প্রাচীন মিশর মানেই যেন নীল নদ, পিরামিড, ফারাও, মমি, ও হায়ারোগ্লিফিকের বর্ণিল চিত্র মনের পর্দায় ভেসে ওঠা। রহস্যময় সকল মমি-পিরামিড ও ফারাওদের বিচিত্র ইতিহাস রহস্য পিপাসু মানুষদের কাছে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতাকে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলেছে। প্রাচীন মিশরের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে যে ক’জন ফারাওয়ের নাম ইতিহাসে গুরুত্বের সাথে লেখা রয়েছে, তাদের মধ্যে তুতেনখামেন অন্যতম। প্রাচীন মিশরের প্রসঙ্গে পিরামিডের পর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ছবি বোধহয় তুতেনখামেনের স্বর্ণের মুখোশটি। তবে বীরযোদ্ধা নিষ্ঠুর শাসক হিসেবে নয়, তুতেনখামেন ‘প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাস’ অংশে জনপ্রিয় হয়ে আছেন তার বিখ্যাত অভিশাপ ঘটনার কারণে।
কে এই তুতেনখামেন?
ফারাও তুতেনখামেন ছিলেন মিশরীয় ফারাওদের ১৮তম বংশের একজন রাজা। খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৪১ অব্দের কাছাকাছি সময়ে প্রাচীন মিশরের আমারনায় জন্ম নেন তিনি। তুতেনখামেন নাম ছাড়াও তিনি তুতানখামুন, তুতেনখাতুন বা সংক্ষেপে শুধু রাজা তুত নামেও পরিচিত ছিলেন। শুরুতে বংশপরিচয় নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, তার পিতা যে আখেনাতেন, তা ২০১০ সালে এক ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। পিতার মৃত্যুর পর মাত্র আট বছর বয়সেই দেশ পরিচালনার দায়ভার কাঁধে দিয়ে সিংহাসনে বসানো হয় তাকে। তবে তার রাজত্বকাল ছিল খুবই অল্প (১৩৩৩ খ্রি. পূ. – ১৩২৩ খ্রি. পূ.)। বছরের হিসেবে মাত্র দশ বছর। আঠারো বছর বয়সেই মৃত্যু হয় তার।
এত অল্প বয়সে রাজা হওয়ায় তিনি কিশোর রাজা নামেও পরিচিতি পান। ২০১০ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, রাজার শরীরের রক্তে লোহিত রক্তকণিকার ঘাটতি ছিল। ২০১৪ সালে তুতের ভার্চুয়াল অটোপ্সি করে দেখা হয়, তার বাম পায়ে একটি হাড়ের রোগ ছিল। তখনকার ফারাওরা রক্ত বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য, আপন ভাই-বোনেরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতো। এ রকম নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে হলে জিন-ঘটিত অসুখ হবার সম্ভাবনা থাকে প্রবল। তাই হাড়ের রোগ হোক বা লোহিত রক্ত কণিকার অভাব, তার মৃত্যু হয়েছিল জিনগত কারণেই।
তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কার
১৯০৩ সালে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে সুস্থতার জন্য মিশরের কায়রোয় যান ইংল্যান্ডের ধনকুবের লর্ড কার্নারভন। যেহেতু মিশর মমি, পিরামিড, ফারাও, এবং বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদের জন্য বিখ্যাত, সেজন্য তিনি এক প্রকার শখের বশেই জিনিসগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলেন। সংবাদপত্রের মারফতে একটি খবর তার নজরে আটকে যায়। প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ থিওডোর ডেভিসের নেতৃত্বে মিশরের ‘ভ্যালি অব কিংস’ এ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্য চলছে।
