Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মুক্তিযুদ্ধের গল্প: আমার বন্ধু রাশেদ

একটি চেতনার জন্মানোর গল্প হবে আজ। কেমন করে বুকের ভেতর কোনো কিছুর জন্য ভালোবাসা তীব্র হয়ে যায়, যার সামনে নিজের প্রাণ তুচ্ছ লাগতে থাকে, সেই চেতনার গল্প। কেমন করে অধিকারের লড়াই করতে হয়, সেই গল্প। বয়সের চেয়ে ঢের বিশাল মাপের এক বোধ কীভাবে মানুষকে বশ করে নিতে পারে, সেই গল্প। এই গল্পটা এক দেশের গল্প।

এই লাল-সবুজ অনেক সাধনার অর্জন; Source: wordpress.com

বাংলাদেশ, লাখো সন্তানের রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেয়া আমাদের দেশমাতৃকা। ১৯৭১ সালের বিভীষিকাময় যুদ্ধের শেষে জয় আসে যখন, পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, বাংলাদেশ। বাঙ্গালির আবেগ, কষ্ট, ক্ষোভ, ভালোবাসা সবকিছুই মিশে আছে ঐ একটি সময়ে। মুক্তিযুদ্ধ! দেশরক্ষার জীবন বাজি রাখা সেই সংগ্রাম। লাখো মানুষের নিজেদের রক্তমাংস বিলিয়ে দেয়ার সেইসব দিনরাত্রি। পৃথিবীতে এই যুদ্ধের ইতিহাস বড় বেশি গৌরবের, বড় সম্মানের। লড়াইয়ের ময়দানে নিজেদের সাহস, শক্তি, কষ্টসহিষ্ণু মনোভাব আর আত্মসম্মানবোধের পরীক্ষায় উতরে যাওয়া বীরের জাত আমরা। কারো দয়ার দানে পাইনি এই দেশ। কেউ এমনি এমনিই দিয়ে যায়নি আমাদের অধিকার। ছিনিয়ে আনা এই বিজয়, পরম সাধনায় আগলে রাখা এই পরিচয় আমাদের, আমরা বাঙ্গালি জাতি, আমরা স্বাধীন!

আমরা যারা অনেক পরে জন্মেছি, যুদ্ধের সময়ের আঁচ লাগেনি গায়ে, তারা কেমন করে জানলাম এসব কাহিনী? ইতিহাস আছে, নথিপত্র আছে, জানার ইচ্ছে থাকলেই জানা যায়। আর সেই সময়ের বোধটা? কেমন হত যদি একাত্তরের মানুষ হতাম? যুদ্ধে যেতাম কি? বুক কাঁপতো না, যদি মরে যাই! আচ্ছা, ওরা কীভাবে পেরেছিলো নিজেদের জীবন এভাবে বিলিয়ে দিতে? এমন ভাবনাগুলো মনের ভেতর গেঁথে দিতে দেশের সাহিত্যিকরা কলমের জোরে আজ অবধি গল্প সাজিয়ে চলেছেন। কত শত গল্প-উপন্যাস তৈরি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে। কত লেখা পড়ে চোখ আর্দ্র হয়েছে মানুষের, কান্না বাঁধ মানেনি আরো কত! আবেগটা যে এতটাই তীব্র, এত নিরেট।

বিশেষ করে কিশোর গল্পগুলো মনে ভারি দাগ কাটে। ছেলেমানুষদের জন্য গল্প, অথচ ছেলেমানুষি নয় মোটেও! এখানে কথা হবে তেমনই এক গল্প নিয়ে। আমার বন্ধু রাশেদ, আমাদের বন্ধু রাশেদের গল্প। গল্পকার মুহম্মদ জাফর ইকবালের সহজ লেখনীতে কিশোর রাশেদের গল্প কারো মনে দাগ কেটে যাবে না, এই কথা ভাবাও কঠিন।

গল্পটা কিশোর রাশেদের; Source: YouTube

ছেলেটার নাম লাড্ডু। আর কোনো নাম নেই তার। আগে কিছু না, পিছেও না, শুধু লাড্ডু! ভালো নাম না থাকা এই উদাস কিসিমের বাচ্চা ছেলেটা সত্তর সালের সেপ্টেম্বর মাসে নতুন স্কুলে ভর্তি হলো। তার লালচে চুল, শ্যামলা রঙ, ভাবুক ভাবুক চোখ। নতুন ক্লাসে তার নতুন নামকরণ হলো রাশেদ হাসান। মজিদ স্যার সবাইকে বলে রাখলেন, একে আর লাড্ডু ডাকা চলবে না। ধীরে ধীরে রাশেদের স্বরূপ প্রকাশ পাওয়া শুরু হলো। আর শুরু হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের এক অনবদ্য কাহিনী।

রাশেদ সেই হাজারো কিশোরের প্রতিনিধি, যারা সশরীরে ময়দানে না থেকেও যুদ্ধ করেছে প্রতিনিয়ত। রাশেদের সঙ্গী ইবু, ফজলু, আশরাফরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করতে পিছপা হয়নি। যুদ্ধ এ দেশের কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষ করেনি, করেছে সকলে, যে যেভাবে পেরেছে। রাশেদরাও তাই যোদ্ধা। মুক্তির সংগ্রাম করা বীর যোদ্ধা!

