বিগত ৫ বছর ধরে লড়াই করছি ব্লাড ক্যান্সারের সাথে। ব্লাড ক্যান্সারের সাথেই জীবনটা বেশি উপভোগ করছি ও বেশ আনন্দে কাটাচ্ছি। তাই কিছুদিন বেশি আনন্দ করে যাবার লোভে ও পৃথিবীর না দেখা অনেক কিছু দেখে যাবার লোভে উন্নত চিকিৎসার জন্য ক’দিন পর পরই স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ভারত গমন করতে হয়। আর সেই সুবাদে পরিচিত হয়েছি এই বিশাল দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির সাথে। পরিচিত হতে হয়েছে এ দেশের অনেক বিস্ময়কর অজানার সাথে! এসব হাজারো অজানার মধ্যে যা আমাকে সবচেয়ে বিস্মিত করেছে তা হলো পশ্চিমবঙ্গের তথা কলকাতার ‘জয় বাংলা’ রোগ। হ্যাঁ, জয় বাংলা-ই এর নাম।
এই পৃথিবীতে জয় বাংলা নামে যে কোনো রোগ থাকতে পারে তা আমার জানা ছিলো না। এপাড় বাংলায় যে ‘জয় বাংলা’ এক আবেগের স্লোগান, ওপাড় বাংলায় তা একটি রোগের নাম? অবশ্য তাই বলে এটা ভাববার কোনো সুযোগ নেই যে এর মাধ্যমে ওপাড় বাংলায় ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের অবমাননা করা হচ্ছে। বরং এর পিছনের ইতিহাস ঘাটলে মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাস উঠে আসবে ও যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তদানীন্তন ভারত সরকারের এদেশের শরণার্থীদের আশ্রয়ের এক অজানা গল্প ফুটে উঠে।
বিস্ময়কর এই তথ্যের সাথে পরিচয় ২০১৪ সালে কলকাতার এক হাসপাতালে। ভারতে অবস্থানকালীন অধিকাংশ সময়ই হাসপাতালেই কাটাতে হয়। সেখানে একটা সময় হঠাৎ করেই আশেপাশে অনেকের মুখে ’জয় বাংলা’ নাম শুনতে পেলাম। কিন্তু নামটার সাথে অনেকের মুখে কেমন যেন এক আতঙ্কও বিরাজ করছিলো। বিষয়টি পরিস্কার হতে বেশি দেরি হলো না। চোখ ওঠা অর্থাৎ কনজাংটিভাইটিসকেই কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা ‘জয় বাংলা’ রোগ বলে থাকে। প্রথমে বিষয়টা বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি। কিন্তু ঘটনা যে সত্য তা পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে যায় যখন দেখি, আনন্দ বাজার পত্রিকায় স্বাস্থ্য ও লাইফস্টাইল পাতায় ও পূজোর সময় ‘জয় বাংলা’ রোগের প্রকোপ সম্পর্কে সচেতনতামূলক কলাম ছাপিয়েছে।
কী অদ্ভুত! চোখ ওঠা রোগের নাম জয় বাংলা হয় কিভাবে? সেই উত্তর খুঁজতে গিয়েই পরিচিত হই এক অজানা ইতিহাসের সাথে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশে কনজাংটিভাইটিস বা চোখ ওঠা রোগ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগে মুক্তিযোদ্ধারা ভুগেছেন, ভুগেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। পাকবাহিনীর ভোগান্তিটা একটু বেশি ছিল, কারণ তারা এই রোগের সাথে পরিচিত ছিল না। অনাকাঙ্খিত এই মহামারি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ট্যাকটিক্যালি গেরিলা যোদ্ধাদের কিছুটা সুবিধা এনে দিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা চোখ ওঠা রোগকে মজা করে বলতেন ‘জয় বাংলা রোগ’। এমনকি সীমান্তের ওপারে যেসব অস্থায়ী হাসপাতালে আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেয়া হত, সেখানকার ডাক্তাররাও কনজাংটিভাইটিসকে বলতেন ’জয় বাংলা রোগ’।
১৯৭১ সালে মহামারী আকারে এই রোগ পশ্চিম বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিলো। রোগটি পূর্ব বাংলায় চলা মুক্তিযুদ্ধের কারণে সীমান্ত পেরিয়ে চলে আসা বাঙালি শরণার্থীদের কারণেই ছড়িয়েছিলো বলে এর নাম দেয়া হয় ‘জয় বাংলা’ রোগ!
