নাপাম বোমা বিস্ফোরণের সময় আগুনের সাথে জেলির মতো রাসায়নিক পদার্থ চারদিকে ছড়িয়ে যায়। এই জেলি মানবদেহের সংস্পর্শে আসলে যায় আটকে। ২,২০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রায় চামড়া, মাংস, এমনকি হাড়ও গলে যেতে পারে! ভিয়েতনামে আমেরিকানদের নাপাম হামলায় মানুষের জ্বলে-পুড়ে মরবার দুঃখজনক ঘটনা বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখেছে। ব্যাপক পরিসরে না হলেও নাপাম বোমা ব্যবহার হয়েছিল বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধেও! ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই বোমা ফেলেছিল এ দেশে।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের ৩ তারিখে চুয়াডাঙ্গায় পাকিস্তানি বাহিনী নাপাম বোমা নিক্ষেপ করে। সেখানকার ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, বর্তমান বিজিবির পূর্বসূরি, বাঙালি সেনাদের সমন্বয়ে এই আধা সামরিক বাহিনী গড়ে ওঠায় ’৭১-এ বাংলাদেশের জন্য সর্বোচ্চ দিয়ে লড়াই করতে শুর করে) উইংয়ের হেডকোয়ার্টারে আগুন ধরে যায়। ফরাসি টেলিভিশন কর্পোরেশনের একটি দল তখন সেখানে অবস্থান করছিল। তাদের ফটোগ্রাফাররা গাছে উঠে নাপাম বোমা নিক্ষেপের ভিডিও ধারণ করেন। পাকবাহিনী নিজস্ব F-86 sabre দিয়ে দফায় দফায় হামলা করে চুয়াডাঙ্গায়। পরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এই ভিডিও। এই হামলার ঘটনা প্রত্যক্ষ করে আঁতকে ওঠে বিশ্ববাসী!
চুয়াডাঙ্গায় নাপাম হামলার কারণ দুটি:
১) স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রথমে চুয়াডাঙ্গায় তাদের শপথ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করে। এ খবর ছড়িয়ে গেলে চুয়াডাঙ্গাকে লক্ষ্য করে তীব্র আক্রমণ চালায় শত্রুরা। উল্লেখ্য, অপারেশন সার্চলাইট শুরু হবার পরেও কিছুদিন শত্রুমুক্ত ছিল এই জেলাটি। পরে তীব্র হামলার মুখে বাংলাদেশ সরকারের শপথ মেহেরপুরের মুজিবনগরে স্থানান্তর করা হয়।
২) ৩০ মার্চ ভোরে ‘অপারেশন ফার্স্ট লেগ’ এর মাধ্যমে চুয়াডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী জেলা কুষ্টিয়া কয়েকদিনের জন্য শত্রুমুক্ত হয়। সেখানে অবস্থান নেয়া ২৯ বেলুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানির প্রায় সবাই মুক্তিবাহিনীর শিকার হয়।
ভোরবেলায় হঠাৎ একযোগে হামলা শুরু করে মুক্তিবাহিনী। ঝাঁক ঝাঁক বুলেটের সাথে শুরু হয় হাজার পাঁচেক কণ্ঠে গগণবিদারী চিৎকার! “জয় বাংলা!” শ্লোগানে বিভ্রান্ত পাকসেনারা। শত্রু আসলে কত? মেজর শোয়েবের নেতৃত্বাধীন পাকসেনারা ভেবে বসে, যারা জয় বাংলা ধ্বনি তুলেছে, তাদের সবার কাছে অস্ত্র আছে। শহরে মোট তিনটি শত্রুঘাঁটি ছিল। বিভ্রান্ত পাকসেনারা মূল ঘাঁটিতে এক হবার চেষ্টা করে এবং দ্রুতই মুক্তিবাহিনীর শিকারে পরিণত হয়।
এই যুদ্ধে ২৪টি যুদ্ধযান (জিপ, ট্রাক), ৫৮টি মেশিনগান, ৮৯টি অটোমেটিক রাইফেল, ৫টি রিকয়েললেসগান, ওয়্যারলেস সিস্টেম এবং লক্ষাধিক বুলেট জব্দ করে মুক্তিবাহিনী। ধরা পরে লে. আতাউল্লাহ, বাংলাদেশের মাটিতে সে-ই প্রথম যুদ্ধবন্দী (Prisoner of War বা POW)।
অপারেশন ফার্স্ট লেগ-এর পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল চুয়াডাঙ্গা থেকেই। এতে ফ্রন্টলাইনে মূলত যুদ্ধ করে ইপিআর সেনারাই। অভিজাত বেলুচ রেজিমেন্ট ইপিআর-এর কাছে ধবল ধোলাই হবার পর তাদের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে।
৪ঠা এপ্রিল চট্টগ্রামে নাপাম হামলা করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। চট্টগ্রামেও স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে উঠছিল। তাই সেখানেও তীব্র শক্তি দিয়ে হামলা শুরু করে শত্রুরা। ৭ এপ্রিল নাপামের শিকার হন নরসিংদীর মানুষ। ২টি F-86 Sabre বিমান দফায় দফায় নাপাম হামলা চালায়।