কথায় আছে, ‘শখের তোলা আশি টাকা’। লর্ড কার্নারভনের মাথায় শখ চেপে বসল, নতুন কোনো পুরাকীর্তি আবিষ্কারের মাধ্যমে তিনিও ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবেন। সেজন্য তিনি যোগাযোগ করলেন মিশর সরকারের সাথে। সরকার কার্নারভনের আগ্রহকে গুরুত্বের সাথে নিয়ে তাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন হাওয়ার্ড কার্টারের সঙ্গে। থিওডোর ডেভিসের আমন্ত্রণে প্রায় দশ বছর আগে ফারাওদের আঁতুড়ঘর মিশরে এসেছিলেন হাওয়ার্ড কার্টার।
ভ্যালি অব কিংসের কাজ প্রায় শেষের পথে থাকায় এক দুশ্চিন্তা আচ্ছন্ন করেছিল তাকে। কারণ, নতুন কাজ না জুটাতে পারলে পেটে আহার পড়বে না। এ সময় তার নিকট দেবদূতের মতো এসে উদয় হলেন লর্ড কার্নারভন। প্রচুর টাকা পয়সার মালিক হওয়ায় তিনি কার্টারকে বললেন, নতুনভাবে খননকাজ শুরু করতে। খরচের সম্পূর্ণ বিষয়টা তিনি একাই সামলাবেন বলেও আশ্বাস দিয়েছিলেন। এর আগে থিওডোর ডেভিসের নেতৃত্বে চলা খননকাজে ফারাও রাজা তুতেনখামেনের নাম লিখা কিছু লিনেনের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছিলেন থিওডোর ও কার্টার। কার্টারের শক্ত বিশ্বাস ছিল, এই এলাকার কোনো স্থানেই স্বর্ণনির্মিত কফিনে শায়িত আছে কিশোর সম্রাট তুতেনখামেন। তাই, ভ্যালি অভ কিংসে খনন শুরু করার কথা ভাবলেন কার্টার। ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে শুরু হলো খোঁড়াখুঁড়ির কাজ।
এরপর পঞ্জিকার পাতা উল্টাতে উল্টাতে কেটে গেছে পাঁচটি বছর, কিন্তু কোথাও হদিস মেলেনি তুতেনখামেনের সমাধির। তখন একপ্রকার নিরাশ হয়ে লর্ড কার্নারভন জানালেন, এই খননকাজের পেছনে আর কোনো পয়সা খরচের ইচ্ছা নেই তার। কিন্তু, কার্টার বহু অনুরোধের পর আর একটি বছর চেয়ে নিল কার্নারভনের কাছ থেকে। ১৯২২ সালের নভেম্বরে আবারও শুরু করা হলো কাজ। নভেম্বরের ৪ তারিখ, সকাল ১০টা। কার্টারের এক শ্রমিক খুঁড়তে গিয়ে একটি সিঁড়ির সন্ধান পায়। কর্মীটি অদ্ভুত কিছুর আঁচ পেয়ে সাথে সাথে ছুটে গেল খনন দলের প্রধান হাওয়ার্ড কার্টারের নিকট। দ্রুত সেখানে পৌঁছানোর পর, কার্টার তার দলবল নিয়ে গর্তটি খোঁড়া শুরু করেন। তীব্র উত্তেজনা নিয়ে খুঁড়তে থাকা কার্টার তখন খুঁজে পেয়েছিলেন পাথরের টুকরোর তলায় চাপা পড়ে থাকা একটি সিঁড়ি। যা ধাপে ধাপে নিচে গিয়ে ঠেকেছিল। সেই সিঁড়ি থেকে বড় বড় ভারী পাথর সরানোর পর দৃশ্যমান হয়ে উঠল বন্ধ দরজার একটি অংশ। দরজাটির উপর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মিশরীয় রাজকীয় কবরখানার সিল।
পিলে চমকে উঠলো হাওয়ার্ড কার্টারের, হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানিও বেড়ে গেল কয়েকগুণ। তবে কি তিনি বহুল প্রতীক্ষিত তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কার করে ফেলেছেন? কর্মীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছেন কালজয়ী ইতিহাসের প্রথম চাক্ষুষ সাক্ষী হবার জন্য। কিন্তু কার্টার মনস্থির করলেন, তিনি এটা লর্ড কার্নারভনকে নিয়েই খুলবেন। সেজন্য তিনি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন কার্নারভনের কাছে। টেলিগ্রাম পাওয়ার সাথে সাথেই সুদূর ইংল্যান্ড থেকে স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে মিশরে পাড়ি জমালেন কার্নারভন। যতোই হোক ইতিহাসের সাক্ষী হতে হবে!
