নগররাষ্ট্রের যুগে কিংবা সাম্রাজ্যবাদের যুগে অধিকাংশ সময়ই রাষ্ট্রক্ষমতা থেকেছে নির্দিষ্ট পরিবারের কাছে, ক্ষমতার লড়াইয়ে হয়তো কখনো এক শাসককে হটিয়ে ক্ষমতায় এসেছে অন্য শাসক। দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রকাঠামোতে উপেক্ষিত থাকা নাগরিকেরা রাষ্ট্রব্যবস্থায় নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করেছে জাতিরাষ্ট্রের যুগে এসে, গণতন্ত্র বিকাশের সাথে সাথে। এই কাঠামোতে যেহেতু জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় যেতে হয়, রাজনৈতিক নেতারা সবসময়ই চেয়েছেন জনগণের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করে, তাদের পছন্দ অনুযায়ী কথা বলে, কাজ করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে।
এই সাধারণ ধারার মধ্যেও কিছু দল আর ব্যক্তির উত্থান আলাদাভাবে আলোচিত হচ্ছে, তারা পরিচিতি পাচ্ছেন জনতুষ্টিবাদী হিসেবে। চল্লিশের অধিক ব্যক্তি বা দলের এই তালিকায় আছেন ২০১৬ সালে নির্বাচিত হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ব্রেক্সিট ইস্যুকে কেন্দ্র করে যুক্তরাজ্যের ক্ষমতায় আসা বরিস জনসন, আছেন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হওয়া এ ধারা বদলে দিচ্ছে প্রথাগত রাজনীতির ধারা, বিশ্লেষকদের কাছে আবির্ভূত হয়েছেন মুক্ত গণতন্ত্রের হুমকি হিসেবে।
তাহলে, জনমত নিয়ে কাজ করা প্রথাগত রাজনৈতিক নেতাদের গ্রহণ করে বিশ্লেষকেরা কেন একই কাঠামোতে থাকা জনতুষ্টিবাদী নেতাদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করছেন?
জনতুষ্টিবাদী নেতারা ধর্ম, গোত্র, শ্রেণী বা অবস্থানের উপর ভিত্তি করে একটি অংশকে গণশত্রু হিসেবে উপস্থাপন করেন, উস্কে দেন বিভাজন। গণশত্রু হিসেবে জনতুষ্টিবাদী নেতাদের পছন্দের তালিকায় আছে ধর্মের ভিত্তিকে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, অভিবাসী হিসেবে বসবাস করতে আসা নাগরিকেরা। আছে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক এস্টাবলিশমেন্ট, যাদেরকে উপস্থাপন করা হয় দুর্নীতিগ্রস্ত আর নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থের রক্ষক হিসেবে। এই উস্কে দেওয়া বিভাজন জাতিরাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে স্থায়ী বিভাজন তৈরি করে বাড়িয়ে দিচ্ছে সংঘাত।
আবার জনতুষ্টিবাদীরা বিভিন্ন ইস্যুতেও বিভাজন তৈরি করেন। এসব ইস্যুতে তারা একটা সহজ সমীকরণ তৈরি করেন, নাগরিকেরা হয় ইস্যুর পক্ষে থাকবেন, বিপক্ষে গেলেই আখ্যায়িত হবেন ‘জনগণের স্বার্থের শত্রু’ হিসেবে। এ ধরনের বিভাজনের ফলে গণতন্ত্রের যে মৌলিক ধারণা, বহুত্ববাদ আর মুক্তমত প্রকাশের স্বাধীনতা, বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
কেন উত্থান ঘটছে জনতুষ্টিবাদীদের?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আছে প্রায় আড়াইশো বছর ধরে, ভারতে আছে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে, জনতুষ্টিবাদীদের জয়জয়কার যেখানে সবচে বেশি, ইউরোপেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আছে দীর্ঘদিন ধরেই। দীর্ঘ এই পথ পরিক্রমার মধ্যে তাহলে কেন হঠাৎ করে জনতুষ্টিবাদের উত্থান ঘটছে, জনগণ আকৃষ্ট হচ্ছে বিভাজনের রাজনীতির প্রতি?
