Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

স্বাধীনতা সংগ্রামের সেক্টরগুলো: ২ নং সেক্টর

আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ কোনো সামরিক অভিযান ছিল না; ছিল সাধারণ শোষিত মানুষের মুক্তির অকুতোভয় অসম সংগ্রাম।ধাপে ধাপে দখল হতে থাকা এই দেশকে মুক্ত করার প্রয়াসে এদেশের অগণিত নিষ্পেষিত প্রাণ চালিয়ে যাচ্ছিলো তাঁদের দুর্বার মুক্তিসংগ্রাম। কিন্তু ২৫ মার্চ থেকে চালানো পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্মম নৃশংসতার বিপরীতে সেগুলো ছিল অসংগঠিত ও বিচ্ছিন্ন কিছু ‘ব্যর্থ’ প্রতিরোধ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিরোধযুদ্ধগুলো হচ্ছিলো সমন্বয়হীনভাবে আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। এমতাবস্থায় এসব স্বাধীনতাকামী, সাধারণ জনগণ, বাঙালি ইউনিট আর ‘বিদ্রোহী’ সামরিক সদস্যদের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি করাটা জরুরি হয়ে পড়ে।

সেই লক্ষ্যে ৪ এপ্রিল সিলেটের হবিগঞ্জ মহকুমার সীমান্ত সংলগ্ন তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ডাকবাংলোয় কর্নেল এম এ জি ওসমানীর সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানকে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট ও যশোর- এই চারটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়। পরবর্তীতে অবশ্য এই চার অঞ্চল বিভক্তি থেকে সরে আসে নীতিনির্ধারকেরা। ১১ এপ্রিল শিলিগুড়ি বেতারকেন্দ্র থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সমগ্র দেশকে আটটি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে আটজন সেক্টর কমান্ডার নিয়োগের ঘোষণা দেন।

অবশেষে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে বৃষ্টিস্নাত কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে তাজউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক কনফারেন্সে সারা দেশকে সামরিকভাবে এগারোটি সেক্টরে ভাগ করা হয়। মূলত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর এটিই ছিল সেক্টর কমান্ডারদের প্রথম কনফারেন্স। সভায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এম এ রবকে বাংলাদেশ ফোর্সেস-এর চিফ অব স্টাফ ও গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর রণাঙ্গনের প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে মনোনীত করা হয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো; © বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস-সেক্টর এক, পৃষ্ঠা ৩৩

কলকাতায় সেক্টর কমান্ডারদের সভায় কর্নেল ওসমানীর সাথে সেক্টর কমান্ডারগণ; © মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র

মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে এগারোটি (প্রধানত) সেক্টরে ভাগ ছিল আমাদের রণাঙ্গন; © banglapedia.org

একাত্তরের অন্যতম যুদ্ধবহুল সেক্টর ছিল ২ নং সেক্টর। অন্যান্য সেক্টরের সাথে এই সেক্টরের কার্যপ্রণালীর কিছু বিশেষত্ব ছিল। যেমন- সেক্টর এলাকা, অফিসারের সংখ্যা, গেরিলা অ্যাকশন সব দিক থেকেই এই সেক্টর ছিল অপেক্ষাকৃত বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের দুর্নিবার সাহসী ক্র্যাক প্লাটুন ছিল প্রধানত এই সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের তিনটি প্রধান নদী- পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা এই সেক্টর এলাকার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল ঐতিহ্যমন্ডিত রাজধানী ঢাকা। ঢাকার মুক্তকরণে এই সেক্টরের অবদান অনস্বীকার্য। চলুন, ইতিহাসের পথ ধরে পেছন ফিরে দেখে আসি রণাঙ্গনের সেই ২ নং সেক্টরকে।

প্রধান নদ-নদী

পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা বাদেও আরো যেসব নদ আর নদী বয়ে গেছে ২ নং সেক্টরকে আলিঙ্গন করে- বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, কালীগঙ্গা, ইছামতি, বংশী, তুরাগ, ডাকাতিয়া, কাটাখালী, রহমতখালী, ভুলুয়া, মুহুরী, সালদা, কুমার, গড়াই, কীর্তিনাশা, আড়িয়াল খাঁ, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ইত্যাদি। সামান্য কিছু উঁচু অঞ্চল বাদে এই সেক্টর মোটামুটি পলিগঠিত এক সমতল ভূমি।

২ নং সেক্টরের দায়িত্বপূর্ণ এলাকা; © বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই

সেক্টর এলাকা

২ নং সেক্টর এলাকা বৃহত্তর ঢাকা (মূলত ঢাকা শহরসহ ঢাকা জেলার দক্ষিণাংশ), কুমিল্লা (আখাউড়া-আশুগঞ্জ রেললাইনের উত্তরাংশ বাদে), ফরিদপুরের পূর্বাঞ্চল ও নোয়াখালীর অংশবিশেষ (মুহুরী নদীর পূর্বাঞ্চল বাদে) নিয়ে গঠিত হয়েছিল। অর্থাৎ (বর্তমানের সাপেক্ষে) লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অংশবিশেষও ছিল এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। ২ নং সেক্টরের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকা, দক্ষিণ-পূর্বে ১ নং সেক্টর, পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, উত্তরে ৩ নং সেক্টর, উত্তর-পশ্চিমে যমুনা নদী ও ৭ নং সেক্টর, পশ্চিমে ৮ নং সেক্টর এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে ৯ নং সেক্টরের অবস্থান। ২ নং সেক্টরের আয়তন প্রায় ১৯, ৫২৬ বর্গ কিলোমিটার। কিছু কিছু জায়গায় অবশ্য এই আয়তনকে আনুমানিক ১৭,৬৫৮ বর্গ কিলোমিটারও বলা হয়েছে।

সদর দপ্তর: ভারতের আগরতলা রাজ্যের মেলাঘর

সেক্টর কমান্ডার: মেজর খালেদ মোশাররফ (এপ্রিল থেকে অক্টোবর) এবং মেজর এটিএম হায়দার (অক্টোবর থেকে ১৬ ডিসেম্বর)

মেজর খালেদ মোশাররফ; © মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্স, পৃষ্ঠা ১২

মেজর এটিএম হায়দার; © বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস- সেক্টর দুই, পৃষ্ঠা ৬২৮

সাব-সেক্টরের সংখ্যা: ৬টি; গঙ্গাসাগর, মন্দভাগ, সালদা নদী, মতিনগর, নির্ভয়পুর, রাজনগর।

স্টাফ অফিসার: মেজর আবদুল মতিন ও ক্যাপ্টেন আনোয়ারুল আলম।

মেডিক্যাল অফিসার: ক্যাপ্টেন আকতার আহমেদ।

সেক্টর বাহিনী: ২ নং সেক্টর বাহিনী গঠিত হয়েছিল নিয়মিত বাহিনীর সাথে সাবেক ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ ও বেসামরিক জনগণকে সাথে নিয়ে। সেক্টর বাহিনীর দুটি অংশ ছিল। একটি ছিল প্রায় ৮ হাজার সদস্যের নিয়মিত বাহিনী আর অপরটি ছিল গণবাহিনী যা মোট বাহিনীর প্রায় ৮১ শতাংশ। গণবাহিনীতে প্রায় ৩৫ হাজার দেশপ্রেমিক সদস্য ছিল।

ভারী অস্ত্র প্রশিক্ষণের দীক্ষা নিচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ; © রবীন সেনগুপ্ত

বাংলাদেশ হাসপাতাল

এই সেক্টরের উল্লেখযোগ্য হাসপাতালটির নাম বাংলাদেশ হাসপাতাল। মে মাসে এটি আগরতলার সোনামুড়ায় স্থাপিত হয়। জুলাই মাসে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সীমান্ত এলাকা থেকে অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী আগরতলাস্থ দারোগা বাগিচায় স্থানান্তরিত হয়। আগস্ট মাসে এই হাসপাতাল আগরতলার সন্নিকটে শ্রী হাবুল ব্যানার্জির বাগানে (বিশ্রামগঞ্জ) স্থানান্তর ও সম্প্রসারিত করা হয়। এই হাসপাতালটি ছিল দু’শ শয্যার। ডা. জাফরউল্লা চৌধুরী, ডা. মবিন ও চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়নরত বহু ছাত্র-ছাত্রী এই হাসপাতালের নির্ঘুম চোখে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন।

২ নং সেক্টরের ফিল্ড হাসপাতাল; © বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর- দুই, পৃষ্ঠা ৬৩৯

একাত্তরে বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর সাথে ২ নং সেক্টরের বাংলাদেশ হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মীবৃন্দ; © বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর- দুই, পৃষ্ঠা ৬৩৯

সাব-সেক্টরসমূহ

গঙ্গাসাগর সাব-সেক্ট

এই সেক্টর এলাকা কসবার অংশবিশেষ, আখাউড়া, মুরাদনগর, সৈয়দাবাদ, বাঞ্ছারামপুর, নবীনগর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এখানে ৪ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানি, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের দুটি “X” কোম্পানি ছাড়াও একটি মর্টার চালনাকারী বাহিনী ছিল। এই সাব-সেক্টরে সালদা নদীর অবস্থানের কারণে মুক্তিযোদ্ধাগণ নৌপথেও বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিতে পারতেন।

এই এলাকায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও রেলপথ অবস্থিত ছিল। ঢাকা থেকে একটি সড়ক ভৈরব ও সিলেট হয়ে জৈন্তাপুর সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত চলে গেছে। আবার ঢাকা থেকে একটি রেলপথ সেই ভৈরব হয়ে পূর্ব দিকে আখাউড়াতে গিয়ে মিলিত হয়েছে এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে ময়মনসিংহ অভিমুখে চলে গেছে। অন্য একটি রেলপথ নোয়াখালীর মাইজদী হতে সীমান্ত ঘেঁষে বিয়ানীবাজারের দিকে চলে গেছে। অর্থাৎ এই সাব-সেক্টর মুক্তিযোদ্ধা ও পাক হানাদার বাহিনী উভয়ের জন্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

