১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের উজবেক প্রজাতন্ত্রের (বর্তমান উজবেকিস্তান) রাজধানী তাসখন্দে মস্কোর মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার মাধ্যমে ১৯৬৫ সালের ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই যুদ্ধে কোনো পক্ষকে সমর্থন প্রদান থেকে বিরত ছিল এবং ‘সৎ মধ্যস্থতাকারী’র ভূমিকা পালন করে। এর মাত্র পাঁচ বছর পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত ভারতীয় সৈন্যরা সোভিয়েত ইউনিয়নের সক্রিয় সমর্থনে বাংলাদেশি সৈন্যদের সঙ্গে ঢাকায় প্রবেশ করে এবং প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যকে বন্দি করে। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে এমন কী ঘটেছিল যে মস্কো তার পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে ১৮০° ঘুরে গিয়েছিল?
১৯৭১ সালের যুদ্ধে মস্কোর ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করার পূর্বে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করে নেওয়া প্রয়োজন।
প্রথমত, সাধারণভাবে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বর্তমান রাশিয়াকে এক হিসেবে ধরে নেয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এটা সত্যি যে, রাশিয়া আইনগতভাবে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরী রাষ্ট্র। কিন্তু প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক শাসিত ১৫টি সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের একটি ইউনিয়ন, যাদের মধ্যে একটি ছিল রুশ সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (বর্তমান রাশিয়া)। এটি ছিল একটি একদলীয় রাষ্ট্র এবং এটির অর্থনীতি ছিল সমাজতান্ত্রিক। অন্যদিকে, বর্তমান রুশ ফেডারেশন একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং এটির অর্থনীতি পুঁজিবাদী; যদিও রাশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী, বিশেষত পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো (এবং রাশিয়ার পশ্চিমাপন্থী দলগুলো) রাশিয়াকে একটি একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করতেই ভালোবাসে।
দ্বিতীয়ত, কোনো রাষ্ট্রই যে নিজস্ব স্বার্থের বাইরে কিছু করে না, এই বিষয়টি অনুধাবন করা জরুরী। রাষ্ট্রের কোনো নৈতিক অবস্থান থাকে না বা থাকতে পারে না, কারণ প্রতিটি রাষ্ট্রের (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) নেতৃবৃন্দই চেষ্টা করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজ নিজ রাষ্ট্রের সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষা করার জন্য। এক্ষেত্রে তাদের কাছে নীতি–নৈতিকতার বিচার করার সুযোগ খুব কমই থাকে। যেকোনো স্বাভাবিক রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য থাকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, অখণ্ডতা, স্বাধীনতা এবং ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা।
এবং তৃতীয়ত, ১৯৭১ সালের যুদ্ধে মস্কোর ভূমিকাকে বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন লেখক ও বিশেষজ্ঞ নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। এজন্য এসময় মস্কো যে ভূমিকা রেখেছিল, তার বহুসংখ্যক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় আর্কাইভ ঐতিহাসিকদের জন্য পরিপূর্ণভাবে উন্মুক্ত করে না দেয়া হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত এই যুদ্ধের সময় মস্কোর গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর সঙ্গে জড়িত প্রক্রিয়া ও কারণ সম্পর্কে নির্ভুল তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। এজন্য, এই বিষয়ে আলোচনার সময় এ পর্যন্ত জানা তথ্যের ভিত্তিতেই আলোচনা করতে হবে।
মস্কো সম্পর্কে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে মস্কো বিভিন্ন কারণে বহু রাষ্ট্রের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের কাছ থেকে গ্রিস, সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো, রুমানিয়া ও বুলগেরিয়ার স্বাধীনতা লাভ, চীনের কাছ থেকে মঙ্গোলিয়ার স্বাধীনতা লাভ, ফ্রান্সের কাছ থেকে সিরিয়া, ভিয়েতনাম ও আলজেরিয়ার স্বাধীনতা লাভ, কিংবা পর্তুগালের কাছ থেকে অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক ও গিনি–বিসাউয়ের স্বাধীনতা লাভ– প্রতিটি ক্ষেত্রেই মস্কো/সেন্ট পিটার্সবার্গ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তাই বিভিন্ন জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন প্রদানের ঐতিহ্য মস্কোর জন্য অনেক পুরনো। (অবশ্যই এসবের পেছনে মস্কোর স্বার্থ নিহিত ছিল!)
