৩০ জুলাই, ১৯৪৫; উল্লাস করছে জাপানি সাবমেরিন আই-৫৮ এর নাবিকরা। দূরন্ত গতির মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস ইন্ডিয়ানাপোলিসকে ডুবিয়ে ক্যাপ্টেন হাশিমোতোর মুখে অবশেষে হাসি ফুটেছে। কিন্তু বিস্তারিত ঘটনা জানতে পেরে যুদ্ধের পর এই হাসি চির বিষাদে রূপ নিল। আর চারদিন আগে এই জাহাজ ডোবাতে পারলে হাজার হাজার জাপানি নাগরিকের জীবন বেঁচে যেত। কেননা উক্ত জাহাজ গোপন মিশনে বিশেষ এক কার্গো ডেলিভারি দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল। আর সেই কার্গো আর কিছুই নয়, হিরোশিমাতে ফেলা সেই পারমাণবিক বোমা ‘লিটল বয়’!
গুটিকয়েক অফিসার ব্যতীত যুদ্ধজাহাজের কেউই জানতো না যে তারা কী বহন করছে। বহুসংখ্যক জাপানির মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে হাজির হওয়া ইন্ডিয়ানাপোলিসের নাবিকদের কপালে নেমে আসে নির্মম দুর্ভোগ। টর্পেডোর আঘাতে ডুবে যাওয়ার পরবর্তী চারদিন ক্ষুধা-তৃষ্ণা ছাড়াও হাঙরের আক্রমণে একে একে মারা যায় ৫৭৯ জন নাবিক! এটি একক কোনো যুদ্ধজাহাজডুবির ঘটনায় সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা।
ইউএসএস ইন্ডিয়ানাপোলিস (CA-35) ছিল পোর্টল্যান্ড ক্লাস হেভি ক্রুজার। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা রাজ্যের রাজধানীর নামে নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৩১ সালে নির্মাণের পর এটি স্কাউটিং ফোর্স ১ এর ফ্ল্যাগশিপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্যাসিফিক থিয়েটারে এটি এডমিরাল রেমন্ড স্প্ৰুয়েন্সের ফ্ল্যাগশিপ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। D-Day, ব্যাটল অফ মিডওয়ে, লেইতে গালফ, ফিলিপাইন সি, ওকিনওয়াসহ একাধিক যুদ্ধে এটি অংশগ্রহণ করে।
৬১০ ফুট লম্বা জাহাজটির ডিসপ্লেসমেন্ট ১২,৯৬০ টন। চারটি ইঞ্জিনের সাহায্যে এটি ঘণ্টায় প্রায় ৬১ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারত। যুদ্ধজাহাজটির রেঞ্জ ছিল ১৯,০০০ কি.মি.। এসব কারণে পারমাণবিক বোমা ডেলিভারি দেয়ার টপ সিক্রেট মিশনে ইউএসএস ইন্ডিয়ানাপোলিসকে বেছে নেয়া হয়। জাহাজটিতে বিশালাকারের নয়টি কামান, অসংখ্য এন্টি এয়ারক্রাফট গান থাকলেও এর একমাত্র দুর্বলতা হলো এর কোনো টর্পেডো টিউব বা ডেপথ চার্জ লঞ্চার ছিল না। অর্থাৎ ইন্ডিয়ানাপোলিস পানির নিচের শত্রু সাবমেরিনের মোকাবেলায় একেবারে অক্ষম ছিল। এ ধরনের যুদ্ধজাহাজ সাধারণত তাদের এসকর্ট হিসেবে এন্টি সাবমেরিন অস্ত্রে সজ্জিত যুদ্ধজাহাজের প্রহরা নিয়ে চলাচল করে। কিন্তু ইন্ডিয়ানাপোলিসের মিশন এতটাই গোপনীয় ছিল যে তাকে এসকর্ট যুদ্ধজাহাজ না দিয়েই মিশনে পাঠানো হয়। মূলত জাপানি ইন্টেলিজেন্সের নজর এড়াতে এই ঝুঁকিপূর্ণ মিশনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে এসে আবিষ্কৃত হয় পারমাণবিক বোমা। ১৬ জুলাই, ১৯৪৫ সালে প্রজেক্ট ম্যানহাটনের প্রথম বোমার পরীক্ষা ‘ট্রিনিটি টেস্ট’ সংগঠিত হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পরই ইউএসএস ইন্ডিয়ানাপোলিস পরিশোধিত ইউরেনিয়াম-২৩৫ ও লিটল বয় বোমার প্রয়োজনীয় পার্টস নিয়ে রওনা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্যান ফ্রান্সিসকো নৌ ঘাঁটি থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের পার্ল হারবার ঘাঁটিতে পৌঁছাতে মাত্র ৭৪.৫ ঘণ্টা সময় নেয়, যা তৎকালীন রেকর্ড!
