১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলার চেষ্টা করে এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই ‘পূর্ব পাকিস্তান সমস্যা’র সমাধানের চেষ্টা করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের দক্ষিণ এশীয় মিত্র রাষ্ট্র ভারত নিজস্ব ভূরাজনৈতিক স্বার্থে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে আগ্রহী ছিল, কিন্তু ১৯৭১ সালের জুন পর্যন্ত মস্কো পাকিস্তানের ভৌগোলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘন করতে ইচ্ছুক ছিল না। ১৯৭১ সালের জুলাইয়ে পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় চীনা–মার্কিন মৈত্রীর সূত্রপাত হলে দক্ষিণ এশিয়াসহ সমগ্র বিশ্বের কৌশলগত ভারসাম্যে পরিবর্তন আসে এবং এর ফলে মস্কোর পক্ষে এই সঙ্কটে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা ক্রমশ কঠিন হয়ে ওঠে।
চীনা–মার্কিন দাঁতাতের পর ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেকে একটি দুর্বল অবস্থানে আবিষ্কার করে এবং এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য ১৯৬৯ সালে সোভিয়েত–প্রস্তাবিত ‘এশীয় যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা’কে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। মস্কো এটিকে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার এবং সম্ভাব্য ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ রোধের একটি চমৎকার উপায় হিসেবে বিবেচনা করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই গ্রোমিকো ও ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং ভারতের নয়াদিল্লিতে ২০ বছর মেয়াদী ‘ভারতীয়–সোভিয়েত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি’তে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির মাধ্যমে মাধ্যমে ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের ভারত সফরের পর থেকে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে ‘অনানুষ্ঠানিক’ মৈত্রী স্থাপিত হয়েছিল, সেটি আনুষ্ঠানিক রূপ লাভ করে।
এই চুক্তিটির ৮ নং ধারা অনুযায়ী ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পরস্পরের বিরোধী কোনো সামরিক জোটে যোগদান থেকে বিরত থাকার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় এবং ৯ নং ধারা অনুযায়ী ভারত বা সোভিয়েত ইউনিয়ন তৃতীয় কোনো পক্ষের দ্বারা আক্রান্ত হলে উক্ত হুমকি প্রতিহত করার জন্য উভয় পক্ষ তৎক্ষণাৎ পরস্পরের সঙ্গে আলোচনায় লিপ্ত হবে বলে একমত হয়। এই চুক্তিটিকে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পূর্ণরূপে ‘আত্মরক্ষামূলক’ এবং ‘তৃতীয় কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে’ নয় বলে অভিহিত করে। কিন্তু ওয়াশিংটন, পিকিং ও ইসলামাবাদে এই চুক্তিটিকে চীনা–মার্কিন–পাকিস্তানি জোটের বিরুদ্ধে সম্পাদিত একটি চুক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পাকিস্তানি প্রচারমাধ্যমে চুক্তিটিকে ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় আগ্রাসনের ছাড়পত্র’ হিসেবে বর্ণনা করা হয় এবং পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো চুক্তিটিকে চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘আক্রমণাত্মক চুক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
অন্যদিকে, ভারতের মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট দলগুলো থেকে শুরু করে হিন্দুত্ববাদী দলগুলো পর্যন্ত এই চুক্তিকে স্বাগত জানায়, এবং সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই গ্রোমিকো এই চুক্তি ভারতীয়–সোভিয়েত সম্পর্কে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করবে বলে উল্লেখ করেন। কলকাতাকেন্দ্রিক প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারও এই চুক্তিটিকে স্বাগত জানায়, কারণ এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সোভিয়েত মনোভাবে পরিবর্তন ঘটবে বলে তারা আশা করেছিল।
কিন্তু মস্কো তখনো পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার ব্যাপারে রাজি ছিল না এবং তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার চেষ্টা করে। গ্রোমিকোর ভারত সফরের সময় ভারতীয় কর্মকর্তারা তাকে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে অবস্থিত বাঙালি শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করার প্রস্তাব করেন, কিন্তু গ্রোমিকো তাতে অস্বীকৃতি জানান। ১৯ আগস্ট জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে জাতিসংঘে স্থায়ী সোভিয়েত প্রতিনিধি ইয়াকভ মালিক পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে সোভিয়েত ইউনিয়নের মনোভাব পুনর্ব্যক্ত করেন এবং পাকিস্তানকে পূর্ব পাকিস্তানে শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির আহবান জানান।
পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। ১৯৭১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি পররাষ্ট্র সচিব সুলতান মুহাম্মদ খান মস্কো সফর করেন এবং সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রোমিকোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। গ্রোমিকো তাকে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাকে যত দ্রুত সম্ভব রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার পরামর্শ দেন এবং ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো হঠকারিতা থেকে বিরত থাকতে আহবান জানান। ১৫ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের রাজা জহির শাহ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন এবং তার সফর শেষে প্রদত্ত সোভিয়েত–আফগান যৌথ বিবৃতিতেও পাকিস্তানকে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধানের আহবান জানানো হয়। ২০ সেপ্টেম্বর গ্রোমিকো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গে বৈঠককালে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পাকিস্তানের ওপরে চাপ প্রয়োগ করতে বলেন। কিন্তু মার্কিনিরা পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে আগ্রহী ছিল না এবং এর ফলে বৈঠকটি ব্যর্থ হয়।
বস্তুত পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে ওয়াশিংটনের কোনো আগ্রহ ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের উপায় ছিল দুইটি– ১৯৭০ সালে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা, অর্থাৎ আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা, নয়তো বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেওয়া। কিন্তু মস্কোর প্রতি সহানুভূতিশীল এবং মার্কিন সামরিক জোট থেকে পাকিস্তানকে প্রত্যাহার করে নিতে আগ্রহী আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা কিংবা পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার ক্ষেত্রে সরাসরি জড়িত থাকা– এর কোনোটাতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ছিল না।
এমতাবস্থায় বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সৈন্যদের নিরবচ্ছিন্ন নির্যাতন এবং মস্কোর পরামর্শ সত্ত্বেও সমস্যাটি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে ইসলামাবাদের অনীহা সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিরক্ত করে তোলে। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে ভারতীয়–সমর্থিত বাংলাদেশি গেরিলাদের সংঘর্ষ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং মস্কো আশঙ্কা করছিল যে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর সম্ভাবনা ক্রমাগত বাড়ছে। এক্ষেত্রে ভারতকে সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে মস্কো ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীকে অত্যাধুনিক সোভিয়েত অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতে শুরু করে। ১৯৭১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত কূটনীতিবিদ ও নিরস্ত্রীকরণ বিশেষজ্ঞ সেমিয়ন ৎসারাপকিন নয়াদিল্লি সফর করেন এবং ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীকে সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তোলার ব্যাপারে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সাথে বিশদ আলোচনা করেন।
এমতাবস্থায় ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষদিকে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার ক্ষেত্রে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মস্কো সফরে যান। ২৮ সেপ্টেম্বর তার উদ্দেশ্যে প্রদান করা অভ্যর্থনাসূচক ভাষণে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন মন্তব্য করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কার্যকলাপ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় এবং পাকিস্তানি সরকারের উচিত পূর্ব পাকিস্তানি জনসাধারণের ‘ন্যায়সঙ্গত’ স্বার্থকে বিবেচনায় রেখে সমস্যাটির একটি রাজনৈতিক সমাধান করা। পরবর্তীতে ভারতীয় প্রচারমাধ্যমকে প্রদান করা এক সাক্ষাৎকারে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার কথা উল্লেখ করে সরাসরি বলেন, ‘যারা এ ধরনের নৃশংসতা চালিয়েছে তারা কখনো আমাদের সমর্থন পাবে না। আমাদের সহানুভূতি পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতি।’
ইন্দিরা গান্ধীর সফর শেষে ভারতীয়–সোভিয়েত যৌথ বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এবং শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য পাকিস্তানকে আহবান জানানো হয়। উল্লেখ্য, এই বিবৃতিতেও ‘বাংলাদেশ’ বা ‘পূর্ববঙ্গ’ নামটি ব্যবহার না করে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামটি ব্যবহৃত হয়, যেটি ইঙ্গিত করে যে, তখনো মস্কো পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ভারতীয় পরিকল্পনার প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রদান করেনি।
২৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রোমিকো পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি কার্যকলাপের ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় বিরাজমান গুরুতর পরিস্থিতির প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং মন্তব্য করেন যে, পরিস্থিতি এরকম চলতে থাকলে এটি আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় থাকবে না। এর মাধ্যমে মস্কো পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট নিরসন করার জন্য পাকিস্তানের প্রতি চাপ বৃদ্ধি করার প্রয়াস পায়। কিন্তু পাকিস্তান এতে ক্ষিপ্ত হয় এবং ১৯৭১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের রাষ্ট্র–নিয়ন্ত্রিত ‘পাকিস্তান টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয়তে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভারতের প্রতি ‘অন্ধ পক্ষপাতিত্বে’র দায়ে অভিযুক্ত করা হয়।
১৯৭১ সালের অক্টোবরে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সোভিয়েত প্রচারমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা আরম্ভ করে। এর আগ পর্যন্ত সোভিয়েত রাষ্ট্র–নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যম পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি নিষ্পেষণের পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরেনি এবং এর ফলে সোভিয়েত জনসাধারণ পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখায়নি, যেমনটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণ দেখিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘প্রাভদা’ পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে একটি বিস্তৃত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে ভারতে অবস্থানরত বাঙালি শরণার্থীদের দুর্দশা, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ এবং ২৫ মার্চে ঢাকায় সংঘটিত গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়।
এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের জনসাধারণ পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের গৃহীত নীতির প্রতি তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে প্রথম সপ্তাহে সোভিয়েত ট্রেড ইউনিয়নসমূহ, সোভিয়েত শান্তি সমিতি, সোভিয়েত আফ্রো–এশীয় সংহতি সমিতি, সোভিয়েত মহিলা সমিতি এবং অন্যান্য সোভিয়েত জনসংগঠন তাদের নিজ নিজ বিবৃতিতে পূব পাকিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতি তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থ অনুসারে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের দাবি জানায় এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য গণতন্ত্রী নেতাকে মুক্তি দেয়ার জন্য পাকিস্তানি সরকারকে আহবান করে। মস্কোর শিল্প শ্রমিকরা জনসভার আয়োজন করে এবং সেগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানিদের ওপর নিষ্পেষণ বন্ধের ও শেখ মুজিব ও অন্যান্য রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়ার দাবি জানায়।
১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর সোভিয়েত–আলজেরীয় যৌথ বিবৃতিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আলজেরিয়া ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের ‘জাতীয় ঐক্য ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা’র প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং ‘তাসখন্দ চুক্তি’র মর্ম অনুসারে উভয় পক্ষের মধ্যেকার সমস্যা সমাধানের আহবান জানায়। এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন তখনো পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্য পুরোপুরি পরিত্যাগ করেনি। কিন্তু মস্কো পাকিস্তানের ওপরে চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে।
