২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর। পৃথিবীর ইতিহাসে এই দিনে ঘটে গিয়েছিল সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর একটি। ভারত মহাসাগরের তলদেশ থেকে শুরু হওয়া ভূমিকম্প ও এর থেকে উৎপত্তি হওয়া সুনামিতে এক বীভৎস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন। বক্সিং ডে-তে সংঘটিত হওয়ায় এই দুর্যোগের আরেকটি নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বক্সিং ডে সুনামি’। প্রায় একশো ফুট উঁচু ঢেউ ও রিখটার স্কেলের ৯.৩ মাত্রার ভূমিকম্পে ভারত মহাসাগরের উপকূলীয় দেশগুলোতে সেদিন প্রকৃতি উন্মাদের মতো মেতে উঠেছিল তার নির্মম খেলায়।
বক্সিং ডে সুনামি ও ভূমিকম্প ঠিক কতটা বিধ্বংসী ছিল, তা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ থেকে কিছুটা আন্দাজ করা যাবে। ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভের মতে, সব মিলিয়ে প্রায় দুই লাখ ত্রিশ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল এই প্রলয়ঙ্কারী প্রাকৃতিক দুর্যোগে! প্রায় দশ হাজার বিদেশি নাগরিক মারা যান কিংবা নিখোঁজ হন, যারা ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। মৃত ব্যক্তিদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ছিল শিশু, যারা সুনামির বিশাল ঢেউয়ের হাত থেকে বাঁচতে কিছুই করতে পারেনি। পুরুষদের তুলনায় নারীদের মৃত্যুহার ছিল চারগুণ বেশি। ধারণা করা হয়, উপকূলীয় অঞ্চলে সন্তান ও ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে না চাওয়ায় পুরুষের তুলনায় এত বেশি সংখ্যক নারী মারা গিয়েছিলেন। সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল ইন্দোনেশিয়ায়, কারণ ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র ছিল সুমাত্রা। শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়া– এই তিনটি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল।
অর্থনৈতিক দিক থেকে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল এশিয়ার ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোর জন্য বিরাট আঘাত। সুনামির কারণে ভারতের তামিলনাড়ু, ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের অর্থনৈতিক অবকাঠামো দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মাছ ধরা ও পর্যটন ছিল উপকূলীয় অঞ্চলের আয়ের মূল দুই উৎস। সুনামির কারণে মাছ ধরার সমস্ত সরঞ্জাম ভেসে চলে যায়, পর্যটনশিল্পের মেরুদণ্ড ধসে পড়ে। অসংখ্য জেলে রাতারাতি বেকার হয়ে পড়েন এবং অন্য পেশায় গিয়ে যে জীবিকা নির্বাহ করবেন, সে ব্যবস্থাটুকুও অবশিষ্ট ছিল না। ধারণা করা হয়, সুনামি ও ভূমিকম্পের কারণে প্রায় দশ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ ক্ষতি হয়েছিল চৌদ্দটি দেশে। জাতিসংঘের মহাসচিব তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল পরিদর্শন করার পর মন্তব্য করেছিলেন, ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে অন্তত দশ বছর সময় প্রয়োজন হবে।
তবে এরকম প্রলয়ঙ্কারী দুর্যোগের পরও সবচেয়ে আশাজাগানিয়া বিষয় ছিল এই যে, পৃথিবীবাসী ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তা করতে খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলো বিপুল পরিমাণ অর্থ সহায়তা করেছিল। প্রায় চৌদ্দ বিলিয়ন ডলার অর্থ সংগ্রহ করে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোর হাতে বুঝিয়ে দেয়া হয়। সুনামিতে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া অঞ্চলগুলোতে বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব ও নোংরা পরিবেশের জন্য বিভিন্ন রোগের বিস্তার হয়ে মানবিক বিপর্যয় হওয়ার আশংকা ছিল, যেটি যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার কারণে আর হয়নি। সময়মতো সাহায্য না পৌঁছালে যে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোতে আরও অনেক বেশি মানুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হতো, তা বলাই বাহুল্য। পৃথিবীর অনেক দেশ তাদের সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দিয়েছিল সাহায্যের জন্য। মানুষ মানুষের জন্য– এই মহান বাণীকে সত্যে পরিণত করে সেসময় আসলেই সমস্ত বিভেদ ভুলে গিয়ে মানুষ মানবতার খাতিরে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছিল।
প্রায় দেড় যুগ আগের সুনামি ও ভূমিকম্পের প্রসঙ্গ দিয়ে কেন শুরু করা হলো, তা এবার খোলাসা করা যাক। রাষ্ট্রীয় জোট নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে শুরুতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রসঙ্গ নিয়ে আসলে চোখ কপালে ওঠাটাই স্বাভাবিক বৈ কি। ২০০৪ সালের সেই বক্সিং ডে সুনামির পর ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর জন্য অন্যান্য দেশের পাশাপাশি আমেরিকা, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান– এই চারটি দেশ একটু ভিন্নভাবে সহযোগিতার পরিকল্পনা নেয়।