প্রথমত, বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিসরে এখন পর্যন্ত জনতুষ্টিবাদের দুটি ঢেউ দেখা গেছে। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে, আর এই শতাব্দীর গত দশকে। গত শতাব্দীতে যখন জনতুষ্টিবাদের ঢেউ আসে, তখন সবে পতন হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের, বিশ্বজুড়ে পতন হয় সমতার কথা বলা সমাজতন্ত্রের। এ শতাব্দীতেও যখন জনতুষ্টিবাদে জোয়ার আসে, বিশ্ব অর্থনীতি তখন সবে একটি মন্দা অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ, প্রথাগত অর্থনীতির সাফল্য-ব্যর্থতার সাথে জনতুষ্টিবাদীদের উত্থানের সম্পর্ক রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, কাজ করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের। কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এই প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হয়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে সামাজিক আর অর্থনৈতিক বৈষম্য। এ বৈষম্যকে পুঁজি করে ভারতে উত্থান ঘটেছে মোদির, যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের, যুক্তরাজ্যে বরিস জনসনের। অর্থাৎ, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথাগত প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে উত্থান ঘটে জনতুষ্টিবাদীদের।
তৃতীয়ত, প্রথাগত রাজনৈতিক সরকার অনেক সময় অজনপ্রিয় নীতি নেয়, অর্থনীতি কিংবা বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির নিরিখে। এই অজনপ্রিয় নীতিগুলো বুঝতে ব্যর্থ হয় নাগরিকদের অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত অংশ। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে উত্থান ঘটে জনতুষ্টিবাদীদের।
চতুর্থত, জনতুষ্টিবাদী নেতারা সাধারণত ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের অধিকারী হন, নেতৃত্বের ধরন হয় কর্তৃত্বপরায়ণ। উৎসাহব্যঞ্জক আর কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত কথা বলে তারা জনগণের সাথে স্থাপন করেন সরাসরি সম্পর্ক, যেমনটা দেখা গেছে ভেনিজুয়েলার শ্যাভেজের উত্থানে।
পঞ্চমত, সমাজে বিদ্যমান উচ্চ বৈষম্য, চাকরির, বাজারে অস্থিতিশীলতাও সুযোগ করে দেয় জনতুষ্টিবাদীদের উত্থানে।
ষষ্ঠত, প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর ফান্ডিং সাধারণত করে রাষ্ট্রের এলিট ব্যবসায়িক শ্রেণী। ফলে, সরকার গঠন করলে নীতিগ্রহণ করতে হয় এদের স্বার্থের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে, সংখ্যাগরিষ্ঠকে বঞ্চিত রেখে হলেও। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের সরকারই জড়িয়ে পড়ে দুর্নীতিতে। এই স্বার্থ আর মূল্যবোধের সংঘাতও উত্থান ঘটায় জনতুষ্টিবাদের।
জনতুষ্টিবাদীরা যেভাবে বদলে দিচ্ছে রাজনীতিকে
রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে মানুষ জড়িত হয় স্বার্থের জন্য, জড়িত হয় আদর্শের জন্যও। প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলো যখন বৃহৎ অংশের স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তখনই বায়বীয় আদর্শ নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হয় জনতুষ্টিবাদীরা। ছয় মহাদেশ মিলিয়ে বর্তমানে প্রায় ২০টিরও অধিক দেশে ক্ষমতায় আছে জনতুষ্টিবাদীরা। বিতর্কিত আর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক কাজ করে তারা পরিবর্তন করে ফেলছেন রাজনৈতিক সংস্কৃতি, ভোটারদের মানসিকতা।
