Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ফাঁস হয়ে যাওয়া ‘সরেজমিন প্রতিবেদন’

১৯৭১ সালের জুন মাস, মুক্তিসংগ্রাম চলছে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার চিত্র বিশ্বের অনেক গণমাধ্যমের প্রথম পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। বিশ্বের কূটনৈতিক মহলে এই নিয়ে তোলপাড় সামাল দিতে হচ্ছে পাকিস্তান কূটনীতিকদের। তারা বরাবরের মতোই বলে যাচ্ছেন, পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক

আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যা ধর্ষণের খবর যাতে বাইরে প্রকাশিত হতে না পারে, সেজন্য বিদেশী রিপোর্টারদের বহিষ্কার করে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন প্রশাসন। ২৫শে মার্চ রাতেই ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে তাদের একপ্রকার বন্দী করে ফেলে পাকিস্তান প্রশাসন। দুদিন পরেই তাদের সকল নোট, টেপ, ছবি জব্দ করে যার যার দেশে ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত অবস্থা হয়। পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের বিশাল ব্যয়ভার বহন করতে অর্থনৈতিক দিক থেকেও পাকিস্তান বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হয়। আর তাই বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া পাকিস্তানের উপায় ছিলো না। তবে বিশ্বব্যাংক পাকিস্তানকে কোনোরকম অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করার আগে, পূর্ব পাকিস্তানে চলমান পরিস্থিতির ব্যাপারে সরেজমিনে পরিদর্শনের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে।

Source: worldbank.org

পাকিস্তান তখন অনেকটাই নিরুপায়। তাই বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদলকে পূর্ব পাকিস্তানে সরেজমিনে পরিদর্শনের অনুমতি দেয়। ১৯৭১ সালের জুন মাসে পূর্ব পাকিস্তান সরেজমিনে পরিদর্শন করে রিপোর্টও তৈরি করেছিল। সেই রিপোর্টে পূর্ব পাকিস্তানি শহর কুষ্টিয়াকে দেখে যেন জার্মান কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরের কথাই মনে পড়েছিলো সেই দলের। তাদের রিপোর্টের ভাষায়,

“East Pakistani town of Kushtia looked like a World War II German town having undergone strategic bombing attacks”

আওয়ামী লীগের সমর্থক, মুক্তিবাহিনী ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায় যে পাকিস্তান সেনাদের চক্ষুশুলে পরিণত হয়েছে এবং এ কারণেই যে তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার নির্যাতন চলছে, সেই ব্যাপারটিও উঠে আসে এ রিপোর্টে। প্রতিবেদনে উঠে আসা চাঞ্চল্যকর বিষয়গুলো নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের ভাবমূর্তিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পাকিস্তানের নানা ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা সেই রিপোর্টটিকে জনসম্মুখে আসার রাস্তা বন্ধ করে দিলেন।

তবে শেষ রক্ষা হলো না। বিশ্বব্যাংকের সেই সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন ফাঁস হয়ে গিয়েছিলো সংবাদমাধ্যমে। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ হেনরিক ভ্যান ডার হাইজেনের তৈরিকৃত প্রতিবেদনটি শেষপর্যন্ত ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ এর সাংবাদিকদের হাতে আসে। ১৯৭১ সালের ১৩ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় সেই প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য অংশ ছাপাও হয়।

ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় নিউ ইয়র্ক টাইমসে; Source: The New York Times

পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু হয়ে যাওয়ার পরে পাকিস্তানের মুখপাত্ররা বরাবরের মতো বিশ্বের কাছে প্রচার করে যাচ্ছিলো যে, পূর্ব পাকিস্তানের অফিস, আদালত কিংবা বাকি সব প্রশাসনিক কার্যকলাপ ঠিকঠাক চলছিলো। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শনে এসে দেখতে পেলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। সরকারি আদেশ অনুযায়ী সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ২১ এপ্রিল থেকে ১৫ জুনের মধ্যে তাদের নিজেদের কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ১৫ জুনের পরেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত কার্যত অচল দেখতে পান বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা। ফলে তারা তাদের রিপোর্টে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে পড়ার কথাই উল্লেখ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ দিনমজুর থেকে শুরু করে শ্রমিক, বিভিন্ন পেশার মানুষের এই কর্মবিরতি দীর্ঘদিন যাবত চলতে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়বে বলে অভিমত দেন এই বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা ছাড়াও বেশ কয়েকটি শহরে ঘুরে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বিশেষজ্ঞ দলটি; Source: The New York Times

পূর্ব পাকিস্তানের চলমান পরিস্থিতি প্রান্তিক মানুষের মধ্যে কী পরিমাণ প্রভাব ফেলেছে, তা জানতে ঢাকা ছাড়াও যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া এবং মংলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখে বিশেষজ্ঞ দলটি।