আয়তন: প্রায় ৭০০ বর্গ কিলোমিটার

সাব-সেক্টর কমান্ডার: ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন। তাঁর সঙ্গে ক্যাপ্টেন মাহবুব, লেফটেন্যান্ট ফারুক ও লেফটেন্যান্ট হুমায়ুন কবীরও ছিলেন।

দায়িত্বপূর্ণ এলাকা: কসবার অংশবিশেষ, আখাউড়া, মুরাদনগর, সৈয়দাবাদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অংশবিশেষ ও নবীনগর।

উল্লেখযোগ্য আক্রমণ, অ্যামবুশ ও যুদ্ধসমূহ: কুমিল্লা-দাউদকান্দি সড়কে মাইন বিস্ফোরণ (১৬ জুলাই), কাশিমপুর রেলসেতু ধ্বংস (১৮ জুলাই), গোসাই পাকিস্তানী ঘাঁটি আক্রমণ (৩১ জুলাই), মুরাদনগরে অ্যামবুশ (১৭ আগস্ট), বিবিরবাজারে মাইন অপারেশন (২ সেপ্টেম্বর), কসবার গোপীনাথপুর অ্যামবুশ (সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ), নবীনগরের মীরপুর গুন্ডিগ্রামের যুদ্ধ ও কসবার চারগাছ গ্রামে যুদ্ধ (সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি), কাইমপুরের যুদ্ধ (১৯ সেপ্টেম্বর), চারদারী জগন্নাথপুর যুদ্ধ (সেপ্টেম্বর), হোমনা থানা আক্রমণ (২ অক্টোবর), উজানচর-আসাদনগর লঞ্চ আক্রমণ (১১ অক্টোবর), দাউদকান্দি থানার (তৎকালীন) অন্তর্ভূত মেহার, ফরিদগঞ্জ ও মতলবে সিরিজ অপারেশন (২৭ অক্টোবর), দৌলতপুর গ্রামে যুদ্ধ (অক্টোবর), মুরাদনগরের চাপিতলার দুর্নিবার লড়াই (৭ ও ৮ নভেম্বর), কৃষ্ণপুর ও বাগবাড়ি দখল (১১ ও ১২ নভেম্বর), চন্দ্রপুর অপারেশন (১৮-২২ নভেম্বর), মুকুন্দপুর আক্রমণ (১৯ নভেম্বর) ইত্যাদি।

চাপিতলার দুর্ধর্ষ যুদ্ধ (৭-৮ নভেম্বর); © বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর- দুই, পৃষ্ঠা ২৪৯

গঙ্গাসাগর সাব-সেক্টর; © বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, পৃষ্ঠা ২৩৫

মন্দভাগ সাব-সেক্টর

এই সাব-সেক্টর এলাকা মন্দভাগ রেলস্টেশন থেকে কুটি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই এলাকার মধ্য দিয়ে সীমান্ত বরাবর একটি রেলপথ চলে গেছে। অর্থাৎ ভারত সীমান্তবর্তী সাব-সেক্টর হওয়ার কারণে এই এলাকাটি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বেশ সুবিধাজনক একটি রণাঙ্গন ছিল। এখানে ৪ বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি কোম্পানি, একটি মর্টার চালনা বাহিনী ও গণবাহিনীর কিছু মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেছেন।

আয়তন: প্রায় ১০০ বর্গ কিলোমিটার।

সাব-সেক্টর কমান্ডার: ক্যাপ্টেন এইচএমএ গাফফার।

দায়িত্বপূর্ণ এলাকা: কসবার অংশবিশেষ, কাইমপুর, বায়েক, আখাউড়ার কিছু অংশ, গোপীনাথপুর।

২ নং সেক্টরের একজন মুক্তিযোদ্ধা রেললাইনের পাশে শত্রুর গতিবিধির উপর নজর রাখছেন; © বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর- দুই, পৃষ্ঠা ৬৪০

উল্লেখযোগ্য আক্রমণ, অ্যামবুশ ও যুদ্ধসমূহ: নোয়াগাঁও অভিযান (১৭ জুলাই), মন্দভাগ অপারেশন (১৯ জুলাই), মন্দভাগ এলাকায় আক্রমণ (৯-১২ আগস্ট), মীরপুর-মাধবপুর অভিযান (২৪ ও ২৫ আগস্ট), কলামুড়া ব্রিজ অ্যামবুশ (আগস্ট), দেউশ মন্দভাগ অভিযান (১৪ অক্টোবর), কাইমপুর আক্রমণ (২ নভেম্বর), মন্দভাগ আক্রমণ (৭ নভেম্বর) ইত্যাদি।

মন্দভাগ সাব-সেক্টর; © মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্স, পৃষ্ঠা ২৫০

সালদা নদী সাব-সেক্টর

এই সাব-সেক্টরে পাকিস্তানী বাহিনী প্রচুর বাঙ্কার নির্মাণ করেছিল। এই এলাকায় নৌ-কমান্ডোরা বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করেন। এই অঞ্চলের পূর্ব দিক দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে চলে গেছে একটি রেলপথ। এখানে ৪ বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা (এ) কোম্পানি, ইপিআর-এর একটি এক্স কোম্পানি ও গণবাহিনীর সদস্যগণ যুদ্ধ করেন।

