ভূমধ্যসাগর ধরণীর বুকে বহমান এক অনন্য জলরাশি। এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপ মহাদেশ পরিবেষ্টিত এই সাগর প্রাচীন সভ্যতা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির এক অনন্য সাক্ষী। এই সাগরের কোলেই জন্ম নিয়েছে মিসরীয় সভ্যতা এবং গ্রিক সভ্যতা যারা কিনা জ্ঞান বিজ্ঞানে ছিল অপরাজেয়। রোমান সাম্রাজ্য ও অটোমান সাম্রাজ্যের মতো দাপুটে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্রের জন্মও ভূমধ্যসাগরের বেলাভূমির তীরেই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই অঞ্চলের গুরুত্ব হ্রাস পেলেও অধুনা তার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠার পেছনে রয়েছে শহুরে সভ্যতার অন্যতম চালিকাশক্তি গ্যাসের আবিষ্কার। ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলে ইসরায়েল, মিসর এবং সাইপ্রাসের জলসীমায় আবিষ্কৃত হয়েছে বিশাল গ্যাসের খনি যা কিনা তাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপে রপ্তানির জন্য যথেষ্ট। অর্থাৎ, আমদানি-মুখী জ্বালানি খাতকে রপ্তানি-মুখী করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের অনন্য সুযোগ করে দিয়েছে এই গ্যাস।
কিন্তু আদর্শিক, ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক কারণে তুরস্ক, লিবিয়া এবং লেবাননের মত দেশগুলোর প্রত্যক্ষ বিরোধিতা এই গ্যাসকেই করে তুলতে পারে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি যা কিনা যেকোনো মুহূর্তেই বিস্ফোরিত হতে প্রস্তুত। তারই সাথে আমেরিকা ও রাশিয়া পরস্পরকে নাজেহাল করার দ্বৈরথ এই অঞ্চলকে করে তুলেছে এক অতীব আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। তাই আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয়বস্তুতে যাওয়ার আগে চলুন জেনে নেওয়া যাক ভূমধ্যসাগর এবং আন্তর্জাতিক সমুদ্র-সীমা আইন-১৯৮২ সম্পর্কে।
ভূমধ্যসাগর
ভূমধ্যসাগর একটি ভূমিবেষ্টিত সাগর যার উত্তরে ইউরোপ, পূর্বে এশিয়া এবং দক্ষিণে আফ্রিকা মহাদেশ। এই সাগরের উত্তর উপকূলের উল্লেখযোগ্য দেশগুলো হল তুরস্ক, গ্রিস, ইতালি, ফ্রান্স এবং স্পেন। মিসর, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া আর মরক্কো রয়েছে দক্ষিণ উপকূল ঘেঁষে। পূর্ব উপকূলের দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সিরিয়া, লেবানন এবং ইসরায়েল।
উত্তরের সিসিলি প্রণালী থেকে দক্ষিণে তিউনিসিয়া পর্যন্ত একটি কাল্পনিক রেখা এই সাগরকে পূর্ব ও পশ্চিম এই দুই ভাগে ভাগ করেছে। এই সাগরের উল্লেখযোগ্য দ্বীপের মধ্যে রয়েছে স্বাধীন রাষ্ট্র সাইপ্রাস, ইতালির সিসিলি, ফ্রান্সের কর্সিকা এবং গ্রিসের ক্রিট। এদের মধ্যে সাইপ্রাস ও গ্রিসের ক্রিট এই দুইটি দ্বীপ পূর্ব ভূমধ্যসাগরের বর্তমান প্রেক্ষাপটের সাথে যুক্ত।
আন্তর্জাতিক সমুদ্র-সীমা আইন-১৯৮২
এটি ‘United Nations Convention on the law of the sea’, সংক্ষেপে UNCLOS নামে পরিচিত যা ১৯৮২ সালে গৃহীত হয়। UNCLOS নির্ধারিত সমুদ্র-সীমা গুলো হল –
১. রাজনৈতিক সমুদ্র-সীমা (Territorial water): সমুদ্র উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সীমা পর্যন্ত সমুদ্রের উপরে ও নিচে রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক আইন প্রয়োগ, সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের ব্যাপারে পূর্ণ ক্ষমতা রাখে। বিদেশি কোনো জলযান ঐ রাষ্ট্রের অনুমতি-সাপেক্ষে ‘শান্তিপূর্ণ চলাচল’ করতে পারবে। শান্তিপূর্ণ চলাচল বলতে এখানে পানি দূষণ, মৎস্য আহরণ, সামরিক মহড়া এবং গুপ্তচরবৃত্তি- এই চারটি ক্ষেত্র ব্যতিরেকে নিরবচ্ছিন্ন এবং আইনসিদ্ধ চলাচলকে বুঝানো হয়।
২. অর্থনৈতিক সমুদ্র-সীমা (Exclusive Economic Zone): সমুদ্র উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত শুধুমাত্র সমুদ্রের নিচে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। এই সীমা পর্যন্ত সামুদ্রিক সম্পদ যেমন মৎস্য, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ও আহরণের ব্যাপারে রাষ্ট্র তার সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগ করে। বিদেশি জাহাজ এই সীমানায় পানির নিচে কোনরূপ অনুসন্ধান বা গবেষণা করতে না পারলে ও পানির উপরে তার অবাধ চলাচল স্বীকৃত। কারণ, রাজনৈতিক সমুদ্র-সীমার বাইরে এই ২০০ নটিক্যাল মাইল পানির উপরিভাগকে আন্তর্জাতিক জলসীমার অংশ ধরা হয়।
