যুদ্ধ এবং ভালোবাসা কোনো নিয়ম মানে না। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীরা যখন আমাদের উপর এক অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল, ২৫শে মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু করেছিল, তখন আমরাও কোনো নিয়ম মানিনি। তৎকালীন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন ভঙ্গ করেই আমরা ঘোষণা করেছিলাম স্বাধীনতা, শুরু করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধ।
যদি আমাদের আন্দোলন ব্যর্থ হতো, তাহলে যারা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল, যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তাদের সবার মৃত্যুদন্ড হতে পারত। কিন্তু সেই ভয়ে আমরা চুপ করে বসে থাকিনি। সময়ের প্রয়োজনে হাতে তুলে নিয়েছিলাম অস্ত্র। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছিলাম বিজয়।
নিয়ম মানেননি বেলজিয়ামের এক ২১ বছর বয়সী তরুণ মারিও রয়ম্যান্সও। ভালোবাসার টানে তিনি ভঙ্গ করেছিলেন রাষ্ট্রের আইন। দীর্ঘ কারাবাসের ঝুঁকি নিয়ে ঘটিয়েছিলেন বেলজিয়ামের ইতিহাসের অন্যতম চাঞ্চল্যকর অপরাধের ঘটনা। না, তার এই ভালোবাসা কোনো নারীর জন্য ছিল না, তার ভালোবাসা ছিল মানবতার জন্য। হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত সদ্য স্বাধীনতা ঘোষণা করা একটি জাতির জন্য, যারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে গণহত্যার শিকার হচ্ছিল, গৃহহারা হয়ে শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছিল, কলেরা আর অন্যান্য মহামারীর সাথে লড়াই করে কোনোমতে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিল।
মারিও পিয়েরে রয়ম্যান্স ছিলেন বেলজিয়ামের লিমবার্গ শহরের অধিবাসী। ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। সে সময় টিভিতে মাঝে মাঝেই বাংলাদেশের সংবাদ স্থান পেত। বাংলাদেশীদের উপর পাকিস্তানী বাহিনীর নারকীয় তান্ডব, গণহত্যা, ধর্ষণ, শরণার্থী শিবিরের দুর্বিষহ জীবনের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ, যা বিদেশী সাংবাদিকদের ক্যামেরায় ধরা পড়ত, তাই মাঝে মাঝে প্রদর্শিত হতো টিভিতে। কিন্তু সেটা দেখেই রয়ম্যান্স আর নিজেকে স্থির রাখতে পারেননি। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এই যুদ্ধবিধ্বস্ত অসহায় মানুষগুলোর জন্য তাকে কিছু একটা করতেই হবে।
রয়ম্যান্স ছিলেন সামান্য একজন হোটেলের ওয়েটার। আর্থিকভাবে অন্যকে সাহায্য করার সামর্থ্য তার ছিল না। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, বৃহত্তর মানবতার স্বার্থে তিনি প্রয়োজনে অন্যায়ভাবে হলেও অর্থ সংগ্রহ করবেন। না, বড় কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের পরিকল্পনা করেননি তিনি। তিনি নিজে ছিলেন একজন চিত্রকর্মের ভক্ত। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন, বিখ্যাত কোনো একটি চিত্রকর্ম চুরি করবেন তিনি এবং সেটা বিক্রি করে পাওয়া অর্থ দিয়েই সাহায্য করবেন বাংলাদেশীদেরকে।
সে সময় ব্রাসেলসের ফাইন আর্টস প্যালেসে একটি চিত্রপ্রদর্শনী চলছিল। এতে প্রদর্শিত ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নেদারল্যান্ডের রিজক মিউজিয়াম থেকে ধার করে আনা সপ্তদশ শতকের মহামূল্যবান চিত্রকর্ম ‘দ্য লাভ লেটার‘ তথা প্রেমপত্র। ডাচ চিত্রশিল্পী ইয়ান ভারমিয়ারের আঁকা এই চিত্রকর্মটি ছিল তার একটি ক্লাসিক্যাল সৃষ্টি। ক্যানভাসের উপর তেল রঙে আঁকা এই ছবিটিতে দেখা যায়, এক গৃহপরিচারিকা গৃহকর্ত্রীর হাতে একটি প্রেমপত্র তুলে দিচ্ছে। ছবিটি রং ও প্রতীকের ব্যবহার এবং তাদের অন্তর্নিহিত ভাবের জন্য বিখ্যাত। ছবিটি ১৬৬৬ সালে আঁকা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এর তৎকালীন মূল্য ছিল প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলার।
১৯৭১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল বেলা রয়ম্যান্স অন্যান্য দর্শনার্থীদের সাথে প্রদর্শনীতে প্রবেশ করেন। ভেতরে ঢুকেই তিনি সুযোগ বুঝে হলরুমের এক কোণে অবস্থিত ইলেক্ট্রিক্যাল বাক্সের ভেতরে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেন। প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রাতের বেলা তিনি বক্স থেকে বের হন এবং ভারমিয়ারের ছবিটি দেয়াল থেকে নামিয়ে নেন। রয়ম্যান্স ভেতর থেকে হল রুমের জানালা খুলে ফেলেন, কিন্তু ছবির ফ্রেমটি আকারে বড় হওয়ায় ফ্রেম সহ ছবিটি বাইরে বের করতে ব্যর্থ হন। তিনি একটি আলু কাটার ছুরি দিয়ে ফ্রেম থেকে ছবিটিকে কেটে বের করেন এবং ভাঁজ করে ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন।
রয়ম্যান্স যে হোটেলে চাকরি করতেন, সেই সোয়টিউই হোটেলেরই একটি কক্ষে বসবাস করতেন। হোটেলে এসে প্রথমে তিনি ছবিটিকে নিজের রুমেই রাখেন। পরে আরো নিরাপত্তার জন্য সেটিকে হোটেলের পেছনের বাগানে গর্ত করে মাটি চাপা দিয়ে রাখেন। কিন্তু কয়দিন পরে যখন বৃষ্টি পড়তে শুরু করে, তখন তিনি আবার বাগানে গিয়ে ছবিটি তুলে নিয়ে আসেন এবং হোটেলের রুমে বালিশের ভেতরে লুকিয়ে রাখেন।
অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে এক রাতের বেলা রয়ম্যান্স ব্রাসেলস ভিত্তিক সংবাদপত্র ল সয়্যারের এক সাংবাদিকের সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি নিজেকে পরিচয় দেন ‘থিল ভ্যান লিমবার্গ’ তথা লিমবাগের থিল হিসেবে। থিল উইলেনস্পিজেল ছিল ফ্লেমিশ লোকগাঁথার এক বিখ্যাত চরিত্র, যে স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের সময় রবিন হুডের মতো ধনীদের ধন-সম্পত্তি দখল করে তা গরীবদের মধ্যে বিতরণ করত। তার নামানুসারেই তিনি নিজের ছদ্মনাম নেন লিমবার্গের থিল।
রয়ম্যান্স সাংবাদিকটিকে জানান, চুরি হওয়া ছবিটি তার কাছে আছে। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ যদি ছবিটি ফেরত পেতে চায়, তাহলে তাদেরকে পরিশোধ করতে হবে নগদ ২০০ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক বা প্রায় ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার! তবে এই টাকার একটি পয়সাও তিনি নিজে নিবেন না। এই টাকা পাঠাতে হবে একটি ক্যাথলিক চার্চে, যারা সেগুলো পাঠিয়ে দিবে পূর্ব পাকিস্তানের দুর্দশাপীড়িত শরণার্থীদের কাছে। ছবিটি যে আসলেই তার কাছে আছে, সেটি প্রমাণ করার জন্য তিনি সাংবাদিকটিকে একটি ক্যামেরা নিয়ে পরদিন ভোরে জোলডার শহরের একটি পাইন বনে তার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য অনুরোধ করেন।
পরদিন ভোর বেলা নির্ধারিত স্থানে কুয়াশাচ্ছন্ন কনকনে শীতের মধ্যে সাংবাদিক তার ক্যামেরা সহ রয়ম্যান্সের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। প্রায় আধঘন্টা পরে রয়ম্যান্স হাজির হন। হালকা পাতলা গড়নের রয়ম্যান্সের মুখ ছিল একটি প্লাস্টিকের মুখোশে ঢাকা। রয়ম্যান্স সাংবাদিকটির চোখ বেঁধে প্যাসেঞ্জার সীটে বসিয়ে নিজে গাড়ি চালাতে থাকেন। প্রায় আধঘন্টা গাড়ি চালানোর পর তারা এসে পৌঁছেন ছোট একটি গির্জার সামনে। রয়ম্যান্স সেখান থেকে সাদা কাপড় দিয়ে মোড়ানো চিত্রকর্মটি নিয়ে আসেন। তিনি সাংবাদিককে তার ক্যামেরা দিয়ে চিত্রকর্মটির ১০টির মতো ছবি তুলে নেওয়ার সুযোগ দেন।
পরদিন সকালে পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয় চুরি হওয়া চিত্রকর্মের ছবিগুলোর ছবি। সেই সাথে জানানো হয় তার তিনটি দাবি। বাংলাদেশীদেরকে সাহায্য করা ছাড়াও তার বাকি দুটি দাবি ছিল নেদারল্যান্ডে রিজক মিউজিয়াম এবং বেলজিয়ামে ফাইন আর্টস কর্তৃপক্ষকে পৃথকভাবে বিশ্বের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য অর্থ সংগ্রহের অভিযান শুরু করতে হবে। রয়ম্যান্স টাকা জমা দেওয়ার জন্য অক্টোবরের ৬ তারিখ পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেন।
পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার পরপরই পুলিশ পত্রিকা অফিসে হানা দেয়। তারা ছবিগুলো জব্দ করে এবং বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হয় যে, এগুলো আসল চিত্রকর্মেরই ছবি। থিল ভন লিমবার্গের খোঁজে পুলিশ ব্যাপক অভিযান শুরু করে। ওদিকে রয়ম্যান্সও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং রেডিও অফিসে ফোন করে তার দাবি জানাতে থাকেন। রয়ম্যান্সের বিপ্লবী বক্তব্য নেদারল্যান্ড এবং বেলজিয়ামের মানুষের মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলে। তারা নিজেরাই বাংলাদেশের জন্য চাঁদা তোলার উদ্যোগ নেয়। হাজার হাজার মানুষ পিটিশনে স্বাক্ষর করে রয়ম্যান্সের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাতিলের দাবি জানায়। শহরের দেয়ালগুলোতে রয়ম্যান্সের উদ্দেশ্যের পক্ষে সমর্থনমূলক শ্লোগানে ভরে উঠতে থাকে।
৬ তারিখে রয়ম্যান্স বেলজিয়ামের সংবাদপত্র হেট ভলজিকে ফোন করেন এবং জানান, কর্তৃপক্ষ যদি টেলিভিশনে জনগণের সামনে তার দাবি মেনে নেওয়ার চুক্তি স্বাক্ষর না করে, তাহলে তিনি এক মার্কিন ব্যবসায়ীর কাছে চিত্রকর্মটি বিক্রয় করে দিবেন। তিনি যখন পাবলিক টেলিফোন থেকে ফোনটি করছিলেন, তখন এক ভদ্রমহিলা তার কথাগুলো শুনে ফেলে এবং পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ খুব দ্রুত ঘটনাস্থলে হাজির হয়। রয়ম্যান্স পুলিশ দেখেই মোটরসাইকেল ফেলে পালানোর চেষ্টা করেন। তিনি নিকটস্থ একটি গোয়ালঘরে প্রবেশ করে খড় দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশ তাকে খুঁজে বের করে।
পুলিশ চিত্রকর্মটি উদ্ধার করে রিজক মিউজিয়ামে ফেরত দেয়। কিন্তু ফ্রেম থেকে খোলা, ভাঁজ করে পকেটে রাখা এবং বাগানের মাটিতে বৃষ্টির পানির সংস্পর্শে আসার ফলে ততদিনে ছবিটির অনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল। ছবিটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য জাদুঘর কর্তৃপক্ষ একটি আন্তর্জাতিক সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়। প্রায় এক বছর প্রচেষ্টার পর ছবিটি প্রায় তার পূর্বরূপ ফিরে পায়।
১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর রয়ম্যান্সকে আদালতে হাজির করা হয়। পরবর্তী বছরের ১২ই জানুয়ারি তার বিচারকার্য শেষ হয়। আদালত তাকে দুই বছরের কারাদন্ড দেয়, যদিও তিনি ছয় মাস পরেই মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু এই ছয় মাসের কারাভোগই রয়ম্যান্সকে আজীবনের জন্য পাল্টে দিয়েছিল। তিনি বিষণ্নতায় ভুগতে শুরু করেন। জেল থেকে মুক্তির পর তিনি বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু তার বিয়েও শেষ পর্যন্ত টেকেনি। তিনি একাকী জীবনযাপন শুরু করেন। সারাদিন এলোমেলোভাবে কাটানোর পর রাতের বেলা তিনি তার গাড়িতেই ঘুমাতে শুরু করেন। ১৯৭৮ সালের বড়দিনের সময় তাকে তার গাড়ির ভেতরে প্রচন্ড অসুস্থাবস্থায় পাওয়া যায়। এর ১০ দিন পর, ১৯৭৯ সালের ৫ জানুয়ারি, ২৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন রয়ম্যান্স।
বাংলাদেশীদের সাথে রয়ম্যান্সের ভৌগলিক, ধর্মীয়, জাতিগত বা ভাষাগত কোনো দিক থেকেই কোনো মিল ছিল না। কিন্তু তারপরেও তাদের দুঃখ-দুর্দশা তাকে বিচলিত করেছিল, তাদের জন্য তিনি নিজের জীবন বিলিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সফল হননি, কিন্তু তিনি আমাদের অনুপ্রেরণা। তার পদক্ষেপ হয়তো আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ, কিন্তু তার উদ্দেশ্য ছিল সৎ। আমরা তার কর্মপদ্ধতি নয়, বরং তার উদ্দেশ্যটাই গ্রহণ করব। আমাদের হৃদয়ে তার স্থান হবে চির অম্লান।
ফিচার ইমেজ- montoyaaftervermeer.com