কোনো পত্রিকা বা প্রতিষ্ঠানে কাজের সুবাদে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন নামজাদা অনেক সাংবাদিক এবং ফটো-সাংবাদিক। তাদের কেউ কেউ শুধুমাত্র কভার করেছিলেন শরনার্থী শিবিরগুলো, কেউ বা সীমান্তবর্তী মুক্তাঞ্চলগুলো। কিন্তু জীবন বাজি রেখে মূল ভূখণ্ডের রণক্ষেত্রে এসে ছবি তুলবার সাহস দেখিয়েছিলেন যারা তাদের সংখ্যা হাতেগোণা। অথচ কোনো অ্যাসাইনমেন্ট ছাড়াই স্বপ্রণোদিত হয়ে শুধুমাত্র পার্শ্ববর্তী দেশের যুদ্ধাক্রান্ত অবস্থা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারতীয় ফটোসাংবাদিক কিশোর পারেখ।
কিশোর পারেখের জন্ম ভারতের গুজরাটের ভাবনগর জেলায়। ছোটবেলা থেকেই সিনেমার পোকা ছিলেন। সিনেমার রূপালী জগৎ নয়, বরং তার পেছনে ক্যামেরার কারুকাজ মুগ্ধ করতো তাকে। তাই লেখাপড়ার বিষয় ঠিক করে নিলেন সেই সিনেমাই। উড়ে গেলেন হলিউডে। ফিল্ম মেকিং অ্যান্ড ডকুমেন্ট্রি ফটোগ্রাফি বিষয়ে পড়াশোনা করেন ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়াতে। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি কাজের মাধ্যমে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন, জিতেছিলেন বেশ কিছু পুরষ্কার।
১৯৬০ সাল নাগাদ ভারতে ফিরে এলেন তিনি। কিন্তু যেমনটি তিনি ভেবেছিলেন, বলিউড হয়তো মুখিয়ে থাকবে তাকে লুফে নেবার জন্য, বাস্তবতা ছিলো ভিন্ন। তখনকার ভারতের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তাকে মূল্যায়ন করবার জন্য তৈরি ছিল না। দিন-মাস পেরিয়ে গেলেও সিনেমার কাজ আর করা হয় না পারেখের। আক্ষেপ করে বলেছিলেন, মাত্র ৫০০ রূপি বেতনে হলেও কেউ তাকে নিলে পুরো সিনেমা দাঁড় করিয়ে দেবেন। তা আর হয়নি।
একদিন এক বন্ধুর সাথে গিয়েছিলেন এক বৃদ্ধের কাছে। সে বৃদ্ধ হলেন ভারতের বিখ্যাত শিল্পপতি জি ডি বিড়লার চাচা। সেখানে পারেখ তার লাইকা ক্যামেরা দিয়ে আনমনে এক ক্লিক করে বসেন বৃদ্ধ বিড়লার। দুদিন বাদে সে ছবি নজরে আসে জি ডি বিড়লার। তিনি পারেখকে খবর দেন এবার তার নিজের জন্য একটি পোর্ট্রেইট তুলে দিতে। আবার কাজে নেমে পড়েন কিশোর। বিড়লাকে স্টাডি শেষে দশ মিনিটের ফটোসেশান সেরে বেড়িয়ে পড়েন তিনি। পরেরদিন ফিরে আসেন ছবির রোল সহ।
ছবি দেখে অভিভূত হন বিড়লা। বিশাল এক টেবিল, পেছনের দেয়ালে টাঙানো তেমনই বিশাল ভারতের মানচিত্র। সেখানে চিহ্নিত করা বিড়লাদের বিশাল ব্যবসা সাম্রাজ্য। মাঝখানে আলো-আধারিতে বসে আছেন একজন মানুষ। সে মানুষটি কে বা তার চেহারা কেমন তা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে মানুষটি যে এই বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকর্তা ছবিটি তা স্পষ্ট বলে দিচ্ছে।
পারেখ ভাবলেন, বিড়লাকে একটু হলেও নাড়া দিতে পারলে তার কথায় হয়তো সিনেমায় কাজের সুযোগ মিলবে। এত বড়ো মানুষের কথা তো আর কেউ ফেলতে পারবে না। অথচ বিড়লা ভিন্ন চিন্তা করছিলেন। হঠাৎ তিনি নিজেই পারেখকে কাজের প্রস্তাব করে বসেন, তাদের পত্রিকা দি হিন্দুস্থান টাইমসের প্রধান আলোকচিত্রী হিসেবে।
সিনেমাকে নিজের ক্যামারায় ধারণ করার স্বপ্নে বিভোর পারেখ দোটানায় পড়ে যান। সিনে ফটোগ্রাফি ছেড়ে দিয়ে তাকে মেইনস্ট্রিম প্রিন্ট মিডিয়ায় কাজ করতে হবে। প্রথমে তা মানতে রাজি না হলেও প্রয়োজন বড়ো হয়ে দাঁড়ায় পারেখের সামনে। সাথে আছে বিশাল এই প্লাটফর্মে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ।