৩. আন্তর্জাতিক জলসীমা (International waters): ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে সাত মহাসমুদ্রের পুরো অংশটুকুই আন্তর্জাতিক জলসীমার অন্তর্গত যাতে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের আইনগত অধিকার স্বীকৃত। যেকোনো দেশই এখানে মৎস্য শিকার, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ও গবেষণা, তলদেশে ক্যাবল নেটওয়ার্ক স্থাপন, সামরিক মহড়া পরিচালনা করতে পারবে। তবে বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র এই আন্তর্জাতিক জলসীমার নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে তার জগদ্বিখ্যাত ইউএস নেভির মাধ্যমে। উল্লেখ্য, আমেরিকা এখন পর্যন্ত UNCLOS এ স্বাক্ষর করেনি।
এখন সমস্যা হলো, প্রতিবেশী দুইটি দেশের সমুদ্র-সীমার দূরত্ব যখন ৪০০ নটিক্যাল মাইলের কম থাকে তখনই তাদের অর্থনৈতিক সমুদ্র-সীমা (২০০ নটিক্যাল মাইল) নিয়ে টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়। কারণ এ শুধু পানি নয়, সম্পদের প্রশ্ন। এমতাবস্থায় কূটনৈতিকভাবে দ্বিপাক্ষিকভাবে দুই দেশের উপকূল থেকে সমদূরত্বের ভিত্তিতে সমাধান করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, যদি দুইটি দেশের আন্তঃজলসীমা হয় ২৫০ নটিক্যাল মাইল তাহলে প্রত্যেকে পাবে ১২৫ নটিক্যাল মাইল করে। এভাবে দ্বিপাক্ষিক সমাধান না হলে ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘International Tribunal for the Law of the sea’ এর সহায়তায় সমাধানের চেষ্টা করা হয়ে থাকে। কিন্তু ঐতিহাসিক শত্রুতা, ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা, আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা উপরোক্ত যেকোনো সমাধানকেই অগ্রাহ্য করে তোলে।
ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা ও বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তুরস্ক, গ্রিস, সাইপ্রাস, মিসর, ইসরাইল, লেবানন ও লিবিয়া পূর্ব ভূমধ্যসাগরে জলসীমা তথা নব্য আবিষ্কৃত গ্যাসের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য পক্ষে-বিপক্ষে ভাগ হয়ে গেছে। কারণ, যার জল-সীমানা যত বেশি তার সম্পদ প্রাপ্তির সম্ভাবনাও তত বেশি। প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পর্কিত এই বিবাদ সম্পর্কে জানার আগে চলুন জেনে নেওয়া যাক এই অঞ্চলের কিছু দেশের পারস্পরিক অতীত ও বর্তমান সম্পর্ক বিষয়ে যা তাদেরকে এ বিষয়ে মুখোমুখি দাড় করিয়েছে।
তুরস্ক বনাম গ্রিস ও সাইপ্রাস শত্রুতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার সেকাল-একাল
১৪৫৩ সালে অটোমানদের হাতে কনস্টান্টিনোপলের পতনের মাধ্যমে গ্রিস অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ১৮৩২ সালে Treaty of Constantinople এর মাধ্যমে গ্রিস অটোমানদের হতে স্বাধীনতা লাভ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পরাজয় হলে মূলভূমি তুরস্ক ছাড়া সাম্রাজ্যের বাকি অংশ ব্রিটিশ আর ফ্রেঞ্চদের নিকট হাতছাড়া হয়ে যায়। এমনকি ব্রিটিশরা অটোমানদের রাজধানী ইস্তাম্বুল এবং বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালিরও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। আর তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রিস, ইতালি, ফ্রান্স ও আর্মেনিয়া তুরস্কের চতুর্মুখী দখল নেয়। অতঃপর, তুর্কিরা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে গ্রিক, আর্মেনিয়ান আর ব্রিটিশদের হটিয়ে ১৯২৩ সালে স্বাধীনতা লাভ করে Treaty of Lausanne এর মাধ্যমে। এভাবে জন্মলগ্ন থেকেই গ্রিক-তুরস্ক শত্রুতার সৃষ্টি। এখনও সমুদ্র-সীমা, সাইপ্রাস প্রভৃতি নিয়ে তুরস্ক-গ্রিস দ্বন্দ্ব চলমান। এমনকি আজ পর্যন্ত তাদের মধ্যকার সমুদ্র-সীমাও নির্ধারিত হয়নি।