আহমদ ছফা ‘অলাতচক্র’ উপন্যাসে লিখেছেন,
“কলকাতা শহরের লোকদের মুখে ইদানিং (১৯৭১) ‘জয় বাংলা’ শব্দটি শুনলে আমার অস্তিত্বটা যেন কুঁকড়ে আসতে চায়। শেয়ালদার মোড়ে মোড়ে সবচে সস্তা, সবচে ঠুনকো স্পঞ্জের স্যান্ডেলের নাম ‘জয় বাংলা’ স্যান্ডেল।… যে চোখ-ওঠা রোগটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, কলকাতার মানুষ মমতাবশত তারও নামকরণ করেছিল ‘জয় বাংলা’।”
অবশ্য একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীকে নাকি ‘জয় বাংলা’ নামে নামকরণের একটি ফ্যাশন শুরু হয়েছিল। আহমদ ছফা তার অলাতচক্র উপন্যাসে লিখেছেন,
“শেয়ালদার মোড়ে মোড়ে সবচে সস্তা, সবচে ঠুনকো স্পঞ্জের স্যান্ডেলের নাম জয়বাংলা স্যান্ডেল। এক হপ্তার মধ্যে যে গেঞ্জি শরীরের মায়া ত্যাগ করে তার নাম জয়বাংলা গেঞ্জি। জয়বাংলা সাবান, জয়বাংলা ছাতা কতকিছু জিনিস বাজারে বাজারে ছেড়েছে কলকাতার ব্যবসায়ীরা। দামে সস্তা, টেকার বেলায়ও তেমন। বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের ট্যাঁকের দিকে নজর রেখে এ সকল পণ্য বাজারে ছাড়া হয়েছে।”
১৯৭১ সালে এই ‘চোখ ওঠা’ রোগ মহামারী আকার ধারণ করেছিলো। তাই ’জয় বাংলা’ একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ লোকজনের কাছে আবেগের পাশাপাশি হয়ে উঠলো এক আতঙ্কের নাম। মূলত এটি ছিল চোখের কনজাংটিভার প্রদাহ বা চোখ-ওঠা। এই এএইচসি ‘চোখ ওঠা’ বা কনজাঙ্কটিভাইটিস-এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর ভ্যারাইটি। একদিকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরা ‘জয় বাংলা’র সহায়তায় নিজেদের সব কিছু নিয়ে এগিয়ে এসেছিল, অন্যদিকে ‘জয় বাংলা’র মতো চোখের অসুখে বিপর্যস্ত হয়েছিল দৈনন্দিন জীবন। ‘জয় বাংলা’র প্রকোপ ছিলো এতটাই, যে সেসময় ৫০ লাখেরও বেশি লোক এই রোগে ভুগেছেন। তখনকার পত্রিকাগুলোর সংবাদ ঘাঁটলে এই সংখ্যা আরও বেশি বলেই জানা যায়।
এই রোগ কল্যাণী, চাপড়ার বড় আন্দুলিয়া, বেতাই, করিমপুর, শিকারপুর শরণার্থী শিবিরে ছড়িয়ে পড়ে। একসময় এটি আক্রমণ করে কলকাতা শহরের শিবিরগুলোর শরণার্থীদেরও।