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মস্কোর ভূমিকা সম্পর্কে জানার পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশে, বিশেষত পাকিস্তানে, ১৯৭১–পূর্ব সোভিয়েত ভূমিকা সম্পর্কে জেনে নেয়াটা জরুরি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটেন তাদের সাম্রাজ্যের ‘মুকুটের মণি’ (jewel in the crown) ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা প্রদান করে, কিন্তু ভারতবর্ষ ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন সবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হওয়া বিপুল ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছিল এবং ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার মতো সময়, সুযোগ বা সামর্থ্য কোনোটাই মস্কোর ছিল না।
তদুপরি মস্কো তখন ভারত ও পাকিস্তানকে প্রকৃত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করতো না, কারণ তখনো রাষ্ট্র দুইটির সরকার ও সশস্ত্রবাহিনীর শীর্ষ পদগুলোতে ব্রিটিশ কর্মকর্তারাই অধিষ্ঠিত ছিল। ভারত ও পাকিস্তান ব্রিটিশ কমনওয়েলথের সদস্যপদ গ্রহণ করায় মস্কোর এই চিন্তাধারা আরো দৃঢ় হয়। বস্তুত, তখনো মস্কো বিশ্বকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ ও ‘পুঁজিবাদী’ এই বাইনারি দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করত এবং যে কোনো কিছুকে কমিউনিজমের মাপকাঠি দিয়ে বিচার করত।
১৯৪০–এর দশকের শেষ দিকে সোভিয়েত বিশেষজ্ঞরা দুইটি পরস্পরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রে ভারতবর্ষের বিভক্তিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতেন। তাদের মতে, ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ভারতে ধর্মীয় দাঙ্গা–হাঙ্গামার সৃষ্টি করেছিল এবং ভারতকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছিল। তারা মন্তব্য করেছিলেন, ভারতকে দুই ভাগে বিভক্ত করলে উপমহাদেশের ধর্মীয় সমস্যার সমাধান হবে না। (বাস্তবেও ভারতকে দুইভাগে বিভক্ত করার প্রায় ৭৩ বছর পরেও উপমহাদেশে ধর্মীয় সমস্যার কোনো কার্যকরী সমাধান হয়নি, বরং ভারতীয়–পাকিস্তানি দ্বন্দ্ব এতদঞ্চলের চিরস্থায়ী বৈশিষ্ট্যে রূপ নিয়েছে।)
সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী জোসেফ স্তালিন শুধু ধর্মের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র (পাকিস্তান) সৃষ্টির ধারণাটিকেই ‘আদিম’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। বিদেশি সাংবাদিকদের দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এটাও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, একে অপরের থেকে প্রায় ১,০০০ মাইল দূরে অবস্থিত পাকিস্তানের দুইটি অংশ কখনোই একত্রিত থাকতে পারবে না এবং ‘আগে হোক বা পরে হোক’ পূর্ববঙ্গ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে যাবে। বস্তুত, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান ছিল সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিকভাবে বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের বর্ধিতাংশ, আর পূর্ব পাকিস্তান ছিল সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিকভাবে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বর্ধিতাংশ। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যেকার সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, নৃতাত্ত্বিক, এমনকি ধর্মীয় অসামঞ্জস্য তখন বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি এড়ায়নি।
পাকিস্তানের মুসলিম লীগ নেতারাও কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নকে সন্দেহের চোখে দেখতেন এবং এর কারণ ছিল তাদের পশ্চিমাপন্থী মনোভাব ও ব্রিটিশ শাসনামলে সৃষ্ট রুশভীতি ও সোভিয়েতভীতি। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন স্পষ্টতই পশ্চিমাপন্থী। তবে পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস সত্ত্বেও ১৯৪৮ সালের ১ মে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। কিন্তু রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে আর্থ–সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল খুবই সীমিত।
১৯৫০–এর দশকের প্রথম দিকেও কিছু কিছু সোভিয়েত দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ পাকিস্তানকে একটি ‘কৃত্রিম রাষ্ট্র’ এবং ‘ভৌগোলিক অর্থহীনতা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু একই সঙ্গে কিছু সোভিয়েত বিশেষজ্ঞ পাকিস্তানের উৎপত্তির ঐতিহাসিক, আর্থ–সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণ অনুসন্ধান করতে শুরু করেন। তারা পাকিস্তানকে বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পশতুন, বালুচ ও অন্যান্য জাতির সমন্বয়ে গঠিত একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করতেন, কিন্তু পাকিস্তানি সরকার পাকিস্তানকে একটি এককেন্দ্রিক জাতিরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিল।
১৯৫০–এর দশকে পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ‘দক্ষিণ–পূর্ব এশীয় চুক্তি সংস্থা’ (South-East Asian Treaty Organization, SEATO) ও মার্কিন প্রভাবাধীন ‘কেন্দ্রীয় চুক্তি সংস্থা’য় (Central Treaty Organization, CENTO) যোগদান করে, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পৃথক সামরিক চুক্তিতেও স্বাক্ষর করে। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তান চলমান স্নায়ুযুদ্ধে দৃঢ়ভাবে মার্কিন–নেতৃত্বাধীন শিবিরের যোগ দেয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সবচেয়ে মিত্রভাবাপন্ন মিত্র’ (most allied ally) হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপরে নজরদারি করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের উত্তর–পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের (বর্তমান খাইবার পাখতুনখোয়া) বাদাবেরে একটি গোয়েন্দা ঘাঁটিও নির্মাণ করেছিল। এই ঘাঁটি থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপরে ‘ইউ–২’ গোয়েন্দা বিমান ওড়ানোর সময় ১৯৬০ সালে মার্কিন বৈমানিক গ্যারি পাওয়ার্স ভূপাতিত ও বন্দি হয়েছিলেন এবং এরপর সোভিয়েত নেতা ক্রুশ্চেভ পাকিস্তানের পেশোয়ারকে ‘লাল কালি’তে চিহ্নিত করে রাখার হুমকি দিয়েছিলেন। এসবের ফলে স্বাভাবিকভাবেই সোভিয়েত–পাকিস্তানি সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ে এবং মস্কো ভারতের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে, যদিও ভারত ছিল একটি জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র।
এ সময় পাকিস্তানের অধিকতর জনবহুল ও রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল পূর্বাংশের, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে সোভিয়েত ইউনিয়ন অবগত ছিল, কিন্তু তাদের মূল আগ্রহ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানকে ঘিরে। সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তান অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং সোভিয়েতদের কূটনৈতিক উপস্থিতি পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত ছিল। এ সময় ঢাকায় সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি কনস্যুলেট এবং একটি বাণিজ্যিক প্রতিনিধি দপ্তর ছিল, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো কোনো স্বতন্ত্র তথ্য কেন্দ্র ছিল না।
১৯৬০–এর দশকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণে পরিবর্তন ঘটে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের নেতৃত্ব নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় এবং এই বিরোধ ক্রমশ স্নায়ুযুদ্ধে রূপ নেয়। তৃতীয় বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের জন্য মস্কো ও পিকিংয়ের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়। মস্কো–পিকিং দ্বন্দ্বের প্রভাব পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও পড়ে। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট দলগুলো এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিও (ন্যাপ) মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থী এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
এ সময় দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল লক্ষ্য হয়ে উঠে চীনের প্রভাব বিস্তার রোধ করা। এই উদ্দেশ্যে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গে সু-সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য মস্কো উদগ্রীব হয়ে ওঠে, যদিও এর ফলে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের একাংশ মস্কোর ওপরে ক্ষুব্ধ হয়। অন্যদিকে, ১৯৬২ সালের চীন–ভারত যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের পর পাকিস্তান ১৯৬৩ সালে চীনের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং চীনের কাছে ট্রান্স–কারাকোরাম ট্র্যাক্ট অঞ্চলটি হস্তান্তর করে চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন কোনো পক্ষকে সমর্থন না করে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে এবং উভয় পক্ষকে দ্রুত যুদ্ধ বন্ধ করার আহবান জানায়। উভয় পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্যও মস্কো প্রস্তাব করে। ভারত ও পাকিস্তান মস্কোর প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিনের মধ্যস্থতায় ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দ শহরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়। এর পরদিন অর্থাৎ ১১ জানুয়ারি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী তাসখন্দে ‘হার্ট অ্যাটাকে’ মৃত্যুবরণ করেন, যদিও তাঁর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের নিরপেক্ষ ভূমিকার জন্য পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান মস্কোকে পূর্বের তুলনায় ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে থাকেন। তাসখন্দ–পরবর্তী সময়ে আইয়ুব পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতে ‘দ্বিপাক্ষিকতাবাদ’ (bilateralism) প্রবর্তন করেন। এর লক্ষ্য ছিল – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন, কারো বিরুদ্ধে না গিয়ে সকলের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলা।
এর অংশ হিসেবে পাকিস্তান সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। ১৯৬৮ সালের এপ্রিলে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন পাকিস্তান সফর করেন এবং এটিই ছিল কোনো সোভিয়েত সরকারপ্রধানের প্রথম পাকিস্তান সফর। এই সফরের পরপরই পাকিস্তান ১৯৬৮ সালের ১ জুলাইয়ের পর থেকে বাদাবেরে অবস্থিত মার্কিন গোয়েন্দা ঘাঁটির ইজারার মেয়াদ বৃদ্ধি করতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯৬৮ সালের ৯ জুলাই সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে শুরু করে। এর ফলে মস্কোর আরেক মিত্র ভারতের ক্ষুব্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও পাকিস্তান যাতে পুরোপুরি চীনের কব্জায় না চলে যায় সেজন্য মস্কো এই পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
১৯৬৯ সালের মার্চে চীনা–সোভিয়েত সীমান্তবর্তী উসুরি নদীতে অবস্থিত দামানস্কি (বর্তমান ঝেনবাও) দ্বীপে চীনা ও সোভিয়েত সৈন্যদের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হয় এবং বিস্তৃত চীনা–সোভিয়েত সীমান্ত জুড়ে এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র সীমান্ত যুদ্ধে ৬০ জন সোভিয়েত এবং প্রায় ২০০ থেকে ৮০০ জন চীনা সৈন্য নিহত হয়। এই ঘটনার ফলে চীনা–সোভিয়েত সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে এবং পারমাণবিক অস্ত্রধারী চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বৃহদাকার একটি যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। ১৯৭০–এর দশক জুড়ে মস্কো রুশ দূরপ্রাচ্য, সাইবেরিয়া বা মধ্য এশিয়ায় চীনা আক্রমণের আশঙ্কায় শঙ্কিত ছিল। অন্যদিকে, পিকিং–ও এ সময় মাঞ্চুরিয়া, অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়া বা জিনজিয়াং–এ সোভিয়েত আক্রমণের ভয়ে ভীত ছিল।
এমতাবস্থায় মস্কো ১৯৬৯ সাল থেকে এশিয়ায় একটি চীনবিরোধী জোট গঠনের জন্য প্রচেষ্টা শুরু করে। এই প্রকল্পকে মস্কো ‘এশীয় যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা’ নামকরণ করে। এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রকে মস্কো এই জোটে অন্তর্ভুক্ত করার জোর প্রচেষ্টা চালায়। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পাকিস্তানও ছিল। এই জোট গঠনের উদ্দেশ্য ছিল চীনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা। ১৯৫০–এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নকে শত্রু রাষ্ট্র দিয়ে ঘিরে ফেলতে চেয়েছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের চীনকে ঘিরে ফেলার কৌশলটিও ছিল অনুরূপ।
১৯৬৯ সালের মার্চে পাকিস্তানের উভয় অংশে প্রবল গণআন্দোলনের ফলে রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের পতন ঘটে এবং পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার স্থলাভিষিক্ত হন। আইয়ুবের পতনের ফলে মস্কোয় আংশিক উদ্বেগের সৃষ্টি হয়, কারণ মস্কোর আশঙ্কা ছিল আইয়ুবের পতনের ফলে সৃষ্ট নৈরাজ্যের সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে পারে। সোভিয়েত পত্রিকা ‘ইজভেস্তিয়া’র একটি সম্পাদকীয়তে ইয়াহিয়া পাকিস্তানের সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারবেন কিনা সে সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানি সরকার মস্কোকে অবহিত করে যে, তারা আইয়ুবের পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করবে এবং পাকিস্তানে সরকার পরিবর্তনের ফলে সোভিয়েত–পাকিস্তানি সম্পর্কের ওপরে কোনো প্রভাব পড়বে না।
