গতানুগতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে সাধারণত শহুরে আফগান নারীদের অধিকার নিয়েই বেশি আলোচনা করা হয়। আড়ালে রয়ে যায় গ্রামীণ আফগান নারীদের চাওয়া-পাওয়ার কথা। অথচ এরাই মূলত আফগানিস্তানের প্রতিনিধিত্বশীল নারী। কারণ আফগানিস্তানের ৭০% মানুষই গ্রামে বসবাস করে। সেই নারীদের কথাই নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনের একটি দীর্ঘপাঠ প্রবন্ধে তুলে এনছেন সাংবাদিক আনন্দ গোপাল।
সেই সাথে প্রবন্ধটিতে উঠে এসেছে আমেরিকান বাহিনীর এবং তাদের সহযোগী আফগান ন্যাশনাল আর্মির সীমাহীন অমানবিকতার কথা, আফগান জনগণের উপর চালানো তাদের গণহত্যার কথা এবং তালেবানদের বিজয়ের পেছনের কারণগুলোর কথা।
আমাদের এই সিরিজটি দীর্ঘ এই চমৎকার প্রবন্ধটিরই অনুবাদ। মোট সাতটি পর্বে করা অনুবাদ সিরিজটির এটি পঞ্চম পর্ব। সবগুলো পর্বের লিঙ্ক এখানে: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব
২০০৮ সালে মার্কিন স্পেশাল ফোর্স এবং ব্রিটিশ সৈন্যদের সাহায্য করার জন্য মার্কিন নৌবাহিনীকে সাংগিনে মোতায়েন করা হয়। সাংগিনে সে সময় ব্রিটিশ বাহিনী কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছিল। আফগানিস্তানে তাদের এক-তৃতীয়াংশ হতাহতের ঘটনাই ঘটেছিল সাংগিনে, যার কারণে কিছু সৈন্য এই মিশনকে “সাংগিনগ্রাদ” বলে সম্বোধন করতে শুরু করেছিল। নিলুফার ততদিনে আট বছরে পা দিয়েছে। সে যুদ্ধের ছন্দও বুঝতে শিখেছে। শাকিরাকে সে জিজ্ঞেস করত, “আমরা কবে ফারজানা আন্টির বাসায় যাবো?” ফারজানা মরুভূমিতে বাস করত।
কিন্তু সবসময় বিশৃঙ্খলা অনুমান করা সম্ভব ছিল না। এক বিকেলে কেউ পালাতে পারার আগেই বিদেশীরা আবার এসে হাজির হয়। শাকিরাদের পরিবার পেছনের উঠোনের পরিখার দিকে ছুটে যায়। কয়েক বাড়ি পরে প্রয়াত আবদুস সালামের স্ত্রী এবং সন্তানরাও একই কাজ করে। কিন্তু একটি মর্টারের আঘাতে তার পনেরো বছর বয়সী মেয়ে বোর জানা নিহত হয়।
উভয়পক্ষই যুদ্ধে বেসামরিক মৃত্যু এড়াতে চেষ্টা করেছিল। সরে যাওয়ার জন্য সতর্কতা জারির পাশাপাশি কোন কোন এলাকায় আইইডি স্থাপন করা হয়েছে, সেই ব্যাপারে তালেবানরা গ্রামবাসীকে অবগত রাখত। এ ছাড়াও তারা গাড়ি বহরে হামলা চালানোর সময় বেসামরিক যান চলাচল বন্ধ করে দিত। অন্যদিকে যৌথ বাহিনী লেজার-গাইডেড বোমা ব্যবহার করত, গ্রামবাসীকে যুদ্ধ সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য লাউডস্পিকার ব্যবহার করত এবং যুদ্ধ শুরুর আগে হেলিকপ্টার পাঠাত। “তারা লিফলেট ফেলে বলত, ‘আপনার বাড়িতে থাকুন! নিজেকে বাঁচান!’” শাকিরা স্মরণ করেছিল।
কিন্তু কাদামাটির প্রাচীরওয়ালা ঘনবসতিপূর্ণ বস্তির মধ্যে চলমান এই যুদ্ধে আসলে কোনো জায়গাই পুরোপুরি নিরাপদ ছিল না। বিপুল সংখ্যক বেসামরিক মানুষ এই যুদ্ধে মারা যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে এ ধরনের হতাহতের ঘটনা ব্যাপক নিন্দার জন্ম দিত। যেমনটি ঘটেছিল ২০১০ সালে সাংগিনে গ্রামবাসীদের ভিড়ের উপর ন্যাটোর রকেট হামলায় বাহান্নজন নিহত হবার পর। কিন্তু বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হামলায় কেবল একজন বা দুজন মারা যেত। এসব বেনামী ব্যক্তির মৃত্যুর কথা কোনো রিপোর্টে উঠে আসত না, সরকারি সংস্থাগুলো দ্বারা কখনও নথিভুক্ত হতো না, এবং এর ফলে যুদ্ধের বেসামরিক হতাহতের সংখ্যার অংশ হিসেবেও এসব মৃত্যু কখনও গণ্য হতো না।