পরিকল্পনানুযায়ী, চারটি দেশের প্রতিটি পৃথকভাবে সহযোগিতার পরিবর্তে একত্রিত হয়ে একটি অস্থায়ী ‘সুনামি কোর গ্রুপ’ গঠন করে এবং সম্মিলিত উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে। চার দেশের সমন্বিত উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে চমৎকার সফলতা আসে এবং কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর খুশিমনে চারটি দেশ থেকে আগত কর্মীরা জাহাজ ও হেলিকপ্টারে করে স্বদেশে ফিরে যান। সেইসময় কেউ ভেবে উঠতে পারেনি যে এই চারটি দেশের সমন্বয়ে তৈরি হওয়া অস্থায়ী জোট একসময় ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করবে।
২০০৭ সালের দিকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে জাপানের স্বার্থরক্ষার জন্য এমন একটি জোটের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন, যে জোটটি মহাদেশীয় বাণিজ্যের জন্য একই রাজনৈতিক মতাদর্শের দেশগুলোকে সুবিধা এনে দেবে। তার এই চিন্তা বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য বক্সিং ডে সুনামির সময় যে চারটি দেশের সেনাবাহিনী একত্রে ‘সুনামি কোর গ্রুপ’ তৈরি করে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেছিল, তাদেরকে পুনরায় একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানান। জাপান, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত– চারটি দেশই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে গণতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী দেশ। তাই এই দেশগুলোর মধ্যে জোট তৈরি হলে তা টিকে যাওয়ার সম্ভাবনাও খুব বেশি। কিন্তু জাপানের আহ্বানে প্রাথমিকভাবে চারটি দেশই স্বতস্ফূর্তভাবে সাড়া দিলেও পরবর্তীতে চীনের চাপে অস্ট্রেলিয়া বেরিয়ে আসে। অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি ভারতও চীনের কূটনৈতিক চাপের কারণে জোটে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারেনি– এই দাবিও করতে দেখা যায় বিশেষজ্ঞদের।
মূল বিষয়টি হচ্ছে, ভারত মহাসাগরের ভূমিকম্প ও সুনামি-পরবর্তী সময়ে অস্থায়ীভাবে একত্রে অভিযান পরিচালনার পর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের চারটি দেশ (ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা) যে পরবর্তীতে অনানুষ্ঠানিক ‘কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়লগ’ বা সংক্ষেপে ‘কোয়াড’ (Qaud) গঠনে তৎপর হবে, তা কেউ ভাবতে পারেনি। কিন্তু জাপানের সক্রিয় তৎপরতায় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তামূলক দিক থেকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থরক্ষার বিষয়টি চিন্তা করে পরবর্তীতে চারটি দেশ একত্রিত হয়ে অনানুষ্ঠানিক জোট গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০৭ সাল থেকেই অনিয়মিতভাবে চারটি দেশ ভারত মহাসাগরে বিশাল সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত করে আসছে প্রতিবছর। সম্প্রতি চারটি দেশকেই জাতীয় ও বৈশ্বিক পরিমন্ডলে এক অভিন্ন প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করতে হচ্ছে, তাই গঠিত হওয়ার পর থেকে আলোচনার বাইরে থাকলেও বর্তমানে নতুন করে প্রাসঙ্গিকতার সৃষ্টি হয়েছে এই জোটের। ২০০৭ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের আহ্বানে জোট গঠন করা হয়েছিল, কিন্তু এবার সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তৎপরতায় দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পরও আবারও এই জোট সক্রিয় হচ্ছে।
আমেরিকার সাথে চীনের কূটনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় চীন-মার্কিন সম্পর্ক স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে তলানিতে নামে। এখনও যে খুব ভালো, তা নয়। পাল্টাপাল্টি করারোপ ও নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে দুই দেশের বাণিজ্যযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কেউই লাভবান হয়নি। মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বনাম চীনা তথ্যপ্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বাজার দখল ও একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার যে প্রতিযোগিতা, তাতে পৃথিবীর যেকোনো দেশকেই বর্তমানে একটি বলয় বেছে নিতে হচ্ছে। এই শতাব্দীকে ধরা হচ্ছে ‘চাইনিজ সেঞ্চুরি’ হিসেবে, যেখানে আমেরিকার একাধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে পরাশক্তি হিসেবে চীন বিশ্বব্যবস্থায় নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করবে। তবে বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে সবার প্রথমে অর্থনৈতিকভাবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া জরুরি, আর এটা করতে গিয়েই আমেরিকার সাথে দ্বন্দ্বে জড়াতে হচ্ছে চীনকে। আমেরিকা কোনোভাবেই চায় না চীন তার প্রভাবকে খর্ব করে বিশ্বশক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করুক।