সেখান থেকে রিফুয়েলিংয়ের পর গন্তব্য ছিল ফিলিপাইন সাগরের তিনিয়ান আইল্যান্ড। ২৬ জুলাই সেখানে পারমাণবিক বোমার পার্টস ও ইউরেনিয়াম-২৩৫ পৌঁছে দিয়ে গুয়াম দ্বীপের মার্কিন ঘাঁটিতে নোঙর করে ইউএসএস ইন্ডিয়ানাপোলিস। প্রয়োজনীয় রসদ ও ক্লান্ত নাবিকদের বদলি করে ২৮ জুলাই এটি জাপানের ওকিনওয়া দ্বীপের অপারেশনে যোগ দিতে রওনা দেয়।
বলে রাখা ভাল, কার্গো ডেলিভারির আগে-পরে জাহাজটি কমপ্লিট রেডিও সাইলেন্স বজায় রাখে যেন জাপানিদের রেডিওতে ইন্ডিয়ানাপোলিসের উপস্থিতির কথা কোনোভাবেই ধরা না পড়ে। শত্রুপক্ষের কোন যুদ্ধজাহাজ এই মুহূর্তে কোথায় আছে তা নজরদারি করা যুদ্ধরত নৌবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স বিভাগের সাধারণ কর্তব্য। কী কারণে একটি হাইস্পিড ক্রুজার যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের মার্কিন ঘাঁটিতে এত অল্প সময়ের মধ্যে এলো- এমন প্রশ্ন জাপানিদের মনে উদয় হতে পারে। তাই কার্গো ডেলিভারির পরেও রেডিও সাইলেন্স বজায় রেখে জাহাজটি সতর্কতার সাথে পথ চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করে উদয় হলো বিপদ। জাপানি সাবমেরিন আই-৫৮ এর সোনারে ধরা পড়ে গেছে ইউএসএস ইন্ডিয়ানাপোলিস।
ডুবে যাওয়া ও নাবিকদের দুর্দশা
জাপানি সাবমেরিন আই-৫৮ কয়েক ঘণ্টা ধরে শিকারিকে অনুসরণ করছে। ক্যাপ্টেন মোশিতসুরা হাশিমোতো টর্পেডো হামলার জন্য সুবিধাজনক পজিশনে গিয়ে টার্গেট সম্পর্কে নেভিগেশনাল চার্টে হিসাবনিকাশ করছেন। নাবিকদের মধ্যে টানটান উত্তেজনা। প্রথমবারের মতো মার্কিন ব্যাটলশিপ ডোবানোর সুযোগ পেয়েছে তারা। কিন্তু ব্যাটলশিপ এলো কোথা থেকে? ইউএসএস ইন্ডিয়ানাপোলিস তো ক্রুজার শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজ।
আসলে মার্কিনীরা এত সতর্কতার সাথে কার্গো ডেলিভারি দিয়েছিল, জাপানিদের ধারণাই ছিল না যে এই অঞ্চলে কোনো ক্রুজার রয়েছে। হাশিমোতোর মতো অভিজ্ঞ কমান্ডারও পেরিস্কোপে জাহাজ দেখে রেফারেন্স বুকের সাথে মিলিয়ে একে নিউ মেক্সিকো ক্লাস ব্যাটলশিপ ‘ইউএসএস আইদাহো’ হিসেবে শনাক্ত করেন।
৩০ জুলাই, রাত সোয়া বারোটায় খুব কাছ থেকে ফায়ার করা হয় দুটো টাইপ ৯৫ টর্পেডো। ইউএসএস ইন্ডিয়ানাপোলিস সেগুলোকে ফাঁকি দেয়ার সুযোগও পায়নি। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে সাথে আগুন ধরে যায় জাহাজের গোলাবারুদের গোডাউনে। আগুন নেভানো অসম্ভব ভেবে ক্যাপ্টেন জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেন। আক্রান্ত হওয়ার বারো মিনিটের মাথায় বিশাল জাহাজটি সম্পূর্ণ উল্টে যায়! আক্রান্ত হওয়ার মুহূর্তে জাহাজে মোট ১,১৯৫ জন নাবিক ছিল। অল্প সময়ের মধ্যে ডুবে যাওয়ায় আনুমানিক ৩০০ নাবিক জাহাজ থেকে বের হওয়ার সুযোগ পাননি।