শাকিরার ট্র্যাজেডিও এভাবে দিনে দিনে বাড়তেই থাকে। মুহাম্মদ নামে তার পনেরো বছর বয়সী এক কাজিন ছিল। এক বন্ধুর সাথে গ্রামের মধ্য দিয়ে মোটরসাইকেল চালানোর সময় বাজবুজ্জাক তথা ড্রোন হামলায় সে নিহত হয়। “ড্রোনের আওয়াজ তখন সর্বত্র শোনা যেত,” শাকিরা স্মরণ করে। “যখন আমরা সেই শব্দ শুনতাম, বাচ্চারা কাঁদতে শুরু করত। আমি তাদের সান্ত্বনা দিয়ে থামাতে পারতাম না।”
মুহাম্মদ ওয়ালি নামে তার আরেকজন বয়স্ক কাজিন ছিল। এক অপারেশন চালানোর সময় কোয়ালিশন বাহিনী গ্রামবাসীদের তিন দিন পর্যন্ত ঘর থেকে বের না হতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু দ্বিতীয় দিন পার হওয়ার পর খাওয়ার পানি শেষ হয়ে যায়। পানি আনার জন্য বাইরে গেলে ওয়ালিকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
সাত বছর বয়সী কাজিন খান মুহাম্মদের পরিবার গাড়িতে করে একটি সংঘর্ষের স্থান থেকে পালানোর চেষ্টা করছিল। ভুল করে তাদের গাড়ি কোয়ালিশন বাহিনীর অবস্থানের কাছাকাছি চলে গেলে গাড়ির উপর আক্রমণ করা হয় এবং তাকে হত্যা করা হয়।
বারো বছর বয়সী কাজিন বোর আগা সন্ধ্যার সময় হাঁটতে বেরিয়েছিল। আফগান ন্যাশনাল পুলিশের ঘাঁটি থেকে আসা গুলিতে বিদ্ধ হয়ে সে মারা যায়। পরদিন সকালে তার হতবিহ্বল বাবা ঘাঁটিতে যান উত্তর খুঁজতে। তাকে বলা হয়, তার ছেলেকে এর আগেও ঘাঁটির কাছাকাছি যাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছিল। “তাদের কমান্ডারের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়,” তার বাবা স্মরণ করেন।
ষোল বছর বয়সী কাজিন আমানউল্লাহ যখন আফগান সেনাবাহিনীর স্নাইপারের গুলিতে নিহত হয়, তখন সে ক্ষেতে কাজ করছিল। কেউ ঐ ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। এবং সেনা ঘাঁটির কাছে যেতে ভয় পাবার কারণে তাদের পরিবারও কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারেনি।
প্রাপ্তবয়স্ক আরেক কাজিন আহমেদ সারাদিন ক্ষেতে কাজ করার পর যখন বাসায় ফিরছিল, তখন কোয়ালিশন বাহিনীর গুলির আঘাতে সে নিহত হয়। সে সময় তার হাতে ছিল একটি বহনযোগ্য চুল্লী। তার পরিবারের বিশ্বাস, বিদেশীরা তার হাতের চুল্লীকে আইইডি বিস্ফোরক বলে মনে করেছিল।
আহমেদের ভাই নিয়ামতউল্লাহ যখন একদিন ক্ষেত থেকে আফিম তুলছিল, তখন কাছাকাছি কোনো জায়গায় গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। যখন সে পালাতে চেষ্টা করে, তখন একটি বাজবুজ্জাক থেকে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়।
এক চাচাশ্বশুর গুল আহমেদ ভোর বেলা ক্ষেতে কাজ করার জন্য বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ছেলেদের তিনি বলে গিয়েছিলেন বেলা বাড়লে তার জন্য নাস্তা নিয়ে যেতে। নাস্তা নিয়ে ক্ষেতে পৌঁছার পর ছেলেরা দেখতে পায়, সেখানে তার মৃতদেহ পড়ে আছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, তিনি কোয়ালিশন বাহিনীর টহলের সামনে পড়েছিলেন। শাকিরার বর্ণনা অনুযায়ী, সৈন্যরা তাকে “পশুর মতো সেখানে ফেলে গিয়েছিল”।
শাকিরার পারিবারিক বৃক্ষের সবগুলো শাখা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। তার যে চাচারা ছোটকালে তাকে গল্প শোনাত, তারা থেকে শুরু করে তার যেসব কাজিন ছোটকালে গুহার ভেতরে তার সাথে খেলা করত, তারা সবাই একে একে নিহত হয়েছিল। সব মিলিয়ে শাকিরা তার পরিবারের ষোলজন সদস্যকে হারিয়েছিল। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, পান কিল্লায়ের অন্যান্য পরিবারের ক্ষেত্রেও একইরকম ঘটনা ঘটেছিল কিনা।
দৈব-চয়নের ভিত্তিতে আমি গ্রামের এক ডজন পরিবারের নমুনা সংগ্রহ করেছিলাম। অন্যান্য গ্রামেও আমি একইরকম অনুসন্ধান করেছিলাম, যেন নিশ্চিত করা যায় যে পান কিল্লায়ের ঘটনা বিচ্ছিন্ন কিছু ছিল না। প্রতিটি পরিবারের ক্ষেত্রে আমি মৃতদের নাম নথিভুক্ত করি, ঘটনার বিবরণের সাথে ডেথ সার্টিফিকেট এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য মিলিয়ে দেখি। আমি দেখতে পাই, যে যুদ্ধকে স্থানীয়রা আমেরিকান যুদ্ধ বলে সম্বোধন করে, তাতে গড়ে প্রতিটি পরিবার দশ-বারোজন করে বেসামরিক সদস্য হারিয়েছে।
কাবুলের মতো ব্যস্ত মহানগরে, যেখানে নাগরিকরা তুলনামূলক নিরাপত্তা উপভোগ করত, সেখানে মানুষ গ্রামাঞ্চলের দুর্ভোগের এই ব্যাপক মাত্রা সম্পর্কে জানত না। কিন্তু সাংগিনের মতো বিচ্ছিন্ন গ্রামাঞ্চলে নিরন্তর বেসামরিক নাগরিক হত্যা অনেক আফগানকে তালেবানদের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। ২০১০ সাল নাগাদ ইসহাকজাইদের গ্রামগুলোর অনেক পরিবারের ছেলেই তালেবানদের সাথে যোগ দেয়। এদের অধিকাংশই তালেবানে যোগ দেয় শুধুমাত্র নিজেদের রক্ষার জন্য অথবা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। তালেবানরা এবার সাংগিনবাসীর জীবনের সাথে নব্বইয়ের দশকের চেয়েও ভালোভাবে মিশে যেতে পেরেছিল। এখন শাকিরা এবং তার বান্ধবীরা যখন তালেবানদের নিয়ে আলোচনা করে, তখন তারা আসলে নিজেদের বন্ধু, প্রতিবেশী এবং প্রিয়জনদের নিয়েই আলোচনা করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সময় এত বেশি পরিমাণে বেসামরিক মানুষকে হত্যা করছিল যে, কিছু ব্রিটিশ অফিসারও এতে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিল। তারা আমেরিকান বিশেষ বাহিনীকে এই এলাকা থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। উল্টো অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং ডেনমার্কসহ সারা দুনিয়া থেকে স্রোতের মতো সৈন্য এসে হেলমন্দে জড়ো হয়। গ্রামবাসীরা অবশ্য তাদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারত না। তাদের কাছে দখলদাররা সবাই ছিল কেবলই “আমেরিকান”।
“এখানে দুই ধরনের মানুষ ছিল- এক দলের চেহারা ছিল কালো, অন্য দলের চেহারা ছিল গোলাপী,” পাজারো নামের পাশের গ্রামের মহিলা স্মৃতিচারণ করেছিল। “তাদেরকে দেখলেই আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়তাম।” কোয়ালিশন বাহিনী স্থানীয় জনগণকে তালেবানদের হাত থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হিসেবে চিত্রিত করেছিল, কিন্তু ২০১১ সালের এক গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কোয়ালিশন বাহিনী সম্পর্কে স্থানীয় জনসাধারণের ধারণা ছিল “প্রতিকূল”। প্রতিবেদন অনুযায়ী গ্রামবাসীরা সতর্ক করছিল যে, কোয়ালিশন বাহিনী যদি “প্রস্থান না করে, তাহলে স্থানীয় নাগরিকরা এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হবে।”
জবাবে কোয়ালিশন বাহিনী জঙ্গিবাদ দমনের হার্টস-অ্যান্ড-মাইন্ডস কৌশল অবলম্বন করতে শুরু করে। কিন্তু নিজেদের জনগণের মধ্যে সংস্থাপন করার বিদেশীদের এই প্রচেষ্টা ছিল অমার্জিত: তারা প্রায়ই গ্রামবাসীদের বাড়িঘর দখল করত এবং এর ফলে গ্রামবাসীরা আরও বেশি ক্রসফায়ারের মুখোমুখি হতো। “তারা আমাদের কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে জোর করে ঘরে ঢুকে পড়ত,” সাংগিনের অন্য একটি গ্রামের এক মহিলা, পাশতানা বলেছিল আমাকে। “মাঝে মাঝে তারা দরজা ভেঙে আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ত, সবগুলো জানালা ভেঙেে ফেলত এবং এরপর সারা রাত অবস্থান করত। তালেবানরা তাদের উপর গুলি চালাতে পারে, এই আশঙ্কায় আমাদেরকে পালিয়ে যেতে হতো।” মারজিয়া নামের পান কিল্লায়ের আরেক নারী স্মরণ করে, “তালেবানরা অল্প কয়েকটা গুলি ছুঁড়ত, কিন্তু আমেরিকানরা মর্টার দিয়ে তার জবাব দিত।” এরকম একটি মর্টার একবার তার শাশুড়ির বাড়িতে আঘাত করেছিল। তার শাশুড়ি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন, কিন্তু এরপর থেকে তিনি “নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন”- সব সময় তিনি “অদৃশ্য কোনো কিছুর প্রতি চিৎকার করতেন। তিনি এমন ভূতুড়ে কিছু দেখতেন, যা আমরা দেখতাম না।”
হৃদয়-মন জয় করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর কিছু ন্যাটো কর্মকর্তা তালেবান কমান্ডারদেরকে পক্ষ পরিবর্তন করার জন্য প্ররোচিত করার চেষ্টা করেন। ২০১০ সালে সাংগিনের তালেবান কমান্ডারদের একটি দল ব্রিটিশদের সাথে যোগাযোগ করে এবং স্থানীয় জনসাধারণের প্রতি সাহায্য প্রদানের বিনিময়ে পক্ষ পরিবর্তন করার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু তালেবান নেতারা যখন তাদের চুক্তি চূড়ান্ত করার জন্য মিলিত হয়, তখন মার্কিন বিশেষ অপারেশন বাহিনী অন্য কোনো বাহিনীর সাথে যোগাযোগ ছাড়াই সেই সমাবেশে বিমান হামলা করে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত শীর্ষ তালেবান নেতাদের হত্যা করে।
২০১৪ সালে অবশেষে মার্কিন নৌবাহিনী সাংগিন ত্যাগ করে। আফগান সেনাবাহিনী এরপরেও তিন বছর পর্যন্ত তাদের অবস্থান ধরে রাখে। এরপর তালেবানরা যখন উপত্যকার বেশিরভাগ অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র বিমানে করে আফগান সেনাবাহিনীকে সরিয়ে নেয় এবং বিভিন্ন সরকারি কম্পাউন্ড মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। ন্যাটোর এক বিবৃতি অনুযায়ী তারা শুধু “ধ্বংসস্তূপ আর আবর্জনা” রেখে যায়। সাংগিন বাজারও তারা এভাবেই ধ্বংস করে যায়। শাকিরা যখন প্রথম ধ্বংস হয়ে যাওয়া দোকানগুলো দেখেছিল, সে তার স্বামীকে বলেছিল, “তারা আমাদের জন্য কিছুই রেখে যায়নি।”
তারপরেও আমেরিকান এবং আফগান বাহিনীর প্রস্থানে এক হিসেবে পান কিল্লায়ে আশাবাদের অনুভূতি জাগ্রত হয়েছিল। যুদ্ধের সমাপ্তি উদযাপন করার জন্য শাকিরার স্বামী একটি ভেড়া জবাই করে। তারা তাদের বাগান সংস্কারের ব্যাপারে আলোচনা করছিল। তার শাশুড়ি রাশিয়ান এবং আমেরিকানদের আগমনের আগের দিনগুলোর কথা বর্ণনা করছিলেন, যখন পরিবারগুলো খালের পাড়ে পিকনিক করত, পুরুষরা জাম গাছের ছায়ায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকত, আর মহিলারা ছাদের উপর, আকাশের তারার নিচে তন্দ্রা যেত।
কিন্তু ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন কাতারের দোহায় তালেবান নেতাদের সাথে আলোচনা করছিল, সে সময় আফগান সরকার এবং আমেরিকান বাহিনী শেষবারের মতো যৌথভাবে সাংগিনে আক্রমণ চালায়। সে বছর জানুয়ারিতে তারা সাংগিনে এমন বিধ্বংসী আক্রমণ পরিচালনা করে, যা সাংগিনবাসী পুরো যুদ্ধে আর কখনও প্রত্যক্ষ করেনি। শাকিরা এবং অন্যান্য গ্রামবাসী মরুভূমির দিকে পালিয়ে গেলেও সবার পক্ষে পালানো সম্ভব হয়নি।
পে-ফোন ব্যবসার মালিক আহমেদ নূর মোহাম্মদের দুই যমজ ছেলে অসুস্থ থাকার কারণে তিনি বাড়ি ছাড়ার আগে আরেকটু অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। তার পরিবার যখন ঘুমাতে যায়, তখন দূর থেকে কামানের আওয়াজ ভেসে আসছিল। সেই রাতে জমজ বাচ্চা দুটো যে ঘরে ঘুমিয়েছিল, একটি আমেরিকান বোমা এসে সেই ঘরে আছড়ে পড়ে এবং ছেলে দুটোকে হত্যা করে। দ্বিতীয় একটি বোমা পাশের রুমে আঘাত হানলে মোহাম্মদের বাবাসহ আরও অনেকে নিহত হয়, যাদের মধ্যে আটজনই ছিল শিশু।
পরের দিন জানাজার নামাজের সমাবেশে আরেকটি বিমান হামলায় ছয়জন নিহত হয়। একই দিন কাছের একটি গ্রামে গানশিপের আক্রমণে নিহত হয় তিনটি শিশু। পরের দিন আরও চার শিশুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সাংগিনের আরেক জায়গায় একটি মাদ্রাসায় বিমান হামলা চালালে এক শিশু নিহত হয়। এক সপ্তাহ পর একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে বিমান হামলা চালালে নিহত হয় বারোজন অতিথি।
বোমা হামলার পর মুহাম্মদের ভাই কান্দাহারে যান গণহত্যাগুলোর ব্যাপারে জাতিসংঘ এবং আফগান সরকারের কাছে বিচার চাইতে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও কোনো ন্যায় বিচার না পাওয়ায় অবশেষে তিনি তালেবানে যোগ দেন।
অবিরাম নতুন সদস্যের সরবরাহ অব্যাহত থাকার কারণে আপাতদৃষ্টিতে তালেবানদের পক্ষে কোয়ালিশন বাহিনীকে পরাজিত করা কঠিন কিছু ছিল না। কিন্তু যদিও বিদ্রোহ অবশেষে আফগান গ্রামাঞ্চলে শান্তি আনতে পেরেছে, বাস্তবে এটি মূলত নিরানন্দের শান্তি: অনেক গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পুনর্গঠন হবে অন্যতম চ্যালেঞ্জের কাজ, কিন্তু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বিগত দুই দশকের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারা। “আমার মেয়ে রাতের বেলা ঘুম থেকে জেগে উঠে চিৎকার করতে থাকে, আমেরিকানরা আসছে,” পাজারো বলেছিল। “আমাদেরকে তার সাথে কোমল স্বরে কথা বলতে হয়। তাকে বলতে হয়, ‘না, না, তারা আর ফিরে আসবে না।’”
পরবর্তী পর্বে থাকছে তালেবানদের অধীনে সাংগিনবাসীর জীবনযাপনের চিত্র এবং তাদের মনোভাবের বিবরণ। পড়তে ক্লিক করুন এখানে।