এদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ত্যাগ আর সংগ্রামের এক সুবিশাল মহাকাব্য। এই মহাকাব্যের পাতায় পাতায় রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষের প্রতিটি মানুষের নিজ নিজ স্থান থেকে দেশের জন্য করে যাওয়া নিজেদের মতো সংগ্রাম, নিজেদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ ত্যাগ ও চেষ্টা। কেবল তারুণ্য ছুঁয়েছে যে কিশোর, চিরদিন গৃহকোণে উনুনে ভাতের হাঁড়ি চাপিয়েছে যে বউ- এদেশের মুক্তির পথে জীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগটা করে গেছে সেও। স্বজাতির হত্যাযজ্ঞের মহালীলা দেখে বন্দুক হাতে তুলে নিয়েছিল কোনদিন যে যুবক প্রাণীহত্যা করেনি সেও, দুর্বল বৃদ্ধা উৎসর্গ করে গেছে তার একমাত্র অবলম্বন আর সারাজীবনের যক্ষের ধন পুত্রকে- নিজ নিজ স্থান, পেশা আর সামর্থ্য থেকে এই দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেই সময়ে নিজেদের দেশের সেবায় উৎসর্গ করে গেছেন লাখ লাখ মানুষ। একাত্তরে এদেশের আপামর জনসাধারণের নিজেদের প্রাণবিপন্ন করা আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া কি আদৌ কখনো এদেশের স্বাধীন হওয়া সম্ভব ছিল?
সেই আপামর স্বাধীনতাকামী জনগণের এক বিশাল অংশ ছিল আমাদের নারীরা। এদেশের আলো- হাওয়ায় বেড়ে ওঠা অতি সাধারণ পল্লীবালা থেকে শহরের কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে, এমনকি উপজাতি মেয়েরাও কখনো অস্ত্র হাতে, কখনো গুপ্তচর হয়ে, খাবার- রসদের যোগান দিয়ে, কখনো সেবা দিয়ে ৯টি মাস ধরে জিইয়ে রেখেছিল মুক্তির সেই যুদ্ধটিকে। আজ আমরা জানবো এমন এক নারীর কথা যার সেবা, যত্ন ও স্নেহে সেই প্রতিকূল সময়ে অসুস্থ আর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গড়ে উঠেছিল অসাধারণ এক সেবাকেন্দ্র- আগরতলার বাংলাদেশ হাসপাতাল, মুক্তিযুদ্ধের সময় এই হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা বীর প্রতীক সেতারা বেগমের সংগ্রামী আর স্নেহপূর্ণ জীবনের গল্প।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাওয়া সেতারা বেগমের জীবনের সেই সংগ্রামের দিনগুলো বলতে গেলে শুরুতেই সেই বিখ্যাত ‘বাংলাদেশ হাসপাতালের’ কথা কিছু যেন না বললেই নয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের নবম ও দশম খণ্ড থেকে জানা যায়, দুই নম্বর সেক্টর কামান্ডার খালেদ মোশাররফের পরিকল্পনা থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয় এই হাসপাতাল।
দুই নম্বর সেক্টরে আশ্রয় নেওয়া মেডিকেলে অধ্যায়নরত কিছু শিক্ষার্থী নিয়ে অল্প কিছু শয্যার ব্যবস্থা নিয়ে শুরুতে এই হাসপাতাল গড়ে উঠলেও পরবর্তীতে তা হয়ে ওঠে প্রায় ৪০০ শয্যা বিশিষ্ট এক হাসপাতাল। এই হাসপাতাল হয়ে ওঠে রণক্ষেত্রে আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এক আশ্রয়ের ঠিকানা। প্রথম দিকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা দেওয়া কঠিন হলেও জুলাই মাসের শেষে যখন ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম সিও হিসাবে এই হাসপাতালের দায়িত্ব নেন, তখন থেকে তার আন্তরিক পরিশ্রম, আত্মনিবেদন ও পরিকল্পনা এই হাসপাতালকে এক অনন্য সামরিক হাসপাতালের পর্যায়ে নিয়ে যায়।
মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা ধরে দিনের পর দিন এই হাসপাতালে ডাক্তার সিতারার কাজ ছিল অসাধ্য সাধন করে যাওয়া। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আসা গুলিবিদ্ধ, স্প্রিন্টারের আঘাতে ঝাঁঝরা, গুরুতর জখম মুক্তিযোদ্ধাদের সারিয়ে তুলতে হতো খুব সামান্য আর সাধারণ ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে। ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব কেমন ছিল তা বোঝা যায় হাসপাতালের কাঠামোগত বর্ণনা থেকেই।