২৯ এ নভেম্বর চলে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কার্টার তার খননদল, লর্ড কার্নারভন, মিশরের যুবরাজ, সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ও মিশরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে সামনে রেখে খুলে ফেললেন সেই সিল মারা দরজা। যা ভেবেছিলেন, তাই। এটাই তুতেনখামেনের সমাধি! ভেতরে কার্টারের জন্য অপেক্ষা করছে অফুরন্ত বিস্ময়, তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে অগণিত সোনাদানা, হিরে-জহরত ও মূল্যবান ধন-রত্ন।
একে একে সবাই ঢুকতে লাগল তুতেনখামেনের সমাধিতে, প্রতিটা জিনিস দেখে যারপরনাই মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হলো সবাই। সাধারণত মিশরীয় ফারাও মমির সমাধিসৌধগুলো অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যেত না। ডাকাত দল ভেতরের সকল সোনাদানা লুট করে চলে যেত। কিন্তু সেদিক থেকে তুতের সমাধি ছিল ব্যতিক্রম। কোনো ধনরত্ন খোয়া যায়নি এর থেকে। কারণ, কার্টারের আগে কোনো মানুষ তো এর সন্ধানই খুঁজে পায়নি। শোনা যায় সমাধি কক্ষে প্রবেশের পরই কার্টার প্রাচীন মিশরীয় লিপিতে কিছু লেখা দেখতে পান। হায়ারোগ্লিফিকের ভাষা থেকে এর মর্মার্থ উদ্ধার করলে এমন দাঁড়ায়,
‘যে রাজার চিরশান্তির ঘুম ভাঙাবে, তার উপর নেমে আসবে অভিশাপ।’
অভিশাপ ছিল মিশরীয়দের ‘হেকা’ নামক জাদুবিদ্যার অমোঘ এক অস্ত্র, যেটিকে তারা তাদের ঈশ্বরের উপহার হিসেবে আখ্যায়িত করত। তারা ভাবত, অভিশাপের সাথে সরাসরি সংযোগ আছে অতিপ্রাকৃতিক মহাজাগতিক অদৃশ্য কোনো শক্তির, যা নিয়ন্ত্রণ করা হতো মহাজগৎ বা মহাজাগতিক কোনো প্রাণীর দ্বারা।
তাদের এই তাজা খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো কয়েকদিন পর্যন্ত শুধু এই খবর নিয়েই থাকল সরগরম। খনন দল রাতারাতি হয়ে উঠল বিশ্ববিখ্যাত। কিন্তু তাদের এই উল্লাস বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। খনন দলের বেশিরভাগ কর্মীই ছিলেন মিশরের অধিবাসী। তারা ভালো করেই জানতেন, প্রাচীন কবরগুলোতে খোদাই করা রয়েছে ভয়ংকর অভিশাপ। কিন্তু কুসংস্কারে অবিশ্বাসী কার্টার তখন তাদের কথা আমলে নেননি। সমাধির ভেতরে মূল্যবান সোনার জিনিস দেখে সবাই মুগ্ধ হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সেই মুগ্ধতার মূল্য কি চুকানো হয়েছিল ফারাও সম্রাটকে বিরক্ত করার মাধ্যমে? তার হাজার বছরের শান্তির ঘুম ভাঙানোর ফলে কি তিনি ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন? তার অভিশাপ কি মৃত্যুরূপে বর্ষিত হয়েছিল খননকাজের সাথে সম্পৃক্তদের উপর? কিছু ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে তা এক পলক দেখে নেয়া যাক।
১. তুতেনখামেনের সমাধি উন্মোচনের পরের দিনই কার্টারের প্রিয় পাখি ক্যানারি এক গোখরোর ছোবলে মারা যায়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ফারাওদের মুকুটে গোখরোর ফণা তোলা সাংকেতিক চিহ্ন বিদ্যমান।