তবে দ্রুত মৃত্যু হওয়ায় তাদেরকেই ভাগ্যবান বলা যায়। কেননা, যারা বেঁচে ছিল তাদের কপালে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুর্দশা। ইউএসএস ইন্ডিয়ানাপোলিসে পর্যাপ্ত সংখ্যক লাইফবোট ও লাইফ জ্যাকেট ছিল না। খাদ্য, জরুরি ওষুধ, রেডিও, সিগন্যাল লাইট এগুলো তেমন কিছুই জাহাজ থেকে সংগ্রহ করা যায়নি। জাহাজটির তরফ থেকে রেডিও যোগাযোগ না হওয়ায় হেডকোয়ার্টারও ইন্ডিয়ানাপোলিস ডুবে যাওয়ার খবর পায়নি।
টানা চারদিন খোলা সাগরে ভাসতে ভাসতে নাবিকরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েন। মাথার উপরে তপ্ত সূর্য, নিচে খাওয়ার অনুপযোগী লবণাক্ত পানি। সল্ট ওয়াটার পয়জনিং, হ্যালুসিনেশনের পাশাপাশি দিনের বেলা গরমে ডিহাইড্রেশন, রাতের ঠান্ডায় আবার হাইপোথার্মিয়াতে আক্রান্ত হন নাবিকরা। ক্ষুধা-পিপাসা জয় করে তারা যখন বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন, তখনই ক্ষুধা পেয়েছে জলজ শিকারির। আহত নাবিকদের রক্তের গন্ধ পেয়ে দলে দলে হাজির হয় হাঙরের পাল। সাঁতরে পালিয়ে বাঁচতে গিয়ে টাইগার ও হোয়াইটটিপ শার্কের খাবারে পরিণত হয় বহু নাবিক। এজন্য ইউএসএস ইন্ডিয়ানাপোলিসের ঘটনাকে Worst Shark Attack of Maritime History হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ক্ষুধা-পিপাসা সহ্য করতে না পেরে অনেকেই মারা যান, কেউ কেউ আত্মহত্যা করেন, কেউ বা আবার জ্ঞান হারিয়ে ডুবে মারা যান।
জাহাজডুবির সাড়ে তিন দিন পর ২ আগস্ট, ১৯৪৫ সালে একটি পিভি-১ ভেঞ্চুরা পেট্রোল বিমান রুটিন টহলের সময় দূর থেকে পানিতে ধ্বংসাবশেষ ও জ্বালানী তেল ভাসতে দেখে এগিয়ে আসে। কয়েকশো নাবিককে এভাবে জলে ভাসতে দেখে পাইলটদের মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়। নিজেদের বিমানে থাকা লাইফবোট ও রেডিও সেট সেখানে ফেলে তারা ঘাঁটিতে ফিরে যান। খবর পেয়ে আশেপাশের সব মার্কিন বিমান-জাহাজ ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সবার আগে এসে পৌছায় পিবিওয়াই-৫ নামের আরেকটি পেট্রোল বিমান। এটি ছিল উভচর শ্রেণীর, অর্থাৎ বিমানটি প্রয়োজনে পানিতে ল্যান্ড করতে সক্ষম ছিল। কিন্তু তাদের প্রতি অর্ডার ছিল কোনোভাবেই খোলা সাগরের পানিতে ল্যান্ড করা যাবে না। কখন কোনদিক থেকে জাপানি জাহাজ-সাবমেরিনের হামলা হয় তা বলা বলা মুশকিল। তাছাড়া ইউএসএস ইন্ডিয়ানাপোলিসকে ডোবানো সাবমেরিন এখনও ঘাপটি মেরে বসে আছে কিনা জানা নেই।
পাইলট রবার্ট মার্কস ক্রুদের ভোট নিয়ে পানিতে নামার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মোট ৫৬ জন নাবিককে উদ্ধার করেন। বিমানের ভেতরে জায়গা না হওয়ায় ডানার উপরে এবং প্যারাশুট কর্ড দিয়ে কাউকে ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেন। এটি করতে গিয়ে বিমানের বারোটা বেজে যায়। পরে আরেকটি যুদ্ধজাহাজ এসে তাদের উদ্ধার করার পর বিমানটি ধ্বংস করে দেয়া হয়। সব মিলিয়ে পানিতে থাকা প্রায় ৯০০ সার্ভাইভারের মধ্যে ৩১৬ জনকে উদ্ধার করা হয়। অন্তত ১৫০ জন হাঙরের কামড়ে মারা যায়। সব মিলিয়ে এই ঘটনায় ৫৭৯ জন মারা যায় যা আজ অবধি একক নৌযুদ্ধে সর্বোচ্চ প্রাণহানি।
তদন্ত ও কোর্ট মার্শাল
তদন্তে পাওয়া যায়- মার্কিন নৌবাহিনীর গুয়াম, লেইতে ঘাঁটিগুলোর মাঝে সমন্বয় ছিল না। জাহাজগুলোর মুভমেন্ট সম্পর্কে তথ্য রাখা সেই ‘কমান্ডার বোর্ড’ থেকে ৩১ জুলাই গুয়ামের কমান্ডার মেরিনার অপারেটর ইন্ডিয়ানাপোলিসকে সরিয়ে ফেলে। কারণ তারা ধরে নিয়েছিল জাহাজটি সময়মতো লেইতে ঘাঁটিতে পৌঁছেছে। এদিকে ফিলিপাইন সি ফ্রন্টিয়ারের কমান্ডার বোর্ড অপারেটর লেফটেন্যান্ট গিবসন জাহাজটির না পৌঁছানোর খবর সময়মতো হাইকমান্ডকে জানাতে দেরি করে ফেলেন। অন্যদিকে ডুবে যাওয়ার আগমুহূর্তে ইউএসএস ইন্ডিয়ানাপোলিসের রেডিওতে সাহায্যের আবেদন তিনটি উপকূলীয় রেডিও স্টেশন রিসিভ করেছিল। কিন্তু এর একটির কমান্ডার ছিল মাতাল, আরেকজন ঘুমে থাকায় অপারেটররা বিরক্ত করার সাহস করেনি। তৃতীয় স্টেশনের কমান্ডার একে জাপানিদের পাতা ফাঁদ মনে করে উপেক্ষা করেন।
এসব কারণে একাধিক অফিসারের কোর্ট মার্শাল হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইন্ডিয়ানাপোলিসের ক্যাপ্টেন চার্লস ম্যাকভির কোর্ট মার্শাল। এতবড় প্রাণহানির ঘটনায় তাকে বলির পাঁঠা বানানোর চেষ্টা করা হয়। প্রথমে তাকে সময়মতো Abandon Ship তথা জাহাজ পরিত্যাগের নির্দেশ না দেয়ার অভিযোগ দায়ের করা হয়। কিন্তু অধস্তন অফিসার, নাবিকদের সাক্ষ্যে তিনি রেহাই পান। তারপর জাহাজ ধীরগতিতে চালানোর অভিযোগ ওঠানো হয়। আক্রান্ত হওয়ার মুহূর্তে ইন্ডিয়ানাপোলিস ১৭ নট বা ঘণ্টায় ৩১ কি.মি. গতিতে চলছিল যা তার শক্তিমত্তার অর্ধেক। এর জবাবে ম্যাকভি ওয়েদার রিপোর্ট তুলে ধরেন। সেদিন ঐ অঞ্চলের আবহাওয়া বাজে ছিল, মানুষের চোখের ভিজিবিলিটি অর্ধেকে নেমে আসছিল। তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগটি হলো- তিনি ‘জিগজ্যাগ ম্যানুভার’ অনুসরণ করেননি। অর্থাৎ সাবমেরিন হামলার ভয়ে আঁকাবাঁকা পথে জাহাজ চালাননি।
এই অভিযোগের সত্যতা প্রমানের জন্য জাপানি সাবমেরিনের ক্যাপ্টেন হাশিমোতোকেও সামরিক আদালতের সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এটিই ইতিহাসের একমাত্র ঘটনা যেখানে যুদ্ধে জয়ী দেশের কমান্ডারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে এসেছেন পরাজিত দেশের অফিসার। হাশিমোতো যথারীতি ম্যাকভির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন এবং বলেন যে তিনি এত কাছ থেকে হিসাবনিকাশ করে টর্পেডো ফায়ার করেছিলেন যে ইন্ডিয়ানাপোলিস জিগজ্যাগ ম্যানুভার করলেও সেটি ফাঁকি দেয়ার উপায় ছিল না। আরো তদন্তে জানা যায় যে ঐ অঞ্চলে জাপানি সাবমেরিনের উপস্থিতির কথা জানা থাকলেও হেডকোয়ার্টার থেকে ক্যাপ্টেন ম্যাকভিকে সতর্ক করা হয়নি। ফলে ফ্লিট এডমিরাল চেস্টার ডব্লিউ নিমিটজের আদালত তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়। তিনি ১৯৪৯ সালে রিয়ার এডমিরাল হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু কোর্ট মার্শালের ফলে তার ইমেজের ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে।