গ্রিস আন্তর্জাতিক সমুদ্র-সীমা আইন-১৯৮২ এর স্বাক্ষরকারী দেশ হলেও তুরস্ক এটিতে স্বাক্ষর করেনি। কারণ, তুরস্কের পশ্চিমের জলসীমায় পূর্ব ইজিয়ান সাগরে অনেকগুলো গ্রিক দ্বীপ রয়েছে যাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমুদ্র-সীমা যথাক্রমে ১২ ও ২০০ নটিক্যাল মাইল ধরা হলে তুরস্কের জলসীমার নিয়ন্ত্রণ মারাত্মক ভাবে ক্ষুণ্ণ হয়। তাই তুরস্ক এই রাজনৈতিক সীমা ৬ নটিক্যাল মাইল বজায় রাখতে চাপ অব্যাহত রাখছে যা কয়েক দশক ধরে তুরস্ক ও গ্রিস উভয়ে মেনে আসছিল। কিন্তু গ্রিস তার সমুদ্র-সীমা এখন ১২ নটিক্যাল মাইল নির্ধারণের কথা বলছে। আবার, তুরস্ক-গ্রিস স্বাক্ষরিত বিভিন্ন চুক্তিতে পূর্ব ইজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলোতে সামরিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হলেও বর্তমানে গ্রিসের অব্যাহত সামরিকীকরন দুই দেশের সম্পর্কে আরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
সাইপ্রাস নিয়ে দ্বন্দ্ব
সাইপ্রাস সংখ্যাগুরু গ্রিক এবং সংখ্যালঘু তুর্কি জনগোষ্ঠীর একটি ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ। এই দ্বীপটি ১৫৭১ সালে অটোমানরা দখল করে নেয়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পতন হলে দ্বীপটি সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশদের অধীনে চলে যায়। এরপর থেকেই শুরু হয় গ্রিক ও তুর্কি সাইপ্রিয়টদের বিভাজন। গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ ‘ইনোসিস (Enosis)’ নামের একটি ধারণা সাইপ্রাসে গ্রিক সাইপ্রিয়টদের মাঝে ছড়িয়ে দেয় যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে সাইপ্রাসকে গ্রিসের সাথে সংযুক্তিকরণ। ১৯৫০ এর দশকে সাইপ্রাস অর্থোডক্স চার্চ এবং গ্রিকপন্থী সাইপ্রিয়টদের ‘EOKA’ নামক একটি চরমপন্থি সংগঠন ইনোসিস বাস্তবায়নে সহিংস কার্যক্রম শুরু করে। ফলশ্রুতিতে বহু ব্রিটিশ ও তুর্কি সাইপ্রিয়ট সহিংসতার শিকার হয়। অবশেষে, জুরিখ চুক্তির মাধ্যমে ১৯৬০ সালে ব্রিটিশদের থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রিপাবলিক অব সাইপ্রাস গঠিত হয়।
নব-রচিত সংবিধানে তুর্কি সাইপ্রিয়টদের অধিকার সংরক্ষিত করা হয়েছিল এবং গ্রিস ও তুরস্ককে এই দ্বীপের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তব অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছিল। গ্রিকপন্থী সাইপ্রিয়টরা সংখ্যালঘু তুর্কি সাইপ্রিয়টদের হত্যা এবং বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে থাকে এবং ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত গ্রিস ২০,০০০ সেনা প্রেরণ করে। অবশেষে জাতিসংঘ ১৯৬৪ সালে শান্তিরক্ষা বাহিনী প্রেরণ করে যা আজ পর্যন্ত বলবত রয়েছে।
কিন্তু গ্রিকপন্থী সাইপ্রিয়টরা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলে সাইপ্রাস গ্রিসের অধীনে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ফলে তুরস্ক সাইপ্রাসে সামরিক অভিযান চালায় এবং দ্বীপটির উত্তর অংশ দখলে নেয়। ১৯৮৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই উত্তর অংশটি ‘Turkish Republic of Northern Cyprus’ নামে আত্মপ্রকাশ করে এবং আজ অবধি শুধুমাত্র তুরস্ক তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অন্যদিকে গ্রিক অধ্যুষিত রিপাবলিক অব সাইপ্রাস নামে পরিচিত দ্বীপের দক্ষিণ অংশ জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ভুক্ত একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি-প্রাপ্ত রাষ্ট্র। ২০০৪ সালে দুই অংশকে একত্রীকরণের লক্ষ্যে জাতিসংঘের অধীনে একটি গণভোট আয়োজিত হয়েছিল। উত্তর সাইপ্রাসের ৬৫% জনগণ ‘হ্যাঁ’ ভোট দিলেও দক্ষিণের ৭৬% জনগণ ‘না’ ভোট দেয়। ফলে একত্রীকরণ সম্ভব হয়নি।
ফলে তুরস্ক এবং নর্দার্ন সাইপ্রাসের সাথে সাইপ্রাসের সমুদ্র-সীমা নিয়ে চরম বিরোধ রয়েছে। সাইপ্রাসের সমুদ্র-সীমার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ তুরস্ক ও নর্দার্ন সাইপ্রাস দাবি করে। সাইপ্রাস তার দাবীকৃত এলাকায় আমেরিকান কোম্পানি এক্সন মবিল, ফ্রেঞ্চ কোম্পানি টোটাল এবং ইতালিয়ান কোম্পানি এনিকে গ্যাস অনুসন্ধানের দায়িত্ব দিয়েছে। অন্যদিকে, তুরস্ক এই বিবদমান এলাকায় নিজেদের কোম্পানিকে অনুসন্ধানের জন্য পাঠিয়েছে। এই নিয়ে সেখানে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। গ্রিস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সাইপ্রাসকে সমর্থন দিচ্ছে। উত্তর সাইপ্রাসে এখনও তুরস্কের ৪০,০০০ সেনা মোতায়েন রয়েছে সম্ভাব্য গ্রিক হস্তক্ষেপ রোধ করার জন্য। মূলত, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তুরস্ক ও গ্রিস যথাক্রমে নর্দার্ন সাইপ্রাস ও সাইপ্রাসকে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করছে।
