান।

সেদিনই তার চোখের সামনে তার দোস্ত সাইজদ্দি খলিফার মাত্র ষোলো বছরের ছেলেকে নির্মমভাবে গুলি করে মারা হয়। সে মুক্তিযুদ্ধের সাথে যুক্ত ছিলো না। সে হিন্দু ধর্মের কেউও নয়। তারপরেও তাকে রেহাই দেয়নি ঘাতকরা। কলিমদ্দি দফাদার তবুও শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। কিছুই করতে পারে না।

“গ্রামবাসীরা উঠিপড়ি নাও-কোন্দা বেয়ে অথৈ পানিতে ভাসমান উদ্ধত ধানের শীষের আড়ালে আত্মগোপন করে। যারা নাও- কোন্দা পায় না তারা বিলে নামে এবং মাথার ওপরে কচুরিপানা চাপিয়ে নাক জাগিয়ে ডুবে থাকে।”

হানাদার বাহিনীর কথামতো তাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে কলিমদ্দি। এই প্রেক্ষাপটে এসে পাঠক হয়তো ভাবতেও পারেন, লেখক কোনো রাজাকারের গল্প বলছেন। কারণ, একান্ত অনুগত হয়ে এভাবে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতো রাজাকাররাই।

‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর পর দলে দলে দেশান্তরী হচ্ছেন ভীতসন্ত্রস্ত জনগণ; Image Credit: AP Photo/Michel Laurent

 

কিন্তু লেখক আবু জাফর শামসুদ্দিন ভিন্ন এক তুলির আঁচড় দিতে চান। পাঠকের চিন্তাকে পাল্টে দেন চমৎকার এক সাহসী ঘটনার মাধ্যমে।

বর্ষাকালে গ্রামাঞ্চলের নিচু জায়গায় পানি জমে। তা পার হতে নৌকা বা ভেলার দরকার হয়। নতুবা বানানো হয় সাঁকো কিংবা কাঠের পুল। তবে মানুষের নিয়মিত ব্যবহার এবং বৃষ্টির ফলে পচে যায় কোনো বাঁশ কিংবা পুলের কাঠ। এমনই সাঁকোতে চড়ে অভ্যস্ত গ্রামবাসীরা।

হানাদার বাহিনীর সামনেও পড়ে এমন একটি পুল।

“সেরেফ একহি রাস্তা, বাকি চারো তরফ পানি”

কলিমদ্দি দফাদার তাদেরকে এমন এক রাস্তায় নিয়ে আসেন, যেখানে তাদের চলাচলের অভ্যাস নেই। এখানে পাঠকের মনে জিজ্ঞাসু চেতনা তৈরি করেন লেখক। কলিমদ্দি দফাদার কি ইচ্ছে করেই এমনটি করেছেন?  

চারপাশে আর রাস্তা না দেখে পুলসিরাতের ন্যায় কঠিন এই পুলের মাধ্যমেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। দফাদারকে অনুসরণ করে এগিয়ে যায়।  

“কলিমদ্দি দফাদার যত এগিয়ে যায়, তার পদযুগল নিপুণ অভিনেতার পদযুগলের মতো ঠকঠক কাঁপে, পুল কাঁপে দ্বিগুণ তালে”

একক্ষণে পাঠক ব্যপারটি পরিষ্কার বুঝতে পারেন যে কলিমদ্দি দফাদার কিছু একটা করতে যাচ্ছে। তখনই তাদেরকে পুলের উপর থাকা অবস্থায় আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনী। অতর্কিত এই আক্রমণের ফলে পাল্টা আক্রমণের সুযোগ পায়নি মিলিটারিরা। তাদের একজন প্রথমেই গুলি খেয়ে খালের স্রোতে পড়ে যায়। বাকিরা চেষ্টা করলেও বাঁচতে পারেনি।

সংগ্রাম করে বিজয় ছিনিয়ে আনে দামাল ছেলেরা; Image Source: NTV

কলিমদ্দি দফাদার আগে থেকেই মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগ রেখেছিলেন। বুদ্ধি করে পাকবাহিনীকে এমন জায়গায় আনেন। ফলে যোদ্ধাদের কাজ সহজ হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকেই এমন সাহসী কাজের সাথে জড়িয়ে ছিলেন। নিজের জীবনকে শত্রুর হাতের মুঠোয় রেখে কাজ করেছিলেন মাতৃভূমির হয়ে।

কিন্তু গল্পের শেষের দিকে এসে লেখক আবু জাফর শামসুদ্দিন দেখান ভিন্ন এক চিত্র।  

“কলিমদ্দিকে আবার দেখা যায় ষোলই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বাজারের চা স্টলে। তার সঙ্গীরা সবাই মুক্তি, সে-ই শুধু তার পুরনো সরকারি পোশাকে সকলের পরিচিত কলিমদ্দি দফাদার।”

দেশ স্বাধীন হবার পর বেশিরভাগ মানুষ দাবি করে তারা মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু আসল মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই থেকে যান পর্দার আড়ালে। দাপট দেখাতে থাকে নামধারী মুক্তিযোদ্ধারা। আর আবারও সেই আগের জীবনেই ফিরে যেতে হয় মুক্তিযুদ্ধের নীরব অনুঘটকদের।  

This article is mainly the review of story 'Kalimuddi dafadar'. This strory is Writen by Abu Jafar Shamsuddin. 

Featured Image Source:  Guardian 

Related Articles