১৯১৪ সালের ২৮ জুন অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির অন্তর্ভুক্ত ‘বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা কনডোমিনিয়ামে’র রাজধানী সারায়েভোয় সার্বীয় গুপ্ত সামরিক সংস্থা ‘একত্রীকরণ বা মৃত্যু’র (সার্বীয়: Уједињење или смрт) বসনীয় সার্ব সদস্য গাভ্রিলো প্রিন্সিপ অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিন্যান্ড ও তার স্ত্রীকে খুন করেন। অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সরকার এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং ২৮ জুলাই সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত ‘মহাযুদ্ধ’ বা ‘Great War’ নামে পরিচিত ছিল) শুরু হয়ে যায় এবং শীঘ্রই ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মূলত দুটি জোটের মধ্যে। এই জোটগুলোর নাম ছিল ‘মিত্রশক্তি’ (Allied Powers) এবং ‘কেন্দ্রীয় শক্তি’ (Central Powers)। প্রায় সাড়ে চার বছর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর মিত্রশক্তির নিকট কেন্দ্রীয় শক্তির চূড়ান্ত পরাজয় ও আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে এই মহাযুদ্ধের অবসান ঘটে।
উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও বিবদমান দুটি জোটের একটির নাম ছিল ‘মিত্রশক্তি’। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির সদস্য রাষ্ট্রগুলো আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির সদস্য রাষ্ট্রগুলো এক ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তির সদস্য ছিল, এরকম বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তির সদস্য ছিল না। তদুপরি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির সদস্যরাষ্ট্রের তুলনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ছিল বেশি। তাহলে জেনে নেয়া যাক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কোন কোন রাষ্ট্র বিজয়ী জোট মিত্রশক্তির সদস্য ছিল।
ব্রিটেন
‘গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ড যুক্তরাজ্য’ (ইংরেজি: United Kingdom of Great Britain and Ireland) ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। যে ছয়টি রাষ্ট্রকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ‘মুখ্য মিত্রশক্তি’ (Principal Allied Powers) হিসেবে অভিহিত করা হতো, তাদের মধ্যে একটি রাষ্ট্র ছিল ব্রিটেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ব্রিটেন ছিল বিশ্বের প্রধান বৃহৎ শক্তি (Great Power) এবং তাদের ‘রাজকীয় নৌবাহিনী’ (Royal Navy) ছিল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক নৌবহর। একইসঙ্গে সেসময় ব্রিটেনের কর্তৃত্বাধীনে ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য, এবং ব্রিটেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদানের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটেনের সকল উপনিবেশ (যেগুলোর মধ্যে ছিল কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ড) স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের প্রয়োজনে ব্রিটেন এই উপনিবেশগুলোর সম্পদ যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে এবং উপনিবেশগুলো থেকে আগত লক্ষ লক্ষ সৈন্য ব্রিটেনের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশদের তদানীন্তন প্রভাব ধরে রাখা ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পরিধি সম্প্রসারিত করার আকাঙ্ক্ষা এবং উদীয়মান জার্মানির সঙ্গে ব্রিটেনের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের অংশগ্রহণের সর্বপ্রধান কারণ। অবশ্য এগুলো ব্রিটেনের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের একমাত্র কারণ ছিল না, এবং আরো বিভিন্ন কারণ তাদের এই যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য দায়ী ছিল, কিন্তু সেগুলোর আলোচনা এখানে নিষ্প্রয়োজন। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী বছরগুলোতে ব্রিটেন ‘ইঙ্গ–জাপানি মৈত্রী’ (১৯০২), ‘ইঙ্গ–ফরাসি আঁতাত’ (১৯০৪) এবং ‘ইঙ্গ–রুশ কনভেনশনে’র (১৯০৭) মাধ্যমে যথাক্রমে জাপান, ফ্রান্স ও রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল।
ব্রিটেনের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের আনুষ্ঠানিক কারণ ছিল জার্মানি কর্তৃক ক্ষুদ্র ইউরোপীয় রাষ্ট্র বেলজিয়ামের নিরপেক্ষতার লঙ্ঘন। বেলজিয়াম ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র (neutral state) এবং ১৮৩৯ সালে সম্পাদিত ‘লন্ডন চুক্তি’ অনুযায়ী ব্রিটেন ছিল বেলজিয়ান নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা প্রদানকারী। এই চুক্তির শর্তানুযায়ী, কোনো রাষ্ট্র বেলজিয়ামের নিরপেক্ষতা লঙ্ঘন করলে ব্রিটেন প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বেলজিয়ামের নিরপেক্ষতা রক্ষা করতে দায়বদ্ধ ছিল। ১৯১৪ সালের ৩ আগস্ট জার্মানি ফ্রান্সের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য বেলজিয়ামের ভূখণ্ড দিয়ে সৈন্য পরিবহনের অধিকার দাবি করে, কিন্তু বেলজিয়াম এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে। ৪ আগস্ট জার্মানি বেলজিয়াম আক্রমণ করে এবং একই দিনে ব্রিটেন ‘বেলজিয়ামের নিরপেক্ষতা রক্ষা’র কারণ দেখিয়ে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
পরবর্তীতে ব্রিটেন ১৯১৪ সালের ১২ আগস্ট অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে, ১৯১৪ সালের ৫ নভেম্বর ওসমানীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এবং ১৯১৫ সালের ১৫ অক্টোবর বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ব্রিটিশ সৈন্যরা প্রধানত ইউরোপ, আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়া জুড়ে বিভিন্ন রণাঙ্গনে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও তারা কেন্দ্রীয় শক্তিবিরোধী বিভিন্ন সামরিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং রাশিয়া এই মহাযুদ্ধ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এর ফলে ১৯১৮ সালে মিত্রশক্তি রাশিয়ায় আক্রমণ চালায় এবং ব্রিটেন এই আক্রমণে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে, যদিও পরবর্তীতে সেই আক্রমণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর নাগাদ কেন্দ্রীয় শক্তির সকল সদস্য রাষ্ট্র মিত্রশক্তির নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং এর মধ্য দিয়ে মিত্রশক্তি (অর্থাৎ ব্রিটেন) প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী হয়। ব্রিটেনের মূল ভূখণ্ড ও পাঁচটি উপনিবেশ বাদে অন্যান্য উপনিবেশ থেকে আগত ৬২,১১,৯২২ জন সৈন্য এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, এবং এদের মধ্যে ৮,৮৬,৩৪২ জন নিহত ও ১৬,৬৫,৭৪৯ জন আহত হয়। এই হিসেবে ব্রিটেনের যে পাঁচটি উপনিবেশ থেকে আগত সৈন্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, সেগুলো হচ্ছে: কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ড। ব্রিটেনের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটেনের সকল উপনিবেশ এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল বটে, কিন্তু যুদ্ধের পর প্যারিস শান্তি সম্মেলনে ব্রিটেনের পাশাপাশি কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ড নিজ নিজ প্রতিনিধি দল প্রেরণের সুযোগ লাভ করে।
উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে ব্রিটেন জার্মানির কাছ থেকে ‘জার্মান পূর্ব আফ্রিকা’ (বর্তমান তাঞ্জানিয়ার মূল ভূখণ্ড ও কেনিয়ার অংশবিশেষ) এবং ওসমানীয় রাষ্ট্রের কাছ থেকে ইরাক ও ফিলিস্তিন (বর্তমান ইসরায়েল, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের শাসনাধীন অঞ্চল, গাজা ও জর্দান) লাভ করে। তদুপরি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই ব্রিটেন ওসমানীয় রাষ্ট্রের কাছ থেকে মিসর ও সুদান (বর্তমান সুদান ও দক্ষিণ সুদান) দখল করে নিয়েছিল এবং সাইপ্রাস ইজারা নিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে এগুলোও আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটেনের অন্তর্ভুক্ত হয়। এছাড়া ব্রিটেনের স্বশাসিত উপনিবেশগুলোও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ভূখণ্ড লাভ করে, কিন্তু সেটি এই অংশে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
কানাডা
‘কানাডা ডোমিনিয়ন’ (ইংরেজি: Dominion of Canada) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ছিল ব্রিটেনের একটি ‘ডোমিনিয়ন’ বা স্বশাসিত অঞ্চল। কানাডার পররাষ্ট্রনীতি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল, এবং এর ফলে ব্রিটেনের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কানাডা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। কানাডীয় সৈন্যরা প্রধানত ইউরোপের পশ্চিম রণাঙ্গনে (Western Front) কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। পরবর্তীতে রুশ বিপ্লবের পর ১৯১৮ সালে মিত্রশক্তি রাশিয়ায় আক্রমণ চালায় এবং এই আক্রমণে কানাডীয় সৈন্যরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই আক্রমণ ব্যর্থ হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে কানাডার স্বায়ত্তশাসনের মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায় এবং যুদ্ধের শেষে অনুষ্ঠিত প্যারিস শান্তি সম্মেলনে কানাডা ব্রিটেনের প্রতিনিধি দলের পাশাপাশি নিজস্ব প্রতিনিধি দল প্রেরণের অধিকার লাভ করে। কানাডার পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের পথে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। উল্লেখ্য, মোট ৬,২৮,৯৬৪ জন কানাডীয় সৈন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে ৬৪,৯৪৪ জন নিহত এবং ১,৪৯,৭৩২ জন আহত হয়।
অস্ট্রেলিয়া
‘অস্ট্রেলিয়া কমনওয়েলথ’ (ইংরেজি: Commonwealth of Australia) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ছিল ব্রিটেনের একটি ‘ডোমিনিয়ন’ বা স্বশাসিত অঞ্চল। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রনীতি ছিল ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণাধীন, এজন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। অস্ট্রেলীয় সৈন্যরা প্রধানত ইউরোপের পশ্চিম রণাঙ্গণ, পশ্চিম এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তদুপরি, রুশ বিপ্লবের পর ১৯১৮ সালে মিত্রশক্তি রাশিয়া আক্রমণ করে এবং অস্ট্রেলিয়া এই আক্রমণে অংশগ্রহণের জন্য একটি ক্ষুদ্র সৈন্যদল প্রেরণ করে, কিন্তু এই আক্রমণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার স্বায়ত্তশাসনের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর অনুষ্ঠিত প্যারিস শান্তি সম্মেলনে অস্ট্রেলিয়া নিজস্ব প্রতিনিধি দল প্রেরণের অধিকার লাভ করে। অস্ট্রেলিয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের পথে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। মোট ৪,১২,৯৫৩ জন অস্ট্রেলীয় সৈন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং এদের মধ্যে ৬১,৯২৮ জন নিহত ও ১,৫২,১৭১ জন আহত হয়। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রশান্ত মহাসাগরে বিষুবরেখার দক্ষিণে অবস্থিত জার্মান উপনিবেশগুলোর মধ্যে ‘জার্মান সামোয়া’ ব্যতীত বাকি উপনিবেশগুলো অস্ট্রেলিয়ার হস্তগত হয়।
ভারত
‘ভারত’ (ইংরেজি: India) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ছিল ব্রিটেনের একটি ‘মুকুট উপনিবেশ’ (Crown Colony) এবং একে সরাসরি ব্রিটেন থেকে শাসন করা হতো। ভারত সেসময় দুই ভাগে বিভক্ত ছিল – ব্রিটেনের সরাসরি শাসনাধীন প্রেসিডেন্সি ও প্রদেশসমূহ এবং ব্রিটেনের আশ্রিত দেশীয় রাষ্ট্রসমূহ। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল এবং এজন্য ব্রিটেনের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের ফলে ভারত স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়ে। ভারতীয় সৈন্যরা ইউরোপের পশ্চিম রণাঙ্গন, আফ্রিকা এবং পশ্চিম ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন রণাঙ্গনে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তদুপরি, রুশ বিপ্লবের পর মিত্রশক্তি রাশিয়ায় আক্রমণ চালায় এবং এই আক্রমণে ব্রিটিশ ভারতীয় সৈন্যরা বিস্তৃতভাবে অংশগ্রহণ করে, কিন্তু এই আক্রমণের উদ্দেশ্য সফল হয়নি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর অনুষ্ঠিত প্যারিস শান্তি সম্মেলনে ভারত একটি নিজস্ব প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে বটে, কিন্তু এই যুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো ব্রিটিশ ডোমিনিয়নগুলো যেরকম অধিকতর স্বায়ত্তশাসন লাভ করেছিল, ভারতের ক্ষেত্রে সেরকম হয়নি এবং ভারতকে এমনকি ডোমিনিয়নের মর্যাদাও প্রদান করা হয়নি। এজন্য প্যারিশ শান্তি সম্মেলনে ভারতের নিজস্ব প্রতিনিধি দল প্রেরণ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখেনি। উল্লেখ্য, মোট ১৪,৪০,৪৩৭ জন ভারতীয় সৈন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে ৭৪,১৮৭ জন নিহত এবং ৬৯,২১৪ জন আহত হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকা
‘দক্ষিণ আফ্রিকা ইউনিয়ন’ (ডাচ: Unie van Zuid-Afrika; আফ্রিকান্স: Unie van Suid-Afrika) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ছিল ব্রিটেনের একটি ডোমিনিয়ন বা স্বশাসিত অঞ্চল। দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রনীতি ব্রিটেনের অধীনস্থ ছিল, এজন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ আফ্রিকান সৈন্যরা আফ্রিকার বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে এবং ইউরোপের পশ্চিম রণাঙ্গনে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। রুশ বিপ্লবের পর ১৯১৮ সালে মিত্রশক্তি কর্তৃক রাশিয়ায় পরিচালিত আক্রমণে দক্ষিণ আফ্রিকা অংশগ্রহণ করে, কিন্তু এই আক্রমণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার স্বায়ত্তশাসনের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং বিশ্বযুদ্ধের শেষে প্যারিস শান্তি সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকা একটি স্বতন্ত্র পক্ষ হিসেবে নিজস্ব প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। মোট ১,৩৬,০৭০ জন দক্ষিণ আফ্রিকান সৈন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, এবং এদের মধ্যে ৯,৪৬৩ জন নিহত ও ১২,০২৯ জন আহত হয়। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে দক্ষিণ আফ্রিকা জার্মানির কাছ থেকে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত জার্মান উপনিবেশ ‘জার্মান দক্ষিণ–পশ্চিম আফ্রিকা’ (বর্তমান নামিবিয়া) লাভ করে।
নিউজিল্যান্ড
‘নিউজিল্যান্ড ডোমিনিয়ন’ (ইংরেজি: Dominion of New Zealand) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ছিল ব্রিটেনের একটি ডোমিনিয়ন বা স্বশাসিত অঞ্চল। নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল, এজন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিউজিল্যান্ড এই যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়ে। নিউজিল্যান্ডার সৈন্যরা প্রধানত ইউরোপের পশ্চিম রণাঙ্গন, পশ্চিম এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে নিউজিল্যান্ডের স্বায়ত্তশাসনের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এর ফলে মহাযুদ্ধের অবসানের পর অনুষ্ঠিত প্যারিস শান্তি সম্মেলনে নিউজিল্যান্ড নিজস্ব প্রতিনিধি দল প্রেরণের সুযোগ লাভ করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিউজিল্যান্ডের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে কাজ করে। মোট ১,২৮,৫২৫ জন নিউজিল্যান্ডার সৈন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে ১৮,০৫০ জন নিহত এবং ৪১,৩১৭ জন আহত হয়। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে নিউজিল্যান্ড প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত জার্মান উপনিবেশ ‘জার্মান সামোয়া’ (বর্তমান সামোয়া) লাভ করে।
সামগ্রিকভাবে, ব্রিটেন ও তার অধীনস্থ উপনিবেশগুলো থেকে আগত মোট ৮৯,৫৮,৮৭১ জন সৈন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে মোট ১১,১৪,৯১৪ জন নিহত হয় এবং মোট ২০,৯০,২১২ জন আহত হয়। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে ব্রিটেন ও তার উপনিবেশগুলো জার্মানি ও ওসমানীয় রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিস্তৃত ভূখণ্ড লাভ করে এবং এর ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরেই ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়।
[পরবর্তী পর্ব দেখুন]