বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায় ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস এ দেশের মুক্তিকামী জনগণ লড়াই করেছেন তৎকালীন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। মুক্ত করে আনেন স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার। দেশের মানুষদের মনে আসে স্বস্তির হাওয়া। দেশের মানূষ লাভ করে মুক্ত বিহঙ্গের মতো আকাশে উড়ে বেড়ানোর স্বাধীনতা।
কিন্তু আমাদের এই নয় মাসের যাত্রাটা কতটা কঠিন ছিলো তা বর্ণনাতীত। প্রাণ দিতে হয়েছে আমাদের ৩০ লাখ মানুষকে। নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে ২ লাখ নারীকে। মুক্তিযুদ্ধের পর এমন অবস্থা হয়েছিলো যে, প্রায় প্রতিটি পরিবারেরই কেউ না কেউ যুদ্ধে তাদের স্বজন হারিয়েছেন। কিন্তু মুক্তির কাছে এ যেন তুচ্ছ এক ব্যাপার। স্বাধীনতার আনন্দে ভুলে যাওয়া যায় কঠিন ক্ষতটাও।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশে বসবাস করা অনেককেই দেখা যায়, পাকিস্তান বাহিনীকে সাহায্য করছেন। এমনকি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াবহ নারকীয় হামলার পরও অনেকেই সেই নরপিশাচদের সাহায্য করে গেছেন। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে বের করতে সাহায্য করে গেছেন তারা। যাদেরকে আমরা হারিয়েছি। তাদের সাথে হারিয়েছি আমাদের দেশের প্রাণের একটি বড় অংশকে। বলা হয়, বাইরের শত্রুর থেকেও ঘরের শত্রু ক্ষতি করে বেশি। এই ক্ষতি যারা করেছিল তাদের আমরা রাজাকার বা আলবদর বলি।
তাদের একটা বড় অংশ ছিলেন পাকিস্তানের রাজনীতির সাথে যুক্ত। আবার অনেকেই ছিলেন পাকিস্তানপন্থী। বাংলাদেশকে তারা একটি আলাদা দেশ হিসেবে দেখতে চায়নি। পাকিস্তানের সাথে যুক্ত থেকে একটি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চেয়েছিল। তারাও সাহায্য করে পাকিস্তানী বাহিনীকে। আবার, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে বসবাস করা উর্দুভাষী বিহারী সম্প্রদায়ের লোকেরাও এই দলে যুক্ত ছিলেন। তারা বাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
এই কারণে এমন হয়েছে যে, আমরা আজ বিহারী সম্প্রদায়ের সব লোকদের সেই দলে যুক্ত করে ফেলছি। তাদেরকে দেশের শত্রু বলে উল্লেখ করে আসছি। আচ্ছা, তারা দেশের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন বলে তাদের সম্প্রদায়ের সবাই কি একই চিন্তা নিয়ে থাকেন? নাকি তাদের মধ্যেও ভালো কিছু ছিলো? কিংবা আছে? তাদের সবাইকে এক দলে ফেলে ছাঁচে ফেলে দেয়া কি ঠিক হচ্ছে?