আক্রান্তদের মধ্যে শরণার্থীরা যেমন ছিলেন, তেমনি সংক্রামক এই রোগের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন স্থানীয় অধিবাসীরাও। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারি হিসাবমতে প্রায় ৫ লাখ লোক অ্যাকিউট হেমোরেগেজিং কনজাঙ্কটিভাইটিস এর চিকিৎসাসেবা নেন। কলকাতা শহরের শতকরা ৬৫ জন লোক এই রোগে আক্রান্ত হন বলে জানিয়েছিলেন জর্জ চাইল্ডস কোন তার ‘Encyclopedia of plague and pestilence: From Ancient Times to the Present’ গ্রন্থে। তার এই গ্রন্থে একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চাশ লক্ষ লোক চোখ-ওঠায় আক্রান্ত হন বলে উল্লেখ করেন।
একাত্তরে জয় বাংলায় তথা চোখ ওঠায় পশ্চিমবঙ্গ কতটা বিপর্যস্ত হয়েছিল ৪ জুন ১৯৭১ এর দৈনিক যুগান্তরের একটি শিরোনামে তা স্পষ্ট। ‘চোখের রোগে ট্রেন বন্ধের আশঙ্কা’ শিরোনামের রিপোর্টে বলা হচ্ছে,
“চোখ-ওঠায় রেলওয়ের বিপুলসংখ্যক কর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। পূর্ব রেলের শিয়ালদহ ডিভিশনের ৪৯ জন গার্ড এই রোগে আক্রান্ত হয়ে ছুটি নিয়েছেন। বহুসংখ্যক বুকিং ক্লার্ক চোখের রোগে আক্রান্ত। সাধারণ ছুটিতে থাকা ২৭ কর্মীর ছুটি বাতিল করেও ট্রেন-চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়েছে।“
চোখ-ওঠায় বাতিল হয়ে গেছে ফুটবল ম্যাচ। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি স্কুল। এই রোগ নিয়ে মশকরা করতেও ছাড়েনি তখনকার দৈনিক সংবাদ পত্রিকাগুলো। পাত্রী দেখতে গিয়ে পাত্রের চোখে চশমা। গোড়াতেই পাত্রীর প্রশ্ন. ‘চোখ উঠেছে’? চোখ-ওঠা নিয়ে যুগান্তর এ কাটুনিস্ট এঁকেছেন এমনই অনবদ্য এক কার্টুন।
যুগান্তর এর রবিবারের সাময়িকী রম্য করে লিখেছেন,
‘জ্বালা দিতে ঠাঁই নাই জ্বালা দেয় সতীনের ভাই, কলকাতার লোকের হয়েছে সেই দশা। একেই তো জ্বালা-যন্ত্রণার সীমা নেই, তার ওপরে কোথা থেকে এক চোখের রোগ এসে চেপে বসল। ‘জয় বাংলা জয় বাংলা’ ডাক ছাড়তে ছাড়তে সারা শহর যেন কটা দিনের জন্যে… ধুলি পড়ে একেবারে কলুর বলদ হয়ে গেল!’
