এই লেখাটির মাধ্যমে আমরা মনের দৃষ্টিতে হেঁটে যাব সেই যশোর রোড ধরে, যে পথ ধরে ১৯৭১ সালে হাজারো ঘরহারা বাঙালি জীবন বাঁচাতে পাড়ি দিয়েছিল ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোয়, আর জানব- এখন কেমন আছে যশোর রোড?
“ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে
যুদ্ধে ছিন্ন ঘর-বাড়ি-দেশ
মাথার ভেতর বোমারু বিমান
এই কালোরাত কবে হবে শেষ?”
অ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতা থেকে মৌসুমী ভৌমিকের বাংলায় অনূদিত উপরের চারটি বাক্যই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা বোঝার জন্য যথেষ্ট। বলছিলাম বহু বছরের পুরনো গাছের সারিময় যশোর রোডের কথা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক নীরব সাক্ষী হয়ে আছে যেন এই যশোর রোড ও এর গাছগুলো।
ঐতিহাসিকদের মতে, যশোরের তৎকালীন জমিদার কালীপোদ্দার ১৮৪০ সালে যশোর থেকে কালীঘাট পর্যন্ত এই রাস্তা ও এর দু’ধারে এই রেইনট্রি বা সোজা বাংলায় কড়ই গাছগুলো রোপণ করেন, যাতে তীর্থস্নানে যাওয়ার পথে তার মা ও অন্যান্য পুণ্যার্থীরা গাছের ছায়ায় থেকেই যাত্রাস্থানে পৌঁছাতে পারেন।
যখন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের শরণার্থীরা এই রাস্তা ধরে ভারতে পাড়ি জমাচ্ছিল, তখন এই রাস্তাটিই ছিল তাদের শুধুমাত্র বেঁচে থাকার স্বপ্ন পূরণের পথ। তাদের অনেকেই পথ চলার ক্লান্তি সহ্য করতে না পেরে ঢলে পড়েছিলেন মৃত্যুর কোলে। এই রাস্তার প্রতিটি ধূলিকণাও যেন সেই হাজারো শরণার্থীদের ক্লান্তি, দুর্ভোগ ও বয়ে বেড়ানো স্বপ্নের সাক্ষী।
কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ যখন ভারতে এসেছিলেন, এই যশোর রোডের শরণার্থীদের চোখের পানি নাড়া দিয়েছিল তাকেও। পশ্চিম বাংলার একটি শরণার্থী শিবির দেখতে গিয়েছিলেন তিনি, আর তারপরই রচনা করেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামের ১৫২ লাইনের হৃদয়স্পর্শী কবিতা। এ কবিতাটিতে একদিকে কবি যেমন আমাদের সেই সময়ের পূর্বপুরুষদের শরণার্থী জীবনের ছবি দেখিয়েছেন, অন্যদিকে তৎকালীন বৈশ্বিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের মহান মুক্তিযুদ্ধে পালনকারী নেতিবাচক ভূমিকারও ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনা করেছেন।
সে সময়ের পশ্চিমী দুনিয়ার ব্যান্ডভক্তদের জন্য একটি দুঃসংবাদ আসে ১৯৭০-এর বসন্তে; জনপ্রিয় ব্যান্ড বিটলস্ এর ভাঙন! পরবর্তী বছর বিটলসে্র প্রধান গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসন জমকালো কনসার্ট আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন। মূলত পণ্ডিত রবিশঙ্কর, যিনি সে সময়ে বাংলাদেশের শরণার্থীদের অবস্থা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, তার ভাবনার কথা বন্ধু জর্জ হ্যারিসনকে জানান আর ঠিক তখনই জর্জ হ্যারিসন এ সিদ্ধান্ত নেন।
পহেলা আগস্ট, ১৯৭১; নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন। সময় দুপুর দুইটা ত্রিশ থেকে রাত আটটা, কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। অনুষ্ঠানের শুরু হয় পণ্ডিত রবিশঙ্করের সেতারের সুরে। একে একে পরিবেশন করেন লিওন রাসেল, রিংগো স্টার, বিলি প্রেস্টন আরও অনেকে। কনসার্ট উপলক্ষে রিহার্সালের সময়ও জর্জ হ্যারিসন নিশ্চিত ছিলেন না, বব ডিলান আসবেন কিনা, কারণ তার পূর্ববর্তী দুই বছরে বব ডিলান কোনো জনসমাগমে গান করেননি। এই কনসার্টেই বব ডিলান গান, অ্যালেন গিন্সবার্গের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। ফলে, বিশ্ববাসীর সামনে যশোর রোডের ঘটনাপ্রবাহের অন্তরালে, বাংলাদেশে চলমান মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা মূর্তমান হয়ে ওঠে।
অ্যালেন গিন্সবার্গের ভাষায়,
“Millions of souls nineteen seventy one
Homeless on Jessore Road under grey sun
A million are dead, the million who can
Walk toward Calcutta from East Pakistan.”
কনসার্টটিতে দর্শক হয়েছিল প্রায় ৪০ হাজার। কনসার্ট থেকে প্রাপ্ত ২৫০ হাজার মার্কিন ডলার আয়োজকরা ইউনিসেফকে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের শরণার্থীদের উন্নয়নের জন্য প্রদান করেন।
যশোর রোড ধরে মানচিত্রের সীমানা ঘেঁষেই বেনাপোল।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সেখানে ৮ নং সেক্টরের সদর দপ্তর অবস্থিত ছিল। আর এখন এই বেনাপোলে আমাদের সবচেয়ে পুরনো স্থলবন্দরটি রয়েছে। ১৯৭৮ সালে চালু হওয়া দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই স্থলবন্দরটি দিয়ে ভারত থেকে আসা পণ্যসামগ্রী যশোর রোডে পাড়ি জমিয়ে পৌঁছে যায় বাংলাদেশবাসীর কাছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এত বড় অবদান রাখা যে যশোর রোড, তা কিন্তু আরো একবার আলোচনায় আসে গত ২০১৮ সালে। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ যশোর রোডের গাছগুলোকে কেটে দুই লেনের যশোর পেট্রাপোল পর্যন্ত রাস্তাটি চার লেনে উন্নীত করতে চাইছিলেন। আর তখনই দেশ জুড়ে সচেতন নাগরিক সমাজ আরো একবার রাস্তায় নেমে আসেন, যাতে করে দুইশত বছরের বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকা গাছগুলোকে তারা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দুঃখের বিষয় এই যে, স্বাধীনতার ইতিহাসের এমন গুরুত্বপূর্ণ সড়কটিকে রক্ষা করার জন্য শেষ পর্যন্ত বিচার বিভাগকে সিদ্ধান্ত নিতে হলো। ফলে, আরও একটিবার গাছগুলো পেল প্রতিদিনের সূর্যালোকে মাখামাখি করার ভরসা।
ভবিষ্যতে হয়তো আবারো কখনো খবরের শিরোনাম হবে এই যশোর রোড, হয়তো তখন সে সময়ে এই প্রজন্মের কেউ থাকবে না। তবে কামনা এতটুকুই, ভালো থাকুক যশোর রোড, ভালো থাকুক বৃক্ষকূলের এই বয়জ্যেষ্ঠরা এবং আগলে রাখুক ৭১-কে।