যশোর

আকাশ থেকে বোমাবর্ষণের স্পষ্ট চিহ্ন, অগ্নিসংযোগ আর জনশূন্য নীরব ঘরবাড়ি দেখে যশোরকে যেন বিরান জনপদ বলেই মনে হয়েছিলো এই অর্থনীতিবিদদের কাছে। এমনকি নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো যশোর এয়ারপোর্টে নেমে এর আশেপাশের অনেক ঘরবাড়িতে তখনো ধ্বংসের স্পষ্ট চিহ্ন দেখতে পায় দলটি। কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী যশোরের জনসংখ্যা আশি হাজার থেকে নেমে দাঁড়ায় ১৫-২০ হাজারে। যশোর এলাকা ভারতের সীমান্তবর্তী হওয়ায় বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে সীমান্তের দিকে ছুটছে।

শহরের বেশিরভাগ স্থাপনায় ধ্বংসের স্পষ্ট চিহ্ন; Source: Mohammad Shafi

শহরের বেশিরভাগ স্থাপনায় ধ্বংসের ছাপ স্পষ্ট। দোকান-পাট বন্ধ থাকায় ব্যবসা বাণিজ্যের স্থবির অবস্থার কথাও গুরুত্বের সাথে উঠে আসে তাদের রিপোর্টে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের বলা হয়, বিদ্রোহীদের দমনের জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এতে করে যে সাধারণ নিরস্ত্র মানুষ বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সে ব্যাপারে সরকারের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই বলেও উল্লেখ করা হয় এই রিপোর্টে।

খুলনা

খুলনাতেও ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন স্পষ্ট। কলখারখানা সব স্থবির হয়ে আছে। জনসংখ্যা চার লাখ থেকে কমে দেড় লাখে দাঁড়িয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। স্কুল কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ খোলা থাকলেও উপস্থিতির হার অত্যন্ত কম। খুলনার যোগাযোগ ব্যবস্থার অবস্থা বেশ শোচনীয় বলেই উল্লেখ করা হয়। খুলনা এলাকায় জ্বালানি তেলের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে বলেও লিপিবদ্ধ করা হয়। টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু থাকলেও ডাকব্যবস্থা মোটামুটি অচল হয়ে পড়েছে। খুলনার বড় আর গুরুত্বপূর্ণ সব রাস্তায় সাধারণ গাড়ি চলাচল নেমে এসেছে প্রায় শূন্যের কোঠায়।

মংলা

ধ্বংসের চিহ্ন মংলাতেও স্পষ্ট। জনসংখ্যা ২২ হাজার থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র এক হাজারে। বিদ্যুতের খুঁটি থেকে টেলিফোনের লাইন সবকিছুতেই ধ্বংসের ছাপ বিদ্যমান। যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির হয়ে আছে এই এলাকায়।

কুষ্টিয়া

কুষ্টিয়া শহরকে দেখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত কোনো জার্মান নগরীর কথা মনে পড়েছিলো বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদদের সেই দলের। বোমার আঘাতে শহরের নব্বই শতাংশ স্থাপনা পরিণত হয়েছিলো ধ্বংস্তুপে। জনসংখ্যা চল্লিশ হাজার থেকে কমে দাঁড়িয়েছিলো পাঁচ হাজারে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির পুরোটাই ধসে পড়ায় পুরো এলাকা জুড়ে দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্য সংকট। স্থানীয় মানুষকে জিজ্ঞেস করেও তারা তাদের আশেপাশে কোনো খাদ্যদ্রব্যের দোকান খুঁজে পাননি। এই অবস্থাকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সাথেই তুলনা করেছে অর্থনীতিবিদদের সেই দলটি।

পাশাপাশি পাকিস্তানি বাহিনীর সামরিক অভিযানের সংবাদ পাওয়া মাত্রই ভারতে আশ্রয়ের জন্য ঘরবাড়ি রেখে পালানোর ব্যাপারটিও গুরুত্ব পেয়েছিলো এই রিপোর্টে। সেনাবাহিনীর অবস্থানের সংবাদে সাধারণ মানুষ মারাত্মকভাবে আতংকিত হয়ে পড়ে।

সীমান্ত জুড়ে শরণার্থীর ঢল; Source: kushtiatown.com

তাই তদন্ত প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদেরা দেখান যে, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের ফলে পুরো এলাকা কার্যত পরিণত হয়েছে বিরানভূমিতে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে। বন্দর, কলকারখানা কার্যত অকেজো। সরকারি অফিস আদালতে কর্মী নেই। স্কুল-কলেজ বন্ধ করে সেখানে ঘাঁটি গেড়েছে সেনাবাহিনী। পুরো প্রশাসন কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। এই অবস্থার সমাধান না করলে যে মানবিক বিপর্যয়ের আশংকা তারা করেছিলেন, তার সত্যতা শরণার্থী শিবিরগুলোতেই পাওয়া যায়।

আর এই সরেজমিন প্রতিবেদন সামনে রেখেই বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদদের সেই দল তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে তারা সুপারিশ করেন, পাকিস্তান যদি অবিলম্বে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধান না করে, তবে তাদেরকে অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়ার প্রক্রিয়া আপাতত বন্ধ রাখা হোক।

তথ্যসূত্র:

১৯৭১ সালের ১৩ জুলাই ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের কপি

ফিচার ইমেজ:  www.nytimes.com

Related Articles