তখনকার দৈনিক সংবাদ পত্রগুলোতে একদিকে যেমন চোখ ওঠা নিয়ে নানা আশংকা ও সমস্যার খবর প্রকাশ হতো, তেমনি পত্রিকার পাতায় পাতায় প্রকাশ হতো চোখের রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার বিজ্ঞাপন, হোমিওপ্যাথিকের বিজ্ঞাপন, সালফাসিটল কিংবা তরল সাবানের বিজ্ঞাপন। পত্রিকাগুলো ছাপাতে শুরু করল জয় বাংলা থেকে রেহাই পাওয়ার নানা কৌশল। বিনামূল্যে মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করে এই রোগের চিকিৎসা দেওয়া হত। ৬ জুন ১৯৭১ পশ্চিমবঙ্গের সিনিয়র চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. নীহার মুন্সি, ডা. অমল সেন, ডা. আই এস রায়, ডা. প্রকাশ ঘোষ, ডা. জলধর সরকার ও কলকাতা পৌরসভার স্ট্যান্ডিং হেলথ কমিটির চেয়ারম্যান ডা. বীরেন বসু জনসাধারণকে আতঙ্কিত না হয়ে জয় বাংলা রোগে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে বিবৃতি দেন।
চোখ-ওঠা পশ্চিমবঙ্গে এত বেশি প্রভাব ফেলেছিল একাত্তরে, স্থানীয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে এসেছিল জয় বাংলার প্রাদুর্ভাবের কথা। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চাশ লক্ষ লোকের জয় বাংলায় আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ ছাপে। বাংলাদেশের সংবাদ সংগ্রহে এসে পশ্চিমবঙ্গে বিদেশি গণমাধ্যমের কয়েকজন কর্মীও আক্রান্ত হয়েছেন চোখের এই প্রদাহে।
আজ এত বছর পর এসেও পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা “চোখ ওঠা” কে জয় বাংলা” বলে ডেকে থাকেন। ওপাড় বাংলার অনীক দত্তের জনপ্রিয় ‘আশ্চর্য প্রদীপ‘ মুভিতেও তাই দেখা যায় যে, চোখ ওঠাকে জয় বাংলা বলা হচ্ছে। সিনেমাটির ৮ মিনিট ৫০ সেকেন্ড সময়ে প্রধান চরিত্র অনীলাভ গুপ্ত তার বৌয়ের কালো গগলস পড়ার কারণ হিসেবে পাশের প্রশ্নকর্তাকে বলছেন, তার স্ত্রীর জয় বাংলা হয়েছে, এজন্য চশমা পরেছে। অনেকে অবশ্য এই চোখ ওঠাকে “জয় বাংলা” বলায় পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের বাংলাদেশি বা তাদের ভাষায় বাঙ্গালদের ছোট করে দেখবারই একটা উদাহরণ হিসেবে মনে করেন। অনেকের মতে, এখনও পশ্চিম বঙ্গের লোকেরা তাদের ভাষায় “বাঙ্গাল”দের প্রতি সেই অবজ্ঞা-অযত্নকে নিজদের ভেতর ধারণ করে। আর এটিই তার একটি উতকৃষ্ট উদাহরণ
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়সহ পশ্চিমবঙ্গের অনেক সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মে এই ‘জয় বাংলা’র উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রয়াত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদও তার লেখায় এই রোগের কথা উল্লেখ করেছেন। কলকাতার একজন কবি ও সাংবাদিক প্রদীপ কর বলেন,
‘এখনও আমাদের ওখানকার গ্রামগুলোতে এই রোগকে জয় বাংলাই বলে। আমার নিজস্ব ধারণা, বাংলাদেশের পতাকায় যে সবুজের ভেতরে লাল সূর্য দেখা যায়, সেরকমই এই রোগে চোখ টকটকে লাল হয়ে ওঠে বলেই হয়তো একে এখনও জয় বাংলা বলে।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার এত বছর পর ও ওপাড় বাংলায় এই ‘জয় বাংলা’র সাথে জড়িয়ে আছে শরণার্থী শিবিরগুলোর দুরবস্থা ও শরণার্থীদের করুণ ইতিহাস। আজও যখন কেউ ‘চোখ ওঠা’কে “জয় বাংলা” বলে ডেকে ওঠেন, তখন হয়ত ওপাড় বাংলার অনেক প্রবীণের চোখে ভেসে ওঠে কী করে তাদের সামনেই ভাষার ভিত্তিতে এক নতুন দেশের উদয় হয়। আর স্বাধীনতার প্রায় ৪৮ বছর পর সেই দেশ আজ অনেক চড়াই উতড়াই পেরিয়ে এগিয়ে গেছে কতটা দূর! সেই “জয় বাংলা” আজ পৌঁছে গিয়েছে মহাকাশ অব্দি!
ফিচার ইমেজ: atarehman.com