২. ১৯২৩ সালের ৫ এপ্রিল এই খনন অভিযানে অর্থের যোগানদাতা লর্ড কার্নারভন মৃত্যুবরণ করেন। কেউ কেউ বলেন তিনি সামান্য এক মশার কামড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আবার কারও কারও মতে, শেভ করার সময় গলা কেটে অতিরিক্ত রক্তপাত হয়ে মারা যান তিনি।
৩. লর্ড কার্নারভনের মৃত্যুর কয়েক-ঘণ্টা পরেই তার কুকুরটি কোনো একটা কিছুকে তাড়া করতে গিয়ে মারা যায়।
৪. সমাধিতে যারা পা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে আমেরিকান ধনকুবের জর্জ গোল্ড অন্যতম, যিনি পেশায় ছিলেন রেলপথ নির্বাহী। ১৯২৩ সালে তুতেনখামেনের সমাধি পরিদর্শনকালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর আর সুস্থ হননি। কয়েক মাস নিউমোনিয়ায় ভুগে তিনি মারা যান।
৫. সমাধির ভেতরের ছবি ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন তৎকালীন মিশরের যুবরাজ আলি কামেল ফাহমি। ১৯২৩ সালে নিজ পত্নীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান যুবরাজ।
৬. তুতেনখামেনের মমি সর্বপ্রথম এক্স-রে করেছিলেন স্যার আর্চিবোল ডগলাস বে। এক্স-রে করার পরের দিনই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। সেই অসুস্থতা তার শরীরে বিদ্যমান ছিল বহুদিন। ১৯২৪ সালের ২৪ জানুয়ারি তার মৃত্যু হয়।
৭. ফ্র্যাঙ্ক র্যালে নামক একজন ফটোগ্রাফার ছবি তুলেছিলেন তুতেনখামেনের কবর ঘরে। তিনি অন্ধ হয়ে ভগ্নহৃদয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
৮. দক্ষিণ আফ্রিকার ধনী ব্যবসায়ী ওল্ফ জোয়েল শখের বশে সাক্ষী হয়েছিলেন তুতেনখামেনের মমি দেখার। এর কিছুদিন পরেই সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে স্ট্রোক হয় তার। তাতে মারা যান তিনি।
৯. সমাধিটি দেখতে এসেছিলেন সুদানের গভর্নর জেনারেল স্যার লি স্ট্যাক। তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয় কায়রোতে।
১০. আর্থার মেস নামক এক খননকর্মী ছিল কার্টারের দলে। আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় তিনি বেঘোরে প্রাণ হারান ১৯২৮ সালে।
১১. তালিকায় আছে হাওয়ার্ড কার্টারের পার্সোনাল সেক্রেটারি রিচার্ড বেথেলও। তিনিই কার্টারের পেছনে সবার আগে সমাধিতে প্রবেশ করেছিলেন। ১৯২৯ সালের ১৫ নভেম্বর লন্ডনের একটি অভিজাত ক্লাবের কামরা থেকে তার পুড়ে যাওয়া লাশ উদ্ধার করা হয়।
১২. রিচার্ড বেথেল তার বাড়িতে তুতের সমাধি থেকে পাওয়া কিছু প্রত্ন সম্পদ তার বাড়িতে সাজিয়ে রেখে দিয়েছিলেন। রিচার্ডের বাবা বৃদ্ধ লর্ড ওয়েস্টবেরি প্রায় সময়ই আপনমনে বিড়বিড় করে বলতেন, “এই জিনিসগুলো অভিশপ্ত। এগুলোতে ফারাওয়ের অভিশাপ রয়েছে।” তিনি নিজের লেখা সর্বশেষ চিরকুটে লিখে যান, “এই বিভীষিকা আমি আর সহ্য করতে পারছি না, আমি এর থেকে চির মুক্তি চাই।” তারপর তিনি সাত তলা দালান থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