১৯৬৯ সালের মে মাসে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন পাকিস্তান সফর করেন। এ সময় তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন, পাকিস্তান, ইরান, আফগানিস্তান ও ভারতের মধ্যে বহুপাক্ষিক অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর এবং এই রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে একটি অর্থনৈতিক জোট গঠনের প্রস্তাব করেন। প্রকৃতপক্ষে, প্রস্তাবিত জোটটি ছিল সোভিয়েত–প্রস্তাবিত চীনবিরোধী জোট গঠনের প্রথম ধাপ। কিন্তু চীনের সঙ্গে এ সময় পাকিস্তানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক ছিল, অন্যদিকে কাশ্মির সমস্যার সমাধান ব্যতীত ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ পাকিস্তানের পক্ষে ছিল অসম্ভব। এজন্য পাকিস্তান প্রস্তাবিত জোটে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
আসলে শুধু পাকিস্তান নয়, ভারত ও আফগানিস্তান সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্ররাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও এই জোটে যোগ দিতে আগ্রহী ছিল না। কারণ চীনের বিরুদ্ধে গঠিত জোটে যোগ দিলে চীনের সঙ্গে তাদের সরাসরি সংঘাত হতে পারত এবং চীন এই রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরে পিকিংপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে ব্যবহার করে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করতে পারতো। মস্কো এটা বুঝতে পেরে চীনবিরোধী জোট গঠনের প্রচেষ্টার প্রচারের মাত্রা সীমিত করে, কিন্তু তাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখে।
১৯৭০ সালের জুনে পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন এবং মস্কোয় তাকে লাল গালিচা অভ্যর্থনা দেয়া হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সহায়তা প্রদান করতে এবং ২০ কোটি (বা ২০০ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার ব্যয়ে করাচিতে একটি ইস্পাত কারখানা নির্মাণ করে দিতে সম্মত হয়। এছাড়া সোভিয়েতরা কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, সম্প্রচার কেন্দ্র এবং বৈদ্যুতিক দ্রব্যাদি নির্মাণ কারখানা স্থাপন করে দিতে রাজি হয়। উল্লেখ্য, এগুলোর একটিও পূর্ব পাকিস্তানে নির্মিত হওয়ার কথা ছিল না। সোভিয়েত–পাকিস্তানি অর্থনৈতিক সম্পর্কের সিংহভাগই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগের এই বিজয় ছিল সম্পূর্ণভাবে পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত, কারণ পশ্চিম পাকিস্তানে তারা একটি আসনও লাভ করেনি। অনুরূপভাবে, পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বাধিক সংখ্যক আসন লাভকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টি পূর্ব পাকিস্তানে একটি আসনও পায়নি। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিভেদ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আওয়ামী লীগের বিজয় সম্পর্কে মস্কোর প্রতিক্রিয়া ছিল মোটের ওপর ইতিবাচক। যদিও আওয়ামী লীগ ছিল মূলত বাঙালি মধ্যবিত্ত ও ধনিক শ্রেণির দল এবং পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট দলগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল মোটের ওপর চলনসই, তবুও আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে মস্কোর দৃষ্টিতে সেটি লাভজনক হতো। ১৯৭০ সালের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল সুস্পষ্ট, আওয়ামী লীগের সামাজিক–রাজনৈতিক প্রকল্প ছিল মস্কোর চোখে ‘প্রগতিশীল’, ১৯৫০–এর দশক থেকেই আওয়ামী লীগ ছিল পাকিস্তানের মার্কিন–কর্তৃত্বাধীন সামরিক জোটে যোগদানের বিরোধী, এবং আওয়ামী লীগ ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিল।
আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ইতিবাচকভাবে দেখতেন, এবং তার রচিত বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’য় সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে যেসব মন্তব্য রয়েছে, সবই ইতিবাচক; যদিও সমাজব্যবস্থা হিসেবে কমিউনিজমের প্রতি তার আস্থা ছিল না বলে তিনি সরাসরি উল্লেখ করেছেন। মস্কো শেখ মুজিবকে বিবেচনা করতো ‘পাকিস্তানের নেহরু’ হিসেবে। মস্কোর ধারণা ছিল, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যেমন ভারতকে একটি জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন, শেখ মুজিবও তেমনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে পাকিস্তানকে তৎকালীন চরম মার্কিনপন্থী ও চীনপন্থী অবস্থান থেকে সরিয়ে একটি জোট নিরপেক্ষ অবস্থানে নিয়ে আসবেন।
বস্তুত, ১৯৭১ সালের প্রারম্ভে মস্কো প্রায় নিশ্চিত ছিল যে, আওয়ামী লীগের পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা লাভ করবে এবং পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে আসবে। পরবর্তী ঘটনাবলি থেকে প্রমাণিত হবে যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করার ক্ষেত্রে মস্কো কতটা ভুল করেছিল।