নিহত নাবিকদের স্বজনরা তাকে এই ঘটনার জন্য দোষারোপ করতে থাকে। তার কাছে ক্রিসমাসের সময় চিঠি এসেছিল যে, “Merry Christmas! Our family’s holiday would be a lot merrier if you hadn’t killed my son” । মানসিক অবসাদ ও অপরাধবোধের এই গ্লানি সহ্য করতে না পেরে তিনি ১৯৬৮ সালে আত্মহত্যা করেন। এসময় তার লাশের হাতে ছিল নাবিকদের একটি খেলনা পুতুল এবং অফিশিয়াল ইস্যু নেভি রিভলবার।
পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের এক বাচ্চার প্রচেষ্টায় ম্যাকভির রেকর্ড অফিশিয়ালি ক্লিয়ার করা হয়! সিক্সথ গ্রেডের ছাত্র হান্টার স্কট স্কুলের ইতিহাস ক্লাসের প্রজেক্টের রিসার্চ পেপার ঘটনাক্রমে দেশব্যাপী প্রচার পায় যা সাবেক কংগ্রেসনাল লবিস্ট মাইকেল মনরোনির নজরে আসে। তিনি ইন্ডিয়ানাপোলিসের নাবিক হিসেবে শেষ যাত্রায় ভাগ্যবশত অংশ নেননি। মাইকেলের সুপারিশে সিনেট কমিটি আবার তদন্ত করে।
প্রথম নিউক্লিয়ার সাবমেরিন ইউএসএস নটিলাসের ক্যাপ্টেন উইলিয়াম এক অনুশীলনে কমান্ডার হাশিমোতোর ট্যাক্টিক্সের পুনরাবৃত্তি করে দেখান যে ইন্ডিয়ানাপোলিসের আসলে বাঁচার কোনো সুযোগই ছিল না। পরে কংগ্রেস রেজুলেশনে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন সাইন করে ক্যাপ্টেন ম্যাকভিকে দায়মুক্তি দেন। ২০১৭ সালে মাইক্রোসফটের সহ প্রতিষ্ঠাতা পল অ্যালেনের অর্থায়নে পরিচালিত একটি এক্সপেডিশন টিম ফিলিপাইন সাগরের ১৮ হাজার ফুট গভীরে একটি ডুবন্ত পাহাড়ের পাশে ইন্ডিয়ানাপোলিসের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায়।
পরবর্তীতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ও ডিসকভারি চ্যানেল এটি নিয়ে ডকুমেন্টারি প্রকাশ করে। প্রতি বছর ইন্ডিয়ানাপোলিসের বেঁচে যাওয়া নাবিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা একটি পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান করে থাকে। ২০২১ সালের হিসেবে আর মাত্র পাঁচজন বেঁচে আছে। এদের অনেকেই পারমাণবিক বোমার বিরুদ্ধে পরিচালিত বিশ্বব্যাপী সামাজিক আন্দোলনের পরিচিত মুখ ছিলেন। ২০১৬ সালে মুক্তি পাওয়া USS Indianapolis: Men of Courage মুভিতে জাহাজটির ডুবে যাওয়া, ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও হাঙরের কামড়ে নাবিকদের মৃত্যুর ভয়াবহতা চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ক্যাপ্টেন ম্যাকভির চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিখ্যাত অভিনেতা নিকোলাস কেজ। মুভিতে জাপানি ক্যাপ্টেনের ন্যায় বাস্তবেও আই-৫৮ সাবমেরিনের কমান্ডার হাশিমোতোর নিশ্চয়ই সারাজীবন আফসোস করেছেন। কেননা চারদিন আগে ইউএসএস ইন্ডিয়ানাপোলিস ডুবিয়ে দিতে পারলে এক সপ্তাহ পর হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা ফেলার মার্কিন পরিকল্পনা ভেস্তে যেত। তবে লিটল বয় ডুবে গেলেও তখনও যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আরো দুটো পারমাণবিক বোমা ছিল।
জীবিত ফিরে আসা নাবিকের মুখে শুনুন ভয়ংকর অভিজ্ঞতা