১৩. মৃত্যুর পাঁচ দিন পর লর্ড ওয়েস্টবেরির কফিনকে একটি গাড়িতে চাপিয়ে গোল্ডার্স গ্রিনের কবরখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তখন সেই গাড়িতে ধাক্কা লেগে আট বছরের এক বালক নিহত হয়।
১৪. লর্ড কার্নারভনের মৃত্যুর ৫ মাস পরেই তার ভাই অব্রে হারবার্টের মৃত্যু ঘটে। জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন অব্রে হারবার্ট। এছাড়াও তখন দাঁতের সংক্রমণে ভুগছিলেন তিনি। চিকিৎসকরা জানান, দাঁতের সংক্রমণই তার অন্ধত্বের মূল কারণ। পরবর্তীতে কয়েক দফায় তার সংক্রমণ যুক্ত দাঁত তুলে ফেলা হলেও চোখের আলো ফিরে পাননি তিনি। অতিরিক্ত অস্ত্রোপচারের ফলে সেপসিসে মারা যান অব্রে।
১৫. সমাধি আবিষ্কারের সময় কার্টারের সাথে ইভেলিন-হোয়াইট নামক আরেক ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ উপস্থিত ছিলেন। ঘটনার পর থেকে ১৯২৪ সালের মধ্যে প্রায় বারো জন সহকর্মী হারান তিনি। অস্বাভাবিক গোছের ধারাবাহিক মৃত্যুর ঘটনায় প্রচণ্ড ঘাবড়ে যান ইভেলিন-হোয়াইট। এর কিছুদিন পরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। মৃত্যুবরণ করার আগে তিনি এক চিঠিতে লিখে যান, ‘আমি এমন এক অভিশাপের সম্মুখীন হয়েছি, যা আমাকে মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে বাধ্য করেছে।’
আসলেই অভিশাপ, নাকি পরিকল্পিত গুজব?
বিজ্ঞানের উন্নতির এই যুগে প্রগতিশীল ও বিজ্ঞানমনস্করা অভিশাপকে কুসংস্কারের ঝুড়িতেই ঠাঁই দেবে। কারো কারো মতে, সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের জনপ্রিয়তা ও বিক্রি-বাট্টা বাড়ানোর ধান্দায় সুপরিকল্পিত গুজব রটিয়েছিল। তারা গল্পগুলো এমন রসালো করে তৈরি করেছিল যে রহস্যপ্রিয় ও কৌতূহলী মানুষের তা না গিলে উপায় নেই। বিশেষজ্ঞরা মৃত্যুর পেছনে কিছু সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যা দিয়ে সেগুলোকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। এদিকে একবার নজর দেওয়া যাক।
১. শুরু থেকেই অধিকাংশ মিশরবাসীদের বিশ্বাস ছিল ফারাওয়ের সমাধিক্ষেত্রের ক্ষতিসাধন করা হলে, তার প্রতিশোধ নেবেন ক্ষমতাধর ফারাওরা। কারণ, একদম ছেলেবেলা থেকেই তারা মুখে মুখে প্রচলিত এই গল্প শুনে বড় হয়েছে। কার্টারের এই অভিযানের শুরু থেকেই বিভিন্ন অভিশাপের বানানো গল্প ছড়াতে থাকে, কিন্তু তখনও এই কাজে সংশ্লিষ্ট কারও মৃত্যু হয়নি। প্রথম রটা গুজবটা ছিল, সমাধির মূল ফটকের দেয়ালে নাকি লিখা আছে, “যে রাজার ঘুম ভাঙাবে, তার উপর নেমে আসবে মৃত্যুর পরছায়া।”
আবার এ রকম কথাও শোনা যায়, এই লেখাটি কার্টার পেয়েছিলেন সমাধির পাশের রাখা এক চিরকুটে। যদিও বাস্তবে এই কথার কোনো ভিত্তি নেই।