রাশেদের বাবাও পাগলা মতন লোক, এইটুকু বাচ্চার সাথে রাজনীতির আলাপ করেন। মারপিট করে ঘরে ফিরলেও বাবা তাকে বানান না। দিব্যি নিজের মতো চলে সে। মা বেঁচে নেই তার। জীবন তাতে অনেকটাই ছন্নছাড়া। রাশেদের এই এলোমেলো জীবনে স্বাধীনতা যুদ্ধ এলো এক অন্যরকম স্বাদ নিয়ে! নিজেকে দেশের কাজে সঁপে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি ছেলেটা।

একাত্তরের মার্চ মাস এলো। ঐ মাসের মাঝামাঝি সময়ে একদিন রাশেদ স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে হাজির। গাঢ় সবুজের মাঝে লাল বৃত্ত, তাতে হলুদ নকশা কাটা। ওটা নাকি এ দেশের মানচিত্র! সময়টা অসহযোগ আন্দোলনের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে আন্দোলন চলছে দেশে। পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য না করার প্রত্যয় নিচ্ছে জাতি। ইয়াহিয়া খান আর ভুট্টো কূটচাল চালছে কীভাবে শেখ মুজিবকে কাবু করা যায়। রাশেদের কাছ থেকে এসব রাজনৈতিক আলাপ উত্তাপ ছড়ায় কিশোর ইবুদের মাঝেও, এতদিন যারা খেলা আর স্কুল নিয়েই ছিলো। অবাক হয় তারা, দেশের জন্যে ভাবার এতকিছু রয়েছে!

বাংলার জয় আসতে আরো দেরি, কিন্তু রাশেদদের ছোট্ট শহরটা স্বাধীন বাংলা হয়ে বসে আছে তখন। ঘরে, দোকানে বাংলার পতাকা দেখা যায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বেজে চলেছে মানুষের কানে। স্বাধীনতার সংগ্রামে দেশবাসী উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। উত্তেজনা ছড়িয়েছে কিশোর রাশেদের মনেও। কবে আসবে স্বাধীনতা? কবে হবে বাংলার জয়?

রাশেদের গল্প চিত্রায়িত হয়েছে রূপালি পর্দায়ও; Source: IMDb

এর মাঝেই এলো বিভীষিকাময় কালরাত্রি, মার্চের পঁচিশ তারিখের সেই ভয়াল রাত! গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে জানা গেলো, যুদ্ধ লেগে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে দেশে! অনিশ্চয়তায় দিনখানা কাটে মানুষের। পরদিন রেডিওতে ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার। এবার যে পুরোদমে যুদ্ধ শুরু করার ক্ষণ!

হিন্দু হবার দায় কাঁধে নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছাড়ে ইবুদের বন্ধু দিলীপ। ইন্ডিয়াতে পাড়ি জমানো ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। বাস্তুহারা হবার দুঃখে দিলীপের চোখের পানি বাঁধ মানে না। বিদায়কালে ভয়ানক রাগে কাঁদতে থাকে ইবুও। কেন এমন হলো? প্রাণের মানুষগুলো এমন করে প্রাণের দায়ে দূরে চলে যাবে কেন?

রাশেদদের ছোট শহরটায় মিলিটারি এলো এপ্রিলের ত্রিশ তারিখ। শহর তখন প্রায় শূন্য। রাস্তাঘাট ফাঁকা। পাকসেনারা ক্যাম্প করলো ছেলেদের স্কুলঘরে। গোলাগুলি আর লুটপাট চললো ইচ্ছেমতো। আজফর আলী হলো হায়েনাদের দালাল রাজাকার, যার আছে তিন বউ! রাশেদটা এই সব ঘুরে ঘুরে দেখে, খোঁজ রাখে, আর ইবুদের এসে খবর জানায়। গুলি কেমন করে শরীরে এসে আঘাত করে আর তরতাজা প্রাণ শেষ হয়ে যায় নিমিষেই, সে বলতে পারে।

পাড়ার অরু আপা কেমন চুপসে গেছে। শফিক ভাই যে যুদ্ধে গেছে! ভালোবাসার মানুষটাকে দূরে রেখে কেমন করে ভালো থাকে অরু? শফিক ছেলেদের কাছে প্রিয় মানুষ। তাদের এটা-সেটা বানাতে জিনিসপত্র এনে দিতো। বুঝিয়ে দিতো কত বিষয়। কই হারিয়ে গেলো সেসব সহজ-সরল দিনগুলো, যখন ইবুরা বিস্কুট বানানোর কারখানা দিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছিলো!