এ সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে বাংলাদেশের প্রখ্যাত পরিচালক তারেক মাসুদ তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদকে নিয়ে নির্মাণ করেন ‘নরসুন্দর’ শিরোনামের এক স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা। ‘রামরু’ নিবেদিত এই সিনেমাটিতে দেখানো হয় ১৯৭১ সালের পুরান ঢাকার একটি ছোট্ট ঘটনা। যে ঘটনা আপনাকে চিন্তার ছাঁচিকরণ থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে।
শুরুটা হয় দরজা খোলার মাধ্যমে। ঘরে প্রবেশ করেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর উর্দি পড়া কয়েকজন সেনা। তাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছেন এদেশে বসবাস করা এক লোক। হয়তো তিনি কোনো বিহারী কিংবা মদদপুষ্ট কোনো এক দলের সদস্য। এই লোক সেনাদের বলেন, এই বাড়িতে থাকে এক যুবক। সেই যুবক পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে লেখালেখি করেন। কবিতা কিংবা লেখালেখি দিয়ে মুক্তির কথা বলেন। তিনি মূলত একজন কম্যুনিস্ট।
এর চিত্র আমরা পাই সেই যুবকটির পালিয়ে যাওয়া দেখে। এছাড়াও দেখা যায়, তার ঘরের ক্যালেন্ডারে রয়েছে সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি ছবি। এতে বোঝা যায়, সাহিত্যের প্রতি টান রয়েছে এই পরিবারের। ঘর তছনছ করে খুঁজে দেখা হয় তার লেখা কবিতা কিংবা সরকার বিরোধী কিছু পাওয়া যায় কিনা। এদিকে যুবকটি ক্রমাগত দৌড়াতে থাকে। তার দৌড়ানোর ফাঁকে দেখানো হয় কোনো এক দেয়ালে বড় করে লেখা – জননেতা গোলাম আযম জিন্দাবাদ।
যুবকটি পালিয়ে যাবে কোথায়? পুরো এলাকাটাই তো পাকবাহিনীর দালালদের খপ্পরে। তার এই উৎকণ্ঠা আর পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্যের মধ্যেই হুট করে গুলির শব্দ। ব্যাকগ্রাউন্ডে গুলির শব্দের পর দর্শক ভড়কে যান। সেই যুবককেই গুলি করা হয়নি তো?
না, গুলি করা হয়েছে তার বাবাকে। তার বাড়ি তছনছ করে ফিরে যাবার সময় গুলি করে ফেলে রাখা হয় তার বাবাকে। তার মা তখন অসহায়ের মতো তার বাবাকে নিয়ে ছুটে যান ঘোষ ফার্মেসিতে। কিন্তু এই অসময়ে ডাক্তার কি আছেন? তার তো থাকার কথা নয়। ভাগ্যের ছোঁয়া পেয়ে যান তারা। ডাক্তার খুঁজে পান। কিন্তু সেই ডাক্তারকেও ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি নরপিশাচরা।
এদিকে পালাতে গিয়ে এক বিহারীদের সেলুনে আশ্রয় নেয় সেই যুবকটি। দোকানের মালিক এবং কর্মীদের কথাবার্তা ও রহস্যময় হাসির কারণে বুঝতে বাকি থাকে না; তারা যুবককে চেনেন। সেলুনের দোকানে যারা রয়েছেন তারা সবাই বিহারী। এখানে তাই অস্থির এবং অস্বস্তি অনুভব করে যুবকটি। দাঁড়ি কাটাতে গিয়ে কয়েকবার ব্যাঘাত ঘটাতে হয় তার। কেননা তার মনে ভয় যে, এসব লোকেরা তাকে ধরিয়ে দেবেন না তো?