২. প্রাচীন মিশরীয় দেবতা আনুবিসের এক মূর্তিতে খচিত ছিল, “আমি দেবতা আনুবিস। আমি এমনভাবে এখানের বালুকণাকে আটকে দিই যেন কারও পক্ষে এই গোপন প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করা সম্ভব না হয়। আমি এই সমাধির রক্ষাকর্তা।” কিন্তু একজন সাংবাদিক সেই খবরকে রসিয়ে মৃত্যু সম্পর্কিত এক লাইন জুড়ে দেন। ফলে উক্তিটি দাঁড়ায় এ রকম, “আমি দেবতা আনুবিস। আমি এমনভাবে এখানের বালুকণাকে আটকে দিই যেন কারও পক্ষে এই গোপন প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করা সম্ভব না হয়। আমি এই সমাধির রক্ষাকর্তা। যারা সমাধিতে প্রবেশ করে রাজার শান্তির নিদ্রা ভাঙানোর চেষ্টা করবে, আমি তাদের করুণ মৃত্যু প্রদান করব।”
ব্যস আর যায় কোথায়? ফুলে-ফেঁপে খবর হিট!
৩. তুতেনখামেনের অভিশাপের গল্পটি শুরু হলে প্রথম দিকেই স্থান পায় গোখরো কর্তৃক কার্টার ক্যানারি পাখি বধ। গুজবটি ছড়ায় মূলত কার্টারের মিশরীয় এক পরিচারক। প্রকৃতপক্ষে, কার্টার তার পোষা পাখিটাকে কাজের সময় রেখে যেতেন তারই বন্ধু মিনি বার্টনের কাছে। কার্টারের ডায়েরি থেকেও কোবরা সংক্রান্ত কোনো ঘটনা পাওয়া যায় না।
৪. একবার গুজব ছড়ায়, তুতেনখামেনের কফিনের উপরে মিশরীয় চিত্রলিপিতে এক অভিশপ্ত বাণী বর্ণিত ছিল, যা দেখে শ্রমিকরা ভয়ে কাজ বন্ধ রাখে বেশ কিছুদিন। কিন্তু শিক্ষাহীন বা স্বল্প শিক্ষিত শ্রমিকেরা হাজার বছরের পুরনো হায়ারোগ্লিফিকের মর্মোদ্ধার করবে কীভাবে? এজন্য হতে হয় ঝানু বিশেষজ্ঞ, করতে হয় বিস্তর পড়াশোনা। তাই সত্যের কষ্টিপাথরে এই গুজবটিও মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। আবার তুতের সমাধি বা শবাধারের ছবিগুলোতে অভিশপ্ত কোনো বাণী পাওয়া যায়নি।
৫. সবচেয়ে বেশি জল ঘোলা হয় লর্ড কার্নারভনের মৃত্যুকে ঘিরে। একদিন শেভ করার সময় ভুলবশত তিনি গালের মশার কামড়ের একটি জায়গা ব্লেডের আঁচরে কেটে ফেলেন। যা পরবর্তীতে রূপ নেয় ব্লাড ইনফেকশনে। এই সংক্রমণের পর মৃত্যু হয় তার। মৃত্যুর ফলে অভিশাপ তত্ত্বের পালে হাওয়া লাগে আরও ঝড়ো বেগে। একইদিনে লন্ডনে তার কুকুর ‘সুশি’ মারা যাওয়ায়, দুই মৃত্যুকে কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে চমৎকার ও মুখরোচক ভৌতিক গল্প ছড়াতে থাকে সংবাদপত্রগুলো। তাছাড়া, ১৯০৩ সালে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় তিনি আগে থেকেই দুর্বল ছিলেন। এর বাইরেও তিনি ফুসফুস-জনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। শবাধারে জন্মানো ব্যাকটেরিয়া তার ফুসফুসের সমস্যাকে আরও বেশি বাড়িয়ে দিয়েছিল, যার ফলে তার মৃত্যু ঘটাটাই স্বাভাবিক ছিল তার।
৫. কার্নারভনের মৃত্যুর পর ‘কায়রোতে মানসিক ভারসাম্যহীনতা ছড়িয়ে পড়েছে’ এরকম আরেকটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তখন কায়রোতে মানসিক ভারসাম্যহীনতা রোগটি বিরাজমান ছিল।