এপ্রিলে নাপাম হামলা চলে পঞ্চগড়ে। পুরো সেপ্টেম্বর জুড়ে টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জে চলে দফায় দফায় নাপাম হামলা। এছাড়াও ডিসেম্বরের ৫ তারিখে যশোরের সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারতীয় বাহিনীর উপর অন্তত ১৪টি নাপাম বোমা ফেলে পাকিস্তান বিমান বাহিনী। উল্লেখ্য, ভারত সরাসরি পাকিস্তানের সাথে ৬ ডিসেম্বর যুদ্ধে জড়ালেও মার্চ-এপ্রিল থেকেই সীমান্তে ছোট ছোট সংঘর্ষ বা Border Skirmish-এ জড়িয়েছিল। এই নাপাম হামলার ঘটনা হয়তো ইতিহাসে অনেকটাই চাপা পড়ে যেত, কিন্তু চুয়াডাঙ্গায় হামলার সময় সেখানে সংবাদকর্মীরা অবস্থান করায় হামলার ভিডিও ধারণ করতে পারেন তারা।
নাপামের ইতিহাস
যুদ্ধ নিয়ে একটু খোঁজখবর যারা রাখেন, তারা এই বোমার সাথে ভালভাবেই পরিচিত। নাপামের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে। তবে ভিয়েতনাম যুদ্ধে এটি রীতিমতো কুখ্যাতি অর্জন করে।
যুদ্ধ আর আগুন শব্দ দুটো যেন সমার্থক- “শত্রুর উপর অগ্নিবৃষ্টি নামিয়ে আনো!” যুদ্ধে আগুনের ব্যবহার বেশ পুরনো। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকে গ্রিকরা যুদ্ধে আগুনকে অত্যন্ত সফলভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে। বাইজান্টাইনরা যুদ্ধের ময়দানে দারুণভাবে আগুন ব্যবহার করে। সময় অগ্রসর হতে থাকে, সেই সাথে এগোতে থাকে যুদ্ধপ্রযুক্তি আর কৌশলও। তবে প্রযুক্তি আর কৌশল যতই অগ্রসর হোক না কেন, কিছু জিনিস ঠিকই অপরিবর্তিত থাকে। যেমন- শত্রুর দিকে মারণাস্ত্র ছুঁড়ে মারা বা আগুন নিক্ষেপ।
যুদ্ধে আগুন ব্যবহারের ধরন আর কৌশল পরিবর্তন হলেও এর ব্যবহার ঠিকই রয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এই আগুনে-অস্ত্রকে করা হয়েছে আরও শক্তিশালী।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লুই ফিজারের নেতৃত্বে একটি দল ১৯৪২ সালে প্রথম সিন্থেটিক নাপাম প্রস্তুত করে। কয়েক মাস পরেই তারা এর নতুন এক সংস্করণ নিয়ে আসেন। সেটি আঠালো নয়, কিন্তু যখন গ্যাসোলিনের সাথে মেশানো হয় তখন এটি তীব্র দাহ্য পদার্থে পরিণত হয়। ফিজারের এক সহকর্মী নতুন এই রাসায়নিকে ফসফরাস মেশানোর পরামর্শ দেন। ফলে তা হয়ে ওঠে আরো বিধ্বংসী।
দু’মাস পর হার্ভার্ডের এক ফুটবল মাঠে তার দল প্রথম এর পরীক্ষা করেন। পরে সামরিকভাবে পরীক্ষার পর নাপামকে যুদ্ধে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
নাপামকে প্রথমে ফ্লেমথ্রোয়ারের জ্বালানী হিসেবে ব্যাবহার করা হয়। ১৯৪৪ সালে মার্কিন বিমান বাহিনী বার্লিনে নাপাম ব্যবহার করে। পরে ব্রিটিশ এবং আমেরিকানরা ইউরোপে নাপাম ব্যবহার করতে শুরু করে। ১৯৪৫ সালে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপানের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে নাপাম ব্যবহার শুরু করে মার্কিন বাহিনী। প্রশান্ত অঞ্চলের জঙ্গলাকীর্ণ এলাকাগুলোতে এই বোমা দারুণ কাজ করতে শুরু করে। ৪০,০০০ টন নাপাম শুধু জাপানী শহরগুলোতেই নিক্ষেপ করা হয়। কোরিয়া যুদ্ধেও ৩২,৫০০ টনের বেশি নাপাম ব্যবহার করে মার্কিনীরা। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ৩,৮৮,০০০ টন নাপাম বর্ষণ করে মার্কিন বাহিনী।
গোটা বিশ্ব নাপামের ভয়াবহতা তখন প্রত্যক্ষ করতে শুরু করে। মানবদেহ ভয়াবহভাবে পুড়ে যাওয়াসহ ধোয়া, হিট স্ট্রোকে মৃত্যু হতো। ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ধরনের নাপাম ব্যবহার শুরু করে, যা পানির নিচেও কিছুক্ষণ জ্বলতে পারত। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি পানিতে ঝাঁপ দিয়েও রক্ষা পেত না। একটি মাত্র নাপাম বোমা বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে জ্বালিয়ে দিতে পারত। ফলে সামরিক-বেসামরিক, শিশু-বৃদ্ধ সবাই এর নির্মম শিকার হতো।
এ কথা সত্য যে, ৬০-৭০ এর দশকে বিশ্বে নাপামের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। তবে ভিয়েতনামে নাপামের ভয়াবহতা দেখে গোটা বিশ্বে প্রচণ্ড নাপামবিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠে। তাই বিশ্বে নাপামের চল ছিল বলে বাংলাদেশে নাপাম হামলাকে কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত করা চলে না। দিনশেষে, নাপাম হামলা একটি জঘন্য কাজ বলেই বিবেচিত হবে।