রোগীর জন্য প্রতিটি বিছানা তৈরী হতো বাঁশের চারটি খুঁটির উপর মাচা বেঁধে। প্লাস্টিক দিয়ে ঘেরা অপারেশনের ঘরে কেবল দিনের বেলাতেই অপারেশন করা হতো। কখনো কখনো রাতে কোনো জরুরি অপারেশন করার দরকার হলে ব্যবহার করা হতো হারিকেন কিংবা টর্চলাইট। এমন কাঠামো আর ব্যবস্থা নিয়েও এই হাসপাতাল যুদ্ধের সময়কার সবচেয়ে সফলতম হাসপাতালগুলোর একটি হিসাবে গণ্য হয়।
জানা যায়, মাত্র একজন ছাড়া যুদ্ধের সময় কেউ এই হাসপাতালে মারা যায়নি। এই তথ্যই জানিয়ে দেয়, কতটা আন্তরিকতা আর দেশপ্রেম নিয়ে ক্যাপ্টেন সিতারাসহ ঐ হাসপাতালে কর্মরত প্রত্যেক চিকিৎসক আহত যোদ্ধাদের সেবা দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। সিতারা বেগমকে কেবল ওষুধ সংগ্রহ করার জন্য নিয়মিত আগরতলা যেতে হতো। তার রাতদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিপুণ পরিচালনার ফলে বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধরত ভারতীয় সেনাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ছিনিয়ে আনা সম্ভব হয়। এই সিতারা বেগম কিন্তু আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা বীর উত্তম এটি এম হায়দারের সহোদর।
এই সাহসী ও ত্যাগী নারীর জন্ম দেশ বিভাগের প্রাক্কালে ১৯৪৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, কিশোরগঞ্জ জেলায়। বাবা মোহাম্মদ ইসরাইল মিয়া ছিলেন পেশায় একজন উকিল। তার মায়ের নাম ছিল জাকিমুন্নেসা। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে সিতারা ছিলেন তৃতীয়। কিশোরগঞ্জ থেকেই এস.এস.সি পাশ করার পরে ঢাকার হলিক্রস কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাশ করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে দীক্ষা নেওয়ার পর তিনি পাকিস্তানের আর্মি মেডিকেলে লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন। ছোটবেলা থেকেই তার মেধা আর অধ্যাবস্যায়ের সাক্ষর পাওয়া গিয়েছিল। এই পরিবারেরই আরেক সন্তান ছিলেন তখনকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম এক দক্ষ সেনা কর্মকর্তা- মেজর এটিএম হায়দার। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দারও অত্যন্ত সাহসী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭০ সালের উত্তাল দিনগুলোতে সিতারা বেগম কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সেসময় মেজর হায়দারও সেখানে বদলি হয়ে এসে তিন নম্বর কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের দায়িত্ব নেন। একাত্তর সালের ফেব্রুয়ারিতে তারা যখন ঈদ পালন করতে বাড়ি আসেন, তখন থেকেই দেশের অবস্থা অস্থিতিশীল হতে থাকে, অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তাদের ফিরে যাওয়া।
এরপর ভাই হায়দারের পরামর্শে পরিবারের অন্যদের সাথে সিতারা ভারতে পাড়ি জমান। একাত্তরের জুলাই মাসে ‘বাংলাদেশ হাসপাতালের’ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, পাশে পান ফারুক, মোবিন, আখতারসহ আরো অনেক নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসকদের। সিতারার মেধা, দক্ষতা, পরিশ্রম আর সেবা অচিরেই এই সেবাকেন্দ্রকে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের তার এই অনন্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীরপ্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করে।
১৬ ডিসেম্বর যখন এই মাটিতে দেশের মানুষ নিজেদের স্বাধীন পতাকা ওড়ায়, তখন আগরতলার বাংলাদেশ হাসপাতালে বসে সিতারা বেগম রেডিওতে সেই খবর শোনেন। পরিবার নিয়ে ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে। কিন্তু স্বাধীন দেশে এর পরের জীবনটা কি তার ও পরিবারের জন্য সহজ ও সুখকর ছিল? না।
যে দেশের জন্য তিনি এত কিছু করেছেন, দুঃখে অভিমানে সেই দেশকে ছেড়ে এখন তিনি স্বামী-সন্তান নিয়ে তিনি এখন বাস করেন সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে। স্বাধীন দেশে পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে ঘাতকের হাতে তাকে হারাতে হয় দুই নম্বর সেক্টর কামান্ডার মেজর হায়দার বীরউত্তমকে। এই শোক আর অভিমান ভুলতে পারেননি তিনি আর কখনোই।
ফিচার ইমেজ: commons.wikimedia.org