আয়তন: প্রায় ২০০ বর্গ কিলোমিটার।

সাব-সেক্টর কমান্ডার: মেজর আবদুস সালেক চৌধুরী।

দায়িত্বপূর্ণ এলাকা: কুমিল্লা জেলার সালদা নদী এলাকা, নয়নপুর, বুড়িচং এলাকার কিছু অংশ, দেবীদ্বার, ব্রাহ্মণপাড়া।

সালদা নদী অঞ্চলে অ্যামবুশে যাবার আগে ব্রিফিং; মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ভারতীয় এসএলআর এবং কমান্ডারের হাতে চীনা সাব মেশিনগান; © বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর- দুই, পৃষ্ঠা ৬৪০

উল্লেখযোগ্য আক্রমণ, অ্যামবুশ ও যুদ্ধসমূহ: সালদা নদী এলাকায় আক্রমণ (১০-১৩ আগস্ট), চান্দলা অভিযান (২৪ আগস্ট), ধনদইল গ্রামে আক্রমণ (২৫ আগস্ট), নয়নপুরে যুদ্ধ (সেপ্টেম্বর),সালদা নদী যুদ্ধ ও অভিযান (সেপ্টেম্বর-নভেম্বর), জাফরগঞ্জ যুদ্ধ (অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ), চানলা আক্রমণ (১৭ নভেম্বর) ইত্যাদি।

সালদা নদী সাব-সেক্টর; © মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্স, পৃষ্ঠা ২৫১

মতিনগর সাব-সেক্টর

এই সাব-সেক্টরটি উঁচুনিচু বেশ কিছু টিলা আর ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে মতিনগরে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু মে মাসের দিকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ট্রেনিং ক্যাম্পের ঘরগুলোকে পুড়িয়ে দিলে ট্রেনিং ক্যাম্প ভারতের মেলাঘরে স্থানান্তর করা হয়। কুমিল্লা জেলার বুড়িচং থেকে পশ্চিমে ভারতের সীমান্ত এলাকা আর অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমে দক্ষিণ পয়ালগাছা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই সাব-সেক্টর। এখানে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস তথা ইপিআর-এর ১টি এক্স কোম্পানি, ৪ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সংখ্যক সৈন্য ও গণবাহিনী যুদ্ধরত ছিলেন।

আয়তন: প্রায় ৪০০ বর্গ কিলোমিটার।

সাব-সেক্টর কমান্ডার: লেফটেন্যান্ট দীদারুল আলম।

দায়িত্বপূর্ণ এলাকা: কুমিল্লা জেলার বুড়িচংয়ের অংশবিশেষ, ময়নামতি, বরুরা, কালীরবাজার, পশ্চিম চান্দিনা, আমড়াতলী, রাজাপুর, পয়ালগাছা ইত্যাদি।

উল্লেখযোগ্য আক্রমণ, অ্যামবুশ ও যুদ্ধসমূহ: কৈলাশনগরে সংঘর্ষ (২৩ জুলাই), আমড়াতলী ও কৃষ্ণপুরের যুদ্ধ (১০ সেপ্টেম্বর), বুড়িচং ও জামবাড়ী অ্যামবুশ (৮ অক্টোবর), শিমপুর মাইন বিস্ফোরণ (২৯ অক্টোবর), বামনি অপারেশন (২০ নভেম্বর), তাল মোহাম্মদ হাটের যুদ্ধ (২৭ নভেম্বর) ইত্যাদি।

মতি নগর সাব-সেক্টর; © মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্স, পৃষ্ঠা ২৫২

নির্ভয়পুর সাব-সেক্টর

সাব-সেক্টরগুলো জুলাই মাসে গঠন করা হলেও প্রয়োজনের তাগিদে নির্ভয়পুর সাব-সেক্টরটি গঠনের জন্য মেজর খালেদ মোশাররফ জুন মাসে নির্দেশ প্রদান করেন। দক্ষিণ-পশ্চিমে নদী এলাকার অবস্থান ছিল বলে নৌ অপারেশনের জন্য এই সাব-সেক্টরের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই সাব-সেক্টরের উত্তর-পূর্ব দিক ভারতের সাথে যুক্ত ছিল।

আয়তন: ২ নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছয়টি সাব-সেক্টরের মধ্যে নির্ভয়পুর সাব-সেক্টর ছিল আয়তনের দিক থেকে বৃহত্তর। আয়তনের দিক থেকে এই সাব-সেক্টর ছিল ১,২০০ বর্গ কিলোমিটার।

সাব-সেক্টর কমান্ডার: প্রথমে ক্যাপ্টেন আকবর ও পরে লেফটেন্যান্ট মাহবুব।

দায়িত্বপূর্ণ এলাকা: ফরিদগঞ্জ, শাহরাস্তি, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর, নোয়াখালী ও কুমিল্লার কিছু অংশ।