সেলুনের যে লোকটি তার দাঁড়ি কাটছিলেন তার একটি বক্তব্যে সুন্দরভাবে তারেক মাসুদ ফুটিয়ে তুলেছেন আমাদের বাঙ্গালির একতার শক্তিকে। যে শক্তির জোরে পাহাড়সম বাধা টপকে যাওয়া সম্ভব। লোকটির বক্তব্য ছিলো এমন-
বাঙ্গালি বাবুর দাঁড়ি এত শক্ত আর এত লম্বা যে অনেক বেশি ধার লাগে।
রেডিওতে তখন বাজছিলো উর্দু গান। সেখানে হুট করে ঘোষণা আসে মুক্তিবাহিনীকে ধরিয়ে দিতে। ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার দেয়া হবে। তখন এটি নিয়ে সেখানকার লোকজন হাসাহাসি করলে যুবকটি ভড়কে যায়। তাকে কি তারা ধরিয়ে দেবেন। পালাতে গিয়ে কি শত্রুর মুখের সামনেই এসে পড়লো সে? নিজেকে খুবই অসহায় মনে হয় তার।
সেলুনের গান বাজানোর সময় গানের মাঝেই আসছিলো বিভিন্ন ঘোষণা। মুক্তিবাহিনীকে ধরিয়ে দেয়া ছাড়াও ঘোষণা করা হচ্ছিলো রাজাকাররা যেন তাদের কর্মকান্ড আগের চেয়ে আরও বাড়ায়। এমতাবস্থায় হুট করে সেই যুবকটির হাত গিয়ে আঘাত করে তার সামনে থাকা রেডিওকে। বদলে যায় চলতে থাকা চ্যানেল। বাজতে থাকে বাংলাদেশের মানুষদেরকে যুদ্ধে সাহস দেয়া এক গান-
জয় বাংলা, বাংলার জয়।
এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আমাদের দেশের স্বাধীনতাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এটি ন্যায়ের লড়াই। এই লড়াইয়ে স্বাধীনতা আসবেই। যতই ধামা চাপা দিয়েই রাখা হোক কিংবা রেডিও দিয়ে প্রচারণা করা হোক না কেন, মুক্তি আসবেই।
সেই সেলুনে এসে হাজির হয় পাকিস্তানী বাহিনী। তারা খোঁজ করে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের। এখানে মুক্তিবাহিনীর সদস্য রয়েছে কিনা তা জানতে চায় তারা। এখানকার বিহারীরা সবাই জানেন এই যুবকটিই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক। অন্যসব বিহারীদের মতো তারা কি বলে দেবে, এই যুবককে ধরে নিয়ে যান, এ দেশদ্রোহী? বলে দেয়াটাই হয়তো স্বাভাবিক। কেননা, তারা নিজেরাও আলাপ করছিলেন এদেশের মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধেই।
কিন্তু না। তারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাঁচিয়ে দেন সেই যুবককে। তারা বলেন, সেখানে থাকা সবাই বিহারী-মুসলিম ভাই। কোনো মুক্তিবাহিনীর সদস্য নেই। বিখ্যাত পরিচালক রোমান পোলনস্কির ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ (২০০২) সিনেমায়ও আমরা একই চিত্র দেখেছিলাম। একজন নাৎসি অফিসার একজন ইহুদী সঙ্গীত শিল্পীকে বাঁচাতে সাহায্য করেন।
এখানেই একটি বড় প্রশ্নের সমাধান করেছেন তারেক মাসুদ। বিহারীরা পাকিস্তানের সমর্থন করলেও সবাই তো তা করেননি। তাহলে আমরা কেন সব বিহারীদের মুক্তিযুদ্ধের শত্রু মনে করবো? এই যুক্তির অসারতা দেখাতে চেয়েছেন তারেক মাসুদ তার নরসুন্দর শর্টফিল্মে। এর মাধ্যমে তিনি চিন্তার গোঁড়ামি থেকে বেরিয়ে আসার চেতনাকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেন।
একটি ব্যাপার এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। এই শর্টফিল্মটির খরচের টাকা দিয়েছিলেন রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরী মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট বা ‘রামরু’। এটি একটি সংস্থা যারা মূলত অভিবাসী কিংবা আটকে পড়া উদ্বাস্তু মানুষদের নিয়ে কাজ করে। বাংলাদেশে বন্দী বিহারীদের নিয়েও কাজ করেছেন তারা। তাদের দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণ দিতে কাজ করে যাচ্ছে রামরু। তারেক মাসুদ তার এই শর্টফিল্মে বিহারীদের পক্ষে কথা বলেন। তবে সেটি একটি তীক্ষ্ণ উপায়ে।
এই শর্টফিল্মটির আরও একটি মহান বার্তা হচ্ছে আমাদের ভিতরে লুক্কায়িত থাকা অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। যেটি আমাদের উপমহাদেশের যেকোনো সংগ্রামের ক্ষেত্রেই অন্যতম এক চালিকা শক্তি ছিলো। যার অভাবে আজও এখানে মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। হামলা হচ্ছে গীর্জা কিংবা মসজিদ-মন্দিরে।