ইসরায়েল-লেবানন বৈরিতা
ইসরায়েল-লেবানন দ্বৈরথ এখন স্থলযুদ্ধ থেকে জলসীমায় এসে ঠেকেছে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত দুই দেশ বড় কোনো বিরোধে না জড়ালেও সম্পর্ক ভালো ছিল না। ১৯৮২ সালে ইসরাইল দক্ষিণ লেবানন আক্রমণ করে যার ফলশ্রুতিতে হিজবুল্লার জন্ম হয়। ২০০০ সালে ইসরাইল দক্ষিণ লেবানন ত্যাগ করে এবং জাতিসংঘ দুই দেশের মাঝে ব্লু লাইন নামক একটি সীমান্ত রেখা প্রতিষ্ঠা করে যা শান্তিরক্ষা মিশন UNIFIL রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। কিন্তু ২০০৬ সালে ইসরাইল ও হিজবুল্লার মধ্যে বড় ধরনের যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং তারপর থেকেই সীমান্তে উত্তেজনা ও সংঘর্ষ বিদ্যমান রয়েছে।
এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে সমুদ্র-সীমা বিরোধ। ২০০৮ সালে লেবানন সাইপ্রাসের সাথে তার সমুদ্র-সীমা নির্ধারণ করে। কিন্তু সমস্যা হল, ২০০৯ সালে লেবাননের দক্ষিণের জল-সীমানার ৮৫০ বর্গকিলোমিটার বিতর্কিত এলাকা ইসরাইল নিজের বলে দাবি করে। লেবানন বিষয়টি জাতিসংঘে নিয়ে যায় এবং যুক্তরাষ্ট্র এতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়। যুক্তরাষ্ট্র ৮৫০ বর্গ কি.মি. এলাকাকে দুইটি অংশে ভাগ করে দেয় যার মধ্যে ৪৬৮ বর্গ কি.মি. এলাকা লেবাননকে এবং ৩৯২ বর্গ কি.মি. এলাকা ইসরাইলকে দেয়ার প্রস্তাব করা হয়।
কিন্তু লেবানন এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ তাদের মতে যেখানে ইসরাইলের অধিকার ০% সেখানে অবৈধ দাবি উত্থাপন করে আমেরিকার মাধ্যমে প্রায় ৫০% সমুদ্র এলাকা ইসরাইল নিজের করে নিচ্ছে। উল্লেখ্য, লেবানন রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি। উপরন্তু, ইসরাইল আন্তর্জাতিক সমুদ্র-সীমা আইন-১৯৮২ তেও স্বাক্ষর করেনি। ২০১৩ সালের আমেরিকার এই মধ্যস্থতা ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধানের আশা কমে যায়। এদিকে নিজেদের সমুদ্র-সীমা তথা তেল ও গ্যাসের উপর ইসরায়েল দৃষ্টিপাত করলে ইসরায়েলের গ্যাস প্লাটফর্মগুলোতে হামলার হুমকি দিয়েছে হিজবুল্লাহ। ২০১৮ সালে ফ্রান্সের টোটাল, ইতালির এনি এবং রাশিয়ার নোভাটেক কোম্পানিকে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের দায়িত্ব দিয়েছে লেবানন। ইসরায়েল এ উদ্যোগের ব্যাপারে লেবাননকে সতর্ক করেছে।
পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্যাস আবিষ্কার
ইসরায়েলে একটি কৌতুক প্রচলিত আছে যে, তাদের নবী মোজেস (ইসলামে মুসা) দীর্ঘ ৪০ বছর হেঁটে মিসর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের এমন একটা জায়গায় অর্থাৎ ইসরায়েলে আসলেন যেখানে কোন তেল- গ্যাস নেই। এ কৌতুকের অবসান ঘটে ২০০৯ সালে ইসরায়েলের প্রথম গ্যাসক্ষেত্র ‘Tamar’ আবিষ্কারের মাধ্যমে। এর মজুত প্রায় ২৪০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার।
২০১০ সালে আবারো ইসরায়েলি জলসীমায় ‘leviathan’ নামক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় যার মজুত প্রায় ৪৫০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। এরপর ২০১১ সালে সাইপ্রাসের জলসীমায় আবিষ্কার হয় ‘Aphrodite’ গ্যাসক্ষেত্র। এদিকে ২০১৫ সালে মিসরের জলসীমায়ও আবিষ্কৃত হয় ৮৫০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার মজুতবিশিষ্ট ‘Al zohr’ গ্যাস-ফিল্ড যা তা দেখে সকলেরই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।
ভূতাত্ত্বিকরা বলছেন, ভৌগোলিক দিক থেকে কাছে হওয়ায় লেবানন, সিরিয়া, তুরস্কের জলসীমায়ও বিশাল গ্যাস মজুত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। ইউরোপের দোরগোড়ায় আবিষ্কৃত এই গ্যাসক্ষেত্রগুলো ঘরোয়া চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপে রপ্তানির জন্য যথেষ্ট। সাধারণত দুই উপায়ে গ্যাস রপ্তানি করা যায়- পাইপলাইন এবং তরলীকৃত গ্যাস (LNG)। এলএনজির খরচ বেশি হওয়ায় সাধারণত পাইপলাইনের মাধ্যমেই সকলে গ্যাস আমদানি করতে চায়। পাঠক, তাই এবার চলুন দেখে নেওয়া যাক পূর্ব ভূমধ্যসাগরের গ্যাসকে ঘিরে পাইপলাইনের রাজনীতির খেলা।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে কায়রোতে মিসরের উদ্যোগে ইসরায়েল, মিসর, সাইপ্রাস, গ্রিস, ইতালি, জর্ডান ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (ফাতাহ)- এই ৭ টি দেশের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘East Mediterranean Gas Forum’ যার সদর দপ্তর হয় কায়রোতে। ফোরামের উদ্দেশ্য হল, নিজেদের জলসীমায় আবিষ্কৃত গ্যাসকে কীভাবে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায়। এখানে তুরস্ক, উত্তর সাইপ্রাস, লেবানন, লিবিয়া ও সিরিয়াকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
গ্রিস ও সাইপ্রাসের সাথে তুরস্কের সমুদ্রসীমার বিরোধের কথা আগে বলা হয়েছে। ২০১৩ সালে মিসরের ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে তুরস্কের সাথে মিসরের দা-কুমড়া সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। তাছাড়া ফিলিস্তিন সম্পর্কিত বিভিন্ন ইস্যুতে তুরস্কের সরব ভূমিকা তুরস্ক-ইসরায়েল সম্পর্কেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এ সকল কারণে তুরস্ককে বাদ দেয়া হয়েছে যদিও তুরস্ক ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দানকারী প্রথম মুসলিম দেশ।
লেবাননের সাথে ইসরায়েলের স্থল এবং জল সীমান্তে বিরোধের কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৬৭ সালের ৬ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল কর্তৃক দখলকৃত সিরিয়ার গোলান মালভূমি নিয়ে সিরিয়ার সাথেও ইসরায়েলের বিরোধ রয়েছে। উপরন্তু সিরিয়া ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি। আবার লিবিয়াও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি। এছাড়া গ্রিসের সাথে লিবিয়ার সমুদ্র-সীমা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। এসব কারণে লেবানন, লিবিয়া এবং সিরিয়াকে ফোরামে রাখা হয়নি।
১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে মিসর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় এবং ১৯৭৯ সালে ইসরায়েলের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। তাছাড়া, মিসরের ক্ষমতা এখন ইসলামপন্থীদের থেকে হাতছাড়া হয়ে স্বৈরশাসক সিসির হাতে। আর জর্ডানের সাথে ইসরায়েলের ১৯৯৪ সালে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ ফাতাহ ১৯৯৩ সালে অসলো শান্তিচুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। যার কারণে এই দুইটি আরব দেশ এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে ফোরামে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মূলত, এই গ্যাস ফোরাম কোন সার্বজনীন পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় ফোরাম নয়। বরং এটি ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের বিরুদ্ধে একটি ফোরাম হয়ে উঠেছে।
ইস্টমেড গ্যাস পাইপলাইন চুক্তি-২০২০
ইউরোপ গ্যাসের জন্য বরাবরই রাশিয়ার মুখাপেক্ষী, আর সরবরাহ রুটের জন্য অর্থাৎ পাইপলাইন গমনের জন্য তুরস্কের মুখাপেক্ষী। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্যাস আবিষ্কার ইউরোপকে রাশিয়া এবং তুরস্কের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ হল, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় গ্যাস পাইপলাইন চুক্তি East mediterranean (EastMed) gas pipeline যা ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি গ্রিসের এথেন্সে গ্রিস, সাইপ্রাস এবং ইসরায়েল এই তিন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণ কর্তৃক স্বাক্ষরিত হয়। ২০০০ কি.মি. দীর্ঘ এই পাইপলাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ বিলিয়ন ডলার। এই পাইপলাইনের পথ-পরিক্রমা হল- ইসরায়েল-সাইপ্রাস-ক্রিট দ্বীপ-গ্রিস-ইতালি। এই পাইপলাইন ইউরোপের প্রায় ১০% গ্যাসের চাহিদা মেটাবে। তুরস্ক শুরু থেকেই এই চুক্তির ঘোরতর বিরোধী। কিন্তু তুরস্ক এবং নর্দার্ন সাইপ্রাসের বিরোধিতা এবং তুরস্ক-লিবিয়া MOU চুক্তি সত্ত্বেও এটি স্বাক্ষরিত হয়।
এবার জানবো, এই MOU চুক্তি কী এবং তা কীভাবে এই ইস্টমেড গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর লিবিয়ায় ত্রিপলিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান এবং লিবিয়ার জিএনএ প্রধান ফায়েজ আল সারাজের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ‘Memorundum of Understanding (MOU)‘ চুক্তি। উল্লেখ্য, লিবিয়ায় সারাজ নেতৃত্বাধীন ত্রিপোলিভিত্তিক ‘Government of National Accord (GNA)’ এবং জেনারেল হাফতার নেতৃত্বাধীন তবরুকভিত্তিক ‘Libyan National Army (LNA)’ এর মধ্যে ২০১৪ সাল থেকে গৃহযুদ্ধ চলছে। এদের মধ্যে জিএনএ হল জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কর্তৃক স্বীকৃতি-প্রাপ্ত। তবে বাস্তবে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, রাশিয়া, ফ্রান্স হাফতারকে সমর্থন দিলেও জিএনএ সরকারের সহযোগিতায় কেউ এগিয়ে আসেনি। জেনারেল হাফতারের আক্রমণে ত্রিপলি পতনের আশংকা দেখা দিলে সারাজ তুরস্কের সাহায্য কামনা করেন।
অন্যদিকে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় গ্যাস ফোরাম থেকে তুরস্কের বাদ পড়া এবং ইস্টমেড পাইপলাইন পরিকল্পনা তুরস্কের সমুদ্র-সীমা তথা সম্পদ সংরক্ষণের প্রতি হুমকি হয়ে উঠে। আবার ২০১১ সালে আরব বসন্তে মিসরে তুরস্ক সমর্থিত মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতা লাভ করলেও ২০১৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়। তাই লিবিয়ার জিএনএ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে না পারলে একদিকে যেমন আরব বসন্ত বিরোধী ফ্রন্ট পুরোপুরি জয়ী হয়ে যাবে তেমনি অন্যদিকে ইসরায়েল-মিসর-সাইপ্রাস-গ্রিস ফ্রন্ট লিবিয়াকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করে তুরস্ককে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে পুরোপুরি ঘেরাও করে ফেলবে। ফলে লিবিয়ায় তুরস্কের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও হুমকির মুখে পড়বে।
এমতাবস্থায়, এই MOU চুক্তি তুরস্ক এবং লিবিয়া উভয়ের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই চুক্তিতে তুরস্ক ও লিবিয়ার সমুদ্র-সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে যেখানে উভয় দেশের অর্থনৈতিক সমুদ্র-সীমা সংযোগ করে একটি করিডোর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাই কোন ধরনের পাইপলাইন পূর্ব ভূমধ্যসাগর থেকে ইউরোপে যেতে হলে এই করিডোর দিয়ে যেতে হবে এবং এক্ষেত্রে এই দুই দেশের অনুমতি লাগবে।
এই চুক্তির আরেকটি দিক হল, এখন থেকে জিএনএ সরকার তুরস্কের গোয়েন্দা ও সামরিক সহযোগিতা পাবে। তবে এই চুক্তির একটি দুর্বল দিক হল, জিএনএ সরকার টিকে থাকলেই কেবল এই চুক্তি টিকে থাকবে। জিএনএ সরকারের যদি পতন হয় তাহলে এই চুক্তিও বাতিল হয়ে যাবে। তাই যেভাবেই হোক না কেন, জিএনএ সরকারকে টিকিয়ে রাখাই লিবিয়ায় তুরস্কের মূল লক্ষ্য। ২০২০ সালের ২ রা জানুয়ারি তুরস্কের পার্লামেন্ট এই চুক্তি অনুমোদন করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে লিবিয়ায় তার সামরিক সহযোগিতা প্রদান শুরু করে।
MOU চুক্তি বনাম ইস্টমেড পাইপলাইন চুক্তি
তুরস্ক-লিবিয়া চুক্তিটি গ্রিসের ক্রিট দ্বীপের অর্থনৈতিক সমুদ্র-সীমাকে উপেক্ষা করেই হয়েছে। গ্রিসে লিবিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং গ্রিসের সমুদ্র-সীমায় তুরস্কের কোন অনুসন্ধানমূলক কার্যক্রম দেখলেই সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। আবার, তুরস্ক লিবিয়ার জিএনএ সরকারকে সামরিকভাবে সহায়তা করায় ক্ষেপে গিয়েছে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের অপর পক্ষ জেনারেল হাফতার ও তার সমর্থনদানকারী দেশ মিশর ও ফ্রান্স। চুক্তির পরপরই গ্রিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিবিয়া এবং মিসর সফর করেন। হাফতার এই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেন এবং মিসরও একই অবস্থান নেয়। উপরন্তু এই চুক্তি ইস্টমেড পাইপলাইনের প্রতি একটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে যা ইসরায়েলকেও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
অন্যদিকে তুরস্ক এই চুক্তির মাধ্যমে জানান দিচ্ছে যে, ইস্টমেড পাইপলাইন ‘ইসরায়েল-সাইপ্রাস-ক্রিট দ্বীপ-গ্রিস-ইতালি ‘রুটের পরিবর্তে’ ইসরায়েল-সাইপ্রাস-তুরস্ক- ইউরোপ’ রুট দিয়ে যেতে হবে। ফলে দুই পরস্পরবিরোধী চুক্তি এবং তার স্বাক্ষরকারী ও সমর্থনকারী দেশগুলো এক ধরনের মুখোমুখি অবস্থানে চলে এসেছে।
ইসরায়েল-জর্ডান গ্যাস পাইপলাইন চুক্তি
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, জর্ডান পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় গ্যাস ফোরামের একটি সদস্য দেশ। ১৯৯৪ সালে জর্ডানের সাথে ইসরায়েলের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও পরবর্তীতে তেমন কোনও সহযোগিতা চুক্তি তারা করেনি। কিন্তু ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল-জর্ডান গ্যাস পাইপলাইন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই ১০ বিলিয়ন ডলার চুক্তির আওতায় আগামী ১৫ বছরে জর্ডানের ৪০% গ্যাসের চাহিদা মেটাবে ইসরায়েল। এই চুক্তি এবং পাইপলাইন নির্মাণের বিরুদ্ধে জর্ডানে প্রবল মতবিরোধ রয়েছে, ‘Enemy’s gas is occupation’ নামে একটি আন্দোলন গড়ে উঠেছে।
বিরোধিতা-কারীদের যুক্তি হল, এই ১০ বিলিয়ন ডলারের মাধ্যমে জর্ডান ইসরায়েলকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করছে অথচ এই অর্থ জর্ডানের নিজস্ব জ্বালানি ও শক্তি-খাতে ব্যয় করা যেত। আবার যে কোনও ইস্যুতে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে ইসরায়েল যেকোনো মুহূর্তে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। তখন জর্ডান কী করবে? আর অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাবার জন্য কি লিবিয়া, আলজেরিয়া বা কাতার থেকে গ্যাস আমদানি করা যেত না? এতসব বিরোধিতা ও প্রশ্নের মুখেই চুক্তি অনুসারে পাইপলাইনের কাজ এগিয়ে চলছে। অবশ্য ১৯৯৪ সালের শান্তিচুক্তিও জনমত উপেক্ষা করেই সম্পাদন করেছিল জর্ডানের রাজপরিবার।
মিসর-ইসরায়েল গ্যাস পাইপলাইন চুক্তি
ভূমধ্যসাগরে আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় গ্যাস-ফিল্ড মিসরের। পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় গ্যাস ফোরামের উদ্যোক্তা দেশও মিসর। ইসরায়েল-জর্ডান চুক্তির মতোই ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত হয় ইসরায়েল-মিসর গ্যাস চুক্তি। চুক্তি অনুযায়ী, ২০ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে আগামী ১৫ বছরে ইসরায়েল মিসরে ৮৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস রপ্তানি করবে। মিসর এই আমদানিকৃত গ্যাসের একটি অংশ স্থানীয় চাহিদা মেটাতে এবং বাকি অংশ তরলীকরণ করে এলএনজি রূপে ইউরোপে রপ্তানি করবে। কারণ মিসরের ২টি এলএনজি প্ল্যান্ট রয়েছে যা এই অঞ্চলের অন্য কারো নেই। সবচেয়ে বড় গ্যাস-ফিল্ড আবিষ্কার এবং ইসরায়েল থেকে আমদানিকৃত গ্যাস পুনঃ-রপ্তানির মাধ্যমে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের এনার্জি হাব হওয়ার স্বপ্ন দেখছে মিসর। তবে ইস্টমেড পাইপলাইন প্রজেক্টে মিসরের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় তার সেই স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ফলে আমেরিকার মধ্যস্থতায় মিসর ও জর্ডানে গ্যাস রপ্তানি করে এবং ইস্টমেড পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির মাধ্যমে ইসরায়েলই হয়ে উঠছে এই অঞ্চলের প্রকৃত শক্তিকেন্দ্র।
আমেরিকা বনাম রাশিয়া
এখন কথা হল, ভূমধ্যসাগরে এরকম এক জটিল ভূরাজনৈতিক খেলার উদ্ভব হয়েছে অথচ তাতে দুই বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার ভূমিকা থাকবে না, তা কি হয়? তাই এখানেও কে কাকে টেক্কা দেবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। আমেরিকা সমর্থিত ইস্টমেড গ্যাস পাইপলাইন হয়ে উঠতে পারে রাশিয়ার গলার কাঁটা। কীভাবে? চলুন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি।
ইউরোপের জ্বালানি চাহিদার প্রায় ৭৭% ই আমদানিকৃত। আর ইউরোপে গ্যাসের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী দেশ হল রাশিয়া। ভৌগোলিক দিক থেকে কাছে হওয়ায় পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপের প্রায় ৪৩% গ্যাসের চাহিদা মেটায় রাশিয়া। কিন্তু এই ৪৩% গ্যাস আটলান্টিকের অপর পাড়ের দেশ আমেরিকা থেকে এলএনজি রূপে আমদানি করলে ইউরোপের ব্যয় বহুগুণে বেড়ে যেত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ইউরোপ রাশিয়ার গ্যাসের উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে রাশিয়া তার রাজনৈতিক প্রভাব অব্যাহত রাখতে পারছে। তাই ইউরোপ বিকল্প কোনও দেশ থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস আমদানি করার মাধ্যমে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে। আর এ উদ্যোগকে আমেরিকা তার সর্বস্ব দিয়ে সাহায্য করছে।