প্রথমত, জনতুষ্টিবাদীরা যেহেতু একটি গণশত্রু তৈরি করে ক্ষমতায় আসে, ফলে নাগরিকরা আসলে বিভাজিত হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভাজন ঘটিয়েছেন শ্বেত আমেরিকান আর বাকিদের মধ্যে, বরিস জনসন বিভাজন ঘটিয়েছেন যুক্তরাজ্যের নাগরিক আর অভিবাসীদের মধ্যে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ ভারতে জনতুষ্টিবাদীরা বিভাজন করেছে ধর্মের ভিত্তিতে। এই বিভাজন সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে উসকে দেয় সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করতে, বিভিন্নভাবে হরণ হয় নাগরিক অধিকার।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে ক্রমাগত কালোদের উপর শ্বেত আমেরিকানদের হামলার ঘটনা বেড়েছে, বেড়েছে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে আক্রমণের ঘটনাও। ভারতে ধর্মীয় কারণে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের ঘটনা বেড়েছে, বেড়েছে অসহিষ্ণুতা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের উদাহরণ হয়ে থাকবে দিল্লির ঘটনা।
ফলে, জনতুষ্টিবাদীদের দ্বারা গণতন্ত্রের যে মৌলিক আবেদন, বহুত্ববাদ আর বৈচিত্র্য, সেটি প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, হুমকির মুখে পড়ছে জাতীয় ঐক্য।
দ্বিতীয়ত, স্বভাবত কর্তৃত্ববাদী জনতুষ্টিবাদী শাসকেরা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রতি খুব একটা শ্রদ্ধাশীল হন না। ফলে জনতুষ্টিবাদী নেতাদের শাসনামলে গড়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কমে ৭ শতাংশ, নাগরিক স্বাধীনতা কমে গড়ে ৮ শতাংশ, ১৩ শতাংশ পতন হয় রাজনৈতিক অধিকার সূচকে। ফলে প্রায় এক-চতুর্থাংশ জনতুষ্টিবাদী সরকারের সময়ে কোনো না কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। বামপন্থী জনতুষ্টিবাদী সরকার হোক বা ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদী সরকার, কোনো মতাদর্শের সময়েই নাগরিক স্বাধীনতা, সংখ্যালঘুদের অধিকার, আইনের শাসনের মতো মূল্যবোধগুলো বিকশিত হয়নি, মুক্ত চিন্তাধারার জন্য সমাজ উন্মুক্ত হয়নি।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার আরেকটা ধারণা পাওয়া যাবে জনতুষ্টিবাদী নেতাদের ক্ষমতাত্যাগের বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে, অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ছেড়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ জনতুষ্টিবাদী সরকার। প্রায় এক-চতুর্থাংশ জনতুষ্টিবাদী সরকার ক্ষমতা ছেড়েছে আন্দোলনের মুখে কিংবা অভিশংসিত হয়ে, বাকিরা এখনও অধিষ্ঠিত আছে ক্ষমতায়।
তৃতীয়ত, জনতুষ্টিবাদী সরকারগুলোর অসাংবিধানিক অনেক দাবি তৈরি করে ক্ষমতায় আসে, অফিসে এসে তারা এগুলো বাস্তবায়ন করতে পাশ কাটাতে চায় সাংবিধানিক মূল্যবোধগুলোকে, রাজনৈতিক সংস্কৃতি দুর্বল হলে ব্যবহার করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠাগুলোকে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যেমন মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তৈরি করতে বার বার কংগ্রেসকে পাশ কাটাচ্ছেন, ভারতে বিজেপি সরকার ব্যবহার করছে সুপ্রিম কোর্ট আর সংবিধানকে।
চতুর্থত, প্রচলিত রাজনৈতিক দল আর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা জনতুষ্টিবাদী নেতাদের একটা সহজাত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু, জনতুষ্টিবাদী নেতারা দুর্নীতি নির্মূলে কার্যকর ভূমিকা রাখার পরিবর্তে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ সমস্যাকে আরো গভীর করেছেন, নিজেরাই জড়িয়ে পড়েছেন দুর্নীতিতে। ব্রাজিলের জনতুষ্টিবাদী প্রেসিডেন্ট দিলমা রৌসেফ অভিশংসিত হয়েছেন দুর্নীতির অভিযোগে, বর্তমান জনতুষ্টিবাদী প্রেসিডেন্টের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বন্ধু গ্রেপ্তার হয়েছেন দুর্নীতির অভিযোগে।
ফলে রাষ্ট্রের কর কমানো, পেনশন বৃদ্ধি কিংবা অভিবাসন সমস্যার মতো বিষয়গুলো নিয়ে মুখরোচক জনতুষ্টিবাদী আবেদনগুলোতে নাগরিকদের সাড়া আসলে খুব বেশি প্রভাব রাখে না গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকাশে; বরং ধর্ম, বর্ণের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা জনতুষ্টিবাদী দাবিগুলো রাষ্ট্রের নাগরিকদের স্থায়ীভাবে বিভাজিত করে, ক্ষেত্রবিশেষে বাধাগ্রস্ত করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন।