১৬ই ডিসেম্বরের সোনালী বিকেল, সারা দেশে মুক্তির মিছিল, শিকল ভাঙ্গার আনন্দে ছেয়ে গেছে পুরো দেশ। ১৯৪৭ সালে বাঙ্গালির পায়ে যে শিকল পড়ানো হয়েছিলো, ৩০ লক্ষ রক্তের বন্যায় ভেসে গেছে সে শিকল। চট্টগ্রাম শহরেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি, বিজয়ের উল্লাস চলছে। সেই উল্লাসে হুট করেই যোগ দিলো একদল তিব্বতিয়। সাধারণ মানুষ তো বটেই, মিত্রবাহিনীর ভারতীয় সেনারাও বেশ অবাক চোখে তাকিয়ে তাদের দেখতে লাগলো। অনেকের মনেই প্রশ্ন চট্টগ্রামে তিব্বতিয় নাগরিক এলো কোথা থেকে? তা-ও গেরিলা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে? অনেক প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই যেভাবে উদয় ঠিক সেভাবেই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো এই গেরিলারা। কিন্তু বেঁচে রইলো তাদের বীরত্ব নিয়ে অনেক কিংবদন্তী। অনেকেই এদের নাম দিলো চট্টগ্রামের ভূত। ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া ‘র এক লেখনীতে সাংবাদিক মানস পাল এদের নাম দিলেন ‘The Phantoms of ’71’। কিন্তু এই ভূতের দলের নেপথ্যে আসলে কারা?
সময়টা ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর, পার্বত্য চট্টগ্রামের হাড়ে কাঁপন ধরানো শীতের রাতে ক্যাম্পের অদূরে বসে আছে এক পাকিস্তানি স্নাইপার। হুট করেই অশরীরী আত্মার মত ক্যাম্পের আশেপাশে কারো নড়াচড়া অনুভব করেই গুলি চালালো সে। নিশঃব্দে সেই গুলি আঘাত করলো পৃথিবীর গোপনতম এক গেরিলা সংগঠনের সদস্যের গায়ে। পাকিস্তানি স্নাইপার তখনো টের পায়নি, কারণ গুলি হজম করেও টু শব্দটিও করেনি সেই গেরিলা সেনা। রেডিওর উপারে বসে থাকা কমান্ডারকে শুধু জানিয়ে দিলো আমি আর পারছি না। কমান্ডারও নির্ভীকভাবে বাকিদের নির্দেশ দিতে শুধু দুটি বাক্য ব্যয় করলেন, “Push ahead”।
বাকিটা গল্পের চেয়েও ভয়ানক। বুলগেরিয়ান একে-৪৭ আর তিব্বতিয় ছোরা হাতে নিমিষের মধ্যে পাকিস্তানিদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে একদল গেরিলা। এমনই অতর্কিত আক্রমণ করে কিছু বুঝে উঠার আগেই আবার কোথাও হারিয়ে গেলো এই গেরিলা দল। পার্বত্য চট্টগ্রামের পকিস্তানি সেনাদের উপরে এমনই একের পর এক অতর্কিত আক্রমণ করে অনেকটাই নাজেহাল করে দেয় এই ‘Phantoms of Chittagong’।
নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে অনেক গেরিলা অপারেশন হয়েছে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে নানাভাবে নাজেহাল করেছে বাঙ্গালি মুক্তিবাহিনী। বাঙ্গালি মুক্তিবাহিনীর সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে যোগ দেয় ভারতের ‘স্পেশাল ফ্রন্ট্রিয়ার ফোর্স’ যেটি সংক্ষেপে ‘SFF’ নেমে পরিচিত। মূলত ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইং’ বা ‘RAW’ এর অধীনে এরা কাজ করে থাকে। বাংলাদেশের চরম দুর্দিনে মুক্তিবাহিনীর পাশে এসে দাঁড়ায় এই স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স। মুক্তিবাহিনীর কাধে কাধ মিলিয়ে চালাতে থাকে একের পর এক বিধ্বংসী অপারেশন। পার্বত্য অঞ্চলে পাকিস্তানী সেনাদের উপর মরণকামড় দেওয়ার এই অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘Operation Mountain Eagle’। এদের আক্রমণের দ্রুততা আর প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অকুতোভয় চরিত্র পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে এদেরকে এক ত্রাসের প্রতিশব্দ করে তোলে।
মুক্তিযুদ্ধে কীভাবে অংশগ্রহণ করেছিলো এই স্পেশাল ফ্রন্ট্রিয়ার ফোর্স ?
কাঠমুন্ডুভিত্তিক রিভিউ ম্যগাজিন Himal Southasian এর গবেষক থাসি ডুন্ডাপ এর মতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সকে চিঠি লিখেছিলেন। বিশেষায়িত এই গেরিলা বাহিনীর কাছে ইন্দিরা গান্ধীর লেখা চিঠিটির ভাষ্য ছিলো–
“We cannot compel you to fight a war for us, but the fact is that General AAK Niazi is treating the people of East Pakistan very badly, the same way the Chinese are treating the Tibetans in Tibet. India has to do something about it. It would be appreciated if you could help us fight the war for liberating the people of Bangladesh.”
ভারতীয় বাহিনীতে তিব্বতিয় গেরিলা কেন?
গল্পটা এবার অন্য প্রান্ত থেকে শুরু করা যাক। ষাটের দশকে তিব্বতের নিত্যদিনের সঙ্গী ছিলো অস্থিরতা। চীনের আগ্রাসনের মুখে তিব্বতের প্রধান ধর্মগুরু দালাই লামা আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতে। তার সাথে তিব্বত থেকে বিতাড়িত হয় অনেক সাধারণ তিব্বতিয় নাগরিকও, যাদের অনেকেই ভারতে আশ্রয় নেয়।
১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের পর ওড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী বিজু পাটনাইক প্রস্তাব দিলেন তিব্বত থেকে বিতাড়িত এই যুবকদের নিয়ে গঠন করা যেতে পারে বিশেষায়িত গেরিলা ইউনিট। বিজু পাটনাইক এককালে নিজেও ছিলেন দুধর্ষ পাইলট। তাই তার প্রস্তাবকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে ভারতীয় সরকার। ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর তৎকালীন প্রধান ভোলানাথ মল্লিকের কাঁধে এই বাহিনী গঠনের দায়িত্ব পড়ে। ১৯৬২ সালের ১৪ নভেম্বর তার নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স’, যেটি ‘Establishment 22’ নামেও পরিচিত ছিলো।
অপারেশন মাউন্টেন ইগল
১৯৭১ বাংলাদেশে মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়েছে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গণহত্যা আর নৃশংসতার বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়েছে। বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়া সহ বিভিন্ন ধরনের সহায়তা পেয়েছে বাংলদেশের মুক্তিকামী যোদ্ধারা।
সময়ের পরিক্রমা পাড়ি দিয়ে ‘স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স’ ততদিনে বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘RAW’ এর অধীনে বিভিন্ন মিশনে কাজ করে বেশ দক্ষতা আর ক্ষীপ্রতার প্রমাণ দিয়েছে এই তিব্বতিয় যুবারা। ১৯৬২ সালে জন্ম নেওয়া এই গেরিলা সংগঠন ততদিনে হঁটি হাঁটি পা পা করে মোট আটটি ব্যাটালিয়নে পৌঁছেছে। সাথে আছ বুলগেরিয়ান একে-৪৭ সহ নানা ধরনের অত্যাধুনিক গেরিলা অস্ত্র।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে স্পেশাল ফ্রন্ট্রিয়ার ফোর্সের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল সুজান সিং উবান।ইন্দিরা গান্ধির কাছ থেকে অনুরোধপত্র পাওয়ার পরেই তিনি ফোর্সের নেতৃস্থানীয় বাকিদের সাথে আলোচনা করে ঐক্যমতে পৌছান যে বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের পাশে এসে তারা দাঁড়াচ্ছেন।
অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে, তিন হাজারের অধিক স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের কমান্ডোকে মিজোরামের ডেমাগিরিতে নিয়ে আসা হয়। কর্ণফুলী পাড়ি দিয়েই দুর্গম পাহাড়ি পথে মিজোরাম থেকে প্রবেশ করা যায় পার্বত্য চট্টগ্রামে। মূলত এভাবেই পাকিস্তানী বাহিনীকে লক্ষ্য করে ‘hit-and-run raids’ অপারেশন সাজাতে থাকে এই গেরিলারা। কর্ণফুলি পাড়ি দিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলে ঢুকে পাকিস্তানী বাহিনীর উপর অতর্কিত আক্রমণ করে আবারো ডেমাগিরিতে গা ঢাকা দিতো এই গেরিলারা। ফলে এদের অস্তিত্ব সম্পর্কে ঘুণাক্ষরে টের পেতো না পাকিস্তানী হানাদারেরা। আর এভাবেই অনেকটা ভূতুড়ে আক্রমণ করে পাহাড়ি এলাকার ভূতুড়ে গেরিলা বা ‘Phantoms of Chittagong’ নামে খ্যাতি পায় স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সদস্যরা।
নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে তিব্বতিয় গেরিলারা পাকিস্তানী বাহিনীকে মরণকামড় দেওয়ার জন্যে ডুন্ডাপ গিয়াৎসুর নেতৃত্বে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে প্রবেশ করে। নয়টি নৌকাভর্তি গেরিলারা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পার্বত্য অঞ্চলের গভীরে। যুদ্ধের একপর্যায়ে ডুন্ডাপ গিয়াৎসু প্রাণ হারান। এরপরই গেরিলারা সরাসরি যোগাযোগ করেন মেজর জেনারেল উবানের সাথে। তার সহজ সরল নির্দেশটি ছিলো, “Push ahead”।
মূলত চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীকে মোকাবেলা করার দায়িত্বে ছিলো পাকিস্তানের ৯৭তম ইডিপেন্ডেন্ট বিগ্রেড আর দ্বিতীয় এসএসজি কমান্ডো ব্যাটালিয়ন। বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এই দুই দলের ধারণার বাইরে ছিলো কী পরিমাণ অতর্কিত আক্রমণ হতে পারে তাদের উপর। যোগাযোগের সকল রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তানী কমান্ডোরাও দিশেহারা হয়ে পড়ে।
মুক্তিযুদ্ধে কম ঝরেনি তিব্বতিয়দের রক্ত
পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় পকিস্তানী বাহিনীর সাথে যুদ্ধে কম রক্ত ঝরেনি ভূতুড়ে গেরিলাদের। প্রায় ৯০ জন গেরিলা প্রাণ হারিয়েছেন। অপারেশন মাউন্টেন ঈগলের সাথে জড়িত প্রায় ১৯০ জন আহত হয়েছেন যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে।
১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমপর্ণের সংবাদের আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে রাস্তায় নেমে উল্লাস শুরু করেন এই গেরিলা দলের সদস্যরা। তাদের দেখে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। স্বয়ং ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনেকেই স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স সদস্যদের যুদ্ধে যুক্ত থাকার কথা জানতেন না। মেজর জেনারেল সুজান সিং উবানের কাছে সংবাদ গেলে তিনি তৎক্ষণাৎ তাদের আবারো তাদের আস্তানায় ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। শুধু কিংবদন্তী হয়েই বেঁচে রইলেন এই তরুণ ভূতুড়ে গেরিলাদলের সদস্যরা।
সম্মান আর স্বীকৃতি
তিব্বত থেকে নির্যাতিত আর নিপীড়িত হয়ে কিছু যুবক আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতে, ইন্দিরা গান্ধী তার চিঠিতে এই যুবকদেরকেই বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিব্বতের এই ঘরছাড়া যুবকেরা বুকের রক্ত দিয়ে নিঃস্বার্থ এক উপাখ্যান লিখে গেছেন। বাংলাদেশের মানুষকে সহায়তা করেও অনেকটাই নিভৃতে থেকে গেছেন তারা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করায় ভারত সরকার স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের ৫৮০ জনকে বিশেষ সম্মাননা দেয়। বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে প্রাণ দিয়ে যাওয়া এই মানুষগুলোর স্মৃতির চির অম্লান থাকবে আমাদের হৃদয়ে, তাদের প্রতি রইলো আকণ্ঠ শ্রদ্ধা।
“উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ,
‘ ভয় নাই , ওরে ভয় নাই —
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই ।”