২০১৪ সালে ইউক্রেন সংকটকালে আমেরিকা ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সাহায্য করেছে। রাশিয়া থেকে ইউক্রেন হয়ে ইউরোপে গ্যাস পাইপলাইন তখন বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ নিয়ে বিপাকে পড়ে রাশিয়া। কিন্তু রাশিয়া নতুন ২ টি পাইপলাইন নির্মাণের মাধ্যমে তার সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। একটি হল তুরস্ক হয়ে ইউরোপে প্রবেশের ৯০০ কি.মি. দীর্ঘ টার্ক-স্ট্রিম পাইপলাইন যা কৃষ্ণ সাগরের নিচ দিয়ে গেছে। অন্যটি হল, জার্মানি হয়ে ইউরোপে প্রবেশের নর্ড-স্ট্রিম পাইপলাইন যা বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে গেছে।
অপরদিকে সিরিয়াতে রাশিয়া কাতার এবং ইরানকে হটিয়ে জ্বালানির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সিরিয়ান জলসীমায় গ্যাস সম্পর্কিত বিষয়ে রাশিয়ান কোম্পানি Soyuzneftgaz ২৫ বছরের চুক্তিও করেছে।
কিন্তু ইউরোপ রাশিয়ার গ্যাসের উপর নির্ভরতা কমাতে বিকল্প প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে এবং অবধারিতভাবে আমেরিকারও এতে সমর্থন রয়েছে। সাউদার্ন গ্যাস করিডর নামে পরিচিত এই প্রজেক্টটি বাস্তবায়িত হলে আজারবাইজান হতে গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে পৌঁছাবে। তুর্কমেনিস্তান-আজারবাইজান রুটে ট্রান্স-কাস্পিয়ান পাইপলাইন, আজারবাইজান-জর্জিয়া-তুরস্ক রুটে ট্রান্স-আনাতোলিয়ান পাইপলাইন (Trans-anatolian pipeline -TANAP) এবং তুরস্ক-গ্রিস-ইতালি রুটে ‘Trans-adriatic sea pipeline’ প্রতিষ্ঠা হল এই প্রজেক্টের মূল উদ্দেশ্য। লক্ষণীয় বিষয় হল, তুরস্ক রাশিয়া সমর্থিত টার্ক-স্ট্রিম পাইপলাইন এবং আমেরিকা সমর্থিত TANAP নির্মাণের মাধ্যমে উভয় দিকেই সমতা রক্ষা করছে। এই প্রেক্ষাপটে আমেরিকা সমর্থিত ইস্টমেড গ্যাস পাইপলাইন এবং সাউদার্ন গ্যাস করিডর ইউরোপের জ্বালানি চাহিদা অনেকাংশে মেটাবে যা রাশিয়ার অন্যতম ভালো বিকল্প। এই পরিস্থিতি রাশিয়া কীভাবে সামাল দেবে এবং ইউরোপে নিজের বাজার ধরে রাখবে সেটাও একটি দেখার বিষয়।
মধ্যপ্রাচ্যের বিগত ১০০ বছরের তেলসম্পদভিত্তিক রাজনীতির সাথে এ শতাব্দীতে যুক্ত হয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং পাইপলাইন-ভিত্তিক রাজনীতি। একদিকে রাশিয়া ইউরোপে তার গ্যাসের বাজার ধরে রাখতে মরিয়া আর অন্যদিকে আমেরিকা রাশিয়ার ‘গ্যাস’ থেকে ইউরোপকে মুক্ত করতে সচেষ্ট। একদিকে তুরস্ক চায় ইউরোপগামী সকল পাইপলাইনের মধ্যমণি হয়ে বিশ্বের এনার্জি-হাব হয়ে উঠতে, অন্যদিকে ভূমধ্যসাগরীয় কিছু দেশ চায় তুরস্ককে এড়িয়ে তার এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে প্রতিহত করতে। তাই সাইপ্রাস এবং লিবিয়ার মতো দ্বিধাবিভক্ত দেশগুলো হয়ে উঠছে এই প্রতিযোগিতার লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্র। ভূমধ্যসাগরীয় এই গ্যাস একদিকে যেমন পুরনো শত্রুতাকে নতুন রূপ দিয়েছে, তেমনি মিত্র বেশে শত্রুর সাথে মৈত্রী স্থাপন করার মাধ্যম হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছে।
তাই এই চরম ঘোলাটে এবং জটিল উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কাউকে বাদ দিয়ে বা কাউকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে শুধুমাত্র নিজ পক্ষের এজেন্ডা বাস্তবায়ন সংঘর্ষের বারুদে আগুন জ্বালানোরই নামান্তর। কারণ, সাংঘর্ষিক পরিবেশ সৃষ্টি হলে কোনো পক্ষই নিজের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভ করতে পারবে না। তাই, সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি অর্থবহ আলোচনাই পারে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিভেদকে পাশে সরিয়ে এই গ্যাসকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি সোপান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। আর রাজনৈতিক বিভেদ পাশে সরিয়ে রাখার একমাত্র উপায় হল নিজের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্যতার পরিচয় দেওয়া যা হয়তো এই অঞ্চলে অভূতপূর্ব, কিন্তু অসম্ভব নয়।