তাই পরের সোমবার হিন্দুস্থান টাইমসের প্রধান আলোকচিত্রী হিসেব যোগ দেন দিল্লীর অফিসে। যোগ দিয়েই মাসখানেকের মধ্যে বদলে দিতে থাকেন ভারতীয় ফটো জার্নালিজমের আদল। তখনকার সময়ে পত্রিকাতে হাফ বডি পোর্ট্রেইট বা নেতাদের হাত মেলানোর ছবিই দেখা যেতে অহরহ। কিশোর পারেখ সেই গৎবাঁধা নিয়ম থেকে বেরিয়ে আসতে থাকেন। তিনি তার সাবজেক্টকে খুব গভীর থেকে নিরীক্ষা করেন। শুধুমাত্র মূর্ত বিষয়কে সামনে না এনে তার পেছনের গল্পগুলোকে তুলে আনতে থাকেন। কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জনমনের অবস্থা তুলে ধরেন তার ছবিগুলোতে। ভারতীয় ফটো জার্নালিজমে এক নীরব বিপ্লবের কান্ডারী হয়ে রইলেন কিশোর পারেখ।
দ্য হিন্দুন্থান টাইমসের হয়ে বাষট্টি সালের চীন-ভারত যুদ্ধ, পঁয়ষট্টি সালের পাক-ভারত যুদ্ধ কভার করেন। এ যুদ্ধে দুই পক্ষের মাঝে সমাপনী বৈঠকটি বসে উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে, সে বৈঠক কভার করার জন্য তিনি তৎকালীন ম্যাগাজিন, সোভিয়েত ল্যান্ডের গোল্ড মেডেল অর্জন করেন। ষেষট্টি-সাতষট্টি সাল পারেখের জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তিনি তখন বিহারের দূর্ভিক্ষ কভার করেন এবং তার সেই ছবিগুলো প্রদর্শিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এছাড়াও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছেন নেহেরুর মৃত্যুর আগপর্যন্ত।
হিন্দুস্থান টাইমসে ছয় বছর কাজ করার পর সাতষট্টি সালে তিনি যোগ দেন এশিয়া ম্যাগাজিন-এ। তার নতুন অফিস হয় হংকং। তখন সমগ্র এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল তিনি ভ্রমণ করেছেন। এরপর তিনি প্যাসিফিক ম্যাগাজিন লিমিটেডের প্রধান ফটো সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন বাহাত্তর সাল অব্দি। তারপর তিনি ফিরে আসেন মুম্বাই। এছাড়াও পারেখ নামজাদা ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রকাশনায় নিজের জায়গা তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন। তন্মধ্যে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, প্যারিস ম্যাচ, সানডে টাইমস, টাইম ম্যাগাজিন, স্টার্ন, পপুলার ফটোগ্রাফি এবং আসাহি গ্রাফিক উল্লেখযোগ্য।
আজ কিশোর পারেখের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে আমাদের আলাপ। পারেখ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের বাংলাদেশের ছবি তুলতে এসেছিলেন শুধুমাত্রই যুদ্ধটিকে ইতিহাসের অংশ করে রাখতে। হংকংয়ে অবস্থান করছিলেন তখন। এক বন্ধুর সহায়তায় ভারত হয়ে বাংলাদেশের প্রবেশ করেন তিনি। প্রবেশ করেছিলেন ৮ই ডিসেম্বর, শেষ যুদ্ধের দামামা বাজছে চারদিকে। তুমুল যুদ্ধের সেই মুহূর্ত থেকে বিজয়ের মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন এ দেশে।
একজন বেসামরিক লোক হয়ে ছবি তোলা তার জন্য বেশ বিপজ্জনক ছিল। তাই কোনো একভাবে জোগাড় করে নিলেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পোষাক। তারপর আটদিন সারেজমিনে ভ্রমণ করে তুলে আনলেন মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য সাতষট্টিটি ছবি। সেই ছবিগুলো প্রকাশ করেন ’বাংলাদেশ: আ ব্রুটাল বার্থ’ বইয়ে, ১৯৭২ সালে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে জনমত গঠনের জন্য ভারত সরকারের সহায়তায় ২০ হাজার কপি ছাপা হয় বইটি। বাংলাদেশ ফটোবুক আর্কাইভের সৌজন্যে বইটির ভিডিও সংস্করণ দেখা যাবে এখানে।
“কিশোর পারেখের জন্য বাংলাদেশের যুদ্ধাবস্থা কভার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কোনো অ্যাসাইনমেন্ট নেই, নিজের পয়সা খরচ করে শুধুমাত্র নিজের আবেগ, প্রেরণা আর সাহসকে পুঁজি করে তিনি বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। দুই সপ্তাহে তিনি তুলে এনেছিলেন চমৎকার সব ছবি যেগুলো দিয়ে তৈরী করে করেছিলেন তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেই বইটি, যেখানের হৃদয়গ্রাহী ছবিগুলোর সাথে তিনি জুড়ে দিয়েছিলেন খুবই শক্তিশালী কিছু শব্দ।” পারেখের স্বদেশী আরেক বিখ্যাত আলোকচিত্রী পাবলো বার্থেলমেও এভাবেই মূল্যায়ন করেন পারেখের কাজ।
পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পোষাকে একবার ধরা পড়েন ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে। পরে অবশ্য তিনি বোঝাতে সক্ষম হন, আদতে তিনি একজন ভারতীয় এবং আলোকচিত্রী- শুধুমাত্র নিরাপত্তার জন্যই এই পোষাক। ভারতীয় সেনাবাহিনী কথা যখন আসলোই, এখন আমরা দেখে নেব বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত একটি ছবি। এ ছবিটি কিশোর পরেখেরই তোলা।
ছবিটির ক্যাপশনে কিশোর পারেখ তার বইতে লিখেছেন – Indian troops grimly round up villagers suspected to be Pakistani spies. Ther peer into lungis in search of weapons. অর্থাৎ, মিত্রবাহিনীর সেনারা পাকিস্তানী চর সন্দেহে তাদের শরীরে তল্লাশী চালাচ্ছে এবং দেখে নিচ্ছে তারা লুঙ্গির ভেতর কোনো অস্ত্র বহন করছে কিনা।
আমাদের প্রচলিত ইতিহাসের বয়ানে এটি সাংঘর্ষিক। সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকার গণহত্যা সংখ্যায় অধ্যাপক গোলাম জিলানী নজরে মোরশেদ ছবির সৈনিককে পাকিস্তানী বলে আখ্যা দেন। তারপর বহু বছর ধরে তেমনটিই প্রচারিত হয়েছে। আমাদের সে ভুল ভাঙান যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক, নয়নিকা মুখার্জী। ২০১২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন এবং প্রমাণ করেন, ছবির সেনা সদস্য আদতে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর। কিশোর পারেখের ছেলে স্বপন পারেখও নিশ্চিত করেছেন বিষয়টি।
২০০০ সালে দৃক গ্যালারীতে আয়োজন করা হয় এক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘১৯৭১: দি ওয়ার উই ফরগট’ শিরোনামে। সেখানে দেশি-বিদেশি অনেক ফটোগ্রাফারের সাথে স্থান পায় কিশোর পারেখের কিছু ছবি। সে-ই হয়তো কিশোর পারেখকে দেওয়া আমাদের সর্বোচ্চ সম্মান। অথচ প্রতিবছরই নানান সময়ে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক আলাপে আমাদের প্রিন্ট, টেলিভিশন কিংবা ইন্টারনেট মিডিয়া অহরহ ব্যবহার করে চলেছে তার ছবি। কিন্তু মহান এই আলোকচিত্রীকে কৃতজ্ঞতার প্রদর্শনের ন্যূনতম সৌজন্যতার প্রকাশ করে না কেউ। আমরা হয়তো তাকে রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মাননা জানাতে পারতাম। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জীবদ্দশায় কিংবা মরণোত্তর কোনো সম্মাননা পাননি এই ক্যামেরাযোদ্ধা।
ছবিপাগল এই মানুষটির বিদায়ও হয়েছে ছবি তুলতে তুলতেই। ১৯৮২ সালে হিমালয় পর্বতে ছবি তুলতে গিয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন মহান এই আলোকচিত্রী।
Featured Image: Kishor Parekh