Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি (শেষ পর্ব): মহাযুদ্ধের বিজয়ী জোট

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তিতে এমন বেশ কিছু সদস্য রাষ্ট্র ছিল, যারা এই মহাযুদ্ধে সীমিত মাত্রায় অংশগ্রহণ করেছিল এবং ক্ষেত্রবিশেষে যুদ্ধে অংশই নেয়নি, কিন্তু অন্যান্য উপায়ে মিত্রশক্তির যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সহায়তা করেছিল। উক্ত রাষ্ট্রগুলো এই পর্বের আলোচ্য বিষয়বস্তু।

চীন

‘চীন প্রজাতন্ত্র’ (মান্দারিন: 中華民國) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর নিজেকে নিরপেক্ষ ঘোষণা করে। সেসময় চীন ছিল রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল, অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ও সামরিকভাবে দুর্বল, সুতরাং মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মতো সামর্থ্য তাদের ছিল না। অবশ্য যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে চীনা সরকার গোপনে ব্রিটেনকে প্রস্তাব করেছিল যে, ব্রিটেনের অনুমতি পেলে তারা যুদ্ধের জন্য ৫০,০০০ চীনা সৈন্য প্রস্তুত করতে পারে এবং চীনের কিংদাওয়ে অবস্থিত জার্মান উপনিবেশটি দখল করে নিতে পারে। কিন্তু ব্রিটেন এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং জাপান উক্ত উপনিবেশ দখল করে নেয়।

চীনা সরকার তাদের নিরপেক্ষতার নীতি অনুসারে চীনা নাগরিকদের যুদ্ধরত রাষ্ট্রগুলোর কোনোটির হয়ে কাজ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। কিন্তু অচিরেই এই নিষেধাজ্ঞা পরিত্যক্ত হয় এবং অন্তত ১,৪০,০০০ চীনা শ্রমিক ব্রিটেন ও ফ্রান্সের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করে। এই শ্রমিকরা মাইন অপসারণ, সড়ক ও রেলপথ পুনর্নির্মাণ এবং অস্ত্রাগার তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিল। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের অস্ত্র ও জাহাজ নির্মাণ কারাখানাগুলোতেও এদেরকে কাজে নিযুক্ত করা হয়। এরা কখনো সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়নি, কিন্তু তারপরও শত্রুপক্ষের গোলাবর্ষণে বা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে এদের মধ্যে ২,০০০-২০,০০০ শ্রমিকের মৃত্যু হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তির পক্ষে কর্মরত একদল চীনা শ্রমিক; Source: Chatham House/Wikimedia Commons

অবশ্য চীন মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তাদের কাছ থেকে কিছু সুযোগ–সুবিধা আদায় করতে আগ্রহী ছিল। ইতোমধ্যে ১৯১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জার্মান সাবমেরিন ‘এসএস অ্যাথোস’ নামক একটি ফরাসি যাত্রীবাহী জাহাজকে ডুবিয়ে দেয়। এই জাহাজটিতে প্রায় ৯০০ চীনা শ্রমিক ছিল এবং জাহাজডুবির ফলে এদের মধ্যে ৫৪৩ জনের সলিলসমাধি ঘটে। এই ঘটনার পর মার্চে চীন জার্মানির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং ১৪ আগস্ট কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর পরপরই চীন তিয়ানজিন ও উহানে অবস্থিত ক্ষুদ্র জার্মান ও অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় উপনিবেশগুলো দখল করে নেয়।

অবশ্য কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও কার্যত চীন কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। কেবল মিত্রশক্তির রাশিয়া আক্রমণে চীন যোগদান করে এবং ২,৩০০ সৈন্যের একটি দল সাইবেরিয়ায় প্রেরণ করে। সেখানে তারা বলশেভিক ও বলশেভিকবিরোধী কসাকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়। অবশ্য মিত্রশক্তির রাশিয়া আক্রমণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং এর ফলে চীন রাশিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। সামগ্রিকভাবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করে চীন বিশেষ কোনো সুবিধা লাভ করতে পারেনি।

শ্যামদেশ

‘সায়াম রাজ্য’ (থাই: อาณาจักรสยาม) বা শ্যামদেশ, যেটি বর্তমানে থাইল্যান্ড নামে পরিচিত, ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর রাষ্ট্রটি নিজেদের নিরপেক্ষতা ঘোষণা করে, কিন্তু রাষ্ট্রটির অভ্যন্তরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা বা না করার বিষয়ে দুটি দলের সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে একদল যুদ্ধে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার পক্ষে এবং অপর দল মিত্রশক্তিতে যোগ দেয়ার পক্ষে ছিল। অবশেষে ১৯১৭ সালের ২২ জুলাই রাষ্ট্রটি জার্মানি ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ফ্রান্সের মার্সেইয়ে একদল শ্যামদেশীয়/থাই সৈন্য; Source: Wikimedia Commons

কেন্দ্রীয় শক্তিভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে শ্যামদেশের কোনো বিরোধ ছিল না, বরং এশিয়ার তদানীন্তন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শ্যামদেশেই জার্মানির বাণিজ্যিক উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে বিস্তৃত। কিন্তু ১৯১৭ সাল নাগাদ শ্যামদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে এরকম ধারণার সৃষ্টি হয় যে, যেসব রাষ্ট্র যুদ্ধে মিত্রশক্তির পক্ষে যোগদান করেনি বা নিরপেক্ষ ছিল, যুদ্ধ শেষে মিত্রশক্তি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করতে পারে এবং তাদের ওপর ইতিপূর্বে চাপিয়ে দেয়া ‘অসমান চুক্তি’গুলোর পুনর্মূল্যায়ণ করার ক্ষেত্রে অনীহা দেখাতে পারে। এজন্য থাইল্যান্ড মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

শ্যামদেশ ইউরোপের পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ১,২৮৪ জন সৈন্যের একটি দলকে প্রেরণ করে এবং তাদের মধ্যে ১৯ জন নিহত হয়। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই মহাযুদ্ধে শ্যামদেশের অংশগ্রহণ ছিল কার্যত প্রতীকী। কিন্তু এই যুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে শ্যামদেশ মিত্রশক্তির কাছ থেকে কিছু সুযোগ–সুবিধা আদায় করে নিতে সক্ষম হয়। শ্যামদেশের সরকার নিজেদের ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে কর সংগ্রহের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে এবং শ্যামদেশের ভূখণ্ডে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকরা শ্যামদেশের আইনের আওতায় আসে (এর আগে শ্যামদেশের আইন তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না)।

হিজাজ

‘হিজাজ হাশেমীয় রাজ্য’ (আরবি: المملكة الحجازية الهاشمية‎, ‘আল–মামলাকাহ আল–হিজাজিয়াহ আল–হাশিমিয়াহ’) ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ওসমানীয় রাষ্ট্রের হিজাজ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় রাষ্ট্রের প্রবেশের পর মিত্রশক্তি (ব্রিটেন ও ফ্রান্স) ওসমানীয় রাষ্ট্রের অধীনস্থ পশ্চিম এশীয় ভূখণ্ডে আক্রমণ চালায়। কিন্তু এসময় ইউরোপের পশ্চিম রণাঙ্গনে জার্মানির অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে রাখার জন্য ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে বিপুল সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করে রাখতে হচ্ছিল এবং এর ফলে পশ্চিম এশিয়ায় ওসমানীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক সৈন্য প্রেরণ ব্রিটেন ও ফ্রান্সের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। এজন্য ব্রিটেন ও ফ্রান্স কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে এবং ওসমানীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আরবদের ক্ষোভকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে।

সেসময় ওসমানীয় রাষ্ট্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল ‘তরুণ তুর্কি’দের নেতৃত্বাধীন একটি উগ্র তুর্কি জাতীয়তাবাদী সরকার এবং তাদের উগ্র জাতীয়তাবাদী নীতির কারণে আরবরা তাদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। মক্কার শরিফ (শাসক) হুসেইন বিন আলী ছিলেন এরকমই একজন আরব নেতা। ব্রিটিশরা তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং তাকে প্রতিশ্রুতি প্রদান করে যে, আরবরা ওসমানীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তারা যুদ্ধের শেষে আরব ভূমিতে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ পাবে। হুসেইন এই প্রস্তাবে সম্মত হন এবং ১৯১৬ সালের জুনে নিজেকে হিজাজের স্বাধীন শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে যায় বিখ্যাত ওসমানীয়বিরোধী ‘আরব বিদ্রোহ’, যেটিতে ব্রিটিশ ও ফরাসি সৈন্যরাও সীমিত আকারে অংশগ্রহণ করে এবং ব্রিটেন ও ফ্রান্স এই বিদ্রোহকে ব্যাপকভাবে অর্থায়ন করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্যারিস শান্তি সম্মেলনে হিজাজের প্রতিনিধি দল; Source: Wikimedia Commons

আরব বিদ্রোহ দমনের জন্য ওসমানীয় রাষ্ট্রকে এই অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করতে হয়, এবং এর ফলে অন্যান্য রণাঙ্গনে পর্যাপ্ত সংখ্যক সৈন্য সরবরাহের ক্ষেত্রে তারা সমস্যার সম্মুখীন হয়। এর ফলে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের জন্য সেসব রণাঙ্গনে ওসমানীয়দের পরাস্ত করার পথ সহজতর হয়। সামগ্রিকভাবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের কাছে ওসমানীয় রাষ্ট্রের পরাজয়ের ক্ষেত্রে হিজাজ কর্তৃক পরিচালিত আরব বিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।

অবশ্য মহাযুদ্ধের শেষে ব্রিটেন ও ফ্রান্স তাদের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। ওসমানীয় রাষ্ট্রের আরব ভূখণ্ডগুলোকে স্বাধীনতা প্রদানের পরিবর্তে তারা সেগুলোকে নিজস্ব সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত করে। হিজাজ এই পরিস্থিতি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং হিজাজের রাজা হুসেইন ভার্সাই চুক্তির অনুমোদন দিতে বা ‘জাতিপুঞ্জ’ কর্তৃক প্রবর্তিত ‘ম্যান্ডেট’ ব্যবস্থাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। প্রত্যুত্তরে ব্রিটেন হিজাজের ওপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় এবং হিজাজের প্রতিদ্বন্দ্বী নজদকে সমর্থন করতে শুরু করে। ১৯২৫ সালে নজদ হিজাজ দখল করে নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে স্বাধীন হিজাজ রাষ্ট্রের অবসান ঘটে। বস্তুত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে হিজাজ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ এই যুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে তারা কার্যত কিছুই অর্জন করতে পারেনি, উল্টো নিজেদের স্বাধীনতাও হারিয়ে ফেলে।

অন্যান্য রাষ্ট্র

এই রাষ্ট্রগুলো ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মিত্রশক্তিতে যোগদান করেছিল। কিন্তু এই রাষ্ট্রগুলোর মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিল মূলত প্রতীকী। এদের মধ্যে কোনো কোনোটি কেবল কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেই ক্ষান্ত ছিল, সক্রিয়ভাবে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়ার চেষ্টা করেনি। আবার কোনো কোনো রাষ্ট্র কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সৈন্যদল প্রেরণ করেছিল। বস্তুত এই রাষ্ট্রগুলো যদি মিত্রশক্তিতে যোগ না দিত, তাহলেও যুদ্ধের ফলাফলে কোনো বিশেষ পার্থক্য দেখা দিত না। কিন্তু এই রাষ্ট্রগুলোর মিত্রশক্তিতে যোগদান মিত্রশক্তিকে কূটনৈতিক সুবিধা প্রদান করে, কারণ মিত্রশক্তির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় শক্তির তুলনায় তাদের গ্রহণযোগ্যতাও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সাতটি ছিল ল্যাটিন আমেরিকার এবং একটি আফ্রিকার অন্তর্ভুক্ত।

মানচিত্রের সবুজ রঙে চিহ্নিত রাষ্ট্রগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির অংশ ছিল; Source: Wikimedia Commons

(১) পানামা: যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পরবর্তী দিন, অর্থাৎ ১৯১৭ সালের ৭ এপ্রিল পানামা জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর ১৯১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর পানামা অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। উল্লেখ্য, ১৯০৩ সালে পানামা কলম্বিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং পানামাকে কলম্বিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করার পশ্চাতে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এজন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পানামার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক প্রভাব ছিল এবং যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জার্মানি ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পানামার উক্ত রাষ্ট্র দুটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ছিল কার্যত পানামার পররাষ্ট্রনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের প্রতিফলন।

(২) কিউবা: যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা পরবর্তী দিন, অর্থাৎ ১৯১৭ সালের ৭ এপ্রিল কিউবা জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর ১৯১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর কিউবা অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৮৯৮ সালে কিউবা যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের একটি আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এজন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কিউবার পররাষ্ট্রনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক প্রভাব ছিল এবং এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের পর কিউবাও তাদের অনুগামী হয়। একটি কিউবান চিকিৎসক দল ইউরোপের পশ্চিম রণাঙ্গনে মোতায়েন করা হয়েছিল এবং পশ্চিম রণাঙ্গনে প্রেরণের জন্য কিউবা ২৫,০০০ সৈন্যের একটি সৈন্যদলকে প্রস্তুত করে, কিন্তু তারা ইউরোপের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পূর্বেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে।

(৩) লাইবেরিয়া: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় লাইবেরিয়া ছিল আফ্রিকার মাত্র দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যে একটি। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে লাইবেরিয়া ১৯১৭ সালের ৪ আগস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কার্যত লাইবেরিয়া ছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত কৃষ্ণাঙ্গদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রটির পররাষ্ট্রনীতির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ছিল অত্যন্ত বিস্তৃত। এটিই ছিল লাইবেরিয়ার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের মূল কারণ। অবশ্য যুদ্ধে লাইবেরিয়ার অংশগ্রহণ ছিল খুবই সীমিত। ১৯১৮ সালের জুনে একটি জার্মান সাবমেরিন লাইবেরিয়ার রাজধানী মনরোভিয়ার ওপর গোলাবর্ষণ করে এবং লাইবেরিয়া ইউরোপের পশ্চিম রণাঙ্গনে একটি ক্ষুদ্র সৈন্যদল প্রেরণ করে, কিন্তু লাইবেরীয় সৈন্যরা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি।

কোস্টারিকান রাষ্ট্রপতি ফেদেরিকো তিনোকো তার সরকারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভের উদ্দেশ্যে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন; Source: Wikimedia Commons

(৪) গুয়াতেমালা: ১৯১৮ সালের ২৩ এপ্রিল গুয়াতেমালা জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মিত্রশক্তির অন্তর্ভুক্ত হয়, কিন্তু কার্যত কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে গুয়াতেমালার সক্রিয় ভূমিকা ছিল খুবই অল্প। কার্যত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই গুয়াতেমালা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি আশ্রিত রাষ্ট্র এবং গুয়াতেমালার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি’র ব্যাপক প্রভাব ছিল। এজন্য গুয়াতেমালার পররাষ্ট্রনীতি ছিল বহুলাংশে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। এজন্য গুয়াতেমালা কর্তৃক জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ছিল কার্যত যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার যৌক্তিক সম্প্রসারণ।

(৫) নিকারাগুয়া: ১৯১৮ সালের ৬ মে নিকারাগুয়া জার্মানি ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং এর মধ্য দিয়ে মিত্রশক্তিতে যোগদান করে। কিন্তু কার্যত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিকারাগুয়ার অংশগ্রহণ যুদ্ধ ঘোষণা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল, কারণ নিকারাগুয়া এই যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য কোনো সৈন্য প্রেরণ করেনি। কার্যত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিকারাগুয়ার প্রবেশ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের এই মহাযুদ্ধে প্রবেশের যৌক্তিক পরিবর্ধন মাত্র। কারণ ১৯১২ সাল থেকে মার্কিন সৈন্যরা নিকারাগুয়া দখল করে রেখেছিল এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে নিকারাগুয়া ছিল কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক দখলদারিত্বের অধীনে থাকা একটি রাষ্ট্র। এই পরিস্থিতিতে নিকারাগুয়া কর্তৃক জার্মানি ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা যে নিকারাগুয়ার ওপর মার্কিন চাপের ফল ছিল, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

(৬) কোস্টারিকা: ১৯১৮ সালের ২৩ মে কোস্টারিকা জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং এর মধ্য দিয়ে মিত্রশক্তিতে যোগদান করে। অবশ্য নিকারাগুয়ার মতো কোস্টারিকারও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ যুদ্ধ ঘোষণা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল, কারণ কোস্টারিকা যুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে কোনো সৈন্য বা সামরিক সরঞ্জাম প্রেরণ করেনি। বস্তুত কোস্টারিকা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশ ছিল কোস্টারিকার রাষ্ট্রপতি ফেদেরিকো তিনোকো কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভের প্রচেষ্টার ফল। তিনোকো ১৯১৭ সালের জানুয়ারিতে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কোস্টারিকার ক্ষমতা দখল করেছিলেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করছিল না এবং তারা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকারকে কোস্টারিকার বৈধ সরকার হিসেবে বিবেচনা করছিল। এমতাবস্থায় তিনোকো জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করে তাদের স্বীকৃতি আদায় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়, কারণ যুক্তরাষ্ট্র তিনোকোর সরকারকে বৈধ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেনি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে হাইতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সরঞ্জাম; Source: Wikimedia Commons

(৭) হাইতি: ১৯১৮ সালের ১২ জুলাই হাইতি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং এর মধ্য দিয়ে মিত্রশক্তিতে যোগদান করে। কিন্তু এই মহাযুদ্ধে হাইতির অংশগ্রহণের মাত্রাও ছিল খুবই সীমিত। কার্যত ১৯১৫ সাল থেকে মার্কিন সৈন্যরা হাইতি দখল করে রেখেছিল এবং হাইতি এসময় ছিল কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক দখলদারিত্বের অধীন। ১৯১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পরপরই হাইতি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদানের চেষ্টা করে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিরোধিতার কারণে এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অবশেষে ১৯১৮ সালের জুলাইয়ে হাইতির মার্কিনপন্থী সরকার জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করে। হাইতির প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশ যে হাইতির পররাষ্ট্রনীতির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক প্রভাবের ফল ছিল, সেটি বলাই বাহুল্য।

(৮) হন্ডুরাস: ১৯১৮ সালের ১৯ জুলাই হন্ডুরাস জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং এর মধ্য দিয়ে মিত্রশক্তির অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু এই মহাযুদ্ধে হন্ডুরাসের অংশগ্রহণ ছিল মূলত প্রতীকী, কারণ হন্ডুরাস যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য কোনো সৈন্যদল প্রেরণ করেনি। কার্যত হন্ডুরাস কর্তৃক জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ছিল হন্ডুরাসের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের ফলাফল। উল্লেখ্য, বিংশ শতাব্দীর প্রথম ২৫ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র অন্তত সাতবার হন্ডুরাসে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছিল। এজন্য হন্ডুরাসের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের পশ্চাতে যে যুক্তরাষ্ট্রের ইঙ্গিত ছিল, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

সামগ্রিকভাবে, মোট ৬টি বৃহৎ শক্তি (ব্রিটেন, রাশিয়া, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এবং অন্তত ১৮টি অন্যান্য রাষ্ট্র (সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো, বেলজিয়াম, পর্তুগাল, রুমানিয়া, গ্রিস, ব্রাজিল, চীন, শ্যামদেশ, হিজাজ, পানামা, কিউবা, লাইবেরিয়া, গুয়াতেমালা, নিকারাগুয়া, কোস্টারিকা, হাইতি ও হন্ডুরাস) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির সদস্য ছিল। এই ২৪টি রাষ্ট্রের পাশাপাশি ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম ও পর্তুগালের উপনিবেশগুলোও সক্রিয়ভাবে এই মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে, মিত্রশক্তির সামরিক–অর্থনৈতিক সামর্থ্য ছিল কেন্দ্রীয় শক্তির তুলনায় অনেক বেশি, ফলে মিত্রশক্তিই শেষ পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী জোটে পরিণত হয়।

Related Articles