১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর প্রাভদায় ‘সঙ্কটের মূল’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয় এবং এটিতে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কটের জন্য পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচারকে দায়ী করা হয়। এই নিবন্ধে ‘রাষ্ট্রদ্রোহে’র অপরাধে শেখ মুজিবের বিচার করার জন্য গৃহীত পাকিস্তানি সরকারের সিদ্ধান্তকে একটি ‘বিচার বিভাগীয় প্রতিশোধ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে তাসখন্দ, মিনস্ক, কুইবিশেভ (বর্তমান সামারা) ও আলমা-আতা (বর্তমান আলমাতি) সহ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন শহরে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি নির্যাতন এবং প্রগতিশীল নেতাদের প্রতি জুলুমের বিরুদ্ধে সোভিয়েত জনসাধারণ আলোচনা সমাবেশ ও মিছিল বের করে।
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করে নেয়া জরুরি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একটি একদলীয় রাষ্ট্র এবং সেখানকার প্রচারমাধ্যম ছিল রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত, সুতরাং সোভিয়েত জনসাধারণ পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল সেটি সোভিয়েত সরকার কর্তৃক আয়োজিত ছিল কিনা এ ব্যাপারে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু ১৯৭০–এর দশকেও কমিউনিস্ট সমাজব্যবস্থায় বেড়ে ওঠা সোভিয়েত জনসাধারণের বড় একটি অংশ বিশ্বাস করত যে, তাদের দেশ সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত জনগণের পক্ষে লড়াই করছে এবং এজন্য ভিয়েতনাম, ফিলিস্তিন, মিসর কিংবা পূর্ব পাকিস্তানের ‘নিপীড়িত’ জনসাধারণের প্রতি তাদের সহানুভূতি ছিল বহুলাংশেই স্বতঃস্ফূর্ত।
১৯৭১ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে ইসলামাবাদ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে ভারতীয় সীমান্তের নিকটে পাকিস্তানি সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। এমতাবস্থায় অক্টোবরের শেষদিকে নয়াদিল্লি ও মস্কো ভারতীয়–সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির ৯ নং ধারা কার্যকর করে এবং পারস্পরিক আলোচনায় লিপ্ত হয়। সোভিয়েত উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরিয়োবিন নয়াদিল্লি সফর করেন এবং ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বিপজ্জনক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। এসময় তিনি অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন এবং তাদেরকে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনে’র ভিত্তিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যেই থেকে যাওয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা তো বটেই, এমনকি মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরাও আর পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে রাজি ছিল না এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ ছাড়া অন্য কোনো সমাধান মেনে নিতে আগ্রহী ছিল না।
একই সময়ে সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেঝনেভ ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস সফর করেন এবং সেখানে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় পাকিস্তানকে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার আহবান জানান। অন্যদিকে, ইরানের তেহরানে সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান নিকোলাই পদগর্নি ও পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান সাক্ষাৎ করেন এবং পদগর্নি পাকিস্তানের দুই অংশের ঐক্য রক্ষার জন্য পাকিস্তানে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, শেখ মুজিবকে মুক্তিদান এবং পূর্ব পাকিস্তানে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের পরিস্থিতি সৃষ্টির পরামর্শ দেন। ২৭ অক্টোবর সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের কানাডার রাজধানী অটোয়া সফর শেষে সোভিয়েত–কানাডীয় যৌথ বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করার এবং উভয় পক্ষকে সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের আহবান জানানো হয়।
এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাকে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের জন্য মস্কোর সর্বশেষ প্রচেষ্টা। বস্তুত, ১৯৭১ সালের নভেম্বেরের প্রথম দিকে মস্কো অনুধাবন করে যে, এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান আর সম্ভব নয়। পাকিস্তান বা বাংলাদেশ কোনো পক্ষই একে অপরকে কোনো ধরনের ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিল না। বিশেষত পাকিস্তানের ধারণা ছিল যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সম্ভাব্য যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নেবে এবং এজন্য মস্কোর সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা করতে তারা অনীহা প্রকাশ করে। তদুপরি, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে একটি পাকিস্তানি প্রতিনিধি দল চীন সফরে যায় এবং সেখান থেকে ফিরে ভুট্টো পাকিস্তানি সরকারকে জানান যে, সম্ভাব্য ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধে চীন পাকিস্তানকে সর্বতোভাবে সহায়তা করবে। এর ফলে পাকিস্তানি সরকারের মনোভাব আরো দৃঢ় হয় এবং সমঝোতার পরিবর্তে যুদ্ধকে তারা পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা সমাধানের একমাত্র পন্থা হিসেবে গ্রহণ করে।
এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রচার মাধ্যমগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার আহবান জানানো অব্যাহত থাকে, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন বুঝতে পারে যে, নতুন একটি ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধের সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত। এজন্য তারা ভারতের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা ও পর্যালোচনা অব্যাহত রাখে এবং ভারতে সোভিয়েত অস্ত্রের প্রবাহ নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সোভিয়েত বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল পাভেল কুতাখভ নয়াদিল্লি সফর করেন। পাকিস্তান তাকে বহনকারী বিমানটিকে নিজ আকাশসীমায় ঢুকতে দেয়নি, ফলে তাকে ইরানের আকাশসীমা হয়ে ঘুরপথে ভারতে আসতে হয়। স্বভাবতই এই ঘটনা মস্কোকে পাকিস্তানের ওপরে আরো ক্ষুব্ধ করে তোলে।
নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশি যোদ্ধাদের তীব্র লড়াই শুরু হয় এবং সোভিয়েত সমর্থন পেয়ে ভারত ‘মুক্তি বাহিনী’কে ব্যাপক হারে সহায়তা প্রদান করতে থাকে। সোভিয়েত প্রচারমাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর সাফল্য প্রচারিত হয় এবং প্রথমবারের মতো ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৯ নভেম্বর ‘প্রাভদা’ পত্রিকার ধারাভাষ্যকার ওলেগ ওরেস্তভ মার্কিন গণমাধ্যমে চলমান ভারতবিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী বিবৃতিকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেন এবং সৃষ্ট যুদ্ধাবস্থার জন্য পাকিস্তানি সরকারের কার্যকলাপকে দায়ী করেন।
২১ নভেম্বর থেকে ভারতীয় সৈন্যরা সরাসরি বাংলাদেশি সৈন্যদের সমর্থন প্রদান করতে শুরু করলে পূর্ব পাকিস্তান–ভারত সীমান্তে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয় এবং পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। পাকিস্তান চীনের সহায়তা লাভের আশা করলেও বাস্তবে এসময় চীনের পক্ষে পাকিস্তানকে সরাসরি সামরিকভাবে সহায়তা করা সম্ভব ছিল না। কারণ, তখন শীতকাল হওয়ায় হিমালয় পর্বতমালার গিরিপথগুলো বরফাচ্ছন্ন হয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং এর মধ্য দিয়ে চীনের পক্ষে ভারতকে আক্রমণ করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া, ১৯৭১ সালে ভারত ১৯৬২ সালের মতো অপ্রস্তুত ছিল না এবং চীন–ভারত সীমান্ত জুড়ে সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছিল। তদুপরি, ভারতে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত নিকোলাই পেগভ ভারতীয় সরকারকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, চীনা–সোভিয়েত সীমান্তে ৪৪ ডিভিশন সৈন্য মোতায়েনকৃত অবস্থায় আছে এবং চীন ভারত আক্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনের জিনজিয়াং ও মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলে আক্রমণ করবে।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বিমানবাহিনী ভারতের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন চেঙ্গিজ খান’ পরিচালনা করে এবং উত্তর ও পশ্চিম ভারতে অবস্থিত ভারতীয় বিমানবাহিনীর ঘাঁটিগুলো আক্রমণ করে। ১৯৬৭ সালের ৫ জুন ইসরায়েলি বিমানবাহিনী ‘অপারেশন ফোকাস’ পরিচালনা করে মিসরীয়, সিরীয় ও জর্দানীয় বিমানবাহিনীকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়েছিল এবং এর ফলে মাত্র ৬ দিনের মধ্যে তিনটি আরব রাষ্ট্রকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। পাকিস্তানের ৩ ডিসেম্বরের আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল অনুরূপভাবে ভারতীয় বিমানবাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়া। কিন্তু পাকিস্তানি বিমানবাহিনী থেকে পালিয়ে এসে যেসব বাঙালি বৈমানিক মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল, তাদের কাছ থেকে ভারতীয়রা পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পেরেছিল, এজন্য তারা তাদের বিমানগুলো নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রেখেছিল এবং পাকিস্তানিরা এই আক্রমণে মাত্র ৫০টি বিমান ব্যবহার করেছিল (যেখানে ইসরায়েলিরা ব্যবহার করেছিল প্রায় ৪০০টি বিমান)।
