মুক্তিযুদ্ধ বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এদেশের দামাল ছেলেদের অস্ত্র হাতে পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। এদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী- সকলের এক মহাসংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধ মানেই আমরা জানি এদেশের নিরীহ নারী-পুরুষের ওপর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতন, পুড়ে ভষ্ম হয়ে যাওয়া পুরো শহর আর গ্রামের পর গ্রাম, সেই সাথে ব্যাপক নারী নির্যাতন। ক্যাম্পে ক্যাম্পে জন্তু-জানোয়ারের মতো ফেলে রাখা লক্ষ লক্ষ বীরাঙ্গনা আর স্বামী-সন্তান-আশ্রয় সর্বহারা কোটি কোটি সাধারণ নিরীহ নারী। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা কি এই নির্যাতন আর সব হারানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ?
না, এখানেই মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা শেষ হয় না। এদেশের সাহসী নারীরা পুরো যুদ্ধকালে তথ্য, অস্ত্র, খাদ্য, সেবা- বিভিন্নভাবে যুদ্ধকে বিজয়ের দিকে এগিয়ে নিতে কাজ করে গেছে। এমনকি আমাদের বাহাদুর মেয়েরাও অস্ত্র হাতে লড়াই করেছিলো সেদিন দেশমাতৃকার জন্য। কিন্তু অত্যন্ত দু:খের সাথে বলতে হয়, তাদের কথা এদেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে এখনো অজানা। এদেশের নারী মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রাপ্য স্বীকৃতি ও সম্মানও পেয়েছেন অনেক পরে।
এমনি একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা বীরপ্রতীক তারামন বিবি, একাত্তরে অস্ত্র হাতে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে যিনি পিছুপা হননি একদমই। অন্যান্য নারী মুক্তিযোদ্ধাদের মতো তিনিও দীর্ঘ সময় পর্দার আড়ালে ছিলেন। আজ আপনাদের এই সাহসী নারীর জীবনের গল্প, দেশ ও মাটির টানে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করার গল্প জানাবো।
অত্যন্ত সাহসী এই নারী কুড়িগ্রাম জেলার শঙ্কর মাধবপুর গ্রামের আবদুস সোবহান নামের এক অতি সাধারণ ব্যক্তির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। মায়ের নাম কুলসুম বেওয়া। নিজ গ্রামেই বেড়ে ওঠা তারামন যুদ্ধে অংশ নেন ১১ নং সেক্টরের অধীনে। কুড়িগ্রাম ও এর আশেপাশের এলাকা ছিলো এই সেক্টরের অধীনস্থ। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সাথে সাথেই তারামন সশস্ত্র সংগ্রামে জড়াননি।
মুহিব হাবিলদার নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা তারামনদের গ্রামের পাশে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি তারামনকে মুক্তিযোদ্ধাদের রান্নাবান্নায় সহায়তার কাজের প্রস্তাব দেন। কিন্তু মায়ের আপত্তির কারণে সে দায়িত্ব পালন সম্ভব হয়নি। পরে মুহিব হাবিলদার ১৪ বছর বয়সী কিশোরী তারামনকে নিজের ধর্মকন্যা হিসাবে গ্রহণ করলে তারামনের মা মেয়েকে রান্নার কাজে যোগ দেওয়ার অনুমতি দেন।
কিন্তু প্রথম থেকেই তারামনের কিশোরী মনে প্রবল আগ্রহ ছিলো কেবল পরোক্ষ নয়, অস্ত্র হাতে প্রত্যক্ষভাবেও দেশের জন্য কাজ করে যাওয়ার। তার এই ইচ্ছাকে আরো অনুপ্রাণিত করেন মুহিব হাবিলদার। ধর্ম পিতার কাছেই তিনি ব্রিটিশ রাইফেল .৩০৩ ও সাবমেশিনগান চালানোর প্রশিক্ষণ নেন। এই সময় ১১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন কামান্ডার আবু তাহের।
যুদ্ধের পুরো ৯টি মাস ধরেই বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো পরোক্ষভাবে অংশ নেন। কিন্তু প্রথম দিনের সম্মুখযুদ্ধের বর্ণনা জানা যায় তারামনের নিজেরই দেওয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে। মুহিব হাবিলদারের ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অবস্থানকালে একদিন দুপুরের খাবারের সময় তারা জানতে পারে এক গানবোট ভর্তি পাকিস্তানি সেনা তাদের ক্যাম্প আক্রমণ করতে আসছে। খাবার রেখে তারা তখনই যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন।
প্রথমবার সেই সম্মুখযুদ্ধে তারামন বিবি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে শত্রুর মোকাবেলা করেন। তার এবং অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে একদিকে পাক সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়, অন্যদিকে পুরুষ যোদ্ধাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই নারী যোদ্ধার সশস্ত্র সংগ্রাম করার যোগ্যতা প্রমাণিত হয় সহযোদ্ধাদের কাছে।
এরপর থেকেই তিনি নিয়মিত বিভিন্ন সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। এসব যুদ্ধের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো, এগারো নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত গাইবান্ধার সওঘাটা ও ফুলছড়ি এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ঐ এলাকার কোদালকাঠির আকস্মিক যুদ্ধে তারামন বিবি একাই প্রায় ৫-৬ জন পাক সেনাকে খতম করতে সক্ষম হন। সম্মুখ সমরে তাই তারামনের অর্জন পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
তাই বলে এই নারীর যুদ্ধ কিন্তু কেবল অস্ত্র ধারণের মধ্যেই সীমিত থাকেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের ব্যবস্থা করা ছাড়াও তিনি প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য জোগাড়েও অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দেন। একথা সত্য যে, গুরুত্বপূর্ণ যেসকল তথ্যের ওপর নির্ভর করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গেরিলা অপারেশন হতো তা নারী-পুরুষ-বালক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে এদেশের আপামর জনতার আপ্রাণ সাহায্য ছাড়া কখনোই সম্ভব হতো না।
প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে তারামন ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে শত্রু শিবিরের অবস্থান আর গোপন পরিকল্পনা, সেখানকার লোকবল, মজুদকৃত অস্ত্রের বর্ণনা জানতে পাগলের বেশে গেছেন পাক বাহিনীর ঘাঁটিতে। কখনও সারা শরীরে কাদা মাটি, কালি, ময়লা আবর্জনা, এমনকি মানুষের বিষ্ঠা পর্যন্ত লাগিয়ে পাগল সেজেছেন তারামন৷ আবার কখনো মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী, অন্ধ, বোবা সেজে পাক সেনাদের সামনে দীর্ঘ হাসি কিংবা কান্নার অভিনয় করে শত্রুসেনাদের খোঁজ নিয়ে এসেছেন। যুদ্ধের প্রয়োজনে কখনো সাঁতরে পার হয়েছেন নদী। আবার কখনো কলাগাছের ভেলা নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী। এভাবে মুক্তিযুদ্ধে তার শ্রম, আন্তরিকতা, ত্যাগ সূচনা করেছিলো এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সুবিশাল উপন্যাসের মধ্যে তার নিজস্ব একটি স্বতন্ত্র বীরত্বের গল্পের।
তার মতো আরো লাখো মানুষের আত্মত্যাগে একাত্তরের ডিসেম্বরে স্বাধীন হয় এই দেশ। এরপর ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তার সাহসীকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য “বীর প্রতীক” উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু তখন আর তাঁকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। এরপর অনেক বছর পর্যন্ত এই বীর নারী থেকে গেছেন লোকচক্ষুর আড়ালে, সকলের অগোচরে। আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধার মতো তিনিও হয়তো হারিয়ে যেতেন কালের স্রোতে, কিন্তু ১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহের এক গবেষক বিমল কান্তি দে তারামন বিবিকে এবং মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানকে সকলের সামনে তুলে ধরেন।
এরপর নারী সংগঠনগুলো তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। এই সংগঠনগুলো ও বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে তার বীরত্বকাব্য প্রকাশিত হয়। ১৯৯৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার এক অনাড়ম্বর আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে তাকে সম্মানিত করে। বর্তমানে তিনি কুড়িগ্রামের চর রাজীবপুরে স্বামী ও দুই সন্তানসহ বাস করেন।
তারামন বিবি সেই শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেন যারা চিরকালই অর্থ, সম্পদ, জমিন ও উপর্যুক্ত জীবিকা থেকে বঞ্চিত থেকেছেন, অথচ শুধুমাত্র মাটির টানে ও হৃদয়ের সততা থেকে দেশের জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে গেছেন পদে পদে। আজও তিনি কায়মনোবাক্যে স্বদেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও মঙ্গল ছাড়া কিছু চান না।
বরং একদিক থেকে বরং তাকে ভাগ্যবানই বলা চলে যে, স্বাধীনতার ২৪ বছর পরে হলেও তিনি তার প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি পেয়েছেন। তার মতো আরো হাজারো তারামন যাদের সর্বস্ব ত্যাগের ফলে এদেশ আজ স্বাধীন, তারা হয়তো চিরকালের মতো হারিয়ে গেছেন কালের স্রোতে। তবু আমরা এক তারামনের মধ্য দিয়েই সেই সকল আত্মত্যাগী বীর নারীদের ধারণ করে রাখবো হৃদয়ের মণিকোঠায়।
ফিচার ইমেজ: youtube.com