রাশেদ লিস্ট বানায়। দালালদের লিস্ট, দেশের শত্রু যারা। এই লিস্ট দেয়া হবে মুক্তিবাহিনীর হাতে। এই শহরে যুদ্ধ লাগতে আর দেরি নেই। মুক্তিবাহিনী আসবে শীঘ্রই। ফজলুদের খেলাচ্ছলে তৈরি করা স্কুলের ম্যাপ কাজে লেগে যায়। এই ম্যাপ ধরেই মুক্তিবাহিনী মিশন চালনা করবে পাকসেনাদের ঘাঁটিতে। রাশেদরা প্রবল উত্তেজনায় দিন পার করতে থাকে। তারপর একদিন মুক্তিবাহিনী এসে উপস্থিত হয় তাদের শহরে। নদীর ওপারে তাদের ঘাঁটি। রাশেদ তাদের দূত।

এক রাতে নদী পেরিয়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে যেতে রাশেদের সঙ্গী হয় ইবুও। বাহিনীর দলপতি কাজল ভাই, শত্রুদের হাতে ধরা পড়লে যে বন্দী হবার আগে সহযোদ্ধাদের গুলিতে মরতেও প্রস্তুত। রাশেদরা অবাক হয়ে দেখে, জীবনকে কতখানি তুচ্ছ করে এসেছে এই মানুষগুলো! ক্যাম্পে আরো দেখা হয় শফিক ভাইয়ের সাথে, ক্লাসের গুন্ডা ছেলে কাদেরের সাথে। তারা মুক্তিযোদ্ধা। ইবুদের সেই খেলার ম্যাপটা পাকসেনাদের ঘাঁটি অনুযায়ী ঠিকঠাক করে দেয় রাশেদ। তার উপর ভিত্তি করে শত্রু শিবির আক্রমণের নকশা সাজানো হয়। দু’দিনের মাথায় মিশন বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নেয় মুক্তিবাহিনী। আর রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা শুরু হয় ছেলের দলের।

মিশনে ভাগ্যক্রমে শফিক ভাইয়ের সহযোদ্ধা হয় রাশেদ আর ইবু। দিনের বেলা চার বন্ধুতে মিলে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে গুলি পৌঁছে দেয় শফিক ভাইয়ের হাতে। আর রাতের অন্ধকারে একজন যোদ্ধার কমতি পূরণ করতে যুদ্ধের ময়দানে হাজির হয় রাশেদ এবং ইবু। শফিক আহত হলে তার বদলে গুলি চালায় তারা, সত্যিকারের বন্দুক দিয়ে চালানো গুলি! মিশন শেষ হয় ভালোভাবেই, কিন্তু ধরা পড়ে যায় শফিক। হাসপাতালে ঠাঁই হয় তার। সেরে উঠলে পাঠানো হবে অমানুষিক নির্যাতনের মুখে। তা হতে দেবে কেন ছেলের দল? কঠিন পরিকল্পনা করে সবাইকে বোকা বানিয়ে ঠিক উদ্ধার করে তারা শফিককে! আরেকটা জীবন বাজি রাখা মিশন সম্পন্ন হয় রাশেদদের।

এর মাঝে উপস্থিত হলো ইবুদের শহর ছাড়ার সময়। তার আগেই চলে গিয়েছে ফজলু আর আশরাফদের পরিবার। অরু আপাদের সাথে এবার যাবার পালা ইবুদের। এই শহরে একলা থেকে যায় রাশেদ নামের পাগল কিসিমের ছেলেটা। “যদি আমি কোনদিন মরে যাই, তুই কি আমার কথা মনে রাখবি?” ইবুকে জিজ্ঞেস করেছিলো রাশেদ। তার ছোট্ট বুকে তখন মরণভয়। এইটুকুন কাঁধে দেশের বোঝা বয়ে বেড়ানো রাশেদের ভীষণ ইচ্ছে, কেউ তার প্রাণের বন্ধু হোক। মরে গেলেও যে বন্ধু থেকে যায়, সে বন্ধু। দেশে স্বাধীনতা এলো ডিসেম্বরের ষোলো তারিখে। বিজয় অর্জিত হলো বাংলার বুকে। লাখো মানুষের রক্তের দামে পাওয়া গেলো বাংলাদেশের পরিচয়। শহরে ফিরলো ইবু, আশরাফ, ফজলুরা। ফিরলো না থেকে যাওয়া সেই ছেলেটি। বন্ধুদের ফেরার অপেক্ষায় থাকতে পারলো না রাশেদ।

ডিসেম্বরের দুই তারিখে ধরা পড়েছিলো গ্রেনেড নিয়ে। আজরফ আলীর বাহিনী তাকে নিয়ে গিয়েছিলো নদীর ঘাটে। স্বাধীনতার সাধনা করে যাওয়া রাশেদের মুক্ত দেশে একটা দিন বাঁচা হলো না। যুদ্ধ এত নিষ্ঠুর কেন হয়?

রকিবুল হাসান ইবু কথা রেখেছে। ভোলেনি সে রাশেদকে। মন খারাপের সময়ে সে রাশেদকে পাশে পায়। কত গল্প হয় তাদের। প্রাণের বন্ধুর সাথে কথা কি এত সহজে ফুরোয়? ইবু ভুলতে পারে না তার বন্ধু রাশেদকে। রাশেদদের যে ভোলা যায় না!

ফিচার ইমেজ: YouTube

Related Articles