উল্লেখযোগ্য আক্রমণ, অ্যামবুশ ও যুদ্ধসমূহ: ফরিদ্গঞ্জের শাসিয়ালী ও শাহরাস্তির চিতোষীর যুদ্ধ (২৯ জুলাই), চরশোলাদী গ্রামের যুদ্ধ (৩০ জুলাই), ছাতুরার অ্যামবুশ (জুলাই), বড়দিয়া আড়ং যুদ্ধ (৪ আগস্ট), বাসারা বাজারের যুদ্ধ (৫ আগস্ট), শাহপুরের যুদ্ধ (১৪ আগস্ট), পালিশারা বাজার রেইড (১৬ আগস্ট), বলাখাল হরিসভার বাড়ির যুদ্ধ (১৭ আগস্ট), খিলা বাজারের যুদ্ধ (২১ আগস্ট), হাসনাবাদের যুদ্ধ (২৮ আগস্ট), গঙ্গাজলী ব্রিজ লড়াই (৩০ আগস্ট), চানলা নদী অপারেশন (৩০ আগস্ট), সূচিপাড়ার যুদ্ধ (৭ সেপ্টেম্বর ও ২৭ অক্টোবর), চিতসির যুদ্ধ (২৯ সেপ্টেম্বর), ফরিদগঞ্জ মুক্তকরণ (নভেম্বর), কুমিল্লা শহরের যুদ্ধ (২৩ নভেম্বর), চাঁদপুর মুক্তকরণ (ডিসেম্বর), গাজীপুর যুদ্ধ ইত্যাদি।

নির্ভয়পুর সাব-সেক্টর; © বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর- দুই, পৃষ্ঠা ৩০৯

রাজনগর সাব-সেক্টর

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এই সাব-সেক্টরের মধ্য দিয়ে চলে গেছে। অন্যদিকে ঢাকার সাথে চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগের একমাত্র পথটিও এই অঞ্চল দিয়ে অতিক্রম করেছে। এই সেক্টরের পূর্বদিকে ভারতের ত্রিপুরা। এই এলাকায় ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্রাভো তথা বি কোম্পানি, ইপিআর-এর এক্স কোম্পানি ও গণবাহিনীর সদস্যগণ যুদ্ধ করেন। এই সাব-সেক্টরের দক্ষিণে ছিল বঙ্গোপসাগর।

আয়তন: প্রায় ৫০০ বর্গ কিলোমিটার

সাব-সেক্টর কমান্ডার: ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম। তাঁকে সহায়তার জন্য ছিলেন ক্যাপ্টেন শহীদ ও লেফটেন্যান্ট ইমাম-উজ-জামান।

দায়িত্বপূর্ণ এলাকা: বিলোনিয়ার পশ্চিমাঞ্চল, লাকসামের দক্ষিণাঞ্চল, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম,  নাঙ্গলকোট, ফেনীর আংশিক অঞ্চল ও নোয়াখালীর কিছু অংশ।

উল্লেখযোগ্য আক্রমণ, অ্যামবুশ ও যুদ্ধসমূহ: নবাবপুরের যুদ্ধ (২৮ জুলাই), গোপালপুর যুদ্ধ (১০ আগস্ট), সোনাপুর যুদ্ধ (৮ সেপ্টেম্বর), কল্যাণদীর অপারেশন (১৮ সেপ্টেম্বর), রাজগঞ্জের যুদ্ধ (২১ সেপ্টেম্বর), বিলোনিয়ার যুদ্ধ ও বিজয় (অক্টোবর ও নভেম্বর), ওদারহাটের যুদ্ধ (৩০ অক্টোবর), শালধর ও লেমুয়ার যুদ্ধ (১০ নভেম্বর), বেতিয়ারা গ্রামের যুদ্ধ (১১ নভেম্বর), নোয়াপুরের যুদ্ধ (ডিসেম্বর) ইত্যাদি।

বিলোনিয়ার শেষ যুদ্ধ; © বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর- দুই, পৃষ্ঠা ৩৯৩

রাজনগর সাব-সেক্টর; © বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর- দুই, পৃষ্ঠা ৩৬৭

শহর, শহরতলী ও অঞ্চলভিত্তিক পরিচালিত গেরিলা যুদ্ধসমূহ

ঢাকার গেরিলা যুদ্ধ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গেরিলা যুদ্ধ ছিল অনুকরণীয় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধাদের অনেকেই ছিলেন ছাত্র, বুদ্ধিজীবী তথা মেধাবী তরুণ। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের মুক্তিযুদ্ধে এত উচ্চশিক্ষিত গেরিলা যোদ্ধা দেখা যায়নি যা কিনা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেখা গিয়েছিল। ২ নং সেক্টরে ছিল একাধিক ঢাকাকেন্দ্রিক দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনী। তাঁরা মেলাঘর, নির্ভয়পুর, পশ্চিম দিনাজপুর ও দেরাদুন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অকুতোভয় হৃদয়ে ঢাকা অ্যাটাক করেছিল।

ক্র্যাক প্লাটুন

আমাদের মুক্তি সংগ্রামের এক আবেগমাখা অবিচ্ছেদ্য অংশ এই ক্র্যাক প্লাটুন। এই দুর্ধর্ষ প্লাটুন মেজর খালেদ মোশাররফের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রাজধানীকেন্দ্রিক তাঁদের গেরিলা কার্যক্রম চালাতো। খালেদ মোশাররফ নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি কমান্ডো তথা বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্ষিপ্রগতির একটি গেরিলা বাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল্লাহ খান বাদলকে ঢাকায় ফিরে গিয়ে শিক্ষিত, নিবেদিতপ্রাণ ও দেশপ্রেমিক ছেলেদের নিয়ে বিশেষ গেরিলা দল গঠনের লক্ষ্যে তাঁদের সরাসরি রিক্রুট করার জন্য দায়িত্ব প্রদান করেন। আর বাছাইকৃত গেরিলাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের বিশিষ্ট বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দারকে।

আগরতলা ক্যাম্পে স্বল্পমেয়াদী গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার নেতৃত্বে ১৬ জনের প্রথম দলটিকে জুন মাসের শুরুর দিকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। অন্য কোনো অস্ত্র ছাড়াই এই দলটি চারটি করে হাতবোমা আর ২০ পাউন্ড করে বিস্ফোরক নিয়ে ৬ জুন গোপনে ঢাকাতে প্রবেশ করে।

একাত্তরের দুর্ধর্ষ গেরিলা দল ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যগণ; © ডাঃ আবু জাফর ওসমান

একাত্তরের সেই উত্তাল রণাঙ্গনে ক্র্যাক প্লাটুন ছিল পাকিস্তানীদের কাছে এক ভয়ের নাম, বিভীষিকার প্রতিশব্দ। ক্র্যাক প্লাটুনের উল্লেখযোগ্য অপারেশন হল-

১। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে হ্যান্ড গ্রেনেড ও এক্সপ্লোসিভ চার্জ,

২। পাঁচটি ১১ কেভি পাওয়ার স্টেশন আক্রমণ ও এক্সপ্লোসিভ চার্জ,

৩। যাত্রাবাড়ী ব্রিজে এক্সপ্লোসিভ চার্জ,

৪। হামিদুল হক চৌধুরীর প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিতে এক্সপ্লোসিভ চার্জ,

৫। বিডিআর গেট ও ধানমন্ডি আক্রমণ,

৬। গ্যানিজ ও ভোগ বিপণীকেন্দ্রে হামলা ও কয়েকটি পেট্রোল পাম্পসহ বিভিন্ন স্থানে গ্রেনেড চার্জ,

৭। ফার্মগেট অপারেশন ইত্যাদি।

ঢাকা গেরিলা (দক্ষিণ)

২৫ মার্চ আজিমপুর এলাকার কিছু ছাত্র ও যুবক পাক বাহিনীর উপর আক্রমণের জন্য তাঁদের গেরিলা কার্যক্রম শুরু করে। এই দলের দলনেতা ছাত্র আদিল খানের (টুটুল) নামে পরিচিত ছিল এই গেরিলা বাহিনী। নভেম্বরে নিউ মার্কেট পেট্রোল পাম্প উড়িয়ে দেওয়া ও আর্মি রিক্রুটমেন্ট অফিসে গ্রেনেড চার্জ ছিল এই বাহিনীর অন্যতম দুটি অপারেশন।

ঢাকা গেরিলা (উত্তর)

ঢাকা শহরের কিছু ছাত্র ও যুবক পশ্চিম দিনাজপুরের বালুঘাটে একত্রিত হয়ে দেড় মাসের যুদ্ধ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তাঁদের কথা ২ নং সেক্টর প্রধান মেজর খালেদ মোশাররফ জানতে পারেন। আরও কিছু ঢাকাবাসী ছাত্র-যুবককে উক্ত দলে অন্তর্ভুক্ত করে ১৫ দিনের একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ দেন। অতঃপর তাঁদের ঢাকার উত্তরে গেরিলা যুদ্ধের জন্য পাঠানো হয়। তাঁদের উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছিল- কাকরাইল মোড়ের পেট্রোল পাম্প ধ্বংস করা, সিঙ্গাইর থানার কাছাকাছি একটি গ্রামে অপারেশনের মাধ্যমে ১৪ জন পাকিস্তানী সেনার খাদ্য বহনকারী দলকে হত্যা করা, নভেম্বরে পল্টনে ১৬ পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করা, শাহবাগের রেডিও পাকিস্তান দপ্তরে গ্রেনেড চার্জ ইত্যাদি।

অভিযানের পূর্বে ঢাকার সন্নিকটে ঢাকা গেরিলা (উত্তর) বাহিনীর গেরিলারা; © মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্স, পৃষ্ঠা ৫৭

এছাড়াও ১৩ অক্টোবর গভর্নর মোনায়েম খানকে গেরিলা আক্রমণ করে হত্যা করেন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা সাঁতারকুল ইউনিয়নের মোজাম্মেল হক। গুলিবিদ্ধ মোনায়েম খান পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায়।

নারায়ণগঞ্জের গেরিলা যুদ্ধ

এখানকার উল্লেখযোগ্য গেরিলা যুদ্ধগুলো হলো ঢাকা-নরসিংদী মহাসড়কের উপর অবস্থিত বরদা গ্রামের কারভার্ট ধ্বংস (১৭ জুলাই), ফতুল্লা থানার বিজেসি গোদনাইল প্রেস হাউজে আগুন (৩ আগস্ট), সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অপারেশন (১০ আগস্ট), বন্দর থানাধীন লাঙ্গলবন্দ ব্রিজ অপারেশন (আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ ও ১৪ নভেম্বর), সদর থানার রূপসীবাজার অপারেশন (২৩ আগস্ট), আড়াইহাজার থানা আক্রমণ (২৯ আগস্ট), ফতুল্লা রেলসেতু আক্রমণ (১২ সেপ্টেম্বর), জাঙ্গির অপারেশন (সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর), কাঞ্চনবাজার অপারেশন (১০ অক্টোবর), পাগলা রেলসেতু ধ্বংস (১০ অক্টোবর), কলাগাছিয়ার গানবোট অপারেশন (২৬ অক্টোবর), কাশিপুর অপারেশন (৩ ডিসেম্বর), কলাগাছিয়া অপারেশন (১৩ ডিসেম্বর), ইত্যাদি।

নরসিংদীর গেরিলা অপারেশন

জিনারদি অপারেশন (১৩ আগস্ট), রায়পুরা সদর কলোনির যুদ্ধ (সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি), হাটুভাঙ্গা যুদ্ধ (১৬ সেপ্টেম্বর), অপারেশন বড়ৈবাড়ি (সেপ্টেম্বর) ইত্যাদি।

মুন্সিগঞ্জের গেরিলা অপারেশন

সিরাজদিখান থানা আক্রমণ (২৭ সেপ্টেম্বর), গোয়ালীমান্দার হাটের যুদ্ধ (সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ) ইত্যাদি।

মানিকগঞ্জের হালিম বাহিনী

প্রাথমিক প্রতিরোধে এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী নিজ উদ্যোগে ও স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত অস্ত্র নিয়ে গড়ে তোলেন হালিম বাহিনী। তিনি মানিকগঞ্জ ট্রেজারি থেকে ১৩৬টি রাইফেল ও কয়েক হাজার গুলি নিয়ে প্রাথমিক যুদ্ধ শুরু করেন। দুর্গম অঞ্চল হরিরামপুর থানায় তিনি তাঁর সদর দপ্তর গড়ে তোলেন। আঞ্চলিক বাহিনী হিসেবে হালিম বাহিনীর যুদ্ধ ও প্রতিরোধ তৎপরতা ছিল প্রশংসনীয়। ২ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারদ্বয়ের সাথে ক্যাপ্টেন হালিমের যোগাযোগ ছিল। নভেম্বর মাসে তিনি মেলাঘর যান এবং সেখানে তাঁকে মানিকগঞ্জ, ঢাকা সদর (দক্ষিণ ও পশ্চিম) এর দায়িত্ব লিখিতভাবে দেওয়া হয়। ১৯ নভেম্বর তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা সদর উত্তর ও দক্ষিণ মহকুমার এরিয়া ফোর্স কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

মানিকগঞ্জের হালিম বাহিনীর দায়িত্বপূর্ণ এলাকা; © বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, পৃষ্ঠা ৫০১

টাঙ্গাইলের বাতেন বাহিনী

টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর ও দেলদুয়ার থানাভিত্তিক একটি আঞ্চলিক গেরিলা বাহিনী ছিল ছাত্রনেতা খন্দকার আবদুল বাতেনের নেতৃত্বে বাতেন বাহিনী। দক্ষিণ টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানার কনোরা গ্রামে ছিল এই বাহিনীর সদর দপ্তর। বাতেন বাহিনীর উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলোর মধ্যে ছিল ৪ মে সিঙ্গাইর থানা আক্রমণ, ১৭ মে পদ্মাপাড়ের দৌলতপুর থানা আক্রমণ, মে মাসের শেষ সপ্তাহে ঘিওর থানা আক্রমণ, ১৪ আগস্ট সাটুরিয়া থানা আক্রমণ, ৯ ও ১০ অক্টোবরের কাকনার যুদ্ধ, ১৯ অক্টোবরের তিল্লীর যুদ্ধ, ইত্যাদি।

২ নং সেক্টরের খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাগণ

বীরশ্রেষ্ঠ: এই সেক্টরে একজন বীরশ্রেষ্ঠ ছিলেন।

সিপাহি মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল: মোস্তফা কামালের গল্প তখনের যখন সমগ্র বাংলাদেশ (সামরিকভাবে) ১১টি সেক্টরে ভাগ হয়নি। এই গল্প এক অকুতোভয় যোদ্ধার। এই গল্প দরুইন গ্রামের এক প্রতিরোধ যুদ্ধের।

বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহি মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল; © বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর- দুই, পৃষ্ঠা ৬২৯

১৭ ও ১৮ এপ্রিল ২ নং প্লাটুনের সেকশন কমান্ডার সিপাহি মোস্তফা কামালের অসীম সাহসিকতা রচিত হয়েছিল সেদিন বাংলার মেঘাচ্ছন্ন আসমানে, বৃষ্টিস্নাত জমিনে। তুমুল বৃষ্টির মাঝে দক্ষিণ ও পশ্চিম- এই দুই দিক থেকে আসা হানাদার বাহিনীর আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাগণ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। নিরাপদ পশ্চাদপসরণের জন্য দরকার নিখুঁত কভারিং ফায়ার। কিন্তু কে হবে এই সাহসী রিয়ারগার্ড যোদ্ধা। এগিয়ে আসেন সিপাহি মোস্তফা কামাল। তিনি তাঁর এলএমজি দিয়ে পূর্ণ উদ্যমে শত্রু অবস্থানের উপর গুলি চালাতে থাকেন। প্রায় দেড়শ’ পাক হানাদারকে শেষ করে দিলেন তাঁর অস্ত্রের ঝলকানিতে। সফল হলেন বীর মোস্তফা কামাল। তিনি তাঁর সহযোদ্ধাদের নিরাপদ পশ্চাদপসরণ নিশ্চিত করলেন নিজের জীবন দিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের দরুইন গ্রামে তাঁর রণাঙ্গনের সেই ট্রেঞ্চের পাশেই চির নিদ্রায় শায়িত আছেন আমাদের এই বীরশ্রেষ্ঠ।

দরুইন গ্রাম যুদ্ধ; © বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস- সেক্টর দুই, পৃষ্ঠা ১৪৫

বীর উত্তম: ৬ জন বীর উত্তম ছিলেন।

১। লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ
২। মেজর এটিএম হায়দার
৩। ক্যাপ্টেন আবদুস সালেক চৌধুরী
৪। ক্যাপ্টেন এমএ গাফফার হাওলাদার
৫। ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান
৬। সিপাহি সাফিল মিয়া

বীর বিক্রম: এই সেক্টরের ১৯ জন যোদ্ধাকে এই ৩য় সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব দেওয়া হয়।

বীর প্রতীক: ২ নং সেক্টরের ৫৬ জন যোদ্ধাকে এই উপাধি প্রদান করা হয়। এদের মধ্যে ছিলেন উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ওডারল্যান্ড। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের এই যোদ্ধা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামেও অবদান রেখেছেন। তিনিই একমাত্র বিদেশি যিনি রাষ্ট্রের এই খেতাবটি অর্জন করেছিলেন। টঙ্গীর বাটা জুতার কারখানায় নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কর্মরত ওডারল্যান্ড গোপনে পাকিস্তানী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতেন আর সেগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক অফিসারদের কাছে প্রেরণ করতেন। আমাদের মুক্তি সংগ্রামের এক পরম বন্ধু এই উইলিয়াম ওডারল্যান্ড।

বীর প্রতীক ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড; © ittefaq.com.bd

ফিচার ইমেজ: Edited by writer

তথ্যসূত্র

১. বাংলাদেশ ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ মুজিবনগর সরকার, Sector Boundaries সংক্রান্ত পত্র, এইচ.কিউ/এক্স/সেক্টর, তাং ১৮ জুলাই ‘৭১

২. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস–সেক্টর এক ও সেক্টর দুই, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত

৩. মুক্তিযুদ্ধে রাইফেল‌্স‌্ ও অন্যান্য বাহিনী, সুকুমার বিশ্বাস, মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৯

৪. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধঃ এগারটি সেক্টরের বিজয় কাহিনী, মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড

৫. মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান, এ এস এম সামছুল আরেফিন, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৮

৬. Bangladesh Fights for Independence, Lieutenant General ASM Nasim Bir Bikram, Columbia Prokashani, 2002

৭. সেক্টর কমান্ডারস এবং বেসামরিক বিষয়ক উপদেষ্টা মণ্ডলীর কনফারেন্স-এর মিনিটস, ১২-১৫ জুলাই ‘৭১, বাংলাদেশ ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার

৮. লক্ষ প্রাণের বিনিমিয়ে, রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, অনন্যা প্রকাশনী, অষ্টম সংস্করণ

৯. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, নবম, দশম ও একাদশ খন্ড, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, প্রথম সংস্করণ নভেম্বর ১৯৮২

১০. মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন, মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত, অনন্যা প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৮

১১. আমি বিজয় দেখেছি, এম আর আখতার মুকুল, সাগর পাবলিশার্স, ২০০০

১২. মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন সম্পাদিত, সাহিত্য প্রকাশ, ১ম খন্ড (১৯৯৪) ও ২য় খন্ড (১৯৯৯)

১৩. মুক্তিযুদ্ধে আমি ও আমার বাহিনী, আকবর হোসেন, অক্ষর বিন্যাস, জানুয়ারি ১৯৯৬

১৪. Witness to Surrender, Siddiq Salik, University Press Ltd., 1996

***বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই লেখাটি পূর্ণরূপে সম্পূর্ণ হয়েছে এটা বলা অসমীচীন। বিজ্ঞ পাঠককুলের যেকোনো প্রামাণ্য দলিল ও তথ্য এখানে আপডেট করে দেওয়া হবে।

Related Articles