৬. সমাধিক্ষেত্রটিতে হাজার বছর কোনো মানুষের পদচিহ্ন না পড়ার পাশাপাশি সেটা বদ্ধ থাকায়, তাতে অনেক প্রাণঘাতী ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণুর সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। দুর্বল শারীরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পন্ন কারও জন্য সেই ব্যাকটেরিয়া মারাত্মক দুর্ভোগ ডেকে আনতে পারে। এটাও হতে পারে কয়েকজনের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাচীন কিছু মমি ছত্রাকের জীবাণু (Aspergillus niger, Aspergillus flavus) বহন করে, যেগুলো সরাসরি ফুসফুসের রক্ত জমাট বাধা বা রক্তপাতের জন্য দায়ী। ফুসফুসের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার (Pseudomonas, Staphylococcus) সন্ধানও সমাধির দেয়ালে মিলেছে।
৭. অনেক মিশরবিদের ধারণা, তুতের মমি আবিষ্কারের শত বছর আগেই ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে গিয়েছিল মমি সংক্রান্ত সকল অভিশাপের উপাখ্যান। ইংরেজ কিছু লেখক তখন মমি নিয়ে লিখতে শুরু করে রহস্যপূর্ণ ও রোমাঞ্চকর সকল গল্প। এর মধ্যে লেখক লুইজা এলকটের ‘লস্ট ইন অ্যা পিরামিড’ বইটির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে গল্পে পিরামিডের গোলকধাঁধায় আটকে যাওয়া এক বিবাহিত দম্পতিকে খুন করেছিল ফারাওয়ের বিদেহী আত্মা!
৮. অভিশাপ সংক্রান্ত গুজব ছড়ানোর দৌড়ে গণমাধ্যম ও সংবাদপত্র সবচেয়ে বেশি এগিয়ে ছিল। এর পেছনে অবশ্য সুনির্দিষ্ট কিছু কারণও বিদ্যমান। প্রত্যেক পত্রিকাই চাইত, প্রথম পৃষ্ঠায় তুতেনখামেনের খবর প্রচার করতে। কারণ, সেসময় এটাই ছিল সারাবিশ্বের অন্যতম হট-টপিক। বিশ্বের নামি-দামি সকল গণমাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়ায় খনন কাজে বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এতে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছিলেন লর্ড কার্নারভন। তাই, তিনি লন্ডন ভিত্তিক বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘দ্য টাইমস’ এর সাথে এক চুক্তি করে বসেন। চুক্তি অনুযায়ী, শুধু ‘দ্য টাইমস’ এর সাংবাদিকেরা সমাধির ভিতর ঢুকতে পারবে। এই কর্মকাণ্ডে নাখোশ হয়েছিল অন্যান্য সংবাদপত্র, কারণ মমি সম্পর্কিত সকল খবরের জন্য তাদেরকে দ্য টাইমসের দিকে তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকতে হতো। উপায়ান্তর না পেয়ে বা ক্রোধের বশে তারা সকল তুতের সমাধি নিয়ে উদ্ভট, আজগুবি, ও অবান্তর সকল খবর ছাপাতে লাগল।
৯. তারকাদের মাঝে প্রথম লর্ড কার্নারভনের অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে কথা তুলেন লেখক মেরি কোরেলি। তার কাছে নাকি একটি আরবি পুঁথি সংরক্ষিত ছিল, যেটা থেকে তিনি জানতে পেরেছিলেন মমির অভিশাপ কতটা ভয়ংকর হতে পারে। তিনি জনসাধারণের নিকট প্রশ্ন রেখেছিলেন, কীভাবে শুধু একটি মশার কামড়ে মৃত্যু হতে পারে লর্ড কার্নারভনের? প্রশ্নটি উৎসুক জনতার মনে আরও রহস্যের জন্ম দেয়। সাথে ব্যবসায়িক স্বার্থ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তাতে মালমশলা মেশানোর জন্য ইংল্যান্ড ও আমেরিকার সংবাদপত্রগুলো তো ছিলই।
১০. সেই গুজবের স্রোতে বাকি সবার মতো গা এলিয়ে দিয়েছিলেন শার্লক হোমসের স্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়েলও। তার মতে তুতেনখামেনের অভিশাপের ফলেই মৃত্যু হয়েছে লর্ড কার্নারভনের। গুজব হয়ে উঠলো আরও শক্তপোক্ত আর জোরালো।
১১. ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল ২০০২ সালে প্রকাশিত এক আর্টিকেলে জানায়, খননকাজের সাথে যুক্ত ৪৪ জন ব্যক্তির অধিকাংশই স্বাভাবিকভাবে এবং পরিণত বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যারা কোন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের মৃত্যুও ঘটেছে সমাধি খননের ১০ বছরের মধ্যে।
১২. টানা সাত বছর ধরে তুতের সমাধি সৌধ পাহারা দিয়েছিলেন খননদলের আরেকজন সদস্য রিচার্ড অ্যাডামসন। তিনি বেঁচেছিলেন আরও ৬০ বছর পর্যন্ত।
১৩. অনেক মিশরবিদের ধারণা, কার্টার চোর ডাকাতের লুটপাটের হাত থেকে তুতের চ্যাম্বারকে বাঁচানোর জন্যই ইচ্ছা করেই অভিশাপের এই গুজব রটিয়েছেন।
১৪. রেল কোম্পানির মালিক জর্জ জে. গোল্ড কায়রোর ঠাণ্ডায় সর্দি হয়েছিল, তা থেকে নিউমোনিয়া। তখন সালফা ড্রাগ বা পেনিসিলিন আবিষ্কার হয়নি। প্রচলিত ঔষধ তাকে বাঁচাতে পারেনি। তখনকার যুগে এ রকম মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক।
১৫. শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জেমস ব্রেস্টেড তুতেনখামেনের সমাধি খননের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ১৯৩৫ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ায় আক্রমণে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল সত্তর। শবাধারে ওই ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব মিলেছে।
১৬. তুতের সমাধির প্রত্ন সম্পদ নিয়ে গবেষণা করেছেন, এমন দুইজন ব্যক্তি হলেন স্যার এডওয়ার্ড অ্যা বাজ (৭৯) এবং প্রফেসর পি ই নিউবেরি (৮০) । দুজনেই স্বাভাবিকভাবে এবং স্বাভাবিক বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রফেসর বাজের ভাষায়, “আমি তো মমি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি। কিন্তু কোনো শাপ আমায় ছুঁতে পারেনি।”
আরও ডজনখানেক মৃত্যু ও দুর্ঘটনাকে সমাধি আবিষ্কারের সাথে পেঁচিয়ে সেই সময়টাতে প্রচুর গল্প ও রহস্য প্রচলিত হয়, যেগুলো এখনো অবধি রয়ে গেছে। অথচ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তুতের সমাধি আবিষ্কারের পর প্রথম ১০ বছরে মাত্র ২ জন পরিদর্শনকারীর মৃত্যু হয়, এবং প্রায় সকলের মৃত্যুই ছিল স্বাভাবিক।