এর ফলে পাকিস্তানি আক্রমণটি উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয় এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ আরম্ভ হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে এই যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং তৃতীয় কোনো শক্তিকে এই যুদ্ধে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকার জন্য সতর্ক করে দেয়। ৪, ৬ এবং ১৩ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও চীনের উদ্যোগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অবিলম্বে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির জন্য তিনটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, কিন্তু এতে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের কোনো উল্লেখ নেই – এই কারণ দেখিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রত্যেক বার এই প্রস্তাবে ভেটো প্রদান করে। অন্যদিকে, যুদ্ধ বন্ধের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ড নিরাপত্তা পরিষদে যে প্রস্তাবগুলো উত্থাপন করে, সেগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীন ভেটো প্রদান করে। সোভিয়েত প্রস্তাবগুলোতে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানকে যুদ্ধবিরতির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। বস্তুত, সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল উদ্দেশ্য ছিল সময়ক্ষেপণ করা, যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীন কোনো পদক্ষেপ নেয়ার আগেই ভারতীয় ও বাংলাদেশি সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হয়।
ভারত ও বাংলাদেশের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনের ফলে চীন সোভিয়েত ইউনিয়নের তীব্র নিন্দা জানায়। জাতিসংঘে চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি হুয়াং হুয়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের দায়ে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে অভিযুক্ত করেন, ভারতের শরণার্থী সমস্যা ভারতের নিজেরই সৃষ্টি বলে অভিযোগ করেন এবং বাংলাদেশকে ১৯৩০–এর দশকে উত্তর–পূর্ব চীনে সৃষ্ট জাপানি পুতুল রাষ্ট্র মাঞ্চুকুয়োর সঙ্গে তুলনা করেন। সোভিয়েত প্রতিনিধি ইয়াকভ মালিক এর তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং ভারতে অবস্থানরত প্রায় ১ কোটি বাঙালি শরণার্থী পাকিস্তানি নির্যাতনের কারণে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন। তিনি আরো উল্লেখ করেন, ভারতে অবস্থানরত বাঙালি শরণার্থীদের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি, যা জাতিসংঘের ৮৮টি সদস্য রাষ্ট্রের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি, সুতরাং নিজেদের জন্য এত বড় সমস্যা তৈরি করার ভারতের কোনো প্রয়োজন ছিল না। বাংলাদেশকে পুতুল রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করার জবাবে তিনি চীনাদেরকে জনগণের অধিকার পদদলিত করে রাখা পাকিস্তানি সমরবাদীদের ‘লোহার বুটজুতো লেহনে’র দায়ে অভিযুক্ত করেন।
১০ ডিসেম্বর ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা জানতে পারে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭ম নৌবহর টনকিন উপসাগর থেকে বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রা করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম জাহাজ, ৭৫,০০০ টন ওজনবিশিষ্ট, পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী জাহাজ ‘ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ’ ছিল এই নৌবহরটির শীর্ষ জাহাজ এবং এটিতে ৭০টির বেশি যুদ্ধবিমান ছিল। সব মিলিয়ে মার্কিন নৌবহরটিতে ২০টি জাহাজ ছিল।
সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটিশ বিমানবাহী জাহাজ ‘এইচএমএস ঈগল’–এর নেতৃত্বে একটি ব্রিটিশ নৌবহরও আরব সাগরে ভারতীয় জলসীমার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। সত্যিকার অর্থে মার্কিন ও ব্রিটিশ নৌবহর কেন বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল যে সম্পর্কে কারো কোনো বাস্তব ধারণা ছিল না। তবে ভারতীয় ও সোভিয়েতদের ধারণা ছিল, পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করার জন্যই ইঙ্গ–মার্কিন নৌবহর অগ্রসর হচ্ছিল। এই ঘটনাটি সম্পর্কে ভারতীয় বিশ্লেষক রাকেশ কৃষ্ণান সিমহা মন্তব্য করেছেন, ভাগ্যের পরিহাসে বিশ্বের শীর্ষ দুই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন) একটি গণহত্যাকারী সামরিক সরকারকে (পাকিস্তান) রক্ষা করার জন্য বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে (ভারত) ভীতি প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
প্রত্যুত্তরে ১৩ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌঘাঁটি ভ্লাদিভোস্তক থেকে সোভিয়েত নৌবাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের ‘১০ম অপারেটিভ ব্যাটল গ্রুপ’ ভারত মহাসাগর অভিমুখে যাত্রা করে। অ্যাডমিরাল ভ্লাদিমির ক্রুগ্লিয়াকভের নেতৃত্বাধীন এই পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত নৌবহরটিতে ২৬টি জাহাজ ও ডুবোজাহাজ ছিল। সোভিয়েত সামরিক পত্রিকা ‘ক্রাসনায়া জভেজদা’য় সোভিয়েতরা ইঙ্গ–মার্কিন জোটকে সতর্ক করে দেয় এই বলে যে, ভারত মহাসাগর কোনো মার্কিন হ্রদ নয়!
কিন্তু সোভিয়েত জাহাজগুলোতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকলেও তাদের ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর সীমা ছিল ৩০০ কিলোমিটারের কম। এজন্য তারা একটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয় এবং ইঙ্গ–মার্কিন জাহাজগুলোকে নিজেদের ক্ষেপণাস্ত্রের সীমার মধ্যে আনতে জাহাজগুলোকে ঘিরে ফেলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেন পাকিস্তানের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তে ইচ্ছুক ছিল না এবং ভারতকে ভীতি প্রদর্শন ছাড়া তারা সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করত কিনা সেটিও নিশ্চিত নয়। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, সোভিয়েত নৌবহরের আগমনের পর ব্রিটিশ নৌবহরটি মাদাগাস্কারের দিকে প্রত্যাবর্তন করে এবং মার্কিন নৌবহর বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত থাকে।
১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারতীয়–বাংলাদেশি যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানি কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। ভারত যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে আক্রমণ না চালায়, সেজন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগ করে, যদিও ভারতের তখন পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণের ইচ্ছা ছিল কিনা সেটি নিশ্চিত নয়। যাই হোক, ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতি হয় এবং এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তৃতীয় ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধের অবসান ঘটে।
এভাবে ১৯৬৬ সালে তাসখন্দ চুক্তিতে মধ্যস্থতা করে মস্কো ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের ওপরে প্রভাব বিস্তারের যে প্রকল্প গ্রহণ করেছিল, ১৯৭১ সালে সোভিয়েত–সমর্থিত ভারতীয় ও বাংলাদেশি সৈন্যদের ঢাকা দখলের মধ্য দিয়ে সোভিয়েতদের সেই পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের কৌশলগত উদ্দেশ্য পুরোপুরি সাফল্য লাভ করেনি। পাকিস্তানকে চীনা–মার্কিন বলয় থেকে দূরে সরিয়ে রাখা বা দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যর্থ হয়। কিন্তু ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি মস্কোপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রারম্ভে সোভিয়েত বিশ্লেষকরা যে আশঙ্কা করেছিলেন, সেটিই সত্য বলে প্রমাণিত হয়। বাংলাদেশে সোভিয়েত প্রভাব স্থায়ী হয়নি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশের ইসলামপন্থী এবং পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট দলগুলো ‘রুশ–ভারত নিপাত যাক’ স্লোগান তোলে এবং বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশিদের মধ্যে ভারতবিরোধী ও সোভিয়েতবিরোধী মনোভাব তীব্র হয়ে ওঠে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান একটি সামরিক অভ্যুত্থানে সপরিবারে নিহত হন এবং পরবর্তী সরকারগুলো চীন, পশ্চিমা বিশ্ব এবং মